- বইয়ের নামঃ জরাসন্ধের গল্প
- লেখকের নামঃ চারুচন্দ্র চক্রবর্তী
- বিভাগসমূহঃগল্পের বই
তিলোত্তমা
‘অত গভীর মনোযোগ দিয়ে কী দেখছ?’
বলতে বলতে ঘরে ঢুকলেন মিস্টার ঘোষ। বড় সওদাগরি অফিসে অনেকখানি উপরতলার চাকরে। ছুটির দিন বলে বেশবাসে কিছুটা ঢিলেঢালা। মুখে পাইপটি অবশ্য ঠিক আছে। কাছে এসে যেন আঁতকে উঠলেন, ‘আরে, এ যে দেখছি বাংলা কাগজ!’
লাহিড়ী সাহেব মাথা না তুলেই একটু হাসলেন, ‘কারে পড়লে বাঘেও ঘাস খায়, জান তো?’
মানে?
এবার মুখ তুললেন মিস্টার লাহিড়ী সামনের টেবিলের উপর ছড়ানো খবরের কাগজখানা গুটিয়ে রাখতে রাখতে বললেন, ‘পাত্র-পাত্রীর বিজ্ঞাপন দেখছিলাম রমলা বললে এতে নাকি অনেক ভাল ভাল মেয়ের খোঁজ পাওয়া যায়। তা না হলে এই সব ট্র্যাশ আমি পড়ি! ম্যাটারের কথা না হয় ছেড়ে দিলাম, চেহারা দেখ! তেমনি ছাপা! একটা শীটে চোখ বুলোতেই মাথা ধরে গেছে।‘
লাহিড়ী সাহেবের পুরো নাম তিনকড়ি লাহিড়ী, আধুনিক ভদ্রসমাজে যা উচ্চারণ করা যায় না। এই নামের জন্যে দীর্ঘদিন পরলোকগত পিতামাতার উপর তাঁর ক্ষোভ আজও মেটেনি।
দুটি সন্তান অকালে মারা যাবার পর এঁকে নাকি তাঁরা তিন কড়াকড়ি দিয়ে কিনে নিয়েছিলেন যমের হাত থেকে। সিলী সুপারস্টিশান! কিন্তু স্কুলে-কলেজে ঐ নাম থাকায় পরে আর বদলাতে পারেননি। তবে লোকের কাছে তিনি টি. লাহিড়ী নামেই পরিচিত।
ইংরেজ আমলেই শ্বশুরের টাকায় বিলেত থেকে ব্যারিস্টার হয়ে এসেছিলেন। ঘরে বাইরে সাহেবিয়ানার পত্তন তখন থেকেই। ইংরেজ চলে যাবার পর সেটা আরও বেড়েছে। সেই সঙ্গে বেড়েছে পসার। ছেলেকে ডাক্তারি পড়িয়েছেন এবং বিলেত পাঠিয়েছেন সেখান থেকে আরও গোটাকয়েক বড় বড় ডিগ্রী সংগ্রহ করে দেশে এসে যাতে কোন একটা বিষয়ে স্পেশালিস্ট হয়ে বসতে পারে। জাঁকিয়ে বসার মত প্রাথমিক উপকরণ যোগাবার জন্যে তৈরী হচ্ছিলেন।
ছেলে এই দুটি উদ্দেশ্যের প্রথমটি ভাল ভাবেই পূরণ করেছে। অর্থাৎ তার নামের পরে এমন কতগুলো হরফ যুক্ত হয়েছে যা বিধান রায় প্রমুখ দু’চারজন অত্যন্ত কৃতী ছাত্র ছাড়া আর কোন ভারতবাসী আজ পর্যন্ত অর্জন করতে পারেনি।
লাহিড়ী সাহেবের দ্বিতীয় উদ্দেশ্য অবশ্য সফল হয়নি। সে ওখানেই একটা বৃহৎ অঙ্কের চাকরি যোগাড় করে স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে গেছে। সুদূর ভবিষ্যতেও দেশে ফেরার কোনও ইচ্ছা নেই।
মিসেস লাহিড়ী বড়লোকের ঘর থেকেই এসেছিলেন। তবে সেখানকার ধরনধারণ খুব একটা আধুনিক নয়। শীর্ষেন্দুকে বিলেত পাঠাতে তাঁর আপত্তি ছিল না, তবে তার আগে একটি মনোমত বৌ ঘরে আনার ইচ্ছা ছিল। স্বামীর কাছে প্রকাশও করেছিলেন। লাহিড়ী সাহেব কথাটাকে বিশেষ আমল দেননি। ইন্দু’র উপর তাঁর প্রগাঢ় আস্থা। বাপ-মায়ের অমতে সে কিছু করবে না।
তাছাড়া ধরে নিয়েছিলেন, সে তো কয়েক বছর পরেই ফিরে আসছে এবং এখানেই প্র্যাকটিস করবে ততদিন একটি যুবতী মেয়ে স্বামীর কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে একা একা তাঁদের কাছে পড়ে থাকবে, সেটা কারো পক্ষেই সুখের হবে না।
আর একটা কথাও ভেবেছিলেন। এখানকার একজন এম.বি.-র চেয়ে একটি ফরেন ডিগ্রীওয়ালা কৃতী ছেলের পাত্র হিসাবে কদর অনেক বেশী বিয়ের বাজারে বড় রকম দাঁও মারার অভিপ্রায়ও হয়তো মনে মনে পোষণ করেছিলেন লাহিড়ী সাহেব।
মিস্টার ঘোষ বললেন, ‘মেয়ের খোঁজ করছ, ছেলে আসছে নাকি?’
