- বইয়ের নামঃ ঝিঙেফুল
- লেখকের নামঃ কাজী নজরুল ইসলাম
- প্রকাশনাঃ আহমদ পাবলিশিং হাউজ
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
খাঁদু-দাদু
অ মা! তোমার বাবার নাকে কে মেরেছে ল্যাং?
খ্যাঁদা নাকে নাচছে ন্যাদা – নাক ডেঙাডেং ড্যাং!
ওঁর নাকটাকে কে করল খ্যাঁদা র্যাঁদা বুলিয়ে?
চামচিকে-ছা বসে যেন ন্যাজুড় ঝুলিয়ে!
বুড়ো গোরুর টিকে যেন শুয়ে কোলা ব্যাং!
অ মা! আমি হেসে মরি, নাক ডেঙাডেং ড্যাং!
ওঁর খ্যাঁদা নাকের ছেঁদা দিয়ে টুকি কে দেয় ‘টু’!
ছোড়দি বলে সর্দি ওটা, এ রাম! ওয়াক! থুঃ!
কাছিম যেন উপুড় হয়ে ছড়িয়ে আছেন ঠ্যাং!
অ মা! আমি হেসে মরি, নাক ডেঙাডেং ড্যাং!
দাদু বুঝি চিনাম্যান মা, নাম বুঝি চাং চু,
তাই বুঝি ওঁর মুখটা অমন চ্যাপটা সুধাংশু!
জাপান দেশের নোটিশ উনি নাকে এঁটেছেন!
অ মা! আমি হেসে মরি, নাক ডেঙাডেং ডেং!
দাদুর নাকি ছিল না মা অমন বাদুড়-নাক,
ঘুম দিলে ওই চ্যাপটা নাকেই বাজত সাতটা শাঁখ।
দিদিমা তাই থ্যাবড়া মেরে ধ্যাবড়া করেছেন!
অ মা! আমি হেসে মরি, নাক ডেঙাডেং ডেং!
লম্ফানন্দে লাফ দিয়ে মা চলতে বেজির ছা
দাড়ির জালে পড়ে জাদুর আটকে গেছে গা,
বিল্লি-বাচ্চা দিল্লি যেতে নাসিক এসেছেন!
অ মা! আমি হেসে মরি, নাক ডেঙাডেং ডেং!
দিদিমা কি দাদুর নাকে টাঙতে ‘আলমানাক’
গজাল ঠুকে দেছেন ভেঙে বাঁকা নাকের কাঁখ?
মুচি এসে দাদুর আমার নাক করেছে ‘ট্যান’!
অ মা! আমি হেসে মরি, নাক ডেঙাডেং ড্যাং!
বাঁশির মতন নাসিকা মা মেলে নাসিকে,
সেথায় নিয়ে চলো দাদু দেখন-হাসিকে।
সেথায় গিয়ে করুন দাদু গরুড় দেবের ধ্যান,
খাঁদু-দাদু নাকু হবেন, নাক ডেঙাডেং ড্যাং।
খুকি ও কাঠবেড়ালি
কাঠবেড়ালি! কাঠবেড়ালি! পেয়ারা তুমি খাও?
গুড়-মুড়ি খাও? দুধ-ভাত খাও? বাতাবি-নেবু? লাউ?
বেড়াল-বাচ্চা? কুকুর-ছানা? তাও-
ডাইনি তুমি হোঁৎকা পেটুক,
খাও একা পাও যেথায় যেটুক!
বাতাবি-নেবু সকলগুলো
একলা খেলে ডুবিয়ে নুলো!
তবে যে ভারি ল্যাজ উঁচিয়ে পুটুস পাটুস চাও?
ছোঁচা তুমি! তোমার সঙ্গে আড়ি আমার! যাও!
কাঠবেড়ালি! বাঁদরীমুখী! মারবো ছুঁড়ে কিল?
দেখবি তবে? রাঙাদাকে ডাকবো? দেবে ঢিল!
পেয়ারা দেবে? যা তুই ওঁচা!
তাই তো তোর নাকটি বোঁচা!
হুতমো-চোখী! গাপুস গুপুস
একলাই খাও হাপুস হুপুস!
পেটে তোমার পিলে হবে! কুড়ি-কুষ্টি মুখে!
হেই ভগবান! একটা পোকা যাস পেটে ওর ঢুকে!
ইস! খেয়ো না মস্তপানা ঐ সে পাকাটাও!
আমিও খুবই পেয়ারা খাই যে! একটি আমায় দাও!
কাঠবেড়ালি! তুমি আমার ছোড়দি’ হবে? বৌদি হবে? হুঁ!
রাঙা দিদি? তবে একটা পেয়ারা দাও না! উঃ!
এ রাম! তুমি ন্যাংটা পুঁটো?
ফ্রকটা নেবে? জামা দুটো?
আর খেয়ো না পেয়ার তবে,
বাতাবি-নেবুও ছাড়তে হবে!
দাঁত দেখিয়ে দিচ্ছ ছুট? অ’মা দেখে যাও!-
কাঠবেড়ালি! তুমি মর! তুমি কচু খাও!!
খোকার খুশি
কী যে ছাই ধানাই-পানাই –
সারাদিন বাজছে সানাই,
এদিকে কারুর গা নাই
আজই না মামার বিয়ে!
বিবাহ! বাস, কী মজা!
সারাদিন মণ্ডা গজা
গপাগপ খাও না সোজা
দেয়ালে ঠেসান দিয়ে।
তবু বর হচ্ছিনে ভাই,
বরের কী মুশকিলটাই –
সারাদিন উপোস মশাই
শুধু খাও হরিমটর!
