- বইয়ের নামঃ রুবাইয়াত-ই-হাফিজ
- লেখকের নামঃ কাজী নজরুল ইসলাম
- বিভাগসমূহঃঅনুবাদ বই
রুবাইয়াত-ই-হাফিজ – ০১-১০
১
তোমার ছবির ধ্যানে, প্রিয়, দৃষ্টি আমার পলক-হারা।
তোমার ঘরে যাওয়ার যে-পথ, পা চলে না সে-পথ ছাড়া।
হায়, দুনিয়ায় সবার চোখে নিদ্রা নামে দিব্য সুখে,
আমার চোখেই নেই কি গো ঘুম দগ্ধ হল নয়ন-তারা॥
২
আমার সুখের শত্রু হতে লুকিয়ে চলে আয় লো ত্বরা।
আয়েশ-সুখের আমন্ত্রণ আজ শরাব দিয়ে পাত্র ভরা।
ঈর্ষাতুরের কুমন্ত্রণায় কোথায় যাবে, হে মোর ভীরু?
আমার প্রিয়া! শোনো শুধু আমার কথা দুখ-পাসরা॥
৩
করল আড়াল তোমার থেকে যেদিন আমার ভাগ্য-লেখা,
সেদিন হতে ফোটেনি আর আমার ঠোঁটে হাসির রেখা।
কী নিদারুণ সেই বিরহের বাজল ব্যথা আমার হিয়ায়; –
আমি জানি, আর সে জানে অন্তর-বিহারী একা॥
৪
আমার সকল ধ্যানে জ্ঞানে বিচিত্র সে সুরে সুরে
গাহি তোমার বন্দনা-গান, রাজাধিরাজ, নিখিল জুড়ে!
কী বলেছে তোমার কাছে মিথ্যা করে আমার নামে
হিংসুকেরা, – ডাকলে না আজ তাইতে আমায় তোমার পুরে॥
৫
আনতে বলো পেয়ালা শরাব পার্শ্বে বসে পরান-বঁধুর।
নিঙারি লও পুষ্প-তনু তন্বঙ্গীর অধর-আঙুর।
আহত যে – ক্ষত-ব্যথায় সোয়াস্তি চায়, চায় সে আরাম;
বিষম তোমার হৃদয়-ক্ষত, ডাকো হাকিম কপট চতুর॥
৬
ভাবনু, যখন করছে মানা বন্ধুরা সব আগলে ভাঁটি –
দিলাম ছেড়ে এবার ফুলের মরশুমে ভাই শরাব খাঁটি।
ফুল-বাগিচায় বুলবুলিরা উঠল গেয়ে, – হায় রে বেকুব,
এমন ফাগুন, ফুলের ফসল, নাইকো শরাব? – সকল মাটি॥
৭
বিশ্বে সবাই তীর্থ-পথিক তোমার পথের কুঞ্জ-গলির।
ছুটছে নিখিল মক্ষী হয়ে তোমার আনন-আনারকলির ।
আজকে যদি তোমার থেকে মুখ ফিরিয়ে রয় গো কেহ,
কোন্ চোখে কাল দেখবে তোমায় হায় রে বে-দিল সেই মুসাফির!
৮
তোমার আকুল অলক – হানে গভীর ছায়া রবির করে।
শুক্লা চতুর্দশীর শশী তোমার মুকুট, আঁধার হরে।
ও-কস্তুরী-কালো কেশের নিশান ওড়ায় সন্ধ্যারানি,
হেরে ও-মুখ, – উদয়-উষা – পাণ্ডুর চাঁদ ডুবে মরে॥
৯
ভিন্ন থাকার দিন গো আমার আজকে পরান-প্রিয়ার সাথে।
বন্ধু নিয়ে খুশির মউজ – নেই গো সময় আজকে রাতে।
কী ফল রয়ে সাবধানে আজ, কাছে যখন নেইকো শরাব?
না, না, – কাছে শরাব আছে, নেইকো প্রিয়াই মন ভোলাতে॥
১০
আমার পরান নিতে যে চায় নিঠুরা রূপের পরি,
পরির মতোই রূপেরে সে রাখে আঁখির আড়াল করি।
কইনু তারে, ‘তুমি যে কও, এই তো এ-মুখ কী আর এমন?’
