- বইয়ের নামঃ বেদেনী
- লেখকের নামঃ তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায়
- বিভাগসমূহঃ গল্পের বই
বেদেনী
শম্ভু বাজিকর এ মেলায় প্রতি বৎসর আসে। তাহার বসিবার স্থানটা মা কঙ্কালীর এস্টেটের খাতায় চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মতো কায়েমি হইয়া গিয়াছে। লোকে বলে, বাজি; কিন্তু শম্ভু বলে ‘ভোজবাজি-ছারকাছ’। ছোট তাঁবুটার প্রবেশপথের মাথার উপরেই কাপড়ে আঁকা একটা সাইনবোর্ডেও লেখা আছে ‘ভোজবাজি-সার্কাস’। লেখাটার একপাশে একটা বাঘের ছবি, অপরদিকে একটা মানুষ, তাহার এক হাতে রক্তাক্ত তরবারি, অপর হাতে একটি ছিন্নমুণ্ডু। প্রবেশমূল্য মাত্র দুইটি পয়সা। ভিতরে আছে কিন্তু ‘গোলকধামে’র খেলা। ভিতরে পট টাঙাইয়া কাপড়ের পর্দায় শম্ভু মোটা লেন্স লাগাইয়া দেয়, পল্লীবাসীরা বিমুগ্ধ বিস্ময়ে সেই লেন্সের মধ্যে দিয়া দেখে ‘আংরেজ লোকের যুদ্ধ,’ ‘দিল্লীকা বাদশা’, ‘কাবুলকে পাহাড়’, ‘তাজ-বিবিকা কবর’। তারপর শম্ভু লোহার রিং লইয়া খেলা দেখায়, সর্বশেষে একটা পর্দা ঠেলিয়া দিয়া দেখায় খাঁচায় বন্দি একটা চিতাবাঘ। বাঘটাকে বাহিরে আনিয়া তাহার উপরে শম্ভুর স্ত্রী রাধিকা বেদেনী চাপিয়া বসে, বাঘের সম্মুখের থাবা দুইটা ধরিয়া টানিয়া তুলিয়া আপন ঘাড়ের উপর চাপাইয়া তাহার সহিত মুখোমুখি দাঁড়াইয়া বাঘের চুমা খায়, সর্বশেষে বাঘটার মুখের ভিতর আপনার প্রকাণ্ড চুলের খোঁপাটা পুরিয়া দেয়, মনে হয়, মাথাটাই বাঘের মুখের মধ্যে পুরিয়া দিল। সরল পল্লীবাসীরা স্তম্ভিত বিস্ময়ে নিশ্বাস রুদ্ধ করিয়া দেখিতে দেখিতে করতালি দিয়া উঠে। তাহার পরেই খেলা শেষ হয়, দর্শকের দল বাহির হইয়া যায়, সর্বশেষ দর্শকটির সঙ্গে শম্ভুও বাহির হইয়া আসিয়া আবার তাঁবুর দুয়ারে জয়ঢাক পিটিতে থাকে–দুম-দুম, দুম। জয়ঢাকের সঙ্গে স্ত্রী রাধিকা বেদেনী প্রকাণ্ড একজোড়া করতাল বাজায়–ঝন- ঝন-ঝন।
মধ্যে মধ্যে শম্ভু হাঁকে, বড় বাঘ! এ বড় বা-ঘ।
–পক্ষীরাজ ঘোড়া হয়, মানুষের চুমা খায়, জ্যান্ত মানুষের মাথা মুখের মধ্যে পোরে, কিন্তু খায় না।
কথাগুলো শেষ করিয়াই সে ভিতরে গিয়ে বাঘটাকে একটা তীক্ষ্নাগ্র অঙ্কুশ দিয়া খোঁচা মারে, সঙ্গে সঙ্গে বাঘটা বার বার গর্জন করিতে থাকে। তাঁবুর দুয়ারের সম্মুখে সমবেত জনতা ভীতিপূর্ণ কৌতূহলস্পন্দিত বক্ষে তাঁবুর দিকে অগ্রসর হয়।
দুয়ারের পাশে দাঁড়াইয়া বেদেনী দুইটি করিয়া পয়সা লইয়া তবে প্রবেশ করিতে দেয়। এ ছাড়াও বেদেনীর নিজের খেলাও আছে। তাহার আছে একটা ছাগল, বাঁদর আর গোটাকয়েক সাপ। সকাল হইতেই সে আপনার ঝুলি-ঝাঁপি লইয়া গ্রামে বাহির হয়, গৃহস্থের বাড়ি বাড়ি খেলা দেখাইয়া, গান গাহিয়া উপার্জন করিয়া আনে।
এবার শম্ভু কঙ্কালীর মেলায় আসিয়া ভীষণ ক্রুদ্ধ হইয়া উঠিল। কোথা হইতে আর একটা বাজির তাঁবু আসিয়া বসিয়া গিয়াছে। তাহার জন্যে নির্দিষ্ট জায়গাটা অবশ্য খালিই পড়িয়া আছে, কিন্তু এ বাজির তাঁবুটা অনেক বড় এবং কায়দাকরণেও অনেক অভিনবত্ব আছে। বাহিরে দুইটা ঘোড়া, একটা গরুর গাড়ির উপর প্রকাণ্ড একটা খাঁচা, নিশ্চয় উহাতে বাঘ আছে।
গরুর গাড়ি তিনখানা নামাইয়া শম্ভু নূতন তাঁবুর দিকে মর্মান্তিক ঘৃণায় হিংস্র দৃষ্টিতে চাহিল, তারপর আক্রোশভরা নিম্নকণ্ঠে বলিল, শালা!
