- বইয়ের নামঃ শূন্য
- লেখকের নামঃ হুমায়ূন আহমেদ
- প্রকাশনাঃ সময় প্রকাশন
- বিভাগসমূহঃ বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী
চোখ দিয়ে পানি পড়ছে
সকাল থেকেই তাঁর চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। শুরুতে ব্যাপারটা তিনি বুঝতে
পারেননি। স্কুলে রওনা হবার আগে আয়নার চুল আঁচড়াতে গিয়ে মনে হল—বা চোখের কোণাটা ভেজা ভেজা। চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। আয়নায় ভালো করে তাকিয়ে দেখেন শুধু বা চোখ না, দুচোখ দিয়েই পানি পড়ছে। অথচ চোখে কোনো জ্বালা-যন্ত্ৰণা নেই। রহস্যটা কি? বয়সকালে শরীরবৃত্তির নিয়ম-কানুন কি অন্য রকম হয়ে যায়?
খানিকটা বিস্ময় এবং খানিকটা বিরক্তি নিয়ে তিনি স্কুলে গেলেন। প্রথম পিরিয়ডে বীজগণিত। ক্লাস নাইন। সেকশান বি। ফার্স্ট পিরিয়ডে রোলকল করতে হয়। শুধু শুধু সময় নষ্ট। চুয়ান্নজন ছেলে। প্ৰতি ছেলের পেছনে চার সেকেন্ড করে ধরলে—দুইশ ষােল সেকেন্ড। অর্থাৎ তিন দশমিক ছয় মিনিট। পঞ্চাশ মিনিটের ক্লাসের আঠারো ভাগের একভাগ সময় চলে গেল। সময়ের কি নিদাৰুণ অপচয়! কোনো মানে হয় না।
হেডমাস্টার সাহেবের কঠিন নিয়ম। রোলকল করতে হবে। বত্রিশ বছর মনসুর সাহেব নিয়ম পালন করেছেন। রোলকল করে সময় নষ্ট করেছেন। আজই নিয়মের ব্যতিক্রম করলেন। রোলকল না করে সরাসরি বোর্ডে চলে গেলেন।
চোখ দিয়ে পানি পড়াটা এই সময় বেড়ে গেল। বোর্ডে যা লেখেন পড়তে পারেন না। চোখের পানির জন্যে সব ঝাপসা দেখা যায়। তিনি এক সময় বিব্রত গলায় বললেন, থাক, আজ আর পড়াব না। চোখে সমস্যা।
ছাত্ররা কেউ শব্দ করল না। আগে যেমন বোর্ডের দিকে তাকিয়েছিল এখনো তেমনি তাকিয়ে রইল। মনসুর সাহেব বললেন—চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। বোর্ডের লেখা পড়তে পারছি না।
এই কথার পরেও ছাত্ররা বোর্ডের লেখা থেকে চোখ সরাল না, যেন তারা পাথরের মূর্তি। মনসুর সাহেবের মন কিছুটা খারাপ হল। ছেলেরা তাকে এত ভয় পায় কেন? তিনি তাঁর বত্রিশ বছরের শিক্ষকতা জীবনে—কোন ছাত্রকে ধমক পর্যন্ত দেননি। তাহলে এরকম হচ্ছে কেন?
পাশের ক্লাসের বীরেন বাবু জিওগ্রাফি পড়াচ্ছেন–জলবায়ু। পড়ার ফাঁকে ফাকে কি সব বলছেন ছাত্ররা হো হো করে আসছে। হাসি শুরু হয় আর থামতে চায় না। বীরেন বাবু রাগী গলায় ধমকান, থামবি? না ধরে আছাড় দেব? কানে চাবি দিয়ে বৃন্দাবন পাঠিয়ে দেব, বুঝলি? ছাত্ররা আরো হাসে। মনসুর সাহেবের মনে হল, ক্লাস এরকমই হওয়া উচিত। ছাত্ররা আনন্দে থাকবে। যা শেখার শিখবে আনন্দে। এমন যদি হতবীরেন বাবু বাজে টিচার, ভালো পড়াতে পারেন না, তাহলে একটা কথা ছিল। ব্যাপার মোটেই সে রকম নয়। শিক্ষক হিসেবে বীরেন বাবুর কোনো তুলনা নেই।
মনসুর সাহেব চক হাতে ব্ল্যাকবোর্ডের সামনে দাঁড়িয়ে মনে করার চেষ্টা করছেন—তাঁর এই দীর্ঘ শিক্ষকতা জীবনে কখনো কি তাঁর কোনো কথায়, কোনো রসিকতায় ছাত্ররা প্রাণখুলে হেসেছে?