জবাব দিল, ‘তাই তো বলি লোভ কোরো না এ মুখ স্মরি।’
রুবাইয়াত-ই-হাফিজ – ১১-২০
১১
রক্ত-রাঙা হল হৃদয় তোমার প্রেমের পাষাণ-ব্যথায়।
তোমার ও-রূপ জ্ঞান-অগোচর, পৌঁছে নাকো দৃষ্টি সেথায়।
জড়িয়ে গেল ভীরু হৃদয় তোমার আকুল অলক-দামে,
সন্ধ্যা-কালো কেশে বাঁধা দেখছি ওরে ছাড়ানো দায়॥
১২
রবি, শশী, জ্যোতিষ্ক সব বান্দা তোমার, জ্যোতির্মতি!
যেদিন হতে বান্দা হল – পেল আঁধার-হরা জ্যোতি।
রাগে-অনুরাগে মেশা তোমার রূপের রৌশনীতে
চন্দ্র হল স্নিগ্ধ-কিরণ সূর্য হল দীপ্ত অতি॥
১৩
যেদিন হতে হৃদয়-বিহগ ব্যথার জালে পড়ল ধরা,
সেই হতে তার মাথার পরে ঝুলছে ছুরি রক্ত-ঝরা।
ত্যক্ত আমি হাতের কাছের পেয়ালা-ভরা শরবতে, তাই
করতেছি পান-পাত্রে ব্যথার রক্ত আমার হৃদয়-ক্ষরা॥
১৪
আমার করে তোমার অলক জড়িয়ে বীণার তারের মতো।
এ হৃদি-ভার আমার – শুধু তোমার ঠোঁটে হয় আনত।
চিকন তোমার ও-মুখখানি ভুখা হিয়ার সান্ত্বনা মোর
সর্বগ্রাসী মোর ক্ষুধার খোরাক ওই দেহটুক? হায় বিধাতঃ॥
১৫
তোমার পথে মোর চেয়ে কেউ সর্বহারা নাইকো, প্রিয়!
আমার চেয়ে তোমার কাছে নাই সখী, কেউ অনাত্মীয়।
তোমার বেণির শৃঙ্খলে গো নিত্য আমি বন্দি কেন? –
মোর চেয়ে কেউ হয়নি পাগল পিয়ে তোমার প্রেম-অমিয়॥
১৬
দলতে হৃদয় ছলতে পরান দক্ষ সদা আমার প্রিয়া।
তারই মিলন মাগি ঝুরে ভাগ্য-হত আমার হিয়া।
গোলাব-ফুলী গাল গো তাহার, রুপালি মুখ, চিকন অধর;
ফুলকে ভোলায় ফুল্লমুখী মিঠে হাসির ছিটেন দিয়া॥
১৭
পরান-ভরে পিয়ো শরাব, জীবন যাহা চিরকালের।
মৃত্যু-জরা-ভরা জগৎ, ফিরে কেহ আসবে না ফের।
ফুলের বাহার, গোলাব-কপোল, গেলাস-সাথি মস্ত্ ইয়ার,
এক লহমার খুশির তুফান, এই তো জীবন! – ভাবনা কীসের॥
১৮
আয়না তোমার আত্মার গো – তরল তোমার ওই লাবণি
সাধ জাগে ওই ধ্যানের চরণ করি আমার নয়ন-মণি।
না, না, আমার ভয় করে গো, নয়ন-পাতার কাঁটায় পাছে
কমল-পায়ে বাজে ব্যথা! ধেয়ানে থাক সারাক্ষণই॥
১৯
রঙিন মিলন-পাত্র প্রথম পান করালে ইমান্দারি ।
নেশায় যখন বুঁদ হয়েছি – জাল বিছালে অত্যাচারী।
আঁখির সলিল-ধারা গো, আর বুকের আগুন-জ্বালা নিয়ে
ভেজাই পোড়াই আপনারে পথের ধূলি হয়ে তারই॥
২০
তোমার মুখের মিল আছে, ফুল, সাথে সে এক কমল-মুখীর।
যে-ফুল হেরে দিল দেওয়ানা , গন্ধ যথা সদাই খুশির।
সাধ জাগে – এক ফুলদানিতে রাখি তোরে আর তাহারে,
ফুলেল ঠোঁটে চুম্ব নিতে লাগবে সুবাস পুষ্প-মদির॥
রুবাইয়াত-ই-হাফিজ – ২১-৩০
২১
আপন করে বাঁধতে বুকে পারেনি কেউ তনু প্রিয়ার –
জ্ঞান-বুদ্ধি-বিত্ত মাঝে বদ্ধ থাকে চিত্ত-যাহার।
আমার কথা ঠাঁই পেল না চপল-আঁখি প্রিয়ার কানে –
রত্ন-দুল সে রইল পড়ে, কর্ণে কভু উঠল না আর!
