অনেকের মনে একটা প্রশ্ন ছেড়ে আসা গ্রাম কি ধরনের সাহিত্য? ছেড়ে আসা গ্রাম – দক্ষিণারঞ্জন বসুর একটি জীবনী ও স্মৃতিচারণ সম্পর্কিত বই। ছেড়ে আসা গ্রাম বইটি পারুল প্রকাশনী ২০১৭ সালে প্রথম প্রকাশ করেন। আপনারা বইটি পড়তে চাইলে আর দেরি না করে এখনি শুরু করুণ এবং কোন প্রকার সমস্যা ছাড়াই বইটি পড়ে ফেলুন।
ছেড়ে আসা গ্রাম বইয়ের বিবরণঃ
- বইয়ের নামঃ ছেড়ে আসা গ্রাম
- লেখকের নামঃ দক্ষিণারঞ্জন বসু
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
- প্রকাশনীঃ পারুল প্রকাশনী
- প্রকাশকালঃ ২০১৭
কুষ্টিয়া – শিলাইদহ ভেড়ামারা
প্রমত্তা নদী পদ্মা। জলকল্লোল প্রাণের জোয়ার, প্রাচুর্যের প্লাবন। সে প্লাবনে দু-তীরের গ্রামের মানুষদের অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। তাই গ্রামবাসীরা বড়ো দুঃখে প্রাণ-প্রবাহিনী পদ্মাকে নাম দিয়েছে কীর্তিনাশা। শুধু ধাও, শুধু ধাও, উদ্দাম উধাও। এই উদ্দামতার অত্যাচার সন্তানের আবদারের মতোই যেন সহ্য করে এসেছে আমার জননী, আমার প্রিয় জন্মভূমি শিলাইদহ। জনশ্রুতি আছে শেলি নামে একজন কুঠিয়াল সাহেবের নামানুসারেই গ্রামের নামকরণ হয়েছে শিলাইদহ। নদীর ধারে তাঁর কবরটি অনেকদিন পর্যন্ত গ্রামবাসীর কৌতূহল মিটিয়ে এসেছে। দুরন্ত পদ্মা এখন তা গ্রাস করে নিয়েছে। এমনি করে মানুষের কীর্তি নাশ করেছে পদ্মা এক দিকে, আবার অন্য দিকে নতুন কীর্তি গড়ে তোলার কাজে অকৃপণ সহায়তাও করেছে। কিন্তু আজ পদ্মাতীরের মানুষ পদ্মাকে ছেড়ে এসেছে যে দুঃখে, পদ্মা নিজেও ততখানি দুঃখ দেয়নি কখনো। এ দুঃখের মূল পদ্মা নয়, মানুষের জাতভাই মানুষ।
হাজার গ্রামের মধ্যে শিলাইদার এমন কিছু বৈশিষ্ট্য ছিল না যার জন্যে বাংলাদেশের মানুষ তাকে মনে রাখতে পারে। কিন্তু সে বৈশিষ্টতা দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ সোনারতরীর যুগে অনেক কবিতা রচনা করেছেন এই শিলাইদার কোল ছোঁয়া পদ্মার বোটে বসে বসে। জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িরই জমিদারির অন্তর্গত ছিল এই শিলাইদা।
গ্রামের মাটির স্পর্শ ভুলতে পারি না। ভুলতে পারি না দু-কূল-প্লাবিনী পদ্মকে। বেশ বুঝতে পারছি আজকের এই পরমাশ্চর্য সকালের রোদে নদীর ওপারে ঝাউগাছের দীর্ঘ সারির ফাঁক দিয়ে রোদের ঝলক সারাশিলাইদার গায়ে লুটিয়ে পড়ছে। নদীর ওপরে গাঙচিলগুলো মাছের লোভে চরকির মতো ঘুরপাক খাচ্ছে। আর জলের বুকে নৌকো বেয়ে চলেছে পদ্মানদীর মাঝিরা। কলকাতার এই মধুবংশীয় গলির প্রায়ান্ধকার কুঠুরিতে কোনোরকমে মাথা গুঁজে আজ অনুভব করছি শরতের প্রাক্কালে পদ্মা-স্নাতা শিলাইদার প্রকৃতি ও পরিবেশ। অকাল বর্ষণে নদী পদ্মার যৌবনমদিরতা হয়তো এখনও শেষ হয়নি। হয়তো জলতরঙ্গ এখনও তেমনই প্রবলতায় আছড়ে পড়ছে শিলাইদার দু-তীরে। সে কূলভাঙা ঢেউয়ের শব্দে কত রাত্রে ঘুম গেছে ভেঙে। কত ঝড়ের রাতে পদ্মানদীর মাঝিদের হাঁকাহাঁকিতে সচকিত হয়ে উঠত আমার কিশোরমন। ভাবতাম এই দুরন্ত, দুর্বার পদ্মার বুকে ভগবান যে-মানুষদের জীবন-সংগ্রামে ঠেলে দিয়েছেন তারা যেন প্রকৃতির পরিহাসকে অনায়াসে ভ্রুকুটি দেখিয়ে এই দুর্দম ঝড়ের মধ্যেও নদী পারাপার করছে। এ শক্তি মানুষ অর্জন করেছে নিজেদের বাঁচবার অধিকারকে সুপ্রতিষ্ঠিত করবার জন্যে। কিন্তু সেই মানুষেরাই আবার আত্মপ্রতিষ্ঠার সংগ্রাম ভুলে গিয়ে আত্মধ্বংসী সংগ্রামে কী করে মেতে ওঠে?