তিনি মনে করতে পারলেন না। ছাত্রদের মুগ্ধ করার কোনো বিদ্যা তার জানা নেই। তিনি গল্প করতে পারেন না। গল্প শুনতেও তার ভালো লাগে না। কোনো কিছুই তাঁর বোধহয় ভালো লাগে না। তিনি আগ্রহ বোধ করেন না। এই যে এতগুলি ছাত্র তাঁর সামনে বসে আছে তিনি এদের কারোর নাম জানেন না। রাস্তায় এদের কারোর সঙ্গে দেখা হলে তিনি চিনতে পারবেন না। অথচ তাঁর স্মৃতিশক্তি দুর্বল নয়। আজ ছাত্র কতজন আছে? আজ সবাই কি উপস্থিত? তিনি গোনার চেষ্টা করছেন। চোখে অস্পষ্ট দেখছেন বলে শুনতে অসুবিধা হচ্ছে।
তোমরা আজ কতজন উপস্থিত?
ফর্সা একটা ছেলে উঠে দাঁড়িয়ে ভীত গলায় বলল—স্যার ৪১ জন।
তিনি একটু চমকালেন—একচল্লিশ জন উপস্থিত। একচল্লিশ একটা মৌলিক সংখ্যা। প্রাইম নাম্বার। একচল্লিশ জন উপস্থিত হলে অনুপস্থিত হল ১৩ জন। ১৩ আরেকটি মৌলিক সংখ্যা। প্রাইম নাম্বার। বাহ্, পরস্পর দুটা প্রাইম সংখ্যা পাওয়া গেল। ইন্টারেস্টিং তো।
মনসুর সাহেবের চোখ দিয়ে পানি পড়া বেড়েছে। চশমার ফাঁক দিয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ছে। তিনি রুমাল দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে আবারও বললেন আমার চোখে একটা সমস্যা হয়েছে। পানি পড়ছে। আজ তোমাদের পড়াব না। বাবারা, আমি দুঃখিত ও লজ্জিত।
তিনি নিজের চেয়ারে বসলেন। ক্লাস শেষ হতে এখনো অনেক বাকি। এতক্ষণ কি করবেন? বসে থাকবেন চুপচাপ? এতে ছাত্রদের ক্ষতি হবে। সেটা ঠিক হবে না। উপদেশমূলক কোনো গল্প বলতে পারলে ভালো হত। উপদেশটা গল্পচ্ছলে শিখলেও লাভ। ঈশপের একটা গল্প বলা যেতে পারে। ঈশপের গল্পগুলি কি যেন? একটা গল্প আছে নাথােপাদের নীলের গামলায় একবার এক শেয়াল পড়ে গেল। তার গা হয়ে গেল ঘন নীল—এটা কি ঈশপের গল্প, না অন্য কারো গল্প। এই গল্পের উপদেশটা কি? আশ্চর্য! উপদেশটা মনে পড়ছে না।
মনসুর সাহেব তাঁর সামনের টেবিলে হাত রেখে তার উপর মাথা রাখলেন এই ভাবেই গল্পটা মনে করতে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন। ক্লাস শেষ হবার ঘণ্টা পড়ল। তার ঘুম ভাঙল না। ছাত্ররাও কেউ কোনো শব্দ করল না। পরের পিরিয়ডে হেডমাস্টার সাহেবের ইংরেজি পড়াবার কথা। তিনি মনসুর সাহেবকে ঘুম থেকে ডেকে তুললেন। বিস্মিত হয়ে বললেন, আপনার কি শরীর খারাপ?
জ্বি না।
দেখে তো মনে হচ্ছে শরীর খারাপ। চোখে কি হয়েছে?
বুঝতে পারছি না। পানি পড়ছে।
এই শরীর নিয়ে ক্লাসে এসেছেন কেন? যান যান-বাড়ি যান। বাড়ি গিয়ে রেস্ট নিন।