- বইয়ের নামঃ সুর-সাকী
- লেখকের নামঃ কাজী নজরুল ইসলাম
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
আকুল হলি কেন বকুল বনের পাখি
বেহাগ-মিশ্র – দাদরা
আকুল হলি কেন বকুল বনের পাখি।
দেখেছিস তুইও নাকি প্রিয়ার ডাগর আঁখি॥
মধু ও বিষ মেশা
সেই সে আঁখির নেশা
তোরে করেছে পাগল, তাই কি এত ডাকাডাকি॥
চোখে পড়িলে বালি জ্বালাতে জ্বলিয়া মরি,
চোখে যাহার পড়েছে চোখ সে বাঁচে কেমন করি।
ফরাই আঁখি যেদিক পানে
তারই আঁখি মনে আনে,
বলিস পাখি দেখা হলে প্রাণ শুধু আছে বাকি॥
আজ ভারতের নব আগমনি
ভৈরবী – দাদরা
আজ ভারতের নব আগমনি
জাগিয়া উঠেছে মহাশ্মশান।
জাগরণী গায় প্রভাতের পাখি,
মরুতে বসেছে ফুল-বাথান॥
টলেছে অটল হিমালয় আজি,
সাগরে শঙ্খ উঠিয়াছে বাজি,
হলাহল শেষে উঠিছে অমৃত
বাঁচাইতে মৃত মানব-প্রাণ॥
আঁধারে করেছে হানাহানি যারা
আলোকে চিনেছে আত্মীয় তারা,
এক হয়ে গেছে খ্রিস্টান শিখ
পারসি হিন্দু মুসলমান।
ধ্যানের ভারত নবরূপ ধরে
গড়িয়া উঠিছে গৌরব ভরে,
বিদূরিত হবে বিশ্বে এবার
হিংসা দ্বন্দ্ব অকল্যাণ।
এই তাপসীর চরণের তলে
পাইয়াছে জ্ঞান-আলোক সকলে,
প্রণাম করিয়া দেশ দলে দলে,
আসিবে করিতে তীর্থ স্নান॥
আজ শেফালির গায়ে হলুদ
পিলু – কারফা
আজ শেফালির গায়ে হলুদ
উলু দেয় পিক পাপিয়া।
প্রথম প্রণয়-ভীরু বালা
লাজে ওঠে কাঁপিয়া॥
বনভূমি বাসর সাজায়
ফুলে পাতায় লালে নীলে,
ঝরে শিশির আশিস-বারি
গগন-ঝারি ছাপিয়া॥
বৃষ্টি-ধোয়া সবুজ পাতার
শাড়ি করে ঝলমল,
ননদিনি ‘বউ কথা কও’
ডাকে আড়াল থাকিয়া॥
দেখতে এল দিগ্বালিকা
সাদা মেঘের রথে ওই,
শরৎ-শশীর মঙ্গল-দীপ
জ্বলে গগন ব্যাপিয়া॥
অতীত প্রণয়-স্মৃতি স্মরি
কেঁদে যায় আশিন হাওয়া,
উড়ে বেড়ায় বর সে ভ্রমর
কমল-পরাগ মাখিয়া॥
আজকে দোলের হিন্দোলায়
কাফি – হোরি
আজকে দোলের হিন্দোলায়
আয় তোরা কে দিবি দোল।
ডাক দিয়ে যায় দ্বারে ওই
হেনার কুঁড়ি আমের বৌল॥
আগুন-রাঙা ফুলে ফাগুন লালে-লাল,
আগুন-রাঙা ফুলে ফাগুন লালে-লাল,
লোল হয়ে পড়িল ওই রাতের জোছনা-আঁচল॥
হতাশ পথিক পথ-বিভোল,
ভোল আজি বেদনা ভোল,
টোল খেয়ে যাক নীল আকাশ
শুনে তোদের হাসির রোল,
দ্বার খুলে দেখ–ফুলেল রাত
ফুলে ফুলে ডামাডোল॥
আজি গানে গানে ঢাকব আমার গভীর অভিমান
পিলু-খাম্বাজ – কারফা
আজি গানে গানে ঢাকব আমার
গভীর অভিমান।
কাঁটার ঘায়ে কুসুম করে
ফোটাব মোর প্রাণ॥
ভুলতে তোমার অবহেলা
গান গেয়ে মোর কাটবে বেলা,
আঘাত যত হানবে বীণায়
উঠবে তত তান॥
ছিঁড়লে যে ফুল মনের ভুলে
গাঁথব মালা সেই সে ফুলে,
আসবে যখন বন্ধু তোমার
করব তারে দান॥
