Site icon BnBoi.Com

রিটার্ন অভ শী – হেনরি রাইডার হ্যাগার্ড

রিটার্ন অভ শী - হেনরি রাইডার হ্যাগার্ড

রিটার্ন অভ শী

০০-০৫. সেই অপ্রত্যাশিত ঘটনা

০০.

শুরুর আগে শেষ পর্যন্ত ঘটলো সেই অপ্রত্যাশিত ঘটনা। আমি আরেকটা চিঠি পেলাম লুডউইগ হোরেস হলির কাছ থেকে। শেষ চিঠিটা পেয়েছিলাম অনেক অনেক বছর আগে শী-এর পাণ্ডুলিপির সঙ্গে। তাতে মিস্টার হলি লিখেছিলেন, অপরূপা আয়শার খোঁজে লিও ভিনসি আর তিনি আবার রওনা হচ্ছেন। এবার মধ্য এশিয়ার পথে।

গেল বছরগুলোতে প্রায়ই আমার ওদের কথা মনে হয়েছে। শেষ পর্যন্ত কি ঘটলো জানার কৌতূহল হয়েছে। পাগলপ্রায় মানুষ দুটো বেঁচে আছে না মরে গেছে? নাকি তিব্বতের বৌদ্ধ মঠের পুরোহিতদের সান্নিধ্যে এসে ভিক্ষু হয়ে গেছে? জবাব পাইনি প্রশ্নগুলোর।

অবশেষে আজ, কোনোরকম পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই আমাকে স্তম্ভিত করে দিয়ে হাজির হয়েছে চিঠিটা। হোরেস হলির লেখা শেষবার দেখার পর বহুদিন পার হয়ে গেছে। তবু তার স্বাক্ষর আজ দেখা মাত্র চিনতে পেরেছি। তক্ষুণি পড়লাম চিঠিটা। তাতে লেখা:

প্রীতিভাজনেষু,

আমার ধারণা আপনি এখনও বেঁচে আছেন, আশ্চর্যের কথা আমিও বেঁচে আছি—যদিও আর কদিন থাকবো তা ভবিতব্যই বলতে পারে।

সভ্য জগতে ফিরে আসার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে আপনার (নাকি আমার?) শী বই-এর একটা হিন্দুস্তানী অনুবাদ আমার হাতে আসে। বইটা আমি পড়েছি। বলতে দ্বিধা নেই, আপনার দায়িত্ব আপনি নিষ্ঠার সঙ্গে সমাপন করেছেন। প্রতিটি নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালিত হয়েছে। সুতরাং আপনাকেই আমি এ-ইতিহাসের

শেষাংশ সম্পাদনার ভার দিয়ে যেতে চাই।

আমি খুবই অসুস্থ। অনেক কষ্টে, বোধহয় মরার জন্যে, ফিরে এসেছি আমার পুরনো বাড়িতে। আমার মৃত্যু সন্নিকটে। ডাক্তারকে আমি অনুরোধ জানিয়েছি, আমার মৃত্যুর পর যেন সব কাগজপত্র পাঠিয়ে দেয় আপনার কাছে। অবশ্য এখনও নিশ্চিত নয় ব্যাপারটা। একেকবার মনে হচ্ছে, এবারের পাণ্ডুলিপিটা। পুড়িয়ে ফেলাই বোধহয় ভালো। দেখা যাক, শেষ পর্যন্ত কি ঠিক করি। যদি পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেই তাহলে পাণ্ডুলিপির সঙ্গে একটা বাক্সও যাবে আপনার কাছে। কিছু খসড়া নকশা আর একটা সিট্রাম থাকবে ওতে। নকশাগুলো কখনও হয়তো কাজে লাগবে আপনার। আর সিট্রামটা হলো প্রমাণ। প্রাচীন মিসরের দেবী আইসিস-এর পূজায় ব্যবহার হতো এই সিট্রাম। আপনার কাছে জিনিসটা পাঠাচ্ছি দুটো কারণে: প্রথমত, আপনার প্রতি আমার কৃতজ্ঞতার নিদর্শন হিসেবে, দ্বিতীয়ত, সঙ্গের পাণ্ডুলিপিতে লেখা কথাগুলোর সত্যতা সম্পর্কে যেন নিঃসংশয় হতে পারেন সে জন্যে। আমার বক্তব্যের সপক্ষে একমাত্র প্রমাণ ওটা।

চিঠি দীর্ঘ করতে চাই না। সে শারীরিক ক্ষমতা আমার নেই, ইচ্ছাও নেই। প্রমাণগুলোই নিজেদের পক্ষে যা বলার বলবে,। ওগুলো দিয়ে আপনার যা ইচ্ছে করতে পারেন। বিশ্বাস করা না করা-ও আপনার ব্যাপার। আমি জানি ওগুলো সত্যি, সুতরাং কেউ বিশ্বাস না করলেও আমার কিছু এসে যায় না।

আয়শা কে? পুনর্জন্ম নেয়া এক সৌরভ? বাস্তবে রূপ নেয়া প্রকৃতির কোনো অদৃশ্য শক্তি? সুন্দর, নিষ্ঠুর এবং অমর কোনো আত্মগত প্রাণ? আপনিই বলুন। আমি বাস্তবের সাথে আমার কল্পনাশক্তির সম্পূর্ণটাই মিশিয়ে চেষ্টা করেছি, সমাধান করতে পারিনি।

আপনার সুখ আর সৌভাগ্য কামনা করি। বিদায়, আপনাকে এবং সবাইকে।

–এল, হোরেস হলি।

চিঠিটা নামিয়ে রাখলাম। এর বক্তব্য বিশ্লেষণ করার কোনো চেষ্টা না করে দ্বিতীয় খামটা খুললাম। কিছু অপ্রাসঙ্গিক বক্তব্য ছাড়া এই চিঠিটাও সম্পূর্ণ তুলে দিচ্ছি আপনাদের জন্যে।

চিঠিটা লেখা হয়েছে কাম্বারল্যাণ্ড উপকূলের এক অজ পাড়া গাঁ থেকে। তাতে লেখা:

মহাত্মন,

আমাকে আপনি চিনবেন না, আমি একজন ডাক্তার, শেষ বোগশয্যায় আমি মিস্টার হলির চিকিৎসা করেছিলাম। মৃত্যুর আগে দ্রলোক এক অদ্ভুত দায়িত্ব দিয়ে গেছেন আমাকে, তাই এ চিঠি লেখা। সত্যি কথা বলতে কি এ সম্পর্কে প্রায় কিছু না জানলেও ব্যাপারটা বেশ কৌতূহলী করে তোলে আমাকে। এবং সে জন্যেই আমার নাম এবং ঠিকানা গোপন রাখা হবে এই শর্তে শেষ পর্যন্ত রাজি হই দায়িত্বটা পালন করতে।

দিন দশেক আগে মিস্টার হলির চিকিৎসার জন্যে ডাক পড়ে আমার। পাহাড়ের ওপর এক বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয় আমাকে। বহুদিন ধরে খালি পড়ে ছিলো বাড়িটা। বাড়ির তদারককারী মহিলা জানালো, দীর্ঘদিন বিদেশে কাটিয়ে সম্প্রতি ফিরেছেন বাড়িওয়ালা। তার ধারণা দ্রলোকের হৃৎপিণ্ডটা ভীষণ অসুস্থ, খুব শিগগিরই উনি মারা যাবেন। মহিলার ধারণা সত্যি হয়েছে।

ঘরে ঢুকে দেখি, বিছানায় বসে আছেন অদ্ভুতদর্শন এক বৃদ্ধ। শুনলাম ইনিই রোগী। কালো চোখ ভদ্রলোকের, কুতকুতে হলেও বুদ্ধির অদ্ভুত ঝিলিক তাতে, যেন জ্বলছে জ্বলজ্বল করে। অসম্ভব চওড়া বুকটা ঢাকা পড়ে গেছে তুষারের মতো ধবধবে সাদা দাড়িতে। চুলগুলোও সাদা, লম্বা হতে হতে কপাল এবং মুখের অনেকটা ঢেকে ফেলেছে। তার হাত দুটো অস্বাভাবিক লম্বা, তাতে শক্তিও তেমন। এই বয়েসে মানুষের দেহে এত শক্তি থাকতে পারে আমার ধারণা ছিলো না। এক হাতে দীর্ঘ একটা ক্ষত চিহ্ন। উনি জানালেন কি এক হিংস্র কুকুর নাকি কামড়েছিলো ওখানে। দ্রলোকের চেহারা কুৎসিত, কিন্তু তার মধ্যেও কোথায় যেন একটা অপূর্ব দীপ্তি লুকিয়ে আছে। কোনো সাধারণ মানুষের মুখে আমি অমন দীপ্তি দেখিনি।

আমাকে দেখে যারপরনাই বিরক্তি প্রকাশ করলেন মিস্টার হলি। বুঝলাম, তাকে না জানিয়েই ডাকা হয়েছে আমাকে। তবে শিগগিরই ভদ্রলোকের সঙ্গে ভাব হয়ে গেল আমার। চিকিৎসার শুরুতেই তাঁর শারীরিক কষ্ট অনেকখানি কমিয়ে দিতে পারলাম বলেই সম্ভব হলো সেটা। পরে বিভিন্ন সময়ে দীর্ঘ আলাপ হয়েছে তাঁর সঙ্গে। দুনিয়ার নানা দেশে তার ভ্রমণের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন টুকরো টুকরোভাবে। এলোমেলো ভাবে দুটো অদ্ভুত অভিযানের কথা-ও বললেন একদিন। ভালো বুঝতে পারলাম না তার মর্ম। এই দশদিনে বার দুয়েক তাঁকে প্রলাপ বকতে শুনেছি। সে সময় যে ভাষায় তিনি কথা বলছিলেন, যতদূর বুঝতে পেরেছি তা গ্রীক এবং আরবী। ইংরেজীতেও ছিলো দু’একটা শব্দ। সম্ভবত তার আরাধ্য কোনো দেবীর কথা বলছিলেন তিনি।

একদিন কাঠের তৈরি একটা বাক্স দেখালেন ভদ্রলোক (সেটাই এই চিঠির সঙ্গে পাঠাচ্ছি আপনার কাছে), এবং আপনার নাম ঠিকানা দিয়ে বললেন, যেন তার মৃত্যুর পর ওটা পাঠিয়ে দিই আপনার কাছে। একটা পাণ্ডুলিপিও দিলেন। বললেন বাক্সের সঙ্গে ওটাও পাঠাতে হবে আপনার কাছে। পাণ্ডুলিপিটার শেষ পৃষ্ঠাগুলো পোড়া। কৌতূহলী চোখে আমি তাকিয়ে ছিলাম পোড়া পৃষ্ঠাগুলোর দিকে। দেখে তিনি বললেন (হুবহু তার কথাগুলোই তুলে দিচ্ছি এখানে)–

হ্যাঁ, হ্যাঁ, আর কিছু করার নেই এখন, যে ভাবে আছে ওভাবেই পাঠাতে হবে। দেখতেই পাচ্ছো, আমি ওটা নষ্ট করে ফেলতে চেয়েছিলাম, আগুনে রিটার্ন অভ শী ফেলেও দিয়েছিলাম, তখনই এলো নির্দেশ—হ্যাঁ, পরিষ্কার নির্ভুল নির্দেশ-ছে মেরে তুলে নিয়ে বাঁচিয়েছিলাম আগুনের হাত থেকে।

এই নির্দেশ বলতে কি বুঝিয়েছিলেন মিস্টার হলি আমি জানি না। এ সম্পর্কে আর কিছু তিনি বলেননি।

যা হোক, নাটকের শেষ দৃশ্যে চলে আসি। একদিন রাতে, প্রায় এগারোটার সময়, আমি গেছি মিস্টার হলির বাসায়। তখন ওঁর শেষ অবস্থা। বাড়িতে ঢোকার মুখে দেখা হলো তদারককারিণীর সাথে। হন্তদন্ত অবস্থা তার তখন। মিস্টার হলি মারা গেছেন কি না জানতে চাইলাম। সে জবাব দিলো, না, তবে উনি চলে গেছেন-যে অবস্থায় ছিলেন সে অবস্থায়ই খালি পায়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছেন। বাড়ির ঠিক বাইরে যে ফার বন আছে সেখানে শেষ বারের মতো দেখেছে তাকে মহিলার নাতি। ছেলেটা ভীষণ ভয় পেয়ে গিয়েছিলো। কারণ ওর মনে হচ্ছিলো, ভূত দেখেছেন মিস্টার হলি।

উজ্জ্বল চাঁদের আলো ছিলো সে রাতে। সদ্য পড়া তুষারে প্রতিফলিত হয়ে জ্যোৎস্না আরও উজ্জ্বল দেখাচ্ছিলো। আমি বেরিয়ে পড়লাম তাকে খোঁজার জন্যে। একটু পরেই তুষারের ওপর পায়ের ছাপ দেখতে পেলাম। ছাপ অনুসরণ করে গেলাম বাড়ির পেছনে, সেখান থেকে পাহাড়ের ভাল বেয়ে উঠে গেলাম চূড়ার দিকে।

পাহাড়টার চূড়ায় একটা প্রাচীন পাথরের স্তম্ভ আছে। স্থানীয় অধিবাসীরা তার নাম দিয়েছে শয়তানের আংটি। কে কখন ওটা স্থাপন করেছিলো কেউ বলতে পারে না। অনেক বারই আমি দেখছি ওটা। কিছুদিন আগে এক প্রত্নতাত্ত্বিক সমিতির সভায় ওটার উদ্ভব এবং উদ্দেশ্য সম্পর্কে আলোচনাও শুনেছি। সেই। সভায় খেপাটে ধরনের এক ভদ্রলোক একটা প্রবন্ধ পড়েছিলেন। তাতে তিনি নানা। যুক্তি দিয়ে প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন যে, স্তম্ভটা মিসরীয় দেবী আইসিসের। প্রতিনিধিত্ব করে, এবং ঐ জায়গাটা এককালে আইসিসের পূজারীদের তীর্থস্থান ছিলো। কিন্তু অন্য আলোচকরা অভিমতটাকে গাঁজাখুরি বলে উড়িয়ে দেন। তারা বলেন, আইসিস ব্রিটেনে এসেছিলো এমন কোনো প্রমাণ এখনও পাওয়া যায়নি। অবশ্য আমার ধারণা, রোমান বা ফিনিসীয়রাও এনে থাকতে পারে স্তম্ভটা। কারণ, ওরাও আইসিসের পূজা করতো। তবে এ ব্যাপারে আমার জ্ঞান এত সামান্য যে এ-নিয়ে কথা না বাড়ানোই ভালো।

আমার মনে পড়লো, আগের দিন মিস্টার হলি জিজ্ঞেস করেছিলেন পাথরটার কথা। তিনি জানতে চেয়েছিলেন, এখনও ওটা অক্ষত আছে কিনা। তিনি আরও বলেছিলেন, এবং সঙ্গে সঙ্গে কথাটা আমার মনে দাগ কেটেছিলো, তিনি ওখানে গিয়ে মরতে চান। আমি বলেছিলাম, অতদূর হাঁটার ক্ষমতা সম্ভবত আর কখনও তিনি ফিরে পাবেন না। শুনে মৃদু হেসেছিলেন বৃদ্ধ।

যা হোক, যথাসম্ভব দ্রুত ছুটে পৌঁছুলাম শয়তানের আংটির কাছে। এবং হ্যাঁ, যা ভেবেছিলাম তা-ই—স্তম্ভের গোড়ায় দাঁড়িয়ে আছেন তিনি, খালি পা, খালি মাথা, পরনে রাতের পোশাক। তুষারের ওপর দাঁড়িয়ে আছেন মিস্টার হলি। কেমন একটা সম্মোহিত ভঙ্গি। মন্ত্রোচ্চারণের মতো বিড় বিড় করে কিছু বলছেন। সম্ভবত আরবীতে। ডান হাতে উঁচু করে ধরা একটা আংটা লাগানো রত্ন খচিত দণ্ড (মিস্টার হলির ইচ্ছানুযায়ী ওটাও পাঠাচ্ছি আপনার কাছে)। রত্নগুলো থেকে ঠিকরে পড়ছে আলো। রাতের গভীর নিস্তব্ধতার ভেতর স্পষ্ট শুনতে পেলাম ওটার সোনার ঘণ্টার অতি মৃদু টুংটাং শব্দ।

জীবনে আমি কোনো অতিলৌকিক ব্যাপারস্যাপার বা কুসংস্কারে বিশ্বাস করিনি। কিন্তু ঐ মুহূর্তে সেই আমারও মনে হলো আরও কেউ আছে ওখানে। আমি দেখতে পাচ্ছি না, কিন্ত অনুভব করছি, অশরীরী কেউ। তারপর হঠাৎই অবয়ব নিতে শুরু করলো অদৃশ্য জিনিসটা। চমকে উঠলাম আমি। সত্যিই কিছু দেখেছিলাম, না চাঁদনী রাতে অমন এক পরিবেশে সম্মোহিত, উদ্ভ্রান্ত মিস্টার হলিকে দেখে নিছক মনে হয়েছিলো কিছু দেখেছি, জানি না। দেখলাম, প্রথমে অস্পষ্ট ছায়ার মতো কিছু একটা বেরিয়ে এলো স্তম্ভের চূড়া থেকে। ধীরে ধীরে স্পষ্ট হতে হতে জ্যোতির্ময় এক নারীর চেহারা নিলো। তার কপালে জ্বলে উঠলো উজ্জ্বল তারার মতো নীল একটা আলো

দৃশ্যটা আমাকে এমন ভাবে চমকে দিলো, আমি আর নড়তে পারলাম না। ভুলে গেলাম কেন এসেছি এই অদ্ভুত জায়গায়। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলাম

মুহূর্ত পরে বুঝতে পারলাম মিস্টার হলিও দেখতে পেয়েছেন কিছু একটা। অবয়বটার দিকে ফিরে দুর্বোধ্য স্বরে চিৎকার করলেন তিনি। একটা মাত্র উন্মত্ত আনন্দিত চিৎকার। তারপর মুখ থুবড়ে পড়ে গেলেন তুষারের ওপর। সংবিৎ ফিরলো আমার। ছুটে গেলাম তাকে ওঠানোর জন্যে। ইতিমধ্যে অদৃশ্য হয়েছে। অস্পষ্ট অবয়বটা। দুহাত ছড়িয়ে পড়ে আছেন মিস্টার হলি। মৃত। দণ্ডটা তখনও ধরে আছেন শক্ত করে।

.