পুজো এগিয়ে আসছে। প্রতিবছরই এ সময়টাতে শিলাইদা যাওয়ার জন্যে মন উন্মুখ হয়ে উঠত। কুষ্টিয়া স্টেশনে নামলেই মন এক অপরিসীম আনন্দে ভরে যেত। সামনে গড়াই। নৌকো দিয়ে গড়াই নদী পার হয়ে গিয়ে পৌঁছোতাম কয়াতে। আর দূর নয়। আর মাত্র তিন মাইল হাঁটাপথ। দু-পাশে অতিপরিচিত আমবন, বাঁশঝাড় আরও কত বনলতার শ্যামল স্নিগ্ধ
স্পর্শ। ভাঙা রাস্তা। তার ওপর দিয়ে আবার রহিম ভায়ের গোরুর গাড়ির অত্যাচার। তবুও কলকাতার পিচঢালা রাস্তার চেয়ে সে পথকেই আপন বলে জেনেছি, সে-পথ যে আমার গ্রামের ভিটার সন্ধান দিত আমাকে। বর্ষাকালে জল, শীতকালে ধুলো। তবু যেন কী এক প্রশান্তি সারামন জুড়ে থাকত সে পথে চলবার সময়, তা আজ বোঝাই কী করে? পথ-চলতি মানুষদের সুবিধের জন্যে ঠাকুরবাড়ির লোকেরা পথের দু-পাশে অনেক বাবলা গাছ লাগিয়ে দিয়েছিলেন। কয়া থেকে কুঠিবাড়ি, কুঠিবাড়ি থেকে শিলাইদহ কাছারি পর্যন্ত এই বাবলা গাছের সারি। রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিবিজড়িত সে বাবলা শ্রেণিকে কোনোদিনই তো ভুলতে পারব na। গাছগুলোকে দেখলেই মনে হত যেন আপনার ছত্রছায়ায় আশ্রয় দেওয়ার জন্যে দূরদেশের প্রবাসী সন্তানদের পথ চেয়ে ব্যাকুল আগ্রহে তারা অপেক্ষারত। শুধু গাছ নয়, পথিকদের সুবিধের জন্যে ঠাকুরপরিবারের কর্তারা রাস্তার পাশে একটি বড়ো পুকুর ও টিউবওয়েল খনন করিয়ে দিয়েছেন। বাড়ি যাওয়ার পথেই কত কুশল প্রশ্ন। কেউ বলে : ‘বাবু কখন আসতিছেন?’ কিছুদূর যেতেই আবার প্রশ্ন : ‘আপনি বাড়ি আসেন না কো? আপনের মা আমার কাছে কত প্যাচাল পাড়েন! বাড়ি গিয়ে হয়তো শুনি ওইলোক অনেকদিন আসেইনি আমাদের বাড়ি। তবু সহজ আন্তরিকতায় কুশল প্রশ্ন করতে কার্পণ্য করে না কেউ। হয়তো বলি : ‘তা তোমাদের দেখবার জন্যেই তো এতদূর থেকে এলাম।’