ভারতের নৃতাত্ত্বিক পরিচয়
প্রাগৈতিহাসিক প্রেক্ষাপট
ভূপৃষ্ঠে তার আবির্ভাবের দিন থেকেই মানুষ ভারতে বাস করে আসছে। এর পেছনে যে যুক্তি আছে, সেটাই এখানে দিচ্ছি। পৃথিবীতে মানুষের আবির্ভাব ঘটেছিল আজ থেকে পাঁচ লক্ষ বৎসর পূর্বে। তার আগের দুইশত ষাট লক্ষ বৎসর ধরে প্রকৃতির কর্মশালায় চলেছিল এক বিরাঙ্কুর্মকাণ্ড এক শ্রেণীর বানর-জাতীয় জীবগণ ( dryopithecus ) চেষ্টা করছিল বিভিন্ন লক্ষণযুক্ত হয়ে নানা বৈশিষ্ট্যমূলক শাখা-প্রশাখায় প্রসারিত হতে। এরূপ এক শাখা থেকে উদ্ভূত হয়েছিল নরাকার জীবসমূহ। এসব জীবের মধ্যে যারা বৃক্ষ ত্যাগ করে ভুমিতে আশ্রয় নিয়েছিল তাদের অন্যতম জীবের নাম রামপিথেকাস ( Ramapithecus )। রামপিথেকাস থেকেই পরে মানুষ উদ্ভূত হয়েছিল। রামপিথেকাসের আবিষ্কার ঘটেছিল বর্তমান শতাব্দীর ত্রিশের দশকে।
১৯১৪ খ্রীস্টাব্দে বিখ্যাত প্রত্নাস্থিতত্ত্ববিদ ( palaeontologist ) স্যার আর্থার কীথ তাঁর Antiquity of Man গ্রন্থে লেখেন–‘India is – a part of the world from which the student of early man has expected so much and so far has obtained so little.’ ( ‘প্রাচীন মানুষের সম্বন্ধে যাঁরা অনুসন্ধান করেন, তারা ভারতের দিকেই আশার দৃষ্টিতে চেয়ে থাকেন, কিন্তু এ পর্যন্ত র্তাদের নিরাশ হতে হয়েছে। ) স্যার আর্থারের এই উক্তির অনুসরণেই ত্রিশের দশকে আমেরিকার ইয়েলের স্যাচারাল মিউজিয়ামের অধ্যাপক ডক্টর টেরা (Dr. H. De Terra) ভারতের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে এ বিষয়ে এক অনুসন্ধান চালান। যদিও তার এই প্রথম অভিযানে প্রাচীন যুগের প্রকৃত মানবের কঙ্কালাস্থি পাওয়া যায়নি, তথাপি মানবের বিবর্তনের কতকগুলি মূল্যবান সূত্র তিনি এখানে আবিষ্কার করতে সক্ষম হন। এককথায় বলতে গেলে, মানবাস্থির সন্ধান না পেলেও মানবের পূর্ববর্তী পুরুষদের অস্থির সন্ধান তিনি পেয়েছিলেন। উত্তর-পশ্চিম ভারতের শিবালিক গিরিমালা অঞ্চলে তিনি রামপিথেকাস, সুগ্ৰীবপিথেকাস, ব্রহ্মপিথেকাস প্রভৃতি নামধেয় নরাকার জীবের জীবাশ্মের সন্ধান পেয়েছিলেন। তাঁর এই আবিষ্কারগুলি নৃতত্ত্বের ওপর নূতন আলোকপাত করে ; কারণ ইতিপূর্বে এই পর্যায়ের জীবগণের তথ্য অজ্ঞাত ছিল। ইয়েল অভিযানের সদস্ত লুইস সাহেবের মতে এইজাতীয় জীবগুলি ( higher primates ) জগতের এই অঞ্চলেই প্রথম প্রাতৃভূত হয়েছিল। এদের চিবুকাস্থি ও দান্তিক সংস্থান অনেকটা মানবেরই কাছাকাছি। এ থেকে মনে হয় যে, মানবের বিবর্তন এই অঞ্চলেই ঘটেছিল।
এর অল্পদিন পরে ইয়েল ও কেম্বিজে বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌথ উদ্যোগে ডক্টর টেরা ভারতে তাঁর দ্বিতীয় অভিযান পরিচালনা করেন। কিন্তু এই দ্বিতীয় অভিযানেও তিনি আদিম যুগের মানবের জীবাশ্ম পাননি। তথাপি এই প্রথম ও দ্বিতীয় অভিযানের একটা বিশেষত্ব হচ্ছে, এই অভিযানদ্বয়ে এক লক্ষ থেকে পাঁচ লক্ষ বৎসরের পুরাতন ভূ-স্তর থেকে তৎকালীন ভারতে মানব-বাসের প্রকৃষ্ট প্রমাণ মেলে। এ থেকে মনে হয় যে ভারতে আদিম মানবের জীবাশ্মের সন্ধান নিতান্ত স্বপ্ন বিলাস মাত্র নয়।
