চন্দ্রবিন্দু – কাজী নজরুল ইসলাম-এর লেখা একটি কবিতার বই। চন্দ্রবিন্দু বইটি প্রথম ১৯৩১ সালে ডিএম লাইব্রেরি থেকে প্রকাশিত হয়। নন্দ্রবিন্দু কাব্যগ্রন্থটি বেশ কয়েকটি কবিতা নিয়ে রচিত হয়েছে। বইটি আমরা সংগ্রহ করে আপনাদের সুবিধার্থে এখানে সংরক্ষণ করেছি।
চন্দ্রবিন্দু বইয়ের বিবরণঃ
- বইয়ের নামঃ চন্দ্রবিন্দু
- লেখকের নামঃ কাজী নজরুল ইসলাম
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
আজি শৃঙ্খলে বাজিছে মাভৈঃ – বরাভয়
ইমন – কাওয়ালি
আজি শৃঙ্খলে বাজিছে মাভৈঃ – বরাভয়।
এ যে আনন্দ-বন্ধন, ক্রন্দন নয়॥
ওরে নাশিতে সবার এই বন্ধন-ত্রাস,
মোরা শৃঙ্খল ধরি তারে করি উপহাস,
সহি নিপীড়ন – পীড়নের আয়ু করি হ্রাস,
এ যে রুদ্র-আশীর্বাদ – লৌহবলয়॥
মোরা অগ্র-পথিক অনাগত দেবতার,
এই শৃঙ্খল বন্দিছে চরণ তাহার,
শোন শৃঙ্খলে তাঁর আগমনি-ঝংকার!
হবে দৈত্যকারায় নব অরুণ উদয়॥
আজি পূর্ণশশী কেন মেঘে ঢাকা
পিলু বারোয়াঁ – ঠুংরি
আজি পূর্ণশশী কেন মেঘে ঢাকা।
মোরে স্মরিয়া রাধিকাও হল কি বাঁকা॥
কেন অভিমান-শিশিরে মাখা কমল,
কাজল-উজল-চোখে কেন এত জল,
লহো মুরলী হরি লহো শিখী-পাখা॥
আদি পরম বাণী, ঊর বীণাপাণি
আদি পরম বাণী, ঊর বীণাপাণি।
আরতি করে তব কোটি কোবিদ জ্ঞানী।।
হিমেল শীত গত, ফাল্গুন মুঞ্জরে,
কানন-বীণা বাজে সমীর-মরমরে।
গাহিছে মুহু মুহু আগমনী কুহু,
প্রকৃতি বন্দিছে নব কুসুম আনি।।
মূক ধরণী করে বেদনা-আরতি,
বাণী-মুখর তারে করো মা ভারতী!
বক্ষে নব আশা, কণ্ঠে নব ভাষা
দাও মা, আশিস্ যাচে নিখিল প্রাণী।।
শুচি রুচির আলো-মরাল-বাহিনী
আনিলে আদি জ্যোতি, সৃজিলে কাহিনী।
কণ্ঠে নাহি গীতি, বক্ষে ত্রাস-ভীতি,
করো প্রবুদ্ধ মা, বর অভয় দানি।।
ব্রহ্মবাদিনী আদিম বেদ-মাতা!
এসো মা, কোটি-দল হৃদি-আসন পাতা।
অশ্রুমতী মা গো, নব-বাণীতে জাগো,
রুদ্ধ দ্বার খোলো সাজিয়া রুদ্রানী।।
আমার সকলই হরেছে হরি
আশাবরি – কাওয়ালি
আমার সকলই হরেছে হরি
এবার আমায় হরে নিয়ো।
যদি সব হরিলে নিখিল-হরণ
এবার ওই চরণে শরণ দিয়ো॥
আমায় ছিল যারা আড়াল করে,
হরি তুমি নিলে তাদের হরে,
ছিল প্রিয় যারা গেল তারা,
হরি এবার তুমিই হও হে প্রিয়॥
আমি তুরগ ভাবিয়া মোরগে চড়িনু
হিতে বিপরীত
কীর্তন
আমি তুরগ ভাবিয়া মোরগে চড়িনু
সে লইল মিয়াঁর ঘরে।
আমার কালি-মা ছাড়ায়ে কলেমা পড়ায়ে
বুঝি মুসলিম করে!
আঁখর : আমায় বুঝি মুসলিম করে গো!
শেষে আস্ত ধরিয়া গোস্ত খাওয়ায়ে –
মামদো করিবে গোরা গো!
