- বইয়ের নামঃ গানের মালা
- লেখকের নামঃ কাজী নজরুল ইসলাম
- বিভাগসমূহঃ প্রবন্ধ
অয়ি চঞ্চল-লীলায়িত-দেহা চিরচেনা
সাহানা-বাহার কাওয়ালি
অয়ি চঞ্চল-লীলায়িত-দেহা, চিরচেনা!
ফোটাও মনের বনে তুমি বকুল হেনা
চিরচেনা॥
যৌবন-মদগর্বিতা তন্বী
আননে জ্যোৎস্না, নয়নে বহ্নি,
তব চরণের পরশ বিনা
অশোক তরু মুঞ্জরে না, চিরচেনা॥
নন্দন-নন্দিনী তুমি দয়িতা চির-আনন্দিতা,
প্রথম কবির প্রথম লেখা তুমি কবিতা।
নৃত্যশেষের তব নূপুরগুলি হায়
রয়েছে ছড়ানো আকাশের তারকায়,
সুরলোক-উর্বশী হে বসন্তসেনা! চিরচেনা॥
আঁখি তোলো দানো করুণা
আঁখি তোলো দানো করুণা
ওগো অরুণা!
মেলি নয়ন জীর্ণ কানন
করো তরুণা॥
আঁখি যে তোমার বনের পাখি
ঘুম সে ভাঙায় আঁধারে ডাকি,
আলোক-সাগর জাগাও বরুণা॥
তব আনত আঁখির পাতার কোলে
তরুণ আলোর মুকুল দোলে।
রঙের কুমার দুয়ারে জাগে
তোমার আঁখির প্রসাদ মাগে,
পাণ্ডুর ভোর হোক তরুণারুণা॥
আঁধার রাতের তিমির দুলে আমার মনে
জয়জয়ন্তী মিশ্র দাদরা
আঁধার রাতের তিমির দুলে আমার মনে।
দুলে গো আমার ঘুমে জাগরণে॥
হুতাশ-ভরা বাতাস বহে
আমার কানে কী কথা কহে,
দিনগুলি মোর যায় যে ঝরে
ঝরা পাতার সনে॥
গিয়াছে চলি, সুখের যাহারা ছিল গো সাথি,
গিয়াছে নিভে জ্বলিতেছিল যে শিয়রে বাতি।
স্মৃতির মালার ফুল শুকাইয়া
একে একে হায় পড়িছে ঝরিয়া,
বিদায়বেলার শুনি যে বাঁশি ক্ষণে ক্ষণে॥
আগের মতো আমের ডালে বোল ধরেছে বউ
বসন্ত মিশ্র দাদরা
আগের মতো আমের ডালে
বোল ধরেছে বউ।
তুমিই শুধু বদলে গেছ
আগের মানুষ নও॥
তেমনি আজও তোমার নামে
উথলে মধু গোলাপ-জামে,
উঠল পুরে জামরুলে রস মহুল ফুলে মউ।
তুমিই শুধু বদলে গেছ, আগের মানুষ নও॥
ডালিম-দানায় রং লেগেছে, ডাঁসায় নোনা আতা,
তোমার পথে বিছায় ছায়া ছাতিম তরুর ছাতা।
তেমনি আজও নিমের ফুলে
ঝিম হয়ে ওই ভ্রমর দুলে,
হিজল-শাখায় কাঁদছে পাখি বউ গো কথা কও।
তুমি শুধু বদলে গেছ, আগের মানুষ নও॥
আজ নিশীথে অভিসার তোমার পথে প্রিয়তম
পিলু — খাম্বাজ কাহারবা
আজ নিশীথে অভিসার
তোমার পথে, প্রিয়তম।
বনের পারে নিরালায়
দিয়ো হে দেখা, নিরূপম॥
সুদূর নদীর ধারে জনহীন বালুচরে –
চখার তরে যথা একা চখি কেঁদে মরে,
সেথা সহসা আসিয়ো গোপন প্রিয়
স্বপনসম॥
তোমার আশায় ঘুরি শত গ্রহে শত লোকে,
ওগো আমার বিরহ জাগে বিরহী চাঁদের চোখে,
অকুল পাথার নিরাশার পারায়ে এসো
প্রাণে মম॥
আধখানা চাঁদ হাসিছে আকাশে
বেহাগ মিশ্র দাদরা
আধখানা চাঁদ হাসিছে আকাশে,
আধখানা চাঁদ নীচে