এরপর ডাক্তার যা লিখেছেন তা আর উদ্ধৃত করলাম না। মিস্টার হলির মৃতদেহ . কি করে বাসায় আনা হলো তার বিস্তৃত বর্ণনা আর সেই রহস্যময় অবয়ব সম্পর্কে। তাঁর নিজস্ব ব্যাখ্যা ছাড়া গুরুত্বপূর্ণ কিছু নেই তাতে।

যে বাক্সটার কথা উনি লিখেছেন সেটা নিরাপদে পৌঁছেছে আমার হাতে। নকশাগুলো সম্পর্কে আমার কিছু বলার নেই, তবে সিসট্রাম সম্পর্কে দুচার কথা বলতে চাই। স্ফটিকের তৈরি কুক্স আনসাতা বা হাতলওয়ালা কুশের মতো দেখতে। মিসরীয়দের কাছে জীবনের প্রতীক হিসেবে গণ্য হয় এই কুক্স আনসাতা। দণ্ড, কুশ এবং আংটা-এই তিনে মিলে এক জিনিস হয়ে উঠেছে ওটা। আংটার এপাশে ওপাশে ছারটে সরু সোনার তার। তিনটের সাথে আটকানো মূল্যবান রত্ন। ঝকমকে হীরা, সাগরনীল নীলকান্ত মণি আর রক্তলাল পদ্মরাগ। একদম ওপরের অর্থাৎ চতুর্থ তার থেকে ঝুলছে ছোট ছোট চারটে সোনার ঘণ্টা।

এই অদ্ভুত জিনিসটা যখন হাতে নিলাম তখন কেন জানি না একটু কেঁপে গেল আমার হাত। মিষ্টি মৃদু টুংটাং শব্দে বাজতে শুরু করলো ঘণ্টাগুলো। অপূর্ব এক সঙ্গীতে যেন পূর্ণ হয়ে উঠলো ঘর। তবু কেন যে শির শির করে উঠলো আমার শরীর বলতে পারবো না।

সব শেষে পাণ্ডুলিপির কথা—এ সম্পর্কেও আমি কোনো মন্তব্য করতে চাই না। পাঠক নিজেই বিচার বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেবেন, এর বক্তব্য সত্য না মিথ্যা, নাকি গৃঢ় কোনো অর্থ লুকিয়ে আছে এর ভেতর।

-সম্পাদক।

০১.

যে রাতে লিও সেই অলৌকিক দৃশ্য দেখেছিলো, তারপর বিশ বছর পেরিয়ে গেছে। ভয়ানক, হৃদয় ক্ষতবিক্ষত করা দীর্ঘ বিশটা বছর। আমার মৃত্যুর আর বেশি দেরি নেই। সে জন্যে আমি দুঃখিত নই মোটেই, বরং খুশি। যে রহস্যের কিনারা এই ভুবনে থেকে করতে পারলাম না অন্য ভুবনে গিয়ে হয়তো তার সমাধান খুঁজে পাবো।

আমি, লুডউইগ হোরেস হলি, ভীষণ অসুস্থ। প্রায় মৃত অবস্থায় ওরা আমাকে নামিয়ে এনেছে ঐ পাহাড় থেকে। জানালা দিয়ে দূরে দেখতে পাচ্ছি পাহাড়টা। অন্য কেউ হলে অনেক আগেই শারীরিক, মানসিক দুভাবেই নিঃশেষ হয়ে যেতো। কিন্তু আমি কি ভাবে জানি না এখনও টিকে আছি। ভারতের উত্তর সীমান্তের এক জায়গায় বসে এ-আখ্যান লিখছি। আরও এক বা দুমাস-যতদিন

মোটামুটি সুস্থ হয়ে উঠছি, এখানে থাকতে হবে আমাকে। তারপর ফিরে যাবো আমার জন্মভূমিতে মৃত্যুকে বরণ করার জন্যে।

সেই অলৌকিক দৃশ্য দিয়েই শুরু করি।

১৮৮৫ সালে আমি আর লিও ভিনসি ফিরে এলাম আফ্রিকা থেকে। তখন নিঃসঙ্গতা ভীষণ ভাবে কাম্য হয়ে উঠেছিলো আমাদের কাছে। অমর আয়শার আকস্মিক মৃত্যুতে* যে ভয়ঙ্কর ধাক্কা খেয়েছিলাম তার রেশ কাটিয়ে ওঠার জন্যে এর দরকারও ছিলো।

নিঃসঙ্গতার আশায় গিয়ে উঠেছিলাম কাম্বারল্যাণ্ড উপকূলে আমার পৈতৃক বাড়িতে। দীর্ঘ অনুপস্থিতির কারণে আমাকে মৃত ভেবে কেউ যদি বাড়িটা দখল করে না নিয়ে থাকে তাহলে ওটা এখনও আমারই সম্পত্তি। মরার জন্যে ঐ বাড়িতেই আমি ফিরে যাবো কদিন পরে।

কাম্বারল্যাণ্ডের জনহীন উপকূলের সেই বাড়িতে এক বছর কাটিয়ে দিলাম যা হারিয়েছি তার জন্যে শোক করে।.কি করে আবার তাকে পাওয়া যায় তার পথও  খুঁজেছি এই সময়ে, কিন্তু পাইনি। তবে যা পেলাম তার মূল্যও কম নয়, এখানে আমরা আমাদের হারানো শক্তি ফিরে পেয়েছি। লিওর সাদা হয়ে যাওয়া চুলগুলো আসল রং ফিরে পেয়েছে। প্রথমে ধূসর তারপর ধীরে ধীরে সোনালি হয়ে উঠেছে। আবার। হারানো সৌন্দর্যও ফিরে পেয়েছে ও।

তারপর এলো সেই রাত-আলোকোজ্জ্বল সেই মুহূর্ত।

আগস্টের এক বিষণ্ণ রাত। খাওয়া দাওয়ার পর সাগর তীরে হেঁটে বেড়াচ্ছি। আমরা-আমি আর লিও। কান পেতে শুনছি সাগরের মৃদু গর্জন। মাঝে মাঝে দেখতে পাচ্ছি দূরে মেঘের বুকে বিদ্যুতের চমক। নিঃশব্দে হাঁটছি দুজন। হঠাৎ আমার হাত জড়িয়ে ধরলো লিও। ফোপাতে ফোঁপাতে আর্তনাদ করে উঠলো, আর পারছি না, হোরেস,-এখন আমাকে এভাবেই ডাকে ও-, এ যন্ত্রণা আমি আর সইতে পারছি না। আয়শাকে আর একটিবারের জন্যে আমি দেখতে চাই। না হলে পাগল হয়ে যাবো। আমার যা শরীর স্বাস্থ্য, আরও হয়তো পঞ্চাশ বছর বাঁচবোকিন্তু পাগল হয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে না থাকাই ভালো।

আর কি করার আছে তোমার?

শান্তি পাওয়ার সোজা রাস্তা ধরবো, শান্ত গলায় জবাব দিলো লিও। আমি মরবো। হ্যাঁ, আমি মরবো-আজ রাতেই।

ভয় পেয়ে গেলাম আমি। আত্মহত্যা করতে চাইছে লিও! ক্রুদ্ধ চোখে তাকালাম ওর দিকে।

কাপুরুষ নাকি তুমি, লিও? এটুকু কষ্ট সহ্য করতে পারছে না! অন্যেরা পারছে কি করে?

অন্যেরা মানে তো তুমি, হোরেস, শুকনো হেসে জবাব দিলো ও। তোমার ওপরেও অভিশাপ আছে…যাকগে, তুমি শক্ত তাই সহ্য করতে পারছো, আমি দুর্বল তাই পারছি না। জীবন সম্পর্কে তোমার অভিজ্ঞতা বেশি সেটাও একটা কারণ হতে পারে। না, আমি পারবো না, হোরেস, কিছুতেই পিরবো না, মৃত্যু ছাড়া আর কোনো গতি নেই আমার।

এ তো পাপ, লিও। যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন তার প্রতি চরম অপমান। কঠিন শাস্তি ভোগ করতে হবে তোমাকে এর জন্যে। হয়তো যাকে চাও তার সাথে চিরবিচ্ছেদেই রূপ পাবে সে শাস্তি।

যে মানুষ শাস্তিঘরে নির্যাতন সইছে সে কোনো ফাঁকে একটা ছুরি যোগাড় করে যদি আত্মহত্যা করে তাহলে কি তার পাপ হবে, হোরেস? হয়তো হবে, কিন্তু সে পাপ, আমি মনে করি ক্ষমা-ও পাবে। আমি তেমনই এক মানুষ। ঐ ছুরিটা আমি ব্যবহার করবো। এ যাতনা থেকে মুক্তি পাওয়ার চেষ্টা করবো। ও মরে গেছে। মৃত্যুর ভেতর দিয়ে আমি ওর কাছাকাছি হবো।

কেন, লিও? আয়শা হয়তো বেঁচে আছে।

না। তাই যদি হতো কোনো না কোনো ভাবে ও আমাকে জানাতে সে কথা—কোনো সংকেত বা দৈববাণী। না, হোরেস, আমি মনস্থির করে ফেলেছি, এ নিয়ে আর কিছু বোলো না আমাকে।

আরও কিছুক্ষণ আমি যুক্তি দিয়ে ওকে বোঝাবার চেষ্টা করলাম, কিন্তু লাভ হলো না। অনেক দিন ধরে যা আশঙ্কা করছিলাম তা-ই ঘটেছে। পাগল হয়ে গেছে লিও। অবশেষে শেষ অস্ত্র প্রয়োগ করলাম আমি।

লিও, আমাকে একা ফেলে রেখে যাবে এখানে? এতটা নির্দয় হতে পারবে তুমি? তোমাকে কোলে পিঠে করে বড় করে তুলেছি, গায়ে একটা আঁচড় লাগতে দেইনি, তার প্রতিদান দেবে এভাবে? বুড়ো বয়েসে আমাকে একা ফেলে চলে যাবে! বেশ, তোমার যদি তা-ই ইচ্ছা, যাও। কিন্তু মনে রেখো, আমার রক্ত ঝরবে তোমার মাথায়।

তোমার রক্ত! কেন, রক্ত কেন, হোরেস?

যে পথে তুমি যেতে চাইছো সেটা যথেষ্ট চওড়া। দুজন অনায়াসে যেতে পারবো ঐ পথ দিয়ে। অনেকগুলো বছর আমরা একসঙ্গে থেকেছি, একসঙ্গে অনেক কষ্ট সয়েছি, এখন ইচ্ছে করলেই কি আলাদা হতে পারবো? আমার মনে হয় না।

মুহূর্তে উল্টে গেল দাবার ছক। এবার অর্জিাকৈ নিয়ে ভয় পেতে শুরু করলো লিও।

আমি শুধু বললাম, তুমি যদি মূয়া, আমি বলছি, আমিও মরবো। তোমার মৃত্যু আমি সইতে পারবো না। সে

হাল ছেড়ে দিল লিও। বেশ, বললো ও, আমি কথা দিচ্ছি, আজ রাতে অমন কিছু ঘটবে না। চলো, জীবনকে আরেকটা সুযোগ দিই আমরা।

ভয়ে ভয়ে সে রাতে বিছানায় গেলাম আমি। জানি, একবার যখন আত্মহননের ইচ্ছা জেগেছে, খুব বেশিদিন এ-থেকে নিবৃত্ত রাখা যাবে না লিওকে। ওর এই ইচ্ছা ক্রমশ দুর্দম হতে থাকবে। শেষকালে একদিন হয়তো সত্যিই নিজেকে শেষ করে ফেলবে ও।

ও আয়শা! বিছানায় শুয়ে শুয়ে আকুল কণ্ঠে চেঁচালাম আমি, তোমার যদি সে ক্ষমতা থাকে, দয়া করে প্রমাণ দাও এখনও তুমি জীবিত। তোমার প্রেমিককে বাঁচাও এই পাপ থেকে। তোমার আশ্বাসবাণী না পেলে বাঁচতে পারবে না লিও। আর ওকে ছাড়া আমিও বাঁচবো না।

তারপর ক্লান্ত বিধ্বস্ত আমি ঘুমিয়ে গেলাম।

.

লিওর কণ্ঠস্বরে ঘুম ভেঙে গেল আমার।

হোরেস! ফিসফিসে উত্তেজিত গলায় ওকে বলতে শুনলাম, হোরেস, বন্ধু, বাবা, ওঠো তাড়াতাড়ি!

মুহূর্তে সম্পূর্ণ সজাগ হয়ে গেলাম আমি। গুরুত্বপূর্ণ কিছু ঘটেছে!

দাঁড়াও আলো জ্বালি আগে, আমি বললাম।

আলো লাগবে না, হোরেস, অন্ধকারই ভালো। একটু আগে একটা স্বপ্ন দেখেছি, এমন জীবন্ত স্বপ্ন আর কখনও আমি দেখিনি। এক মুহূর্ত থামলো লিও। তারপর বলে চললো, দেখলাম, আকাশের বিশাল কালো ছাদের নিচে আমি দাঁড়িয়ে আছি। চারদিকে অন্ধকার। আকাশে একটা তারাও নেই। গভীর, শূন্য এক অনুভূতি গ্রাস করেছে আমাকে। তারপর হঠাৎ অনেক উঁচুতে, অনেক দূরে ছোট্ট একটা আলো জ্বলে উঠলো। মনে হলো, আমাকে সঙ্গ দেয়ার জন্যে একটা তারার আবির্ভাব হয়েছে। ভাসমান আগুনের কণার মতো ধীরে ধীরে নেমে আসতে লাগলো আলোটা। নামতে নামতে আমার মাথার ঠিক ওপরে চলে এলো। দেখলাম লকলকে আগুনের শিখা একটা। মানুষের জিভের মতো দেখতে। আমার মাথার উচ্চতায় স্থির হলো ওটা। তারপর, হোরেস, আমি আশ্চর্য হয়ে দেখলাম, ওটার নিচে একটা অস্পষ্ট নারীমূর্তি। আলোটা তার কপালে স্থির হয়ে আছে!

বললে বিশ্বাস করবে, হোরেস, মূর্তিটা আয়শার? হ্যাঁ, আয়শার, হোরেস, ওর চোখ, ওর অপূর্ব সুন্দর মুখ, মেঘের মতো এলো চুল সব আমি স্পষ্ট দেখেছি। বিষণ্ণ চোখে আমার দিকে তাকিয়ে ছিলো আয়শা। সে দৃষ্টির অর্থ বুঝতে অসুবিধা হয়নি। ও যেন বলতে চাইছিলো, কেন সন্দেহ কর?

কথা বলার চেষ্টা করলাম, কিন্তু আমার ঠোঁট, জিভ নড়তে চাইলো না। এগিয়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরতে চাইলাম ওকে, নাড়াতে পারলাম না হাত-পা। অদৃশ্য এক দেয়াল যেন মাথা তুলেছে আমাদের মাঝখানে। হাত উঁচু করে ইশারা করলো ও, যেন পেছন পেছন যেতে বলছে আমাকে।

এরপর বাতাসে ভেসে চলে গেল আয়শা। ওহ্, আমার তখনকার অনুভূতি যদি বুঝিয়ে বলতে পারতাম, হোরেস! মনে হলো, আমার আত্মা দেহ ছেড়ে বেরিয়ে এসে অনুসরণ করছে ওকে। বাতাসের বেগে পুবদিকে ধেয়ে চললাম। সাগর, পাহাড় পেরিয়ে। এখনও চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি, কোথা দিয়ে কোথা দিয়ে উড়ে যাচ্ছিলাম আমরা। এক জায়গায় এসে থামলো ও। নিচে তাকিয়ে দেখলাম চাঁদের রুপালি আলোয় চক চক করছে কোর-এর ধসে পড়া প্রাসাদগুলো। তার ওপাশে, খুব বেশি দূরে নয়, সেই উপসাগর, যেখান দিয়ে আমরা পৌঁছেছিলাম ওখানে।

বিস্তৃত জলাভূমির ওপর দিয়ে উড়ে গিয়ে ইথিওপিয়ানের মাথার ওপর থামলাম আমরা। চারপাশে তাকাতে দেখলাম ডাউ-এর সঙ্গে সাগরে তলিয়ে গিয়েছিলো যে আরবগুলো তাদের মুখ। আকুতিভরা চোখে তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে। জবকেও দেখলাম ওদের ভেতর। করুণ ভঙ্গিতে একটু হেসে ও মাথা নাড়লো, ভাবখানা আমাদের সঙ্গে যেতে চায় কিন্তু জানে, পারবে না।

আবার উড়ে চললাম আমরা সাগরের ওপর দিয়ে, বালুময় মরুভূমির ওপর দিয়ে, তারপর আরও সাগর। অবশেষে নিচে দেখতে পেলাম ভারতীয় উপকূল। এবার উত্তরমুখী যাত্রা শুরু হলো আমাদের। সমভূমির ওপর দিয়ে উড়ে পাহাড়ী এলাকায় পৌঁছুলাম। অনন্ত তুষারের টুপি পরা পাহাড়ের ওপর দিয়ে উড়ে চললাম আমরা। মুহূর্তের জন্যে থামলাম এক মালভূমির কিনারে একটা দালানের ওপর। ওটা একটা মঠ। সন্ন্যাসীদের দেখলাম, বাঁধানো চাতালে বসে প্রার্থনা করছে। মঠটার চেহারা এখনও মনে আছে আমার: অর্ধচন্দ্রের মতো দেখতে। তার সামনে বসে থাকা ভঙ্গিতে বিশাল এক প্রতিমা। কেন জানি না মনে হলো তিব্বতের দূরতম সীমান্তের আকাশে পৌঁছেছি আমরা। সামনে বিস্তীর্ণ সমভূমি। কোনোদিন কোনো মানুষের পাওখানে পড়েছে কিনা জানি না। তার ওপাশে অসংখ্য পাহাড় চূড়া–শত শত। সবগুলোর মাথায় রুপালি বরফের মুকুট।

মঠটার পাশে সমভূমির ভেতর দিকে ঢুকে গেছে একটা পাহাড়, অনেকটা সাগরে ঢুকে যাওয়া পাহাড়ী অন্তরীপের মতো। ওটার তুষার ছাওয়া চূড়ায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম আমরা। তারপর একসময় আচমকা একটা আলোক স্তম্ভ এসে পড়লো আমাদের পায়ের কাছে। এ স্তম্ভের ওপর দিয়ে পিছলে নেমে যেতে লাগলাম আমি আর আয়শা। নামার সময় দূরে তাকিয়ে দেখলাম আরেকটা বিশাল সমভূমি। অনেকগুলো গ্রাম সেখানে। বিরাট এক মাটির স্তূপের ওপর একটা নগর। অবশেষে উঁচু এক চূড়ায় পৌঁছুলাম। চূড়াটা কুক্স আনসাতা—মানে মিসরীয়দের জীবনের প্রতীক-এর মতো দেখতে। আগুনের লেলিহান শিখা বেরিয়ে আসছে ওপাশের এক জ্বালামুখ থেকে। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম আমরা চূড়াটার ওপর। একসময় আয়শার সেই ছায়ামূর্তি হাত তুলে ইশারা করলো নিচের দিকে। একটু হাসলো। তারপর মিলিয়ে গেল। এর পরই ঘুম ভেঙে গেল আমার।

হোরেস, আমি বলছি, সংকেত এসে গেছে। এবার যেতে হবে আমাদের।

.