আমার টিকি করি দূর রেখে দেবে নূর
জবাই করিবে পরে গো॥
আমি বাসব ভাবিয়া রাসভে পূজিনু
স্বর্গে যাইতে সোজা,
সে যে লয়ে এঁদো ঘাটে, ফেলে দিল পাটে
ভাবিয়া ধোবির বোঝা!
আঁখর : হল হিতে বিপরীত সবই গো!
আমি ভবানী ভাবিয়া করিতে প্রণাম
হেরি বাগদিনি ভবি গো
আমি শীতল হইতে চাহিনু, আনিল
শীতলা-বাহনে ধোবি গো॥
বাবা শিবের বাহন ভাবিয়া বৃষভ-
লাঙুল ঠেকানু ভালে,
হায় নিল না সে পূজা, শিং দিয়ে সোজা
গুঁতায়ে ফেলিল খালে!
আঁখর : আমার কপাল বেজায় ফুটো গো!
আমি জগন্নাথ হেরিতে হেরিনু
ধবল-কুষ্ঠী ঠুঁটো গো!
বাঁকা অঙ্গ হেরিয়া জড়ায়ে ধরিতে
হেরি ত্রিভঙ্গ খুঁটো গো॥
মোর মহিষী গৃহিণী খুশি হবে ভেবে
মহিষ কিনিয়া আনি!
বাবা মরি এবে ত্রাসে, শিং নেড়ে আসে
মহিষ, মহিষী রানি!
আঁখর : আমি কেমনে জীবন ধরি গো!
আমি ‘হরি বোল’বলে ডাকিতে হরি-রে!
হয়ে যায় ‘বলো হরি’গো॥
আমি দেখেছি তোর শ্যামে (প্রতিদ্বন্দ্বী)
প্রতিদ্বন্দ্বী
বাউল
আমি দেখেছি তোর শ্যামে
দেখেছি কদম-তলা,
আমি দেখেছি তোর অষ্টাবক্রের
আঁকাবাঁকা চলা
তার যত ছলাকলা।
দেখেছি কদম-তলা॥
তুই মোর গোয়ালের ছিঁড়ে দড়ি
রাত-বিরেতে বেড়াস চরি,
তুই রাখাল পেয়ে ভুলে গেছিস
আয়ান-ঘোষের রলা!
দেখেছি কদম-তলা॥
আমি ভাই খ্যাপা বাউল, আমার দেউল
বাউল
আমি ভাই খ্যাপা বাউল, আমার দেউল
আমারই এই আপন দেহ।
আমার এ প্রাণের ঠাকুর নহে সুদূর
অন্তরে মন্দির-গেহ।
সে থাকে সকল সুখে সকল দুখে
আমার বুকে অহরহ,
কভু তায় প্রণাম করি, বক্ষে ধরি,
কভু তারে বিলাই স্নেহ॥
ভুলাইনি আমারই কুল,
ভুলেছে নিজেও সে কুল,
ভুলে বৃন্ -দাবন গোকুল
(তার) মোর সাথে মিলন-বিরহ।
সে আমার ভিক্ষা-ঝুলি কাঁধে তুলি
চলে ধূলি- মলিন পথে,
নাচে গায় আমার সাথে একতারাতে,
কেউ বোঝে বোঝে না কেহ॥
এসো এসো তব যাত্রা-পথে
টোরি – কাওয়ালি
এসো এসো তব যাত্রা-পথে
শুভ বিজয়-রথে
ডাকে দূর সাথি।
মোরা তোমার লাগি হেথা রহিব জাগি
তব সাজায়ে বাসর জ্বালি আশায় বাতি॥
হেরো গো বিকীর্ণ শত শুভ চিহ্ণ
পথ-পাশে নগর-বাটে,
সবৎসা ধেনু গোখুর-রেণু
উড়ায়ে চলে দূর মাঠে।
দক্ষিণ-আবর্তবহ্ণি,
পূর্ণঘট-কাঁখে তন্বী।
দোলে পুষ্পমালা, ঝলে শুক্লা রাতি॥
হেরো পতাকা দোলে দূর তোরণ-তলে,
গজ তুরগ চলে।
শুক্লা ধানের হেরো মঞ্জরী ওই,
এসো কল্যাণী গো
আনো নব প্রভাতি॥
ওই পথে চেয়ে থাকি
খাম্বাজ-পিলু – কারফা
ওই পথে চেয়ে থাকি
আর কত বনমালি!
করে কানাকানি লোকে,
দেয় ঘরে-পরে গালি॥
মোর কুলের বাঁধন খুলে
হায় ভাসালে অকূলে
শেষে লুকালে গোকুলে
এ কী রীতি চতুরালি॥