তাহার মুখ ভীষণ হইয়া উঠিল। শম্ভুর সমগ্র আকৃতির মধ্যে একটা নিষ্ঠুর হিংস্র ছাপ যেন মাখানো আছে। ক্রূর নিষ্ঠুরতা পরিব্যঞ্জক একধারার উগ্র তামাটে রং আছে–শম্ভুর দেহবর্ণ সেই উগ্র তামাটে; আকৃতি দীর্ঘ, সর্বাঙ্গে একটা শ্রীহীন কঠোরতা, মুখে কপালের নিচেই নাকে একটা খাঁজ, সাপের মতো ছোট ছোট গোল চোখ, তাহার উপর সে দন্তু, সম্মুখের দুইটা দাঁত কেমন বাঁকা হিংস্র ভঙ্গিতে অহরহ বাহিরে জাগিয়া থাকে। হিংসায়, ক্রোধে সে যেন ভয়াবহ হইয়া উঠিল।
রাধিকাও হিংসায়, ক্রোধে, ধারালো ছুরি যেমন আলোকের স্পর্শে চকমক করিয়া উঠে, তেমনই ঝকমক করিয়া উঠিল, সে বলিল, দাঁড়া খাঁচায় দিব গোক্ষুরার ডেঁকা ছেড়্যা!
রাধিকার উত্তেজনার স্পর্শে শম্ভু আরো উত্তেজিত হইয়া উঠিল, সে ক্রুদ্ধ দীর্ঘ পদক্ষেপে অগ্রসর হইয়া নূতন তাঁবুটার ভিতর ঢুকিয়া বলিল, কে বেটে, মালিক কে বেটে?
–কি চাই?–তাঁবুর ভিতরের আর একটা ঘরের পর্দা ঠেলিয়ে বাহির হইয়া আসিল একটি জোয়ান পুরুষ, ছয় ফিটেরও অধিক লম্বা, শরীরের প্রতি অবয়বটি সবল এবং দৃঢ়, কিন্তু তবুও দেখিলে চোখ জুড়াইয়া যায়, লম্বা হাল্কা দেহ, তাজা ঘোড়া যেমন একটি মনোরম লাবণ্যে ঝকমক করে–লোকটির হাল্কা অথচ সবল দৃঢ় শরীরে তেমনই একটি লাবণ্য আছে। রং কালোই, নাকটি লম্বা টিকালো, চোখ দুইটি সাধারণ, পাতলা ঠোঁট দুইটির উপর তুলি দিয়া আঁকা গোঁফের মতো এক জোড়া গোঁফ-সূচাগ্র করিয়া পাক দেওয়া, মাথায় বাবরি চুল, গলায় ঝুলানো একটি সোনার ছোট চৌকা তক্তি,–সে আসিয়া শম্ভুর সম্মুখে দাঁড়াইল! দুজনেই দুইজনকে দেখিতেছিল।
–কি চাই?–নূতন বাজিকর আবার প্রশ্ন করিল, কথার সঙ্গে সঙ্গে মদের গন্ধে শম্ভুর নাকের নিচের বায়ুস্তর ভুরভুর করিয়া উঠিল।
শম্ভু খপ করিয়া ডান হাত দিয়া তাহার বাঁ হাতটা চাপিয়া ধরিল, বলিল, এ জায়গা আমার।
আমি আজ পাঁচ বৎসর এইখানে বসছি।
ছোকরাটিও খপ করিয়া আপন ডান হাতে শম্ভুর বাঁ হাত চাপিয়া ধরিয়া মাতালের হাসি হাসিল, বলিল, সে হবে, আগে মদ খাও টুকটা।
শম্ভুর পিছনে জলতরঙ্গ বাদ্যযন্ত্রে দ্রুততম গতিতে যেন গৎ বাজিয়া উঠিল, রাধিকা কখন আসিয়া শম্ভুর পিছনে দাঁড়াইয়াছিল, সে খিল খিল করিয়া হাসিয়া উঠিল, বলিল, কটি বোতল আছে তুমার নাগর–মদ খাওয়াইবা?