ভারতের উত্তর-পশ্চিমে শিবালিক শৈলমালা ও তৎসংলগ্ন অঞ্চলে রামপিথেকাসের আবিষ্কারের পর আমরা তার জ্ঞাতি-ভাইদের কঙ্কালাস্থি পেয়েছি চীন দেশের কেইয়ুয়ানে ও আফ্রিকার কেনিয়ায়। তবে তাদের মধ্যে রামপিথেকাসই সবচেয়ে প্রাচীন। পণ্ডিতগণ মনে করেন যে আজ থেকে ১২০ লক্ষ বৎসর পূর্বে শিবালিক গিরিমালা অঞ্চলেই রামপিথেকাসের উদ্ভব ঘটেছিল, এবং সেখান থেকেই তার জ্ঞাতিভাইরা আফ্রিকা ও চীনদেশে গিয়ে সেখানকার ভৌগোলিক ও প্রাকৃতিক পরিবেশের প্রভাবে নিজ নিজ বিশিষ্টতা লাভ করে বিবর্তনের পথে এগিয়ে গিয়েছিল। রামপিথেকাসের পরবর্তী যে জীবের কঙ্কালাস্থি আমরা পেয়েছি, তারা আজ থেকে কুড়ি লক্ষ বৎসর পূর্বে পৃথিবীর বাসিন্দা ছিল। তার নাম দেওয়া হয়েছে ‘অস্ট্রালোপিথেকাস। এরা সবাই মানুষের পুর্বপুরুষ মাত্র, ঠিক মানুষ নয়। তবে তারা মানুষের বিবর্তনের পথে এক একটা ধাপ। রামপিথেকাস যেমন আফ্রিকা ও চীনদেশ পর্যন্ত এগিয়ে গিয়েছিল, অস্ট্রালোপিথেকাস তেমনই ভারতের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত জাভা পর্যন্ত গিয়ে পৌছেছিল। এরূপ জীবের অস্থি আমরা পেয়েছি জাভার সানগিরানে। আরও পেয়েছি আফ্রিকার তানজানিয়ার অন্তর্গত ওলডুভালে ও গারুসিতে, কেনিয়ার অন্তর্গত বারিনগো এবং লোথাগামে, দক্ষিণ আফ্রিকার টাউঙ, মাকাপান, সোয়ারটুক্রানস ও স্টার্কফনটেনে। প্রকৃত মানুষ ও অস্ট্রালোপিথেকাসের মধ্যবর্তী জীবের প্রাতুর্ভাব ঘটেছিল আজ থেকে দশ লক্ষ বৎসর পূর্বে। তাদের কঙ্কালাস্থি আমরা পেয়েছি জাভার সানগিরানে ও মডজোকারটোতে, আফ্রিকার তানজানিয়ার ওলডুভালে, দক্ষিণ আফ্রিকার সোয়ারটক্রানস ও সাহার মরুভূমির অন্তর্গত চাদ-এর টায়োতে। তারপর পাঁচ লক্ষ বৎসর পূর্বে ঋজুভাবে চলাফেরা করতে পারে ( homo erectus ) এরূপ মানবের কঙ্কালাস্থি আমরা পেয়েছি জাভার ট্রিনিলে, চীনদেশের পিকিং ও লানটিয়ানে, তানজানিয়ার ওলডুভালে, আলজিরিয়ার টারনিটাইনে, জারমানির হাইডেলবারগে, হাঙ্গেরির ভেরটেস্জোলোসে। তার পরের পর্যায়ের মানুষের কঙ্কালাস্থি আমরা পেয়েছি ইংলণ্ডের সোয়ানস্কুমে, জারমানির স্টাইনহাইমে ও চীনদেশের মা-পা-তে। এর পরবর্তী পর্যায়ের মানুষের নাম দেওয়া হয়েছে নিয়ানডারথাল (Neanderthal) জাতির মানুষ। নিয়ানডারথাল জাতির মামুষের কঙ্কালাস্থি আমরা পেয়েছি ইউরোপের নানা স্থানে ও মধ্যপ্রাচী থেকে। আমুমানিক চল্লিশ হাজার বৎসর পূর্বে নিয়ানডারথাল জাতির মানুষ পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে যায়। তার স্থান অধিকার করে ক্রোম্যানিয়োন ( Cromagnon ) জাতির মানুষ। ক্রোম্যানিয়োন জাতির মানুষ হতেই পৃথিবীর বর্তমান জাতিসমূহের উদ্ভব ঘটেছে।