অন্ধকারে মিলিয়ে গেল লিওর কণ্ঠস্বর। স্থির বসে রইলাম আমি। নড়াচড়ার শক্তিও যেন লোপ পেয়েছে। লিও এগিয়ে এসে আমার হাত ধরলো।

।ঘুমিয়ে পড়লে নাকি? হাতটায় ঝাঁকুনি দিয়ে জিজ্ঞেস করলো ও। কথা বলছো না কেন?

না, জবাব দিলাম, এর চেয়ে সজাগ কখনও ছিলাম না। একটু ভাবতে দাও আমাকে।

বিছানা ছেড়ে উঠলাম আমি। ধীর পায়ে গিয়ে দাঁড়ালাম খোলা জানালার সামনে। পর্দা সরিয়ে চোখ মেলে দিলাম নিঃসীম আকাশের দিকে। লিও এসে দাঁড়ালো আমার পাশে গায়ে গা ঠেকিয়ে। অনুভব করলাম প্রবল শীতে যেমন ঠক ঠকিয়ে কাপে তেমন কাপছে ওর শরীর।

বলছো সংকেত, মৃদুকণ্ঠে আমি বললাম, কিন্তু আমি তো ভয়ানক এক স্বপ্ন। ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারছি না একে।

স্বপ্ন না, হোরেস, ফেটে পড়লো লিও, এ হলো অলৌকিক দর্শন।

বেশ মানলাম। কিন্তু অলৌকিক দর্শনেরও তো সত্যি মিথ্যে আছে। এটা যে সত্যি তা কি করে জানছি আমরা? শোনন, লিও, আমি যতটুকু বুঝতে পারছি, আয়শাকে হারিয়ে যে নিঃসঙ্গতার বোধে তুমি আক্রান্ত হয়েছে তা থেকেই উঠে এসেছে ঐ স্বপ্ন। কিন্তু দুনিয়ার সব প্রাণীই কি অমন নিঃসঙ্গ নয়? তুমি দেখেছো। আয়শার ছায়ামূর্তি এসে দাঁড়িয়েছে তোমার কাছে, তোমার পাশ থেকে কখনও সরেছে ওটা? তুমি দেখেছো, সাগর, পাহাড়, সমভূমি তারপর সেই স্মৃতিময় অভিশপ্ত জায়গার ওপর দিয়ে ও নিয়ে যাচ্ছে তোমাকে। কোথায়? রহস্যময়, অজানা, অনাবিষ্কৃত এক চূড়ায়। তার মানে কি? মৃত্যুর ওপারে জীবনের যে চূড়া সেদিকেই ও পথ দেখিয়ে নিয়ে গেছে তোমাকে তোমার স্বপ্ন।

ওহ! থামো তো! চিৎকার করলো নিও। আমি যা দেখেছি তা দেখেছি এবং সে অনুযায়ী-ই আমি কাজ করবো। তুমি করবে তা তোমার ভাবনা। কালই আমি ভারতের পথে যাত্রা করবো। তুমি গেলে যাবে, না গেলে আমার কিছু বলার নেই। আমি একাই যাবো।

অত উত্তেজিত হয়ো না লিও। তুমি ভুলে যাচ্ছো আমার কাছে কোনো সংকেত এখনও আসেনি। তুমি যে স্বপ্ন দেখেছে তা যদি আমি-ও দেখতাম আমার কোনো সংশয় থাকতো না। কিন্তু মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে যে ছেলে আত্মহত্যা করতে চাইছিলো সে-ই যদি কয়েক ঘণ্টা পরে মধ্য এশিয়ার বরফের রাজত্বে মরতে যেতে চায় তার সঙ্গে কে যেতে রাজি হবে? তোমার কি মনে হয় আয়শা মহিলা দালাইলামা বা ঐ ধরনের কিছু একটা হয়ে পুনর্জন্ম নিয়েছে মধ্য এশিয়ায়?

এ নিয়ে কিছু ভাবিনি আমি। কিন্তু যদি আসেই আশ্চর্য হওয়ার কি আছে? কোর-এর সেই গুহার কথা এর ভেতরেই ভুলে গেলে? জীবিত আর মৃত ক্যালিক্রেটিস মুখোমুখি হয়নি? আয়শা যে শপথ করেছিলো ও আবার আসবে হ্যাঁ এই পৃথিবীতে, তা-ও ভুলে গেছো? পুনর্জন্ম ছাড়া আর কিভাবে তা সম্ভব?

এ প্রশ্নের কোনো জবাব আমি দিতে পারলাম না। নিজের মনের সঙ্গে লড়াই চলছে আমার।

আমার কাছে কোনো সংকেত এখনও আসেনি, বিড় বিড় করে বললাম আমি। এ নাটকে আমারও একটা ভূমিকা আছে, গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয় যদিও, তবু ভূমিকা তো।

হ্যাঁ, বললো লিও, তোমার কাছে কোনো সংকেত এখনও আসেনি। এলেই ভালো হতো, হোরেস, আমার মতো তুমিও নিঃসংশয় হতে পারতে…

চুপ করে গেল লিও। আমিও আর কিছু বললাম না। নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইলাম দুজন আকাশের দিকে তাকিয়ে।

ঝঞ্ঝা বিক্ষুব্ধ একটা ভোর এগিয়ে আসছে। কালো মেঘ স্তূপের পর স্তূপ হয়ে জমছে সাগরের ওপর। একটা স্থূপের চেহারা ঠিক পাহাড়ের মতো। অলস ভঙ্গিতে দেখছি আমরা। প্রতি মুহূর্তে আকার বদলাচ্ছে সেটা। চূড়াটা ধীরে ধীরে জ্বালামুখের চেহারা নিলো। এবং একটু পরে তা থেকে প্রায় ছিটকে বেরিয়ে এলো মেঘের একটা স্তম্ভ। তার মাথায় একটা গোল পিণ্ড মতো। হঠাৎ উঠে আসা সূর্যের রশ্মি পড়লো এই মেঘের পাহাড় আর তার চূড়া থেকে উঠে আসা স্তম্ভে। সঙ্গে সঙ্গে তুষারের মতো সাদা হয়ে গেল ওগুলো। আবার আকার বদলাতে লাগলো। ধীরে ধীরে শীর্ণ হয়ে আসছে স্তম্ভটা। যেন গলে স্কুলে পড়ছে বরফের স্তূপ। থামের ওপরে পিণ্ডটাও ছোট হচ্ছে একটু একটু করে। এক সময় মিলিয়ে গেল দুটোই। পাহাড়ের চেহারার মেঘটা কেবল রইলো কালির মতো কালো।

দেখ, হোরেস, নিচু অথচ উত্তেজিত গলায় লিও বললো, ঠিক এই চেহারার একটা পাহাড়ই আমি দেখেছিলাম। এ যে চূড়ার ওপাশটায় দাঁড়িয়ে ছিলাম আমি আর আয়শা। আর ঐ পেছনে রেখেছিলাম আগুনের শিখা। হোরেস, সংকেতটা মনে হচ্ছে আমাদের দুজনের জন্যেই!

কিছু বললাম না আমি। তাকিয়ে রইলাম যতক্ষণ না পাহাড়ের মতো মেঘটা এলোমেলো হয়ে মিশে গেল অন্য মেঘের সঙ্গে। তারপর লিওর দিকে ফিরলাম। তোমার সঙ্গে যাচ্ছি আমি, লিও।

.

০২.

যোলো বছর কেটে গেছে সেই বিনিদ্র রজনীর পর। আমরা দুজন, আমি আর লিও, এখনও ঘুরছি, এখনও খুঁজছি মিসরীয়দের জীবনের প্রতীক-আকৃতির সেই পাহাড় চূড়া।

এই দীর্ঘ সময়ে অনেক রোমাঞ্চকর ঘটনা ঘটেছে আমাদের জীবনে। লিখতে গেলে মোটা মোটা কয়েকটা বই হয়ে যাবে। পাঁচ বছর তিব্বতের এখানে ওখানে ঘুরেছি, এর বেশির ভাগ সময় কেটেছে বিভিন্ন মঠে। অতিথি হয়ে থেকেছি। লামাদের আচার আচরণ, ঐতিহ্য সম্পর্কে যথাসম্ভব জ্ঞানার্জনের চেষ্টা করেছি। একবার গ্রেফতার হই আমরা নিষিদ্ধ এক প্রাচীন নগরীতে ঢুকে পড়ার অপরাধে। বিচারে প্রাণ-দণ্ড দেয়া হয় আমাদের। ভাগ্যক্রমে এক চৈনিক রাজপুরুষের সহায়তায় পালাতে পারি আমরা।

তিব্বত ছাড়ার পর পুব, পশ্চিম আর উত্তরে হাজার হাজার মাইল পথ হেঁটেছি। চীন দেশের অসংখ্য উপজাতীয় গোত্রের সান্নিধ্যে এসেছি। অনেক নতুন ভাষা শিখেছি—শিখেছি না বলে বলা উচিত শিখতে হয়েছে। এভাবে আরও দুবছর চলে গেল, কিন্তু আমাদের ভ্রমণ শেষ হলো না। কারণ যা খুঁজছি তা এখনও পাইনি।

ঘুরতে ঘুরতে অবশেষে এমন এক জায়গায় গিয়ে পৌঁছুলাম যেখানে এর আগে কোনো ইউরোপীয়ের পা পড়েনি। তুর্কিস্তান নামের সেই বিশাল দেশের এক অংশে বিরাট এক হ্রদ আছে। নাম বলকাশ। এই হ্রদের উপকূল ধরে দীর্ঘ পথ হাঁটলাম আমরা। পশ্চিম দিকে প্রায় দুশো মাইল যাওয়ার পর এক উঁচু গিরিশ্রেণীর কাছে পৌঁছুলাম। মানচিত্রে যার পরিচয় দেয়া হয়েছে আরকার্তি-তাউ বলে। এক বছর কাটলো এখানে। অনুসন্ধান চললো। কিন্তু লাভ হলো না। আবার পুব মুখে যাত্রা। প্রায় পাঁচশো মাইল যাওয়ার পর চেরগা নামের আরেক গিরিশ্রেণীর কাছে এলাম।

এখান থেকে শুরু হলো আমাদের আসল অভিযান। চেরগা পর্বতমালার এক শাখায়—মানচিত্রে এর কোনো নাম খুঁজে পাইনি-না খেয়ে মরতে বসেছি। শীত আসছে, সব পাহাড়ী জন্তুজানোয়ার নিরাপদ আশ্রয়ে লুকিয়ে পড়েছে, সেজন্যে বেশ কয়েকদিন ধরে কোনো শিকার পাইনি। কয়েকশো মাইল দক্ষিণে দেখা হয়েছিলো শেষ মানুষটার সঙ্গে। তার কাছে জেনেছিলাম এই পাহাড় শ্রেণীর কোথাও একটা মঠ আছে। অত্যন্ত ধর্মনিষ্ঠ এক লামা-চক্র সেখানে বাস করে। লোকটা বলেছিলো, আজকের পৃথিবীর কোনো দেশের দাবি নেই সেই ভূ-খণ্ডের ওপর। সম্ভবত, ঐ জায়গার অস্তিত্বের কথাই জানে না কোনো দেশ। কোনো উপজাতীয় গোত্র-ও নেই আশেপাশে। ঐ লামারাই ওখানকার একমাত্র বাসিন্দা। কথাটা বিশ্বাস হয়নি। তবু কেন জানি না মঠটা খুঁজছি আমরা। হয়তো যে কারণে ডুবন্ত মানুষ খড়কুটো আঁকড়ে ধরতে চায় সে কারণে।

সঙ্গে কোনো খাবার নেই; আরগাল-মানে আগুন জ্বালানোর কোনো উপকরণ নেই। চাঁদের আলোয় সারারাত ধরে হেঁটে চলেছি। একটা মাত্র ইয়াক আমাদের সঙ্গী। পথ প্রদর্শক হিসেবে যাদের সঙ্গে এনেছিলাম তাদের শেষ জন মারা গেছে এক বছর আগে।

অসম্ভব কষ্ট সহিষ্ণু ইয়াকটা। আমাদের মতো ওটারও এখন শেষ দশা। খুব যে বেশি বোঝা বইতে হচ্ছে তা নয়। কিছু রাইফেলের গুলি—এই শ দেড়েক হবে; আর তুচ্ছ কিছু জিনিসপত্র, যেমন: ছোট একটা থলেতে কিছু স্বর্ণ আর রৌপ্য মুদ্রা, সামান্য চা, আর কয়েকটা চামড়ার কম্বল ও ভেড়ার চামড়ার পোশাক-ব্যস এই আমাদের মালপত্র।

গিরিশ্রেণীকে ডান পাশে রেখে তুষারের একটা মালভূমি পেরোনোর পরপরই লম্বা একটা শ্বাস টেনে দাঁড়িয়ে পড়লো ইয়াকটা। আমাদের-ও থামতে হলো। উপায় নেই এছাড়া। চামড়ার কম্বল গায়ে জড়িয়ে তুষারের ওপর বসে রইলাম ভোরের অপেক্ষায়। একটু পরে ইয়াকটাও বসলো আমাদের পাশে।

শেষ পর্যন্ত বোধহয় ওকে মারতেই হবে, লিও, হতভাগ্য ইয়াকটার পিঠে একটা চাপড় মেরে আমি বললাম, এবং ওর মাংস কাঁচা খেতে হবে।

কাল সকালেই হয়তো শিকার পেয়ে যাবো। আশাবাদী সুর লিওর কণ্ঠে।

না-ও পেতে পারি। সেক্ষেত্রে ওকে না মারলে আমাদেরই মরতে হবে।

মরবো। আমাদের পক্ষে যদূর সম্ভব আমরাকেরেছি।

নিশ্চয়ই, লিও, যথাসাধ্য করেছি। ষোলো বছর পাহাড়ে পাহাড়ে তুষার মাড়িয়ে চলাকে যদি এক রাতের স্বপ্ন হিসেবে কল্পনা করে নেয়া যায় তাহলে ঠিকই বলেছো।

খোঁচাটা লাগলো লিওর মনে।

তুমি জানো আমি কি বিশ্বাস করি, গম্ভীর গলায় বললো ও।

তারপর দুজনেই চুপ। সত্যি কথা বলতে কি আমিও লিওর মতোই বিশ্বাস করি, খামোকা এই প্রচণ্ড পরিশ্রম করিনি; আমাদের এত কষ্ট বিফলে যাবে না।

রাত শেষ হলো। ভোরের আলোয় উদ্বিগ্নচোখে একে অপরের দিকে তাকালাম। সভ্য কেউ দেখলে নির্ঘাত বুনো জন্তু ভাবতো আমাদের। লিওর বয়স এখন চল্লিশের ওপরে। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সহজাত এক গাম্ভীর্য এসেছে; ফলে আরও আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে ওর চেহারা। গত বছরগুলোর কঠোর পরিশ্রমে ইস্পাতের মতো কঠিন হয়ে উঠেছে পেশী। চুল দীর্ঘ হয়ে নেমে এসেছে ঘাড় ছাড়িয়ে। সিংহের সোনালি কেশরের মতো লাগে দেখতে। দাড়িও লম্বা হয়ে ঝুলে পড়েছে বুকের ওপর। মুখের যেটুকু এখনও দেখা যায় সেটুকু দেখেই বিমোহিত হতে হয়।

আর আমি যেমন ছিলাম তেমনই আছি-কুৎসিত, কদাকার। বয়স ষাটের ওপর হয়ে গেছে, কিন্তু শক্তি সামর্থ্য এক বিন্দু কমেনি, বরং মাঝে মাঝে মনে হয় একটু যেন বেড়েছে। শরীর আগের মতো এখনও পেটা লোহার মতো। আশ্চর্য হওয়ার মতো ব্যাপার হলো, গত ষোলো বছরে দুর্ঘটনার কবলে পড়েছি বেশ কয়েকবার কিন্তু অসুস্থ হইনি একবারওনা আমি, না লিও। কঠোর পরিশ্রম আমাদের শরীরকে সত্যি সত্যিই যেন লোহায় রূপান্তরিত করেছে। নাকি আমরা অন্তত প্রাণের সৌরভ বুক ভরে টেনে নিয়েছিলাম তাই এমন হয়েছে?