হ্যাঁ, ডিসেম্বরের মাঝামাঝি এসে পড়বে। পুরো মাস দেড়েক সময়ও নেই। এর মধ্যেই একটি মেয়ে ঠিক করে ফেলতে হবে।’
‘বিয়ে করতে রাজী হয়েছে তাহলে?
রাজী করাতে হয়েছে। অত টাকা রোজগার করে। ফ্ল্যাট কিনেছে লন্ডনে। এদিকে একা। দেখাশুনো করবার কেউ নেই। তাই আমরা দুজনেই অনেক দিন ধরে লিখছিলামা কদিনের জন্যে এসে বে-থা করে বৌ নিয়ে চলে যাও! ইংরেজি জানা ভাল মেয়ের তো আর এখন অভাব নেই। শেষ পর্যন্ত মতি ফিরেছে। মাকে লিখেছে, পনেরো দিনের ছুটিতে যাচ্ছি। তার মধ্যে যা করবার করো’
‘বিজ্ঞাপনে কিছু পেলে?’
‘মেয়ে তো আছে একগাদা। পছন্দসই একটাও চোখে পড়ল না। তাই ভাবি। আমিই একটা ইনসারশন দিই।’
‘তাই ভাল। পাত্রপক্ষের রিকোয়ারমেন্ট জানিয়ে দিলে সেইমত পার্টিই আসবে। তার থেকে বেছে নেওয়া সহজ।’
‘তাহলে এস, এখনই একটা ড্রাফট করে ফেলা যাক। আমার আবার বাংলা-টাংলা তেমন আসে না।’
‘আমারও তাই। তবু কিছুটা হেলপ করতে পারব আশা করি তুমি আগে একটা দাঁড় করাবার চেষ্টা করা।’
লাহিড়ী সাহেব একটা প্যাড নিয়ে শুরু করলেন, ‘লন্ডন-প্রবাসী উচ্চ উপাধিধারী উচ্চ উপার্জনকারী…ঠিক হচ্ছে তো?’
মিস্টার ঘোষ একটু ভেবে বললেন, ‘শেষ শব্দটা যেন কেমন কেমন লাগছে! ‘হাই-ইনকাম বলতে চাও তো?’
‘হ্যাঁ। ওটাই তো আসল।’
‘তাহলে সু-উপায়ী’ বলতে পার।’
‘ঠিক বলেছ। কাগজেও ঐ কথাটা দেখলাম দু’এক জায়গায়।’
মিস্টার লাহিড়ী লিখে চললেন, ‘সু-উপায়ী ডাক্তার পাত্রের জন্য প্রকৃত সুন্দরী উজ্জ্বল গৌরবর্ণা দীর্ঘাঙ্গী, উচ্চশিক্ষিতা, স্বাস্থ্যবতী, লাবণ্যময়ী, মধুর-স্বভাবা…আর কী লিখব?
‘উচ্চশিক্ষিতা’র পর ব্র্যাকেটে লিখে দাও, ইংরেজি ভাষা ও কথাবার্তায় বিশেষ ব্যুৎপত্তিসম্পন্না’—ওটাই তো আগে দরকার। অনেক এম. এ. পাস মেয়ে পাবে, দু লাইন ইংরেজি বলতে পারে না। সেরকম হলে তো চলবে না!’