শোনো ভাই, মোদের যবে
বিবাহ করতে হবে –
‘বিয়ে দাও’ বলব, ‘তবে
কিছুতেই হচ্ছিনে বর!’
সত্যি, কও না মামা,
আমাদের অমনি জামা
অমনি মাথায় ধামা
দেবে না বিয়ে দিয়ে?
মামিমা আসলে এ ঘর
মোদেরও করবে আদর?
বাস, কী মজার খবর!
আমি রোজ করব বিয়ে॥
খোকার গপ্প বলা
মা ডেকে কন, ‘খোকন-মণি! গপ্প তুমি জানো?
কও তো দেখি বাপ!’
কাঁথার বাহির হয়ে তখন জোর দিয়ে এক লাফ
বললে খোকন, ‘গপপ জানি, জানি আমি গানও!’
বলেই খুদে তানসেন সে তান জুড়ে জোর দিল –
‘একদা এক হাড়ের গলায় বাঘ ফুটিয়াছিল!’
মা সে হেসে তখন
বলেন, ‘উহুঁ, গান না, তুমি গপ্প বলো খোকন!’
ন্যাংটা শ্রীযুত খোকা তখন জোর গম্ভীর চালে
সটান কেদারাতে শুয়ে বলেন, “সত্যিকালে
এক যে ছিল রাজা আর মা এক যে ছিল রানি,
হাঁ মা আমি জানি,
মায়ে পোয়ে থাকত তারা,
ঠিক যেন ওই গোঁদলপাড়ার জুজুবুড়ির পারা!
একদিন না রাজা –
ফড়িং শিকার করতে গেলেন খেয়ে পাঁপড়ভাজা!
রানি গেলেন তুলতে কলমি শাক
বাজিয়ে বগল টাক ডুমাডুম টাক!
রাজা শেষে ফিরে এলেন ঘরে
হাতির মতন একটা বেড়াল-বাচ্চা শিকার করে।
এসে রাজা দেখেন কিনা বাপ!
রাজবাড়িতে আগড় দেওয়া, রানি কোথায় গাপ!
দুটোয় গিয়ে এলেন রাজা সতরোটার সে সময়!
বলো তো মা-মণি তুমি, খিদে কি তায় কম হয়?
টাটি-দেওয়া রাজবাড়িতে ওগো,
পান্তাভাত কে বেড়ে দেবে?
খিদের জ্বালায় ভোগো!
ভুলুর মতন দাঁত খিঁচিয়ে বলেন তখন রাজা,
নাদনা দিয়ে জরুর রানির ভাঙা চাই-ই মাজা।
এমন সময় দেখেন রাজা আসচে রানি দৌড়ে
সারকুঁড় হতে ক্যাঁকড়া ধরে রাম-ছাগলে চড়ে!
দেখেই রাজা দাদার মতন খিচমিচিয়ে উঠে –”
‘হাঁরে পুঁটে!’
বলেই খোকার শ্রীযুত দাদা সটান
দুইটি কানে ধরে খোকার চড় কসালেন পটাম্।
বলেন, ‘হাঁদা! ক্যাবলাকান্ত! চাষাড়ে।
গপ্প করতে ঠাঁই পাওনি চণ্ডুখুড়ি আষাঢ়ে?
দেব নাকি ঠ্যাংটা ধরে আছাড়ে?
কাঁদেন আবার! মারব এমন থাপড়,
যে কেঁদে তোমার পেটটি হবে কামার শালার হাপর!’
চড় চাপড় আর কিলে,
ভ্যাবাচ্যাকা খোকামণির চমকে গেল পিলে!
সেদিনকারের গপ্প বলার হয়ে গেল রফা,
খানিক কিন্তু ভেড়ার ভ্যাঁ ডাক শুনেছিলুম তোফা!
খোকার বুদ্ধি
চুন করে মুখ প্রাচীর পরে বসে শ্রীযুত খোকা,
কেননা তার মা বলেছেন সে এক নিরেট বোকা।
ডানপিটে সে খোকা এখন মস্ত একটা বীর,
হুংকারে তাঁর হাঁস মুরগির ছানার চক্ষুস্থির!
সাত লাঠিতে ফড়িং মারেন এমনই পালোয়ান!
দাঁত দিয়ে সে ছিঁড়লে সেদিন আস্ত আলোয়ান!
ন্যাংটা-পুঁটো দিগম্বরের দলে তিনিই রাজা,
তাঁরে কিনা বোকা বলা? কী এর উচিত সাজা?
ভাবতে ভাবতে খোকার হঠাৎ চিন্তা গেল থেমে,
দে দৌড় চোঁ-চাঁ আঁধমহলে পাঁচিল হতে নেমে!
বুকের ভেতর ছপাই নপাই ধুকপুকুনির চোটে,
বাইরে কিন্তু চতুর খোকা ঘাবড়ালেন না মোটে।
হাঁপিয়ে এসে মায়ের কাছে বললে, “ওগো মা!
আমি নাকি বোক-চন্দর? বুদ্ধি দেখে যা!
ওই না একটা মটকু বানর দিব্যি মাচায় বসে
লাউ খাচ্ছে? কেউ দেখেনি, দেখি আমিই তো সে।
দিদিদেরও চোখ ছিল তো, কেউ কি দেখেছেন?
তবে আমায় বোকা কও যে! এ্যাঁ-এ্যাঁ, হাস ক্যান্?
কী কও? ‘একী বুদ্ধি হল?’ দেখবে তবে? হাঁ,
বুদ্ধি আমার … ভোলা! তু-উ-উ! লৌ-হা হা-হা-হা!”
চিঠি
[ছন্দ :- “এই পথটা কা-টবো
পাথর ফেলে মা-রবো”]