রাত শেষ হতেই রাতের ভয়গুলো কেটে গেছে। অনাহারে মরার দুশ্চিন্তাও আর নেই। কাল দুপুরের পর কিছু খাইনি, প্রায় সারারাত হেঁটেছি, তবু খুব একটা ক্ষুধা বা ক্লান্তি বোধ করছি না। ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালাম আমরা। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালাম চারপাশে। সামনে এক ফালি উর্বর জমি, তার ওপাশ থেকেই শুরু হয়েছে বিস্তৃত মরুভূমি। গাছহীন, জলহীন, বালুময়। শীতের প্রথম তুষার ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে এখানে সেখানে। তার ওপাশে প্রায় আশি কি একশো মাইল দূরে মাথা তুলেছে একসারি পাহাড়। অসংখ্য বরফ ছাওয়া সাদা চূড়া অস্পষ্টভাবে দেখতে পাচ্ছি এখান থেকে।

সূর্যের প্রথম রশ্মি যখন সেগুলোর ওপর পড়লো, আমার মনে হলো, বিশেষ কিছু একটা যেন ধরা পড়েছে লিওর দৃষ্টিতে। ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে আছে সে পেছন দিকে।

দেখ, হোরেস, ঐ যে ওখানে, বিবর্ণ বিরাট কিছু একটার দিকে ইশারা করলো লিও। যে জিনিসটা দেখাতে চাচ্ছি ইতিমধ্যে সেটার ওপরেও আলো পড়েছে। আমাদের যে পাশে মরুভূমি তার উল্টোপাশে প্রকাণ্ড এক পাহাড়। এখান থেকে অন্তত দশ মাইল দূরে ওটার চূড়া। পাহাড়টা ঢালু হতে হতে যেখানে এসে মরুভূমির সঙ্গে মিশেছে সেখানে দাঁড়িয়ে আছি আমরা।

এখন পাহাড়টার চূড়া কেবল আলোকিত। কিন্তু সূর্য যত ওপরে উঠতে লাগলো ততই বন্যার তোড়ের মতো আলো নেমে আসতে লাগলো পাহাড়ের গা বেয়ে। অবশেষে আমাদের শ তিনেক ফুট ওপরে ছোট এক অধিত্যকায় পৌঁছুলো। সূর্য-রশ্মি। সেখানে, অধিত্যকার কিনারে বসে আছে বিরাট এক মূর্তি। আমাদের—মানে মরুভূমির দিকে প্রসারিত তার দৃষ্টি। বিপুলায়তন বুদ্ধ। মূর্তির পেছনে হলুদ পাথরে তৈরি অর্ধচন্দ্রাকৃতির মঠ।

শেষ পর্যন্ত! চিৎকার করে উঠলো লিও, ওহ, ঈশ্বর! পেয়েছি শেষ পর্যন্ত! দুহাতে মুখ ঢাকলো ও। ফোপাতে ফোঁপাতে হাঁটু গেড়ে বসে ধীরে ধীরে উপুড় হয়ে মুখ গুঁজে দিলো তুষারে।

কিছুক্ষণ ওভাবে ওকে পড়ে থাকতে দিলাম। নিজের হৃদয় দিয়ে আমি বুঝতে পারছি কি ঝড় চলছে ওর হৃদয়ে। ইয়াকটার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। হতভাগ্য জন্তুটা আমাদের আনন্দের কণামাত্র ভাগও নিতে পারছে না। ক্ষুধার্ত চোখে চারদিকে তাকাচ্ছে কেবল। চামড়ার কম্বল আর পোশাকগুলো ভাজ করে তুলে দিলাম তার পিঠে। তারপর ফিরে এলাম লিওর কাছে। একটা হাত রাখলাম ওর কাধে।

ওঠো, লিও, মঠটা যদি জনশূন্য না হয় ওখানে আমরা খাবার এবং আশ্রয় পাবো। চলো, শিগগিরই ঝড় উঠবে মনে হচ্ছে।

নিঃশব্দে উঠে দাঁড়ালো ও। দাড়ি এবং কাপড় থেকে তুষার ঝেড়ে ফেলে আমার সঙ্গে হাত লাগালো ঠেলে ইয়াকটাকে দাঁড় করাবার জন্যে। আশ্চর্য এক প্রশান্তিময় আনন্দ-দ্যুতি ছড়িয়ে পড়ছে ওর মুখ থেকে।

তুষার ছাওয়া ঢাল বেয়ে উঠতে শুরু করলাম আমরা।

মালভূমির কিনারে পৌঁছে গেলাম এক সময়। সামনে দেখতে পাচ্ছি হলদে পাথরে গড়া মঠটা। কিন্তু ওতে মানুষজন আছে বলে তো মনে হচ্ছে না! তুষারের ওপর একটা পায়ের ছাপও নজরে পড়ছে না। জায়গাটা পোড়ো নাকি? কথাটা মনে হতেই দমে গেল বুক। চারপাশ ভালো করে দেখে মঠের ওপর দিকে দৃষ্টি ফেললাম। সঙ্গে সঙ্গে লাফিয়ে উঠলো হৃদয়। সরু একটা ধোঁয়ার রেখা, বেরুচ্ছে চিমনি দিয়ে।

মঠের কেন্দ্রস্থলে বড়ো একটা দালান। নিঃসন্দেহে মন্দির ওটা। কিন্তু ওদিকে গেলাম না আমরা। সামনে খুব কাছেই দেখতে পাচ্ছি একটা দরজা। এর প্রায় ওপরেই ধোঁয়া উঠতে দেখেছি। এগিয়ে গিয়ে ধাক্কা দিলাম দরজায়। সেই সঙ্গে চিৎকার।

দরজা খুলুন! দরজা খুলুন! আমরা পথিক, আপনাদের দয়া ভিক্ষা করছি।

প্রথমে কিছুক্ষণ কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না। তারপর হাল্কা একটা পদশব্দ! থেমে গেল। কাঁচ-কুচ আওয়াজ তুলে খুললো দরজা। জীর্ণ হলুদ কাপড়ে মোড়া থুথুরে এক বুড়ো দাঁড়িয়ে আছে দরজায়।

কে! কে? জিজ্ঞেস করলো বৃদ্ধ, শিং-এর চশমার ভেতর দিয়ে পিটপিট করে তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে। কে তোমরা আমাদের শান্তি ভঙ্গ করতে এসেছো!?

পথিক, বৃদ্ধের ভাষাতে-ই জবাব দিলাম আমি। নিরীহ, শান্তিপ্রিয় পথিক, অনাহারে মৃত প্রায়, আপনাদের দয়া চাই।

শিং-এর চশমার ভেতর দিয়ে তীক্ষ্ণ্ণ চোখে তাকালো বৃদ্ধ আমাদের মুখের দিকে। তারপর পোশাকের দিকে। তার মতো আমাদের পরনেও জীর্ণ লামাদের পোশাক।

তোমরা লামা? সন্দেহের সুর বৃদ্ধের গলায়। কোন মঠের?

লামা অবশ্যই, জবাব দিলাম আমি। মঠের নাম পৃথিবী, যেখানে হায়, সবারই খিদে পায়।

জবাব শুনে মনে হলো বেশ খুশি হয়েছে বৃদ্ধ। মুখ টিপে একটু হেসে মাথা নাড়লো।

অপরিচিত লোকদের মঠে ঢুকতে দেয়া আমাদের নিয়ম বিরুদ্ধ। আমাদের ধর্মাবলম্বী হলেও না হয় একটা কথা ছিলো। তা যে তোমরা নও তা তোমাদের চেহারা দেখেই বুঝতে পারছি।

ক্ষুধার্ত সাহায্যপ্রার্থীকে বিমুখ করা-ও আপনাদের নিয়ম বিরুদ্ধ? বলে এ প্রসঙ্গে বুদ্ধের বহুল প্রচলিত একটি বাণী আওড়ালাম।

চমকৃত হলো বৃদ্ধ লামা। বুঝতে পারছি পেটে বিদ্যা আছে তোমাদের। এমন মানুষদের আশ্রয় দিতে রাজি হবে না আমরা। ভেতরে এসো, বিশ্ব মঠের ভাইরা। দাঁড়াও, দাঁড়াও, তোমাদের সঙ্গে ওটা কি?, ইয়াক! ও-ও মনে হয় আমাদের দয়া চায়, বলতে বলতে ঘুরে দাঁড়িয়ে দরজার পাশে ঝোলানো একটা ঘণ্টা বাজালো সে।

কয়েক সেকেণ্ডের ভেতর আরেকজন লোক এসে দাঁড়ালো। প্রথম জনের চেয়েও বেশি এর বয়েস, অন্তত চেহারা তাই বলছে। মুখের চামড়ায় শত শত ভাঁজ। আমাদের দেখে হাঁ হয়ে গেল তার মুখ।

ভাই, প্রথম বৃদ্ধ বললো, অতবড় হাঁ করে থেকো না, অশুভ আত্মারা তোমার পেটে ঢুকে পড়বে ওখান দিয়ে। এই ইয়াকটাকে নিয়ে যাও। অন্য জন্ত গুলোর সাথে বেঁধে রাখো, আর খাবার দিও।

ইয়াকের পিঠ থেকে আমাদের মালপত্র খুলে নিলাম। দ্বিতীয় বৃদ্ধ, যার পদবী পশু-পতি, ওকে নিয়ে চলে গেল।

বৃদ্ধ সন্ন্যাসী, যার নাম কোউ-এন, পথ দেখিয়ে একটা ঘরে নিয়ে গেল আমাদের। একই সাথে বসা এবং রান্নার কাজে ব্যবহার হয় ঘরটা। মঠের অন্য সন্ন্যাসীদের দেখলাম এখানে। সব মিলে বারোজন। আগুনের সামনে গোল হয়ে বসে আছে। একজন সকালের খাবার রান্না করছে, অন্যরা আগুন পোহাচ্ছে। সব কজনই বৃদ্ধ। সবচেয়ে তরুণ যে জন তারও বয়েস পঁয়ষট্টির কম নয়। গম্ভীর ভঙ্গিতে সবার সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিলো কোউ-এন: যে মঠে সবারই খিদে পায় সেই বিশ্ব-মঠের লামা এরা।

আমাদের দিকে তাকালো ওরা। শীর্ণ হাতগুলো ঘষলো তালুতে তালু। লাগিয়ে। মাথা নুইয়ে সম্মান জানালো। অবশেষে কথা বললো একজন: আপনাদের আগমনে অত্যন্ত আনন্দিত আমরা।

শুধু কথায় নয়, কাজেও ওরা সে প্রমাণ দিলো। হাত মুখ ধধায়ার জন্যে পানি গরম করলো একজন। দুজন উঠে চলে গেল আমাদের জন্যে একটা কামরা। সাজিয়ে গুছিয়ে ফেলতে। অন্যেরা আমাদের গা থেকে খুলে নিলো দীর্ঘ ব্যবহারে নোংরা হয়ে যাওয়া পোশাকগুলো। পা থেকে বুটগুলোও খুলে নেয়া হলো। তার বদলে চটি দিলো পরবার জন্যে। তারপর নিয়ে গেল অতিথি কুঠুরিতে। আগুন জ্বেলে দেয়া হলো ঘরের মাঝখানে। বিস্ময়ের ওপর বিস্ময়! এরপর পরিষ্কার কাপড় এনে দেয়া হলো আমাদের পরার জন্যে। তার ভেতর লিনেনও আছে। সব প্রাচীন কালের, দেখলেই বোঝা যায় খুব উঁচু মানের জিনিস, যদিও পুরনো হয়ে গেছে।

আমাদের রেখে চলে গেল সন্ন্যাসীরা। আমরা হাত মুখ ধুয়ে নিলাম-ভালো করে ধুয়ে নিলাম—প্রায় গোসল বলা যেতে পারে। তারপর লামাদের দেয়া পরিষ্কার পোশাক পরলাম। লিওর কাপড়টা একটু ছোট হয়েছে। এ ঘরেও দরজার কাছে ঝুলছে একটা ঘণ্টা। বাজাতেই এক লামা হাজির। আমাদের নিয়ে এলো রান্নাঘরে। সেখানে তখন খাবার পরিবেশন করা হচ্ছে। এক ধরনের পরিজ আর সদ্য দোয়ানো দুধ-পশু-পতি দুইয়ে এনেছে। এছাড়া আমাদের সম্মানে বিশেষ ব্যবস্থা করা হয়েছে শুকমো মাছ আর মাখন দেয়া চায়ের। খেতে গিয়ে মনে হলো এমন সুস্বাদু খাবার জীবনে খাইনি। প্রচুর খেলাম। আমাদের গোগ্রাসে খাওয়া দেখে চোখ বড় বড় হয়ে গেল সন্ন্যাসীদের।

বিশ্ব-মঠের সন্ন্যাসীরা দেখছি সত্যিই ক্ষুধার্ত! শেষ পর্যন্ত একজন বলেই ফেললো; লোকটার পদবী খাদ্য-পতি। এভাবে খেতে থাকলে আমাদের শীতের সঞ্চয় শেষ হতে দুদিনও লাগবে না!

সুতরাং শেষ করলাম আমরা। তারপর বুদ্ধের বাণী থেকে দীর্ঘ এক স্তোত্র আওড়ালাম।

অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলো বৃদ্ধ সন্ন্যাসীরা। বিদেশীদের মুখে বুদ্ধের বাণী যেন তাদের কল্পনারও অতীত।

অতিথি-কুঠুরিতে ফিরে একটানা চব্বিশ ঘণ্টা ঘুমালাম। যখন উঠলাম তখন একেবারে ঝরঝরে তাজা আমাদের শরীর।

.

পরের ছটা মাস এই পাহাড়ী মঠে কাটলো। কয়েক দিনের ভেতরেই সহৃদয় বৃদ্ধ সন্ন্যাসীদের বিশ্বাসভাজন হয়ে উঠলাম। আরও কদিন পর ওরা ওদের ইতিহাস শোনালো আমাদের।

সুপ্রাচীন কাল থেকে মঠটা আছে এখানে। আগে বেশ কয়েকশো সন্ন্যাসী থাকতো। দুই শতাব্দী বা তার কিছু আগে হিংস্র এক উপজাতি হামলা চালিয়ে সন্ন্যাসীদের হত্যা করে দখল করে নেয় মঠটা। সামনে মরুভূমির ওপাশে যে বিশাল পাহাড়ী এলাকা সেখানে বাস করে সেই উপজাতি। আগুনের উপাসনা করে তারা। সন্ন্যাসীদের প্রায় সবাই নিহত হয় সে হামলায়। যে দুচারজন ভাগ্যক্রমে বেঁচে গিয়েছিলো তারা কোনো মতে পালিয়ে গিয়ে লোকালয়ে পৌঁছে দেয়। খবরটা। তারপর পাঁচ পুরুষেরও বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও মঠটা পুনর্দখলের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।

এই মঠের খুবিলগান (প্রধান পুরোহিত) আমাদের বন্ধু কোউ-এন-এর যখন যৌবন কাল তখন প্রথম উদ্যোগ নেয়া হলো। দুশো বছর আগে যে সন্ন্যাসীরা নিহত হয়েছিলো তাদের মধ্যেও এক কোউ-এন ছিলো। আমাদের কোউ-এন-এর ধারণা সে সেই কোউ-এন-এরই পুনর্জন্ম নেয়া রূপ। তার মতে বর্তমান জীবনে তার প্রধান দায়িত্ব ছিলো মঠে ফিরে আসা। সে দায়িত্ব সে পালন করেছে। মঠটা যদি পুনর্দখল করতে পারে তাহলে তার পক্ষে নির্বাণ লাভ কষ্টসাধ্য কিছু হবে না এই ধারণা থেকে আমাদের এই কোউ-এন এক দল উদ্যোগী মানুষ নিয়ে রওনা হয়। অনেক কষ্ট আর ক্ষতি স্বীকার করে জায়গাটা পুনর্দখল করে তারা। প্রয়োজনীয় সংস্কার করে মঠটার।

প্রায় পঞ্চাশ বছর আগের কথা সেটা। তারপর থেকে তারা এখানে আছে। বাইরের দুনিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ বলতে গেলে নেই। বছরে বা দুবছরে এক বা। দুজন পাঁচ মাসের পথ পাড়ি দিয়ে যায় লোকালয়ে। খবরাখবর, সামান্য খাবারদাবার, পোশাক পরিচ্ছদ নিয়ে ফিরে আসে। প্রথম দিকে দু’এক বছর পর পর বাইরে থেকে সগ্রহ করে আনা হতো সন্ন্যাসীদের। এখন লোকালয়ের বাইরে। এমন পোড়ো জায়গায় কেউ আর আসতে চায় না। ফলে ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে মঠবাসীর সংখ্যা।

তারপর? জিজ্ঞেস করলাম আমি।

তারপর আর কি? প্রধান পুরোহিত জবাব দিলো, অনেক জ্ঞান অর্জন করেছি আমরা। চিরবিদায়ের পর পুনর্জন্ম নিয়ে আবার যখন পৃথিবীতে আসবো তখন অনেক শান্তিপূর্ণ হবে আমাদের জীবন। জাগতিক সব মোহ, লোভ লালসাকে জয় করতে পেরেছি, এর চেয়ে বেশি আর কি চাই?

দিনের বিরাট একটা অংশ প্রার্থনা করে কাটায় আর লোকালয়ের বাইরে নারীসঙ্গ বিবর্জিত অবস্থায় আছে; এছাড়া গৃহী মানুষের সঙ্গে কোনো পার্থক্য নেই » এই সন্ন্যাসীদের। পাহাড়ের পাদদেশে উর্বর ভূখণ্ডে চাষ করে এরা, পশুপালন করে; গৃহকর্ম করে। তারপর এক সময় থুথুরে বুড়ো হয়ে মরে যায়। একটা ব্যাপার দেখলাম, সন্ন্যাসীর ব্রত গ্রহণ করে আর কিছু না হোক অন্তত দীর্ঘ জীবন লাভ করেছে এরা।

.