ছোকরাটি শম্ভুর মুখ হইতে পিছনের দিকে চাহিয়া রাধিকাকে দেখিয়া বিস্ময়ে মোহে কথা হারাইয়া নির্বাক হইয়া গেল। কালো সাপিনীর মতো ক্ষীণতনু দীর্ঘাঙ্গিনী বেদেনীর সর্বাঙ্গে যেন মাদকতা মাখা; তাহার ঘন কুঞ্চিত কালো চুলে, চুলের মাঝখানে সাদা সুতার মতো সিঁথিতে, তাহার ঈষৎ বঙ্কিম নাকে, টাকা অর্ধ-নিমীলিত ভঙ্গির মদিরদৃষ্টি দুটি চোখে, সূচালো চিবুকটিতে–সর্বাঙ্গে মাদকতা। সে যেন মদিরার সমুদ্রে সদ্য স্নান করিয়া উঠিল; মাদকতা তাহার সর্বাঙ্গ বাহিয়া ঝরিয়া ঝরিয়া পড়িতেছে। মহুয়াফুলের গন্ধ যেমন নিশ্বাসে ভরিয়া দেয় মাদকতা, বেদেনীর কালো রূপও চোখে তেমনই একটা ধরাইয়া দেয় নেশা। শুধু রাধিকাই নয়, এই বেদেজাতের মেয়েদের এটা একটা জাতিগত রূপবৈশিষ্ট্য। এই বৈশিষ্ট্য রাধিকার রূপের মধ্যে একটা যেন প্রতীকের সৃষ্টি করিয়াছে; কিন্তু মোহময় মাদকতার মধ্যে আছে ক্ষুরের মতো ধার, মোহমত্ত পুরুষকেও থমকিয়া দাঁড়াইতে হয়, মোহের মধ্যে ভয়ের চেতনা জাগাইয়া তোলে, বুকে ধরিলে হৃৎপিণ্ড পর্যন্ত ছিন্নবিচ্ছিন্ন হইয়া যাইবে।
রাধিকার খিল খিল হাসি থামে নাই, সে নূতন বাজিকরের বিস্ময়বিহ্বল নীরব অবস্থা দেখিয়া আবার বলিল, বাক হর্যা গেল যে নাগরের?
বাজিকর এবার হাসিয়া বলিল, বেদের বাচ্চা গো আমি। বেদের ঘরের মদের অভাব! এস। কথা সত্য, এই অদ্ভুত জাতটি মদ কখন কিনিয়া খায় না। উহারা লুকাইয়া চোলাই করে, ধরাও পড়ে, জেলেও যায়। কিন্তু তা বলিয়া স্বভাব কখন ছাড়ে না। শাসন-বিভাগের নিকট পর্যন্ত ইহাদের এ অপরাধটা অতি সাধারণ হিসাবে লঘু হইয়া দাঁড়াইয়াছে।
শম্ভুর বুকখানা নিশ্বাসে ভরিয়া এতখানি হইয়া উঠিল। আহ্বানকারীও তাহার স্বজাতি, নতুবা–। সে রাধিকার দিকে ফিরিয়া কঠিন দৃষ্টিতে চাহিয়া বলিল, তুই আইলি কেনে এখেনে?
রাধিকা এবারও খিল খিল করিয়া হাসিয়া বলিল, মরণ তুমার! আমি মদ খাব নাই?