প্রিয়া তব মুখে ঝলকিছে।
গগনে জ্বলিছে অগণন তারা
দুটি তারা ধরণিতে
প্রিয়া তব চোখে চমকিছে॥
তড়িৎ-লতার ছিঁড়িয়া আধেকখানি
জড়িত তোমার জরিন ফিতায়, রানি।
অঝোরে ঝরিছে নীল নভে বারি,
দুইটি বিন্দু তারই
প্রিয়া তব আঁখি বরষিছে॥
কত ফুল ফোটে ঝরে উপবনে,
তারই মাঝে আছে ফুটি
তোমার অধরে গোলাপ-পাপড়ি দুটি।
মধুর কণ্ঠে বিহগ বিলাপ গাহে,
গান ভুলি তারা তব অঙ্গনে চাহে,
তাহারও অধিক সুমধুর সুর তব
চুড়ি কঙ্কণে ঝনকিছে॥
আধো-আধো বোল লাজে-বাধো-বাধো বোল
ভৈরবী-পিলু কাহারবা
আধো-আধো বোল
লাজে-বাধো-বাধো বোল
বলো কানে কানে।
যে কথাটি আধো রাতে
মনে লাগায় দোল –
বলো কানে কানে॥
যে কথার কলি সখী আজও ফুটিল না
শরমে মরম-পাতে দোলে আনমনা,
যে কথাটি ঢেকে রাখে বুকের আঁচল –
বলো কানে কানে॥
যে কথা লুকায়ে থাকে লাজ-নত চোখে
না বলিতে যে কথাটি জানাজানি লোকে,
যে কথাটি ধরে রাখে অধরের কোল –
লুকিয়ে বলো নিরালায় থামিলে কলরোল।
যে কথাটি বলিতে চাও বেশভূষার ছলে,
যে কথা দেয় বলে তব তনু পলে পলে,
যে কথাটি বলিতে সই গালে পড়ে টোল –
বলো কানে কানে॥
আমার প্রাণের দ্বারে ডাক দিয়ে কে যায়
বাউল লোফা
আমার প্রাণের দ্বারে ডাক দিয়ে কে যায়
বারেবারে।
তার নূপুর-ধ্বনি রিনিঝিনি বাজে
বন-পারে॥
নিঝুম রাতে ঘুমাই যবে
সে ডাকে আমায় বেণুর রবে,
স্বপন-কুমার আসে স্বপন-অভিসারে॥
যবে জল নিতে যাই নদীতটে একলা
নাম ধরে সে ডাকে,
ধরতে গেলে পালিয়ে সে যায়
বন-পথের বাঁকে।
বিশ্ববধূর মনোচোরা
ধরতে সে চায়, দেয় না ধরা,
আমি তারই স্বয়ংবরা
সঁপেছি প্রাণ তারে॥
আমি অলস উদাস আনমনা
মিশ্র মালবশ্রী দাদরা
আমি অলস উদাস আনমনা।
আমি সাঁঝ-আকাশে শান্ত নিথর
রঙিন মেঘের আলপনা॥
অলস যেমন বনের ছায়া,
নীড়ের পাখি শ্রান্ত-কায়া,
যেমন অলস তৃণের মুখে
ভোরের শিশির হিম-কণা॥
নদীর তীরে অলস রাখাল
একলা বসে রয় যেমন,
তেমনি অলস উদাস আমি
রই বসে রই অকারণ॥
যেমন অলস দিঘির জলে
থির হয়ে রয় কমল-দলে,
নিতল ঘুমে স্বপনসম
অলস আমি কল্পনা॥
আমি সুন্দর নহি জানি হে বন্ধু জানি
বেহাগ দাদরা
আমি সুন্দর নহি জানি হে বন্ধু জানি।
তুমি সুন্দর, তব গান গেয়ে
নিজেরে ধন্য মানি॥
আসিয়াছি সুন্দর ধরণিতে
সুন্দর যারা তাদেরে দেখিতে
রূপ-সুন্দর দেবতার পায়ে
অঞ্জলি দিই বাণী॥
রূপের তীর্থে তীর্থ-পথিক
যুগে যুগে আমি আসি
ওগো সুন্দর, বাজাইয়া যাই
তোমার নামের বাঁশি।
পরিয়া তোমার রূপ-অঞ্জন
ভুলেছে নয়ন, রাঙিয়াছে মন,
উছলি উঠুক মোর সংগীতে
সেই আনন্দখানি॥