আমরা মঠে পৌঁছানোর পরপরই প্রচণ্ড ঠাণ্ডা আর তুষার ঝড় নিয়ে শুরু হয়ে গেল শীত। সামনের বিশাল মরুভূমিতে পুরু তুষারের স্তর জমে গেল। শিগগিরই বুঝে ফেললাম, বেশ কয়েক মাস এখানে থাকতে হবে। শীতকাল শেষ হওয়ার আগে যে এখান থেকে নড়তে পারবো না তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

অত্যন্ত সংকোচের সাথে খুবিলগান অর্থাৎ মঠ-প্রধান কোউ-এনকে বললাম, আমরা যদি কয়েকটা দিন থাকি তাহলে কি আপনাদের খুব অসুবিধা হবে? ভাঙাচোরা কোনো ঘরে থাকতে দেবেন আমাদের, খাবার দাবার লাগবে না। পাহাড়ের ওপর একটা হ্রদ আছে বলেছিলেন, ওখান থেকে মাছ ধরে নেবো, তাছাড়া হরিণ-টরিণ-ও শিকার করে নিতে পারবো…

আমাকে শেষ করতে দিলো না কোউ-এন। বাধা দিয়ে বললো, হয়েছে থাক, আর বলতে হবে না। যতদিন ইচ্ছা তোমরা থাকবে এখানে। ভাঙা ঘরে থাকারও কোনো দরকার নেই, যেখানে আছে সেখানেই থাকবে। আর আমাদের যদি খাবার জোটে তোমাদেরও জুটবে। আর যা-ই হোক, ক্ষুধার্ত পথিককে দয়া না দেখানোর মতো পাপ আমরা করতে পারবো না।

শিগগিরই আমরা বুঝে ফেললাম বৃদ্ধের উদ্দেশ্য। আমাদের বুদ্ধের পথের পথিক করে নিতে চায়। ওর বা ওর সঙ্গীদের মতো সংসারত্যাগী লামা বানিয়ে ফেলতে চায়।

আপাতত তাতে কোনো অসুবিধা নেই আমাদের। সুতরাং আমরা পথিক হলাম। আগেও অনেক মঠে থেকেছি, বুদ্ধের শিক্ষা সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করেছি, এবার আরেকটু ভালো করে শিখবো, তারপর সময় হলে আমাদের পথে রওনা হয়ে যাবো।

সন্ন্যাসীদের সাথে তত্ত্ব আলোচনা আর গৃহকর্ম করে দিন কেটে যেতে লাগলো। মাঝে মাঝে আমাদের ধর্ম নিয়ে আলোচনা করি ওদের সঙ্গে, বিশ্ব নামক মঠের গল্প শোনাই। এই সন্ন্যাসীরা রুশ, চীনা আর কিছু আধা বর্বর উপজাতি ছাড়া দুনিয়ার আর কোনো জাতির কথা জানে না। আমরা যখন গল্প করি তখন হাঁ করে শোনে নতুন নতুন দেশের নতুন নতুন মানুষের কথা।

এসব আমাদের শিখে রাখা উচিত, ঘোষণা করলো ওরা। কে জানে আগামী জন্মে হয়তো এসব দেশের কোনো একটার বাসিন্দা হিসেবে জন্ম হবে আমাদের।

দিন চলে যাচ্ছে। মোটামুটি সুখেই আছি। কিন্তু মনে শান্তি নেই। যার খোঁজে বেরিয়েছি কবে পাবো তাকে? বুদ্ধি দিয়ে বুঝতে পারছি, আপাতত কিছু করার নেই, শীত শেষ না হলে এখান থেকে রওনা হতে পারবো না, তবু মনের অস্থিরতা কমে না।

এর মাঝে একদিন আশ্চর্য এক জিনিস আবিষ্কার করে উৎফুল্ল হয়ে উঠলাম আমি। মঠের ধসে পড়া অংশে গিয়েছিলাম। কোনো কাজে নয়, এমনি জায়গাটা দেখতে। একটা কামরায় ঢুকেই চোখ কপালে উঠে গেল। রাশি রাশি হাতে লেখা বই-এ ঠাসা ঘরটা। এক পলক দেখেই বুঝলাম নিহত সন্ন্যাসীদের সময়কার জিনিস। কোউ-এন-এর কাছে জানতে চাইলাম, বইগুলো আমরা উল্টে পাল্টে দেখতে পারি কিনা। সানন্দে অনুমতি দিলো বৃদ্ধ।

অদ্ভুত এক সংগ্রহ ওটা। এক কথায় অমূল্য। নানা ভাষায় নানা বিষয়ে লেখা এমন সব বই ওখানে আছে যার খোঁজ আজকের দুনিয়ার কেউ এখনও পায়নি। বেশির ভাগই বুদ্ধ-দর্শন সম্পর্কে। যে জিনিসটা আমাকে সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ করলো তা হলো বহু খণ্ডে বিভক্ত একটা দিনলিপি। যুগ যুগ ধরে মঠের খুবিলগানরা রচনা করেছে। প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বর্ণনা লিপিবদ্ধ করা হয়েছে ওগুলোয়। পড়তে শুরু করলাম একটা একটা করে। অল্প কিছু দিনের ভেতর কয়েকটা খণ্ড শেষ করে ফেললাম। শেষখণ্ডগুলোর একটার পাতা ওল্টাতে গিয়ে কৌতূহলোদ্দীপক এক কাহিনী জানতে পারলাম। প্রায় আড়াইশো বছর আগে—অর্থাৎ প্রাচীন মঠটা ধ্বংস হওয়ার কিছু আগে লেখা কাহিনীটা। তার যতটুকু মনে আছে তুলে দিচ্ছি পাঠকদের জন্যে

এবছর গ্রীষ্মে, ভয়ানক এক ধূলিঝড়ের পর আমাদের মঠের এক ভাই (অর্থাৎ সন্ন্যাসী, নামটা দেয়া ছিলো, এখন আর মনে নেই আমার) মরণাপন্ন এক লোককে মরুভূমিতে পড়ে থাকতে দেখে। মরুভূমির ওপারে যে বিশাল পাহাড়ী এলাকা সেখানকার মানুষ সে। এতদিন এ দেশ সম্পর্কে নানা গুজব শুনে এসেছি, এই প্রথম ওখানকার একজনের দেখা পাওয়া গেল। আরও দুজন লোক ছিলো ওর সঙ্গে। খাবার এবং পানির অভাবে মারা গেছে দুজনই। ভীষণ হিংস্র দেখতে লোকটা, মেজাজের দিক থেকেও একরোখা। কি করে এই দুর্গম মরুভূমিতে এলো সে সম্পর্কে কিছু বলতে চাইলো না। আমরা অনেক অনুরোধ উপরোধ করেছিলাম, কিন্তু একটা কথাও বের করতে পারিনি তার মুখ থেকে। শুধু এটুকু, বলেছিলো, প্রাচীন কালে বাইরের দুনিয়ার সাথে যোগাযোগ ছিন্ন হয়ে যাওয়ার আগে তার দেশের লোকেরা যে রাস্তা ব্যবহার করতো, সেই পথ ধরে সে এসেছে। শেষ পর্যন্ত আমরা জানতে পারলাম, মারাত্মক কোনো অপরাধ করেছিলো বলে ওকে আর ওর দুই সঙ্গীকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছিলো, তাই দেশ থেকে পালিয়ে যাচ্ছিলো তারা। ওর কাছ থেকে আরও জানতে পেরেছি, ঐ পাহাড় শ্রেণীর ওপাশে চমৎকার এক দেশ আছে। অত্যন্ত উর্বর সেখানকার মাটি। তবে প্রায়ই ভূমিকম্প হয় ওখানে। অনাবৃষ্টিও সেদেশের এক প্রধান সমস্যা। এদুটো বিপর্যয় সৃষ্টিকারী ব্যাপার না থাকলে বলা যেতো সুখে দিন কাটায় ওখানকার মানুষ।

লোকটা বলেছিলো, ওরা খুব যুদ্ধপ্রিয় জাতি, যদিও ওদের প্রধান জীবিকা কৃষিকাজ। দেশ শাসন করে গ্রীক রাজা আলেকজাণ্ডারের বংশধর এক পরিবার। প্রধান শাসকের পদবী খান। কথাটা সত্যি হতেও পারে, কারণ আমাদের নথিপত্র বলছে, প্রায় দুহাজার বছর আগে আমাদের এ-অঞ্চল জয়ের জন্যে এক সেনা বাহিনী পাঠিয়েছিলো ঐ গ্রীক রাজা (অর্থাৎ আলেকজাণ্ডার)।

লোকটা আরও জানায় ওদের দেশের মানুষ অমর এক পূজারিণীর উপাসনা করে, যার নাম হেস বা হে, যুগ যুগ ধরে সে তার আধিপত্য বজায় রেখেছে। আরও দূরের এক পাহাড়ে সে থাকে। সব মানুষ তাকে ভয় করে, পূজা করে। ক্ষমতা থাকলেও রাজ্য পরিচালনার ব্যাপারে সে কখনও হস্তক্ষেপ করে না। তার উদ্দেশ্যে কখনও কখনও বলিদান করা হয়, কেউ যদি এই পূজারিণীর রোষানলে পড়ে তবে তার আর রক্ষা থাকে না, অবশ্যই তাকে মৃত্যুবরণ করতে হয়। এই কারণে দেশের শাসকরাও তাকে ভয় করে।

এসব শুনে আমরা উপহাস করলাম লোকটাকে। বললাম, সে মিথ্যে বলছে। এতে সে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলো, চিৎকার করে ঘোষণা করলো, আমাদের বুদ্ধ নাকি ওদের সেই পূজারিণীর মতো ক্ষমতাবান নয়। আমাদের ওপর প্রতিশোধ নিয়ে সে তার প্রমাণ দেবে।

কিছু খাবার দিয়ে আমরা ওকে মঠ থেকে বিদায় করে দিলাম। যখন ফিরে আসবো তখন টের পাবে কে সত্যি কথা বলে, বলতে বলতে চলে গেল লোকটা। পরে ওর কি হয়েছিলো সে-সম্পর্কে আর কিছু জানতে পারিনি আমরা। আমাদের ধারণা, কোনো এক অশুভ শক্তি ওর ছদ্মবেশে আমাদের ভয় দেখাতে এসেছিলো।

.

পরদিন আমাদের সঙ্গে গ্রন্থ-কক্ষে যাওয়ার অনুরোধ করলাম খুবিলগান কোউ এনকে। কাহিনীটা পড়ে শুনিয়েজিজ্ঞেস করলাম, এ সম্পর্কে আর কিছু সে জানে কিনা। স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে ধীরে ধীরে মাথা দোলালো সে। কোউ-এন-এর এই ভঙ্গিটা দেখলেই কচ্ছপের কথা মনে পড়ে যায় আমার।

সামান্য, বললো সে। খুব সামান্য। তার বেশির ভাগই ঐ গ্রীক রাজার সেনাবাহিনী সম্পর্কে।

যেটুকু জানে সেটুকুই বলতে অনুরোধ করলাম কোউ-এনকে। শান্তভাবে শুরু করলো বৃদ্ধ

তখনও পবিত্র পথের অনুসারীর সংখ্যা খুব বেশি হয়নি। এই মঠ সবেমাত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আমি তখন এই মঠেরই এক অধম ভাই। একদিন সকালে উঠে দেখি, সামনের মরুভূমি দিয়ে হেঁটে চলেছে এক সেনাবাহিনী, ব্যস। সেটা, একটু চিন্তা করে যোগ করলো, আমার পঞ্চাশ জন্ম আগের কথা—না, অন্য এক সেনাদলের কথা বলছি—তিহাত্তর জন্ম আগের কথা।

এখানে হো-হো করে হেসে উঠতে গেল লিও। তাড়াতাড়ি ওর পায়ে পা দিয়ে খোঁচা দিলাম। ভাগ্য ভালো হাসিটাকে হাঁচিতে পরিণত করতে পারলো ও। তা না হলে পরে যে কথাগুলো জানতে পারলাম তার একটাও হয়তো জানা হতো না।

তা কি করে সম্ভব!? অবাক গলায় বললাম আমি। মৃত্যুর সাথে সাথে স্মৃতিও কি বিলীন হয়ে যায় না?

না, ভাই হলি, সব ক্ষেত্রে তা হয় না। পুনর্জন্ম লাভের পর স্মৃতি কখনও কখনও ফিরে আসে বৈকি! বিশেষ করে যারা পবিত্র পথে অনেক দূর এগিয়েছে তাদের স্মৃতি তো প্রায়শঃই ফিরে আসে। আমার কথাই ধরো, তুমি এই অনুচ্ছেদটা পড়ার আগ পর্যন্ত ঐ সেনাবাহিনী সম্পর্কে কিছুই মনে ছিলো না। কিন্তু এখন আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, পাহাড়ের পাদদেশ ঘেঁষে চলে যাচ্ছে সৈনিকরা, আর আমি অন্য সন্ন্যাসীদের সঙ্গে দাঁড়িয়ে আছি ঐ বিরাট বুদ্ধ মূর্তির পাশে, দেখছি ওদের চলে যাওয়া। খুব বড় নয় বাহিনীটা। বেশির ভাগই পথের কষ্ট সহ্য করতে না পেরে মরে গেছে, নয়তো নিহত হয়ছে শক্রর হাতে। সে আমলে আমাদের দক্ষিণে এক জংলী জাতি বাস করতো, তারা তাড়া করেছিলো ওদের। প্রাণভয়ে পালাচ্ছিলো গ্রীকরা। ওদের সেনাপতি—কি যেন তার নাম…মনে করতে পারছি না।

আমাদের এই মঠে উঠে এসেছিলো ওদের সেনাপতি, বলে চললো বৃদ্ধ। তার স্ত্রী ও ছেলে মেয়েদের জন্যে ঘুমানোর মতো একটা জায়গা দাবি করেছিলো। খাবার, ওষুধপত্র আর মরুভূমির পথ ঘাট চেনে এমন একজন পথপ্রদর্শক-ও চেয়েছিলো সে। আমাদের সে সময়কার খুবিলগান তাকে জানিয়ে দিলেন, আমাদের ছাদের নিচে কোনো স্ত্রীলোককে প্রবেশ করতে দেয়া যাবে না, কারণ তা আমাদের আইনের পরিপন্থী। সেনাপতি রেগে গিয়ে বললো, জায়গা না দিলে আমাদের মাথার ওপরে ছাদ বলে কোনো কিছুর অস্তিত্বই থাকবে না; পুরো মঠ জ্বালিয়ে দেবে সে, আমাদেরকেও হত্যা করবে।

তোমরা জানো দাঙ্গা হাঙ্গামায় যারা নিহত হয় পরের জন্মে তারা জন্তু জানোয়ার হয়ে জন্ম নেয়। ভয়ঙ্কর ব্যাপার সেটা! মঠে স্ত্রীলোককে আশ্রয় দেয়া-ও পাপ, তবে অত কঠিন পাপ নয়। তাই আমরা ঠিক করলাম, সেনাপতির স্ত্রীকে আসতে দেবো মঠে। পরে মহা-লামার কাছে পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে ক্ষমা চাইবো। আমি অবশ্য নিজের চোখে সেই রমণীকে দেখিনি, তবে ওদের পূজারিণীকে দেখেছিলাম–হায়! কেন যে দেখেছিলাম! বুক চাপড়াতে লাগলো কোউ-এন।

কেন, হায় কেন? কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করলাম আমি।

কেন? ওহ! সেনাদলের কথা ভুলতে পারলেও ঐ পূজারিণীর কথা কখনও ভুলতে পারিনি। এখনও চোখের সামনে দেখতে পাই তাকে। এই একটাই পাপ আমার জীবনে, এই পাপ আমাকে পিছিয়ে দিয়েছে, না হলে অনেক আগেই মোক্ষ সাগরের উপকূলে পৌঁছে যেতে পারতাম।

তার ঘর গুছিয়ে দেয়ার দায়িত্ব পড়েছিলো আমার ওপর। সবেমাত্র কাজ শেষ করেছি, এমন সময় ঘরে ঢুকলো সে। এক দিকে ছুঁড়ে দিলো মুখাবরণ। তারপর, হ্যাঁ, আমার সাথে কথা বললো সে। আমি তার দিকে তাকাতে চাইছি না বোঝার পরও অনেক প্রশ্ন করলো।

কেমন-কেমন দেখতে ছিলো? আগ্রহ লিওর কণ্ঠস্বরে।

কেমন দেখতে ছিলো? আহ…কি বলবো! দুনিয়ার সব সৌন্দর্য যেন ওর ভেতর পুঞ্জীভূত হয়েছিলো। তুষারের ওপর ভোর হতে দেখেছো? বসন্তের প্রথম ফুল? পাহাড়ের চূড়া ছাড়িয়ে আরও ওপরে সন্ধ্যাতারা? যদি দেখে থাকো তাহলে বুঝতে পারবে ওর সৌন্দর্য কেমন। ভাই, আর কিছু জিজ্ঞেস কোরো না, আমি বলতে পারবো না। ওহ! পাপ, আমার পাপ! আমি গড়িয়ে গড়িয়ে পেছনে চলে যাচ্ছি, আমাকে আর কিছু জিজ্ঞেস কোরো না, তোমরা আমার গোপন লজ্জা দিনের আলোয় নিয়ে আসছে। না…না, আমি স্বীকার করবো, আমি স্বীকার করবো, তোমরা দেখ, আমি কি নীচ। তোমরা হয়তো তোমাদের মতোই পবিত্র ভাবছো আমাকে, কিন্তু আসলে আমি কি তা দেখ।

সেই মেয়েমানুষটা—জানি না সত্যিই সে মেয়েমানুষ কিনা, আমার হৃদয়ে আগুন জ্বেলে দিলো, যে আগুন নেভে না, কিছুতেই নেভে না, জ্বালিয়ে পুড়িয়ে খাক করে ফেলে। তারপর আরও জ্বলে আরও জ্বলে। করুণ ভাবে মাথা দোলাতে লাগলো কোউ-এন। তার শিং-এর চশমার নিচ দিয়ে দুফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়েছে। ও-ও আমাকে ওর পূজা করিয়ে ছেড়েছে। প্রথমে আমার ধর্ম বিশ্বাস সম্পর্কে প্রশ্ন করেছে। আমি অত্যন্ত আগ্রহ নিয়ে বলেছি। আশা করছিলাম, ওর হৃদয়ে সত্যের আলো পৌঁছুবে। কিন্তু আমার কথা শেষ হতেই সে বললো–

তার মানে তোমার পথ ত্যাগের। বোকা! তোমার এই নির্বাণ হলো চমৎকার এক নিরর্থক ধারণা। যার কোনো ভিত্তি নেই। তারচেয়ে এসো তোমাকে মহান এক দেবী আর অনেক আনন্দদায়ক এক উপাসনার পথ দেখাই।

কি পথ? কোন্ দেবী? আমি জিজ্ঞেস করলাম।

প্রেম ও জীবনের পথ, জবাব দিলো সে, যার ভেতর দিয়ে উৎপত্তি সমগ্র পৃথিবীর। হে নির্বাণপিয়াসী সন্ন্যাসী, তোমারও জন্ম এই প্রেমের ভেতর দিয়ে। আর দেবী? সে হলো প্রকৃতি।

আবার আমি জিজ্ঞেস করলাম, কোথায় সেই দেবী। রাজকীয় ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়ালো সে। সুডৌল সুউচ্চ বক্ষে হাত রেখে বললো, আমিই সে। হাঁটু গেড়ে বসো, আমাকে প্রণাম করো।