২২
সোরাই -ভরা রঙিন শরাব নিয়ে চলো নদীর তটে।
নিরভিমান প্রাণে বসো – অনুরাগের ছায়া-বটে।
সবারই এই জীবন যখন সেরেফ দুটো দিনের রে ভাই,
লুঠ করে নাও হাসির মধু, খুশির শরাব ভরো ঘটে॥
২৩
তোমার হাতের সকল কাজে হবে শুভ নিরবধি –
প্রিয়, তোমার ভাগ্যবশে নিয়তির এই নিদেশ যদি;
দাও তাহলে, পান করে নিই তোমার-দেওয়া শিরীন শরাব,
হলেও হব চির-অমর, হয়তো ও-মদ সুধা-নদী॥
২৪
কুঁড়িরা আজ কার্বা -বাহী বসন্তের এই ফুল-জলসায়।
নার্গিসেরা দল নিয়ে তার পাত্র রচে সুরার আশায়।
ধন্য গো সে-হৃদয়, যে আজ বিম্ব হয়ে মদের ফেনায়
উপচে পড়ে শরাব-খানার তোরণ-দ্বারের পথের ধুলায়॥
২৫
কুন্তলেরই পাকে প্রিয়ার – আশয় খোঁজে আমার পরান।
অভিশপ্ত এই জীবনের কারার থেকে চায় যেন ত্রাণ।
‘কী দেবে দাম’ শুধায় তাহার দেহের গেহের রূপ-দুয়ারী
প্রিয়ার ভুরুর তোরণ-তলে পরান দিলাম নজরানা-দান॥
২৬
চাঁদের মতো রূপ গো তোমার ভরছে কলঙ্কেরই দাগে।
অহংকারের সোনার বাজার ডুবছে ক্রমে ক্রান্তি-ফাগে।
লজ্জা অনেক দেছ আমায়, প্রেম নাকি মোর মিথ্যাভাষণ!
আজ তো এখন পড়ল ধরা কলঙ্ক কোন্ মুখে জাগে॥
২৭
রূপসিরা শিকার করে হৃদয়-বনের শিকারীকে –
দেহে তাহার রূপের অধিক অলংকারের চমক লিখে।
নার্গিস – যার শিরে হের ফুলের রানির মুকুট-পরা
নিরাভরণ – তবু তারই রটে খ্যাতি দিগ্বিদিকে॥
২৮
তোমার ডাকার ও-পথ আছে ব্যথার কাঁটায় ভরে খালি।
এমন কোনো নেই মুসাফির ও-পথ বেয়ে চলবে, আলি!
জ্ঞানের রবি ভাস্বর যার, তুমি জান কে সে সুজন –
প্রাণের রূপের পিলসুজে যে দেয় গো ব্যথার প্রদীপ জ্বালি॥
২৯
যেদিন আমায় করবে সুদূর তোমার থেকে কাল-বিরহ,
পড়বে যতই মনে, ততই দিন হবে মোর দুর্বিষহ।
ভুলেই যদি এ চোখ পড়ে আর-কোনো রূপসির রূপে,
অন্ধ আমি বইব তোমার রূপের দাবি অহরহ॥
৩০
দাও মোরে ওই গেঁয়ো মেয়ের তৈরি খাঁটি মদ পুরানা।
তাই পিয়ে আজ গুটিয়ে ফেলি জীবনের এই গালচেখানা।
যদি ধরার মন্দ ভালো দাও ভুলিয়ে মস্ত্ করে,
জানিয়ে দেব এই সৃষ্টির রহস্যময় সব অজানা॥