তাঁবুর ভিতরে ছোট একটা প্রকোষ্ঠের মধ্যে মদের আড্ডা বসিল। চারদিকে পাখির মাংসের টুকরা টুকরা হাড়ের কুচি ও একরাশি মুড়ি ছড়াইয়া পড়িয়া আছে; একটা পাতায় এখনও খানিকটা মাংস, আর একটায় কিছু মুড়ি, পেঁয়াজ, লঙ্কা, খানিকটা নুন, দুইটি খালি বোতল গড়াইতেছে, একটা বোতল অর্ধসমাপ্ত। বিস্রস্তবসনা একটি বেদের মেয়ে পাশেই নেশায় অচেতন হইয়া পড়িয়া আছে, মাথার চুল ধুলায় রুক্ষ, হাত দুইটি মাথার উপর দিয়া ঊর্ধ্ববাহুর ভঙ্গিতে মাটির উপর লুণ্ঠিত, মুখে তখনও মদের ফেনা বুদ্বুদের মতো লাগিয়া রহিয়াছে। হৃষ্টপুষ্ট শান্তশিষ্ট চেহারার মেয়েটি।
রাধিকা তাহাকে দেখিয়া আবার খিল খিল করিয়া হাসিয়া উঠিল। বলিল, তুমার বেদেনী? ই যি কাটা কলাগাছের পারা পড়েছে গো!
নূতন বাজিকর হাসিল, তারপর সে স্খলিতপদে খানিকটা অগ্রসর হইয়া একটা স্থানের আলগা মাটি সরাইয়া দুইটা বোতল বাহির করিয়া আনিল।
মদ খাইতে খাইতে কথা যাহা বলিবার বলিতেছিল নূতন বাজিকর আর রাধিকা।
শম্ভু মত্ততার মধ্যেও গম্ভীর হইয়া বসিয়া ছিল। প্রথম পাত্র পান করিয়াই রাধিকা বলিল, কি নাম গো তুমার বাজিকর?
নূতন বাজিকর কাঁচা লঙ্কা খানিকটা দাঁতে কাটিয়া বলিল, নাম শুনলি গালি দিবা আমাকে বেদেনী।
–কেনে?
–নাম বটে কিষ্টো বেদে।
–তা গালি দিব কেনে?
–তুমার নাম যে রাধিকা বেদেনী, তাই বুলছি।
রাধিকা খিল খিল করিয়া হাসিয়া গড়াইয়া পড়িল। পরক্ষণেই সে কাপড়ের ভিতর হইতে ক্ষিপ্রহস্তে কি বাহির করিয়া নূতন বাজিকরের গায়ে ছুড়িয়া দিয়া বলিল, কই, কালিয়দমন কর দেখি কিষ্টো, দেখি!
শম্ভু চঞ্চল হইয়া পড়িল; কিন্তু কিষ্টো বেদে ক্ষিপ্র হাতে আঘাত করিয়া সেটাকে মাটিতে ফেলিয়া দিল। একটা কালো কেউটের বাচ্চা। আহত সর্পশিশু হিস গর্জন করিয়া ফণা তুলিয়া দংশনোদ্যত হইয়া উঠিল : শম্ভু চিৎকার করিয়া উঠিল, আ-কামা! অর্থাৎ বিষ দাঁত এখনও ভাঙা হয় নাই। কিষ্টো কিন্তু ততক্ষণে তাহার মাথাটা বাঁ হাতে চাপিয়া ধরিয়া হাসিতে আরম্ভ করিয়া দিয়াছে। হাসিতে হাসিতে সে ডান হাতে ট্যাঁক হইতে ছোট একটা ছুরি বাহির করিয়া দাঁত দিয়া খুলিয়া ফেলিল এবং সাপটার বিষদাঁত ও বিশেষ থলি দুইই কাটিয়া ফেলিয়া রাধিকার গায়ে আবার ছুড়িয়া দিল। রাধিকাও বাঁ হাতে সাপটাকে ধরিয়া ফেলিল; কিন্তু রাগে সে মুহূর্ত পূর্বের ঐ সাপটার মতোই ফুলিয়া উঠিল, বলিল–আমার সাপ তুমি কামাইলা কেনে?
কিষ্টো বলিল, তুমি যে বলল্যা গো দমন করতে।–বলিয়া সেও একবার হা হা করিয়া হাসিয়া উঠিল।
রাধিকা মুহূর্তে আসন ছাড়িয়া উঠিয়া তাঁবু হইতে বাহির হইয়া গেল।