আমি তা-ই করলাম, ভাই হলি, ভাই লিও, আমি তা-ই করলাম! হাঁটু গেড়ে বসে তার পায়ে চুমু খেলাম। তারপরই সংবিৎ ফিরলো আমার। লজ্জায় মাটির সাথে মিশে যেতে ইচ্ছে করলো। ছুটে পালিয়ে গেলাম সেখানে থেকে। আমার পালানো দেখে হেসে উঠলো সে। চিৎকার করে বললো: আমি তোমার সাথে সাথেই থাকবো, ও বুদ্ধের দাস। আমার রূপ বদলাতে পারে, কিন্তু আমি মরি না। যদি নির্বাণ লাভ করো, তখনও আমি তোমার সাথে থাকব। যে একবার আমার কাছে প্রণত হয় তাকে আমি কখনও ছেড়ে যাই না।

ব্যস, এখানেই শেষ, ভাই হলি ..সত্যিই ও আমাকে ছেড়ে যায়নি। তারপর যতবার পুনর্জন্ম নিয়ে এ পৃথিবীতে এসেছি, ওর স্মৃতি কুরে কুরে খেয়েছে আমাকে। জানি আগামী জন্মগুলোতেও এমনই চলবে। অনন্ত শান্তি আমি কখনোই পাবো না… শীর্ণ হাতদুটো দিয়ে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে উঠলো কোউ-এন।

হাস্যকর দৃশ্য। মহামান্য একজন খুবিলগান, যার বয়স আশি পেরিয়ে গেছে, বাচ্চাছেলের মতো কাঁদছে। কেন? স্বপ্নে দেখা এক সুন্দরীর স্মৃতি মনে পড়ে গেছে। তাই। কিন্তু আমি বা লিও মোটেই হাসলাম না, বরং অদ্ভুত এক সহমর্মিতা অনুভব করলাম কোউ-এন-এর জন্যে। পিঠে মৃদু চাপড় দিয়ে সান্ত্বনা দিলাম তাকে।

কিছুক্ষণ পর সামলে নিলো বৃদ্ধ। তারপর আরও কিছু তথ্য আদায় করার চেষ্টা করলাম তার কাছ থেকে। কিন্তু লাভ হলো না খুব একটা। বিশেষ করে যে ব্যাপারটায় আমরা আগ্রহী সেই পূজারিণীয় প্রসঙ্গে নতুন প্রায় কিছুই বলতে পারলো না সে। পর দিনই সেনাদলের সঙ্গে চলে গিয়েছিলো পূজারিণী। ব্যস এটুকুই। তবে হ্যাঁ, সে সময়কার সুবিলগানকে একটা মন্তব্য করতে শুনেছিলো। কোউ-এন, তা হলো, কেন জানি না তার ধারণা হয়েছিলো, ঐ পূজারিণীই আসলে গ্রীক বাহিনীর সেনাপতি। তারই ইচ্ছায় বাহিনীটা মরুভূমি পেরিয়ে উত্তরে যাচ্ছিলো। সম্ভবত ওদিকে কোথাও নিজেকে দেবী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলো সে।

মরুভূমির ওপারে যে পাহাড়ী এলাকা সত্যিই সেখানে কোনো জনবসতি আছে কিনা, জিজ্ঞেস করলাম কোউ-এনকে। চিন্তিত ভঙ্গিতে মাথা দুলিয়ে বৃদ্ধ বললো, তার ধারণা আছে। বর্তমানে বা পূর্ববর্তী কোনো জীবনে, ঠিক মনে নেই, সে শুনেছে, ওরা অগ্নি উপাসনা করে। আরও বললো, এক ভাই এই পাহাড়ের চূড়ায় উঠেছিলো নির্জনে সাধনা করার জন্যে। সে নাকি ঐ পাহাড়গুলোর ওপাশে আকাশে বিশাল এক অগ্নি-স্তম্ভ দেখেছে। চোখের ভুল কিনা সে সম্পর্কে অবশ্য নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারেনি সে।

আর কিছু না বলে ধীর পায়ে গ্রন্থ-কক্ষ থেকে বেরিয়ে গেল বৃদ্ধ খুবিলগান। পরের এক সপ্তাহ সে আর আমাদের সামনে আসেনি। এ প্রসঙ্গও আর কখনও তোলেনি আমাদের সামনে। আর আমরা, সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব উঠবে এই পাহাড়ের চূড়ায়।

.

০৩.

সপ্তাহ খানেকের ভেতর সুযোগ এসে গেল।

এখন শীতের মাঝামাঝি। তুষার ঝড় থেমে গেছে। সন্ন্যাসীদের কাছে। শুনলাম, এসময় নাকি ওভিস পোলি এবং আরও নানা জাতের পাহাড়ী হরিণ খাবারের খোঁজে বেরিয়ে আসে গোপন আস্তানা ছেড়ে। শোনামাত্র লাফিয়ে উঠলাম আমরা। বললাম, কালই আমরা শিকারে বেরোবো।

প্রাণী হত্যার কথায় অত্যন্ত মর্মাহত হলো বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা।

দেখুন শিকারটা আসলে মুখ্য নয়, বললাম আমি, চার দেয়ালের মাঝে আটকে থাকতে থাকতে হাত-পায়ে খিল ধরে গেছে। সেজন্যে একটু ঘুরে ফিরে আসতে চাই। সম্ভব হলে এই পাহাড়ের চূড়ায় একবার উঠবো। শরীরের জড়তা কাটবে। এর ভেতর যদি শিকার কিছু মেলে মন্দ কি? আমাদের ধর্মে তো প্রাণী হত্যা নিষিদ্ধ নয়।

বুঝলাম, কিন্তু ব্যাপারটা খুবই বিপজ্জনক, বললো কোউ-এন। যেকোনো মুহূর্তে আবহাওয়ার অবস্থা খারাপ হতে পারে।

খারাপ আবহাওয়ায় আমরা অভ্যস্ত, খুব একটা অসুবিধা হবে না।

ভুরু কুঁচকে খানিকক্ষণ কি যেন ভাবলো বৃদ্ধ। তারপর বললো, ঠিক আছে, যাও। পাহাড়ের ঢালে একটু ওপরে একটা গুহা আছে। হঠাৎ যদি আবহাওয়া খারাপ হয়ে পড়ে, ওখানে আশ্রয় নিও।

অপেক্ষাকৃত কম বয়েসী এক সন্ন্যাসী গুহাটা চিনিয়ে দেয়ার জন্যে আমাদের সঙ্গে যেতে রাজি হলো।

পরদিন ভোরে ইয়াকটার পিঠে (ইতিমধ্যে আবার তরতাজা হয়ে উঠেছে, ওটা) কিছু খাবার, কাপড়-চোপড় আর একটা ছোট চামড়ার তাবু চাপিয়ে বেরিয়ে এলাম মঠ থেকে। পথ প্রদর্শক সন্ন্যাসীর পেছন পেছন মঠের উত্তর পাশের ঢাল বেয়ে উঠে যেতে লাগলাম চূড়ার দিকে। দুপুর নাগাদ পৌঁছে গেলাম গুহার কাছে।

চমৎকার গুহাটা। শীতের দিনে শিকারে বেরিয়ে আশ্রয় নেয়ার আদর্শ স্থান। ঘাস পাতায় ভর্তি হয়ে আছে। ঠাণ্ডা থেকে বাঁচবার জন্যে জ্বালানীর অভাব হবে দিনের বাকি সময়টুকু আমরা গুহায় কাটিয়ে দিলাম। রাতে থাকবার জন্যে পরিষ্কার করলাম খানিকটা জায়গা। সেখানে তাঁবুটা খাড়া করলাম। তারপর ওটার সামনে বড় একটা আগুন জ্বেলে পাহাড়ের ঢালগুলো পরীক্ষা করতে বেরোলাম। সন্ন্যাসীকে বলে গেলাম, হরিণের পায়ের ছাপ খুঁজতে যাচ্ছি।

কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে বাছাই করলাম কোন্ ঢাল বেয়ে চূড়ায় উঠবে। ফিরতি পথে কিছুদূর আসতেই বুনো ভেড়ার একটা পাল নজরে পড়লো। একই সঙ্গে গুলি বেরোলো আমার আর লিওর বন্দুক থেকে। দুটো ভেড়া মরলো। আগামী দিন পনেরো আর খাবারের অভাব হবে না। তুষারের ওপর দিয়ে টানতে টানতে গুহার কাছে নিয়ে এলাম ভেড়া দুটোকে। চামড়া ছাড়িয়ে গুহার ভেতর রেখে দিলাম তুষার চাপা দিয়ে।

বহুদিন পর তাজা ভেড়ার মাংস দিয়ে রাতের খাওয়া সারলাম। প্রাণী হত্যার ব্যাপারে দৃষ্টিভঙ্গি যা-ই হোক না কেন, সন্ন্যাসী বাবাজীও আমাদের মতোই তুপ্তির সাথে মাংস খেলো। এরপর আগুনের সামনে গুটিসুটি মেরে কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লাম আমরা।

ভোর হলো। আবহাওয়া আগের মতোই শান্ত। আমাদের পথ প্রদর্শক বিদায় নিলো। ওকে বলে দিলাম, দু-এক দিনের মধ্যেই আমরা মঠে ফিরবো। যতক্ষণ না ছোট্ট একটা চূড়ার আড়ালে লোকটা অদৃশ্য হয়ে গেল ততক্ষণ অপেক্ষা করলাম আমি আর লিও। তারপর উঠতে শুরু করলাম ঢাল বেয়ে।

কয়েক হাজার ফুট উঁচু পাহাড়। কোনো কোনো জায়গায় প্রায় খাড়া উঠে গেছে। পাহাড়ে ওঠার যত কৌশল জানা আছে সব প্রয়োগ করে উঠে চলেছি আমরা। অবশেষে দুপুরের সামান্য আগে পৌঁছুলাম চূড়ায়। অপূর্ব এক দৃশ্য ভেসে উঠলো আমাদের সামনে। নিচে বিস্তৃত মরুভূমি। তার ওপাশে বরফের টুপি পরা পাহাড়শ্রেণী। সামনে, ডানে, বাঁয়ে যেদিকে যতদূর চোখ যায় শুধু পাহাড় আর পাহাড়।

আঠারো বছর আগে স্বপ্নে যেমন দেখেছিলাম ঠিক তেমন ঐ পাহাড়গুলো, বিড়বিড় করে উঠলো লিও। ঠিক তেমন। হুবহু এক।

আলো ছুটে এসেছিলো কোন্‌খান থেকে? আমি জিজ্ঞেস করলাম।

মনে হয় ওখান থেকে, উত্তর-পুব দিকে ইশারা করলো ও।

কিন্তু এখন তো কিছু দেখছি না।…চলো ফিরি, ভীষণ ঠাণ্ডা এখানে।

নামতে শুরু করলাম আমরা। গুহায় যখন পৌঁছুলাম তখন সূর্য ডুবছে।

পরের চারটে দিন একই ভাবে কাটলো। ভোরে বিপজ্জনক ঢাল বেয়ে উঠে যাই চূড়ায়। লিওর স্বপ্নে দেখা আলোকস্তম্ভের খোঁজ করি। সন্ধ্যা নাগাদ ফিরে আসি গুহায়।

চতুর্থ দিন রাতে ভেতরে ঢুকে ঘুমানোর পরিবর্তে গুহার মুখে বসে রইলো লিও। বারকয়েক আমি ওকে ডাকলাম ভেতরে। ও এলো না। ঘুমিয়ে পড়লাম আমি।

মাঝরাতে লিওর ঝাঁকুনিতে ঘুম ভেঙে গেল আমার। চমকে উঠে বসলাম।

হোরেস! চিৎকার করলো ও, দেখবে এসো!

লিওর পেছন পেছন বেরিয়ে এলাম গুহার বাইরে। পোশাক পরার ঝামেলা পোহাতে হলো না, কারণ আমরা ওগুলো পরেই ঘুমাই। উত্তর দিকে ইশারা করলো লিও। আমি তাকালাম। বাইরে কালো রাত। কিন্তু দূরে, বহু দূরে অস্পষ্ট এক ফালি আলো জ্বল জ্বল করছে আকাশের গায়ে। দেখে মনে হয় মাটিতে আগুন জ্বলছে, তার আভা।

কি মনে হচ্ছে? সাগ্রহে জিজ্ঞেস করলো লিও।

বিশেষ কিছু না। অনেক কিছুই তো হতে পারে। চাঁদ-না, চাঁদ না, ভোর হচ্ছে-না, তা-ও না, ভোর হতে এখনও অনেক দেরি। কিছু জ্বলছে। বাড়ি বা শ্মশান-চিতা। কিন্তু-কিন্তু এখানে ওসব আসবে কোত্থেকে? জানি না!

আমার মনে হয় ওটা প্রতিফলন। চূড়ায় থাকলে দেখতে পেতাম কি থেকে আসছে ওটা।

হ্যাঁ, কিন্তু আমরা চূড়ায় নেই, এই অন্ধকারে যাওয়াও সম্ভব নয়।

সেক্ষেত্রে, হোরেস, অন্তত একটা রাত আমাদের চূড়ায় কাটাতে হবে।

তারপর যদি তুষার ঝড় শুরু হয়ে যায়?

ঝুঁকিটা আমাদের নিতে হবে, তুমি না চাইলে আমি একাই নেবো। দেখ, মিলিয়ে গেছে আলোটা।

দেখলাম, সত্যিই তাই। ঠিক আছে, কাল এনিয়ে আলাপ করা যাবে। আপাতত প্রসঙ্গটার ইতি টেনে গুহায় ঢুকলাম আমি। কিন্তু লিও বসে রইলো বাইরে।

ভোরে ঘুম থেকে উঠে দেখি নাশতা তৈরি।

আমি সকাল সকাল রওনা হয়ে যেতে চাই, ব্যাখ্যা করলো লিও।

পাগল হয়েছো তুমি!? ও জায়গায় থাকবো কি করে আমরা?

জানি না, তবে আমি যাচ্ছি। আমাকে যেতেই হবে, হোরেস।

তার মানে আমাকেও যেতে হবে। কিন্তু ইয়াকটার কি হবে?

যাবে আমাদের সঙ্গে। যেখানে আমরা উঠতে পারবো, সেখানে ও-ও পারবে।

সুতরাং তল্পিতল্পা গুটিয়ে ইয়াকের পিঠে বোঝাই দিলাম আবার। রান্না করা কিছু ভেড়ার মাংস নিলাম সঙ্গে। তারপর রওনা। ইয়াকটা সঙ্গে থাকায় একটু ঘুর পথে উঠতে হলো। বিকেল নাগাদ পৌঁছে গেলাম চূড়ায়।

চূড়ায় উঠে প্রথমেই এক জায়গায় ঝুরো ঝরো তুষার সরিয়ে একটা গর্ত করে তবু খাটালাম তার ওপর। ইতিমধ্যে সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। তাঁবুর ভেতর নেমে পড়লাম আমরা ইয়াক আর তার পিঠের মালপত্রসহ। খাওয়া-দাওয়ার পর অপেক্ষা, শুরু হলো।

ওহ, কি ঠাণ্ডা! শূন্যের নিচে কয়েক ডিগ্রী হবে। আমাদের হাড় পর্যন্ত কাঁপিয়ে দিচ্ছে। ভাগ্য ভালো ইয়াকটাকে এনেছিলাম। ওর লোমশ শরীরের উত্তাপ না পেলে হয়তো মরেই যেতাম।

সময় পেরিয়ে যাচ্ছে। সেকেণ্ড, মিনিট, ঘণ্টা। চার ঘণ্টা পেরিয়ে গেল। নিকষ কালো অন্ধকার ছাড়া আর কিছু দেখতে পাচ্ছি না। বাতাসের একটানা শো শো আওয়াজ কেবল কানে আসছে। ঝিমুনি লেগে এলো আমার। হঠাৎ শুনতে পেলাম লিওর কণ্ঠস্বর।

দেখ, হোরেস, ঐ যে ঐ তারার নিচে!

তাকাতেই দেখলাম দূরে আকাশের গায়ে সেই আভা, গতরাতে যেখানে দেখেছিলাম ঠিক সেখানে। কাল যা দেখতে পাইনি তা-ও দেখতে পেলাম আজ। আভার নিচে আমাদের প্রায় সোজাসুজি হালকা একটা আগুনের শিখা। তার সামনে অস্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে কালো কিছু একটা।

দেখতে দেখতে উজ্জ্বল হয়ে উঠলো আগুন। সামনের কালো জিনিসটা এখন স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। এবং ওটা ,ওহ! গায়ের ভেতর শির শির করে উঠলো। আমার! জিনিসটা মাথা তুলে দাঁড়ানো একটা স্তম্ভের উপরিভাগ, তার ওপর বসানো রয়েছে একটা আংটা। হ্যাঁ, আর কিছু নয়, ওটা ক্রুক্স আনসাতা, মিসরীয়রা যাকে জীবনের প্রতীক বলে মনে করে!

প্রতীকটা মিলিয়ে গেল। আগুন ম্লান হয়ে এলো। তারপর আবার জ্বলে উঠলো দাউ দাউ করে। আগের চেয়ে স্পষ্ট দেখতে পেলাম আংটাটা। আবার মিলিয়ে গেল। তৃতীয় বারের মতো লাফিয়ে উঠলো অগ্নিশিখা। এবার আরও উজ্জ্বল। তীব্রতম বিদ্যুৎচমকও সে উজ্জ্বলতার কাছে হার মানে। সারা আকাশ আলোকিত হয়ে উঠলো। আংটার ভেতর দিয়ে জাহাজের সার্চলাইটের মতো ঠিকরে বেরিয়ে এলো একটা আলোক স্তম্ভ। নিমেষে বিস্তীর্ণ মরুভূমি পেরিয়ে এসে আলোকিত করে তুললো আমাদের পাহাড় চূড়া। মাত্র এক মুহূর্তের জন্যে। তারপর আবার অন্ধকার চারদিক। দূরে সেই আগুন আর আলোও উধাও।

অনেকক্ষণ আমরা কেউ কোনো কথা বলতে পারলাম না।

তোমার মনে আছে, হোরেস, অবশেষে নীরবতা ভাঙলো লিও, টলমলে পাথরটার ওপর দিয়ে যখন আমরা ফিরে আসছিলাম কিভাবে ঝাঁপিয়ে পড়া আলোর রেখা মৃত্যুপুরী থেকে প্রাণ নিয়ে পালানোর পথ দেখিয়েছিলো আমাদের? আমার ধারণা সেই আলোই আবার এসেছে, এবার জীবনপুরীর পথ দেখাবে। সাময়িকভাবে যে আয়শাকে আমরা হারিয়েছি তার কাছে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে আমাদের।

হতে পারে, সংক্ষিপ্ত উত্তর আমার।

নিঃশব্দে বসে রইলাম আমি আর লিও। ভোর হলো। বৃদ্ধ কোউ-এন-এর কথাই ঠিক। বাতাসের বেগ বেড়েছে। সেই সাথে একটু একটু তুষারও পড়ছে। কিন্তু বিন্দুমাত্র ভয় লাগলো না আমাদের। তীব্র কনকনে বাতাস আর তুষারপাত উপেক্ষা করে নামতে শুরু করলাম। অপূর্ব এক তৃপ্তির অনুভূতিতে ছেয়ে আছে হৃদয়। আমরা যেন এ পৃথিবীর নই। এখানকার তুচ্ছ দুঃখ, বেদনা আমাদের মনে আর দাগ কাটছে না। অপার আনন্দের সন্ধান পেয়েছি যেন আমরা।

গুহার কাছে পৌঁছুতে পৌঁছুতে তীব্রতর হলো তুষার-ঝড়। কিন্তু না থেমে নেমে চললাম আমরা। কোন কষ্টকেই আর কষ্ট বলে মনে হচ্ছে না। অবশেষে পৌঁছুলাম মঠের দরজায়। সম্পূর্ণ নিরাপদে। বৃদ্ধ খুবিলগান আলিঙ্গন করে অভ্যর্থনা জানালো আমাদের। হাঁ করে তাকিয়ে রইলো সন্ন্যাসীরা। এমন প্রচণ্ড ঝড়ের মধ্যেও আমরা মরিনি দেখে আশ্চর্য ওরা।

.