আমার সুরের ঝরনা-তীরে
রচব গানের উর্বশীরে
তুমি সেই সুরেরই ঝরনা-ধারায়
উঠবে করে স্নান॥
কথায় কথায় মিলায়ে মিল
কবি রে, তোর ভরল কি দিল,
তোর শূন্য হিয়া, শূন্য নিখিল,
মিল পেল না প্রাণ॥
আজি দোল-ফাগুনের দোল লেগেছে
ধনী – হোরি ঠেকা
আজি দোল-ফাগুনের দোল লেগেছে
আমের বউলে দোলন-চাঁপায়।
মৌমাছিরা পলাশ ফুলের গেলাস ভরে মউ পিয়ে যায়।
শ্যামল পাতার কোলে কোলে
আবির-রাঙা কুসুম দোলে,
দোয়েল শ্যামা লহর তোলে
কৃষ্ণচূড়ার ফুলেল শাখায়॥
বন-গোপিনী ফুল ছুঁড়ে ওই
খেলে হোরি দখিন-বায়ে,
হলদে পাখি দোদুল দুলে
সোনাল শাখায় আদুল গায়ে।
ভাঁট-ফুলের এ নাট-দেউলে
রঙিন প্রজাপতির দুলে,
মন ছুটে যায় দূর গোকুলে
বৃন্দাবনে প্রেম-যমুনায়॥
আজি দোল-ফাগুনের দোল লেগেছে
ধানী – হোরি
আজি দোল-ফাগুনের দোল লেগেছে
আমের বোলে দোলন-চাঁপায়।
মৌমাছিরা পলাশ ফুলের
গেলাস ভরে মউ পিয়ে যায়॥
শ্যামল তরুর কোলে কোলে
আবির-রাঙা কুসুম দোলে,
দোয়েল শ্যামা লহর তোলে
কৃষ্ণচূড়ার ফুলেল শাখায়॥
বন-গোপিনী ফুল ছুঁড়ে ওই খেলে হোরি দখিন বায়ে,
হলদে পাখি দোদুল দুলে সোনাল শাখায় আদুল গায়ে।
ভাঁট-ফুলের ওই নাট-দেউলে,
রঙিন প্রজাপতি দুলে,
মন ছুটে যায় দূর গোকুলে
বৃন্দাবনে প্রেম-যমুনায়॥
আজিকে তনু মনে লেগেছে রং লেগেছে রং
পাহাড়ি মিশ্র – দাদরা
আজিকে তনু মনে লেগেছে রং লেগেছে রং।
বধূর বেশে ধরা সেজেছে অভিনব ঢং॥
কাননে আলোছায়া,
নয়নে রঙের মায়া,
দুলে দোদুল কায়া, পরানে বাজিছে সারং॥
সে রঙের সাগর-কোলে
কত চাঁদ রবি দোলে,
বাজে গগন-তলে জলদ-তালে মেঘ-মৃদং॥
আনমনে জল নিতে ভাসিল গাগরি
বেহাগ – কাওয়ালি
আনমনে জল নিতে ভাসিল গাগরি।
সাঁতার জানি না, আনি কলস কেমন করি॥
জানি না, বলিব কী, শুধাবে যবে ননদি
কাহার কথা ভাবে পোড়া মন নিরবধি,
গাগরি না ভাসিয়া ভাসিতাম আমি যদি–
কী বলিব কেন মোর ভিজিল গো ঘাগরি॥
একেলা কুলবধূ, পথ বিজন, নদীর বাঁকে
ডাকিল বউ-কথা-কও কেন হলুদ-চাঁপার শাখে,
বিদেশে শ্যাম আমার পড়ল মনে সেই সে ডাকে,
ঠাঁই দে যমুনে, বুকে, আমি ডুবিয়া মরি॥
আনো সাকি শিরাজি আনো আঁখি-পিয়ালায়
ভৈরব – সেতারখানি
আনো সাকি শিরাজি আনো আঁখি-পিয়ালায়।
অধীর করো মোরে নয়ন-মদিরায়॥
পানসে জোছনাতে – ঝিম হয়ে আসে মন,
শারাব বিনে হেরো গুলবন উচাটন,
মদালস আঁখি কেন ঘোমটা ঢাকা এমন
বিষাদিত নিরালায়॥
তরুণ চোখে আনো অরুণ রাগ-ছোঁওয়া,
আঁখির করুণা তব যাচে ভোরের হাওয়া।
জীবন ভরা কাঁটার জ্বালা
ভুলিতে – চাহি শারাব-পিয়ালা
তোমার হাতে ঢালা॥
দুলাইয়া দাও মোরে আনন্দের হিন্দোলায়
ভুলাইয়া বেদনায়॥