অবশেষে শীত বিদায় নিলো। একদিন সন্ধ্যায় বাতাস একটু উষ্ণ মনে হলো। পরদিন সকালে উঠে দেখি আকাশ মেঘে ছেয়ে আছে। তা থেকে ঝরছে তুষার নয়, জল। একটানা তিন দিন বৃষ্টি হলো। চতুর্থ দিন ঢল নামলো পাহাড় বেয়ে। এক সপ্তাহের মাথায় সামনের উর্বর জমিটুকু সবুজ হয়ে উঠলো। আমাদের যাবার সময় হয়েছে। কিন্তু কোথায় যাবে তোমরা? ম্লান মুখে, প্রশ্ন করলো বৃদ্ধ খুবিলগান। এখানে আর ভালো লাগছে না? আমাদের প্রতি কোনো কারণে রুষ্ট হয়েছে? কেন আমাদের ছেড়ে যাবে?

আমরা পথিক, আমি জবাব দিলাম, পথের মাঝে পাহাড় দেখলে তা টপকাতেই হবে।

তীক্ষ্ণ চোখে আমাদের দিকে চাইলো কোউ-এন। পাহাড়ের ওপারে কি খুঁজবে তোমরা? আমার কাছে সত্য গোপন কোরো না। বলো, অন্তত প্রার্থনা করতে পারবো তোমাদের জন্যে।

মাননীয় খুবিলগান, কিছুদিন আগে গ্রন্থ-কক্ষে কিছু কথা বলেছিলেন আপনি…।

ও কথা মনে করিয়ে দিও না, ভাই, আমাকে থামিয়ে দিয়ে বৃদ্ধ বললো। কেন আমাকে যন্ত্রণা দিতে চাইছো?

না, বন্ধু, আপনি ভুল ভাবছেন। আমরা যা বলতে চাইছি তা হলো, আপনার কাহিনি আর আমাদের কাহিনি এক। ঐ পূজারিণীর সান্নিধ্যে আমরাও এসেছিলাম।

আচ্ছা! তারপর? কৌতূহল বৃদ্ধের কণ্ঠস্বরে।

সংক্ষেপে আমাদের কাহিনী শোনালাম তাকে। এক ঘণ্টা বা তারও বেশি সময় ধরে শুনলো কোউ-এন। একটা কথাও বললো না। স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে কচ্ছপের মতো মাথা দুলিয়ে গেল শুধু।

এবার বলুন, সব শেষে যোগ করলাম আমি, কাহিনিটা অদ্ভুত না? নাকি আমাদের মিথ্যেবাদী ভাবছেন?

বিশ্ব-মঠের ভাইরা, মৃদু হেসে বৃদ্ধ জবাব দিলো, কেন তোমাদের মিথ্যাবাদী ভাববো, বলো? প্রথম যেদিন দেখেছি সেদিনই বুঝেছি তোমরা খাঁটি মানুষ। যে কাহিনি ততমরা শোনালে তা সত্যি না হওয়ারও কোনো কারণ নেই। একটা ব্যাপারেই শুধু আমি দ্বিমত পোষণ করি, তা হলো, তোমাদের ঐ সে-র। অমরত্ব—পৃথিবীতে কিছুই অমর নয়। তোমরা যাকে দেখেছিলে আর ক্যালিক্রেটিস বা আমেনার্তাস যাকে দেখেছিলো বা যার খোঁজে তোমরা চলেছে তারা এক নয়, হতে পারে না। এসবই সেই পুনর্জন্মের খেলা। যতদিন না আত্মা নির্বাণ লাভ করছে ততদিন ফিরে ফিরে পৃথিবীতে আসতে হবে। তোমাদের আয়শাও তেমনি এসেছে। ভবিষ্যতেও আসবে।

ভাই লিও, তুমি যদি তাকে পাও-ও, পাবে হারাবার জন্যে। অর্থাৎ আবার নতুন করে খোঁজ শুরু করতে হবে তোমাকে। হয়তো জনম জনম ধরে খুঁজে চলবে, কিন্তু পেয়েও পাবে না, হাতের মুঠোয় এসেও বেরিয়ে যাবে। আর, ভাই হলি, তোমার জন্যে, আমার জন্যেও, হারানো-ই সবচেয়ে বড় পাওয়া। তা-ই যদি হয়, তাহলে কেন ছুটবে মরীচিকার পেছনে? কেন নিজে তৃষ্ণার্ত থেকে পানি ঢেলে ভরবার চেষ্টা করবে ফুটো পাত্র? তাতে মাটিই কেবল ভিজবে, তোমার তৃষ্ণা তো মিটবে না?

তৃষ্ণা না মিটুক, মাটি উর্বরা হবে, আমি জবাব দিলাম। যেখানে পানি পড়ে সেখানেই প্রাণের সম্ভাবনা দেখা দেয়। আর দুঃখ তো আনন্দেরই বীজ। ভাই খুবিলগান, আর বাধা দেবেন না আমাদের।

ঠিক আছে, দেবো না। তবে আমার একটা ধারণার কথা বলি, শোনার পর যদি মনে হয় যাবে, যেও, আমি কিছু বলবো না। লিওর দিকে তাকালো কোউ এন। তোমাদের গল্প শুনে বুঝতে পারছি আজ থেকে অনেক অনেক জন্ম আগে আইসিস নামের কোনো দেবীর চরণে তুমি নিজেকে সমর্পণ করেছিলে, তাই না? তারপর এক নারী তোমাকে প্রলোভিত করে, তার সাথে অনেক দূরে পালিয়ে গিয়েছিলে। সেখানে কি হলো? প্রবঞ্চিত দেবী প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে হত্যা করলো তোমাকে। সেই দেবী নিজে না হলেও, আমার বিশ্বাস তার কোনো প্রতিনিধি তার জ্ঞান আত্মস্থ করে তারই ইচ্ছায় তার হয়ে একাজ করে। কিন্তু পরে সেই প্রতিনিধি-সে নারী বা অশুভ আত্মা যা-ই হোক না কেন-মরতে অস্বীকার করে, কারণ ইতিমধ্যে সে ভালোবেসে ফেলেছে তোমাকে। সে জানে তুমি মৃত তবু সে অপেক্ষা করতে লাগলো, এই আশায়, পুনর্জন্ম নিয়ে আবার তুমি আসবে। তারপর তুমি যখন নতুন জন্ম নিলে সত্যিই তোমার সাথে দেখা হলো তার এবং মারা গেল সে। এখন পুনর্জন্ম নিয়েছে ও, ওকে নিতেই হবে। যে তোমাকে প্রলোভিত করেছিলো সে-ও পুনর্জন্ম নিয়েছে। নিঃসন্দেহে এবারও তোমার সাথে তাদের দেখা হবে। তারপর সেই পুরনো ঘটনা নতুন বৃত্তে আবর্তিত হবে। তার মানে তোমার জন্যে আবার কষ্ট, দুঃখ, বেদনা। না, বন্ধুরা, যেও না-ঐ অভিশপ্ত গিরিশ্রেণী অতিক্রম কোরো না। এখানেই থাকো, আমরা সবাই মিলে প্রার্থনা করবো তোমাদের জন্যে।

না, জবাব দিলো লিও, আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করতে পারবো না।

বেশ, যাও তাহলে। তোমাদের প্রতিক্ষা করো। যখন এর ফসল তুলবে তখন আমার কথা স্মরণ কোরো। আমি জানি, বাসনার যে মদ তুমি পান করেছো তার প্রভাব বড় কঠিন।

.

০৪.

দুদিন পর সূর্যোদয় দেখলো আমরা মরুভূমির পথে হাঁটছি। পেছনে প্রায় মাইলখানেক দূরে পাহাড়ের ওপর অধিত্যকায় বসে আছে বিশাল প্রস্তর-বুদ্ধ। তার ওপাশে প্রাচীন মঠ। আকাশ ঝলমলে, পরিষ্কার। বুদ্ধমূর্তির পাশে আমাদের বন্ধু বৃদ্ধ খুবিলগান কোউ-এন-এর ঝুঁকে থাকা অবয়বটা দেখতে পাচ্ছি স্পষ্ট। বিদায় জানানোর সময় হাউহাউ করে কেঁদে উঠেছিলো বৃদ্ধ। সত্যিই ভালোবেসে ফেলেছিলো আমাদের। কিন্তু কিছু করার নেই, যে নিয়তি আমাদের ছুটিয়ে নিয়ে চলেছে তার অমোঘ নির্দেশ কি করে আমরা লংঘন করবো?

যতক্ষণ না ছোট হতে হতে একেবারে মিলিয়ে গেল ততক্ষণ একটু পরপরই ঘাড় ফিরিয়ে দেখলাম বৃদ্ধকে। অবশেষে দীর্ঘ একটা নিঃশ্বাস ফেলে সামনের দিকে চোখ ফেরালাম।

.

পাহাড়-চূড়ায় সেই রহস্যময় আলো যখন আমাদের ওপর এসে পড়েছিলো তখন কম্পাস ছিলো আমার কাছে। আলোটা কোন্‌দিক থেকে এসেছিলো দেখে নিতে পেরেছিলাম। সেদিকেই চলেছি আমরা।

আবহাওয়া চমৎকার। সামনে দুস্তর মরু। সারাদিন হেঁটে গোটা দুয়েক বুনো গাধার পাল ছাড়া আর কিছু নজরে পড়লো না। সন্ধ্যার একটু আগে একটা অ্যান্টেলোপ মারতে পারলাম। তারপর রাতের মতো যাত্রাবিরতি। যেটা নিয়ে পাহাড়-চূড়ায় উঠেছিলাম সেই ছোট্ট তাবুটা সঙ্গে আছে। ওটা খাটালাম। ইয়াকের পিঠে একটা বস্তায় কিছু শুকনো খড়কুটো এনেছি। আগুন জ্বাললাম তা দিয়ে। রাতে চা আর অ্যান্টেলোপের মাংস দিয়ে রাজসিক খাবার খেলাম। অ্যান্টেলোপটা মারতে পারায় আমাদের সাথে যে সামান্য শুকনো খাবার আছে তার ওপর একটু চাপ কমলো।

পরদিন সকালে প্রথমেই আমাদের অবস্থান যাচাই করে নিলাম। সবদিক বিবেচনা করে ধারণা হলো মরুভূমির চার ভাগের একভাগ অতিক্রম করতে পেরেছি। চতুর্থ দিন সন্ধ্যায় প্রমাণিত হলো, নিখুঁত ধারণা করেছিলাম। মরুভূমির ওপাশে যে বিস্তৃত পাহাড়শ্রেণী তার পাদদেশে পৌঁছে গেছি।

তৃতীয় দিন সকালে লিও বলেছিলো, ঘড়ির কাঁটার মতো নিশ্চিন্তে চলছে সব।

আমি ওকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলাম, শুরুটা যার ভালো তার শেষ সাধারণত ভালো হয় না। আমি ভুল বলিনি। সত্যিই এবার কষ্ট শুরু হলো। প্রথমত, পাহাড়গুলো খুব উঁচু। ওগুলোর নিচের দিকের ঢালে পৌঁছুতেই লেগে গেল দুদিন। সূর্যের তাপে তুষার নরম হয়ে গেছে, ফলে তার উপর দিয়ে হাঁটা অনেক বেশি আয়াসসাধ্য হয়ে উঠলো।

সপ্তম দিন সকালে এক সঙ্কীর্ণ শৈলপথের মুখে পৌঁছুলাম। চেহারা দেখে মনে হলো পাহাড়-শ্রেণীর অনেক গভীরে চলে গেছে ওটা। আশপাশে আর কোনো পথ না পেয়ে ঐ পথেই এগোলাম আমরা। কিছুদূর হাটার পর বুঝতে পারলাম এটা প্রাকৃতিক গিরিপথ নয়। কোনো কালে মানুষই তৈরি করেছিলো এ পথ। পাহাড়ের গায়ে অস্ত্রপাতির আঘাতের চিহ্ন দেখতে পাচ্ছি। খাড়া উঠে গেছে পথটা। চওড়া সব জায়গায় মোটামুটি সমান। এটাও একটা প্রমাণ, পথটা প্রাকৃতিক নয়।

তিন দিন এগোলাম এই পথে। এগোলাম না বলে বলা ভালো উঠলাম। গিরিপথ বেয়ে যত এগোচ্ছি ততই এক পাহাড়ের চূড়ার দিকে উঠে যাচ্ছি আমরা। দিনে খুব একটা সমস্যা হলো না, কষ্ট যা হওয়ার হলো রাতে। এমন প্রচণ্ড ঠাণ্ডা যে তাঁবুর ভেতরে, সমস্ত পোশাক-আশাক গায়ে দিয়ে, কম্বল মুড়ি দিয়ে, ইয়াকটার গায়ে গা ঠেকিয়ে বসেও কাঁপতে হয় ঠকঠকিয়ে। সে ঠাণ্ডার স্বরূপ প্রকাশ করার সাধ্য আমার নেই। বরফের মতো ঠাণ্ডা বললে কিছুই বলা হয় না।

অবশেষে দশম দিন বিকেলে শৈল পথের শেষ মাথায় পৌঁছুলাম। আর শখানেক গজ গেলেই গিরিপথের মুখ। সন্ধ্যা হতে বেশি বাকি নেই। ওখানেই তাবু খাটানোর সিদ্ধান্ত নিলাম। আসল কষ্ট শুরু হলো এবার। আগুন জ্বালানোর মতো কোনো জ্বালানী আর অবশিষ্ট নেই। পানি গরম করতে পারলাম না। তৃষ্ণা মেটানোর জন্যে জমা তুষার চুষতে হলো। কিন্তু তাতে কি তৃষ্ণা মেটে? তীব্র ঠাণ্ডায় চোখ জ্বলছে। সারারাতে একটুও ঘুমাতে পারলাম না দুজনের কেউ।

ভোর হলো। তারপর সূর্যোদয়। গুড়ি মেরে তাবুর বাইরে এলাম। গিরিপথের মুখ যেখানে তার শখানেক গজ ভেতরে আমাদের তাঁবু। হাত-পায়ের জড়তা কাটানোর জন্যে দৌড়ানোর ভঙ্গিতে মুখটার দিকে এগোলাম আমরা। আগে লিও, পেছনে আমি। কিছুদূর যাওয়ার পর একটা বাঁক নিয়েছে শৈলপথ।

লিও-ই প্রথম মোড় ঘুরলো। পর মুহূর্তে বিস্মিত এক চিৎকার বেরোলো তার মুখ দিয়ে। এক সেকেণ্ড পর আমিও মোড় ঘুম। তারপর! সামনে আমাদের প্রত্যাশিত দেশ!

নিচে-অনেক নিচে, কমপক্ষে দশ হাজার ফুট হবে, বিছিয়ে আছে বিস্তৃত এক সমভূমি। যতদূর চোখ যায় কেবল সমান আর সমান। আকাশ যেখানে মাটির সাথে মিশেছে সেখানেও শেষ হয়নি এর বিস্তৃতি। তুষারের টুপি পরা বিরাট একটা নিঃসঙ্গ পাহাড়ই কেবল একটু ব্যতিক্রম এই দৃষ্টিক্লান্তিকর সমতলে। যদিও অনেক দূরে, তবু মোটামুটি পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি পাহাড়টার অবয়ব। কুণ্ডলী পাকিয়ে ধোয়া উঠছে গোল চূড়া থেকে। তার মানে ওটা একটা জীবন্ত আগ্নেয়গিরি। এবং আরও দেখতে পাচ্ছি, জ্বালামুখের এপাশে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে প্রকাণ্ড এক পাথরের স্তম্ভ। যার ওপর অংশের আকৃতি আংটার মতো।

হ্যাঁ, আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছে ওটা, আমরা যে অলৌকিক দৃশ্য দেখেছিলাম তার বাস্তব রূপ! দীর্ঘ যোলো বছর যার খোঁজে মধ্য এশিয়ার প্রতিটা অঞ্চল চষে ফেলেছি সেই জীবনের প্রতীক এখন আমাদের সামনে। হৃৎস্পন্দন দ্রুত হয়ে গেল আমাদের। চারপাশে তাকিয়ে দেখলাম, সবচেয়ে উঁচু পাহাড়টার চেয়েও উঁচু ওটার আংটা। এতক্ষণে বুঝলাম, কি করে এই সুউচ্চ গিরিশ্রেণী পেরিয়ে সেই অলৌকিক আলো পৌঁছেছিলো মরুভূমির ওপাশে পাহাড়ের চূড়ায়।

আলোটার উৎস সম্পর্কেও নিশ্চিত হলাম এতক্ষণে। আংটার পেছনের ধোয়াই রহস্যের সমাধান করে দিয়েছে। আগ্নেয়গিরিটা যখন জীবন্ত, নিঃসন্দেহে মাঝে মাঝে ধোঁয়ার বদলে আগুন বেরিয়ে আসে ওটার জ্বালামুখ দিয়ে। সেই আগুনের তীব্রতা কতখানি হতে পারে তা সে রাতে পাহাড় চূড়ায় বসে আমরা টের পেয়েছি।

এছাড়া সমভূমিতে আর যা দেখলাম তা হলো, প্রায় মাইল তিরিশেক দূরে বিশাল এক মাটির ঢিবির ওপর বিরাট একটা নগর। সমভূমির মাঝখান দিয়ে বয়ে চলেছে প্রশস্ত এক নদী। তার তীরে গাছপালা ঘেরা এক জায়গায় নগরটা। চোখে ফিল্ড গ্লাস (আমাদের সামান্য যে দু-একটা যন্ত্রপাতি এখনও অবশিষ্ট আছে তার একটা এটা) লাগিয়ে দেখলাম, নগর ঘিরে ফসলের মাঠ। নগর আর মাঠের মাঝে। সীমানার কাজ করছে গাছগুলো। পরিশ্রমী কৃষকরা বীজ বোনার আগে চাষ দিয়েছে মাঠে। সেচের জন্যে খাল কেটে মাঠের ভেতর পানি নেয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে।

হ্যাঁ, আমাদের সামনে সেই আকাঙ্ক্ষিত দেশ। যোলো বছর কঠোর পরিশ্রমের পর যার খোঁজ পেয়েছি। মুহূর্তে আমরা ভুলে গেলাম সব পরিশ্রম, সব ক্লান্তির কথা। নতুন করে উদ্দীপনা জাগলো মনে। আর একটা মুহূর্তও নষ্ট করতে চাই না। এক্ষুণি রওনা হতে হবে। ছুটে ফিরে এলাম তাবুর কাছে। কোনো রকমে জিনিসপত্র সব গোছগাছ করে চাপিয়ে দিলাম ইয়াকটার পিঠে। তারপর বেরিয়ে পড়লাম আকাঙ্ক্ষিত দেশের পথে।

গিরিপথ শেষ, কিন্তু পথ এখনও শেষ হয়নি। পাহাড়ের এপাশেও ঢাল বেয়ে নেমে গেছে মানুষের তৈরি রাস্তাটা। ধীর অথচ নিশ্চিত পদক্ষেপে নামতে শুরু করলাম আমরা।

যা ভেবেছিলাম তার চেয়ে অনেক দীর্ঘ পাহাড়ের ঢাল। সমস্ত দিন নেমেও পাদদেশে পৌঁছুতে পারলাম না। সুতরাং বাধ্য হয়েই আরেকটা রাত তুষারের ভেতর কাটাতে হলো। ভাগ্য ভালো, কয়েক হাজার ফুট নেমে আসতে পেরেছি। সে কারণে ঠাণ্ডার মাত্রা একটু সহনীয়। এখানে ওখানে দু’একটা খানা খন্দকে সূর্যের তাপে তুষার গলা পানি দেখতে পেলাম। তৃষ্ণা মেটানো সমস্যা হলো না। ইয়াকটাও পেট ভরে নিলো প্রায় শুকনো পাহাড়ী শ্যাওলা দিয়ে।

ভোর হলো। অবশিষ্ট খাবারের খানিকটা খেয়ে নিয়ে আবার রওনা হলাম আমরা। এখন আর নিচের সমভূমিটা দেখতে পাচ্ছি না। সামনে একটা শৈল প্রাচীর আমাদের দৃষ্টি আটকে দাঁড়িয়ে আছে। প্রাচীরের গায়ে এক জায়গায় একটা ফাটল মতো দেখা যাচ্ছে। ওই ফাটল গলে বেরিয়ে যাওয়ার আশায় সেদিকে এগোতে লাগলাম। দুপুর নাগাদ খুব কাছাকাছি পৌঁছে গেলাম প্রাচীরের। ফাটলটা অনেক স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি এখন। মনে হচ্ছে ওখান দিয়ে বেরিয়ে যেতে পারবো। হাঁটার গতি একটু বাড়ালাম আমরা। কিন্তু তাড়াহুড়োর কোনো দরকার ছিলো না। মাত্র এক ঘণ্টা পরেই মুখোমুখি হলাম কঠিন সত্যটার।

শৈল প্রাচীরের ফাটল আর আমাদের মাঝখানে শুয়ে আছে খাড়া নেমে যাওয়া এক গিরিখাত। তিন চারশো ফুট গভীর। জল প্রবাহের শব্দ ভেসে আসছে নিচ থেকে। গিরিখাতের কিনারে পেীছে শেষ হয়ে গেছে পথ। তারপর গভীর খাদ। খাদের এপাশে ওপাশে উঁচু দুটো পাথরের স্তম্ভ। কিন্তু এমন জায়গায় এসে মানুষের তৈরি পথ শেষ হয় কি করে? হতাশ, বিষণ্ণ চোখে চেয়ে আছি আমরা।

হুঁ, বুঝতে পেরেছি, হঠাৎ লিও বললো, ভূমিকম্পের ফলে তৈরি হয়েছে এই খাদ। তারপরই চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে এপথে।

হতে পারে, জবাব দিলাম আমি, বা এমনও হতে পারে, এখানে কোনো কালে একটা সেতু ছিলো। তারপর কালের গ্রাসে পচে, ক্ষয়ে, খসে পড়েছে। যাহোক তাতে আমাদের সমস্যার কোনো সমাধান হচ্ছে না। অন্য একটা পথ খুঁজে বের করতে হবে।

হ্যাঁ, এবং তাড়াতাড়ি। যদি না এখানেই চিরতরে আটকে থাকতে চাই।

সুতরাং ডান দিকে মোড় নিয়ে গিরিখাতের পাড় ধরে এগিয়ে চললাম আবার। প্রায় এক মাইল যাওয়ার পর ছোট একটা হিমশিরার কাছে পৌঁছুলাম। হিমায়িত জলপ্রপাতের মতো খাদের ভেতর ঝুলে আছে সে। কিন্তু খাদের তলায় পৌঁছেছে। কিনা বুঝতে পারলাম না। তবে একটা ব্যাপার বুঝতে পারছি এখান থেকে খাদটা ক্রমশ আরও চওড়া ও আরও গভীর হতে শুরু করেছে।

সুতরাং আবার আগের জায়গায়ুরে এলাম। এবার পথটার বাঁ দিকে এগিয়ে চললাম গিরিখাতের পাডুধের। কিছু দূর যাওয়ার পর দেখলাম খাদের উল্টো দিকে দাঁড়িয়ে আছে আরেকটা পাহাড়। ঝকঝকে তুষার ছাওয়া ঢাল উঠে গেছে চূড়ার দিকে। গিরিখাতের অবস্থা সেই এক। নির্দয়, কূর, অগম্য।

এদিকে দিনের আলো ম্লান হয়ে আসছে। তাড়াতাড়ি আশ্রয় নেয়ার মতো কোনো জায়গা খুঁজে বের করতে না পারলে বিপদ হবে। একটু থেমে চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে নিলাম। প্রায় আধমাইল দূরে খাদের কিনারে বড়সড় এক পাথরের চাঙড় দেখতে পাচ্ছি। ওটার ওপর উঠতে পারলে হয়তো পথের খোঁজ পাওয়া যাবে।

অনেক পরিশ্রমের পর যখন শ দেড়েক ফুট উঁচু চাঙড়টায় উঠলাম তখন সূর্য ডুবছে। অস্পষ্ট হলদেটে আলোতে দেখলাম, এপাশে খাদটা রাস্তা যেখানে শেষ হয়েছে সেখানকার চেয়ে অনেক অনেকগুণ বেশি গভীর এবং চওড়া। গভীরতা এত বেশি যে উঁকি দিয়েও তল দেখতে পেলাম না। তবে জল প্রবাহের মৃদু কুলু কুলু শব্দ ঠিকই সৌছচ্ছে কানে। আচমকা প্রসারিত হয়ে খাদের প্রশস্ততা এখানে দাঁড়িয়েছে প্রায় আধমাই-এ।

এবার? কিছু ভাবতে পারছি না আমি। লিওর মুখেও চরম হতাশার ছাপ। কি করবে কিছু বুঝতে পারছে না। এদিকে সূর্য ডুবে গেছে। দ্রুত আঁধার নেমে আসছে। এখন আর সেই পথের মুখে ফিরে যাওয়ার সময় নেই। পাথরের ওপরেই রাত কাটানোর সিদ্ধান্ত নিতে হলো।  ইয়াকটাকে ভারমুক্ত করে তাবু খাটালাম। তারপর মঠ থেকে আনা খাবারের শেষটুকু খেয়ে নিলাম। কাল সকালে কোনো শিকার না পাওয়া গেলে অমাহারে থাকতে হবে। যা হোক, খাওয়ার পর সবগুলো ফারের পোশাক আর কম্বলে শরীর মুড়ে শুয়ে পড়লাম। ঘুমানোর চেষ্টা করতে লাগলাম দুঃখ ভোলার আশায়।

.

ভোর হতে খুব একটা বাকি নেই, এমন সময় আচমকা ভয়ানক এক শব্দে ঘুম ভেঙে গেল আমাদের। অনেকগুলো কামান যেন একসঙ্গে গর্জে উঠেছে। তারপরেই হাজার হাজার অন্য রকম শব্দ।

হায় ঈশ্বর! ওকি? আঁতকে উঠলাম আমি।

তাড়াতাড়ি তাঁবুর বাইরে বেরিয়ে এলাম। কিন্তু কিছুই দেখতে পেলাম না! দ্রুত ঘাড় ঘুরিয়ে চারদিকে তাকালাম। ভোরের অস্পষ্ট আলোয় কোনোরকম অস্বাভাবিকতা নজরে পড়লো না। এদিকে আওয়াজ চলছে, অসংখ্য বন্দুকধারী একসাথে গুলি ছুঁড়লে যেমন হয় তেমন। ইয়াকটার ভেতর কেমন যেন অস্থিরতা, ছুটে পালানোর প্রবণতা, কিন্তু দীর্ঘদিনের সাথীদের ফেলে পালাতে পারছে না। একটু পরেই বদলে গেল শব্দ। এখন মনে হচ্ছে প্রকাণ্ড একটা যাঁতা যেন কেউ ঘোরাচ্ছে ঘড় ঘড় শব্দে। পিলে চমকে যেতে চায়।

ভোর বেলা অত্যন্ত দ্রুত ফর্সা হয়ে আসে চারদিক। আজও হলো। তারপর দেখলাম-দুচোখে রক্তহিম করা আতঙ্ক নিয়ে দেখলাম, ধীর গতিতে নড়েচড়ে নেমে আসছে পাহাড়ের একটা পাশ। বিশাল এক হিমবাহ!

ওহ! সে দৃশ্য ভোলার নয়। আমাদের দুমাইল কি তারও বেশি দূরে ঢালের ওপর নড়ে-চড়ে, দুমড়ে-মুচড়ে, গড়িয়ে নেমে আসছে বিশাল সাদার একটা স্থূপ। প্রতি মুহূর্তে আকার বদলাচ্ছে যেন ঝঞা বিক্ষুব্ধ সাগরের ঢেউ। উপরে অনেক দূর পর্যন্ত ছিটকে উঠছে গুঁড়ো গুঁড়ো বরফ, তুষার কণা। জমাট বাঁধা ঝরনা যেন।

আতঙ্কে হৃৎপিণ্ড গলার কাছে উঠে আসতে চাইছে আমাদের। বাক রুদ্ধ হয়ে গেছে। কোনো রকমে লিওর দিকে চাইলাম। ও-ও একই রকম বিরত চোখে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। কয়েক সেকেণ্ড লাগলো বিপদের গুরুত্ব অনুধাবন করতে। তারপর সংবিৎ ফিরলো দুজনের। আবার তাকালাম সরীসৃপের মতো ধীর অথচ নিশ্চিত গতিতে এগিয়ে আসা বরফপুঞ্জের দিকে।

নাম না জানা ভয়ঙ্কর কোনো জন্তুর মতো গুড়ি মেরে এগিয়ে আসছে ওটা। এতক্ষণ মনে হচ্ছিলো খুব ধীর গতিতে নামছে। কিন্তু মাত্র চার মিনিটের ভেতর দুমাইল পথ অতিক্রম করতে দেখে বুঝলাম কি ভয়ানক গতি ওটার। আর কয়েক শো গজ মাত্র দূরে রয়েছে আমাদের এই দেড়শো ফুট উঁচু ছোট পাহাড়টা থেকে।

ইতিমধ্যে কখন যে আমাদের ভয় কেটে গেছে টের পাইনি। মুগ্ধ বিস্ময়ে দেখছি ভয়ঙ্করের রূপ। আসছে। ঘোট ঘোট নুড়ি, পাথর, বরফের চাঙড়, তুষার; উঠছে, পড়ছে, ছুটছে, লাফাচ্ছে। এক মুহূর্ত বিরাম নেই।

আর মাত্র শখানেক গজ। তীক্ষ্ণ্ণ চোখে তাকিয়ে দেখলাম, আমাদের পাহাড় চূড়া থেকে পঞ্চাশ ফুট নিচে ওটার সম্মুখভাগ। তারমানে প্রায় একশো ফুট পুরু হিমবাহটা। ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে শব্দের তীব্রতা। একটানা প্রচণ্ড গর্জনের মতো। মনে হচ্ছে কানের পর্দা ফেটে যাবে।

আর পঞ্চাশ গজ। বুঝতে পারছি না, ঠিক কি ঘটবে, যখন ওটা আছড়ে পড়বে এই পাহাড়ের গায়ে। কল্পনাও করতে পারছি না। এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি কখনও হইনি যে। অমোঘ নিয়তির মতো এগিয়ে আসছে ওটা।

শুয়ে পড়ো, লিও! কোনো মতে কথাটা বলার সুযোগ পেলাম। পর মুহূর্তে প্রচণ্ড মেঘ গর্জনের মতো শব্দ করে আছড়ে পড়লো, হিমবাহ আমাদের পাহাড়ের ওপর। ঝঞা বিক্ষুব্ধ সাগরের ঢেউ যেমন ফুলে ফেঁপে, বেঁকে-চুরে ভেঙে পড়ে পাহাড়ী উপকূলে তেমনি। গম-গম, গুরু গুরু আওয়াজ ছাপিয়ে উঠলো তীব্র বাতাসের হিস হিস শব্দ। ভয়ঙ্কর ঝাঁপটাতে গুঁড়ো গুঁড়ো তুষার ছিটকে এসে লাগলো আমাদের গায়ে। প্রায় কবর দিয়ে ফেললো আমাদের। মনে হলো একরাশ জ্বলন্ত কয়লা যেন কেউ ঢেলে দিলো গায়ের ওপর। উপুড় হয়ে মাটি কামড়ে পড়ে আছি আমরা। ভূমিকম্পের মতো কাঁপছে বুকের নিচে পাথুরে মাটি। ঘড় ঘড়, গোঁ গোঁ, গুডুম ডুম আওয়াজ সমানে চলছে। মনে হচ্ছে কোনোদিনই বুঝি শেষ হবে না এই শব্দের তাণ্ডব। বাতাসের বেগ বেড়ে গেছে ভয়ানক। ছোট্ট তবুটাকে অনেক আগেই উড়িয়ে নিয়ে গেছে। কোথায় জানি না। প্রতি মুহূর্তে ভয় পাচ্ছি, বসন্তের প্রথম বাতাস যেমন ঝরা পাতা উড়িয়ে নিয়ে যায় তেমনি আমাদেরও বুঝি উড়িয়ে নিয়ে ফেলবে পেছনের অতল গিরি খাদে।

ওপর দিয়ে, পাশ দিয়ে, প্রায় শরীর ছুঁয়ে সমানে ছুটে যাচ্ছে পাথর আর বরফের চাঙড়। কিন্তু ঈশ্বরের কি করুণা, আমাদের গা স্পর্শ করলো না একটাও। বৃষ্টির মতো আমাদের গায়ে ঝরে পড়ছে নুড়ি আর বরফের কুচি। তাতে কষ্ট হচ্ছে ঠিকই, তবে মরণ কষ্ট নয়। একটু একটু করে আমরা তলিয়ে যাচ্ছি বরফ আর তুষারের নিচে। আর বেশিক্ষণ এভাবে চললে মৃত্যু অবধারিত।

অবশেষে থামলো তাণ্ডব। কতক্ষণ ধরে চলেছে জানি না। দশ মিনিট হতে পারে, দুঘণ্টাও হতে পারে। কোনো ধারণা নেই আমাদের। শুধু মনে আছে, শব্দের প্রচণ্ডতা তুঙ্গে উঠতে উঠতে এক সময় আচমকা কমতে শুরু করলো। তারপর এক সময় মিলিয়ে গেল। শব্দের সঙ্গে সঙ্গে বাতাসের সুতীব্র বেগও প্রশমিত হয়ে এলো। গায়ের ওপর থেকে তুষার আর ছোট ছোট নুড়ির স্থূপ সরিয়ে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালাম আমরা।

সামনে খাড়া পাহাড়ের গায়ে প্রায় দুমাইল লম্বা আধ মাইল চওড়া একটা জায়গা যেখানে একটু আগেও শত ফুট পুরু বরফের স্তর ছিলো, এখন সেখানে দাঁত বের করা কঙ্কালের মতো উলঙ্গ পাথর। আমাদের তাবুটা যেখানে ছিলো সেখানে এখন কিছু নেই। ইয়াকটা মরে পড়ে আছে এক পাশে। বেচারার মাথা উড়ে গেছে কোনো পাথর বা বরফের চাঙড়ের ঘায়ে। ধ্যাতলানো গলার কাছে রক্ত জমে আছে থকথকে হয়ে। পেছনের বিশাল গিরিখাতটার প্রায় অর্ধেক ভরে গেছে হিমবাহ আর তার বয়ে আনা পাথর, নুড়ি, ধুলোয়। ব্যস এ-ই। এ ছাড়া আর কোনো চিহ্ন নেই সেই ভয়ানক ঘটনার। এই মুহূর্তে কেউ যদি হাজির হয় সে টেরও পাবে না একটু আগে কি প্রলয়ঙ্কর কাণ্ড ঘটে গেছে এখানে। আর আমরা তা প্রত্যক্ষ করেছি, সহ্য করেছি এবং এখনও বেঁচে আছি।

বেঁচে তো আছি, কিন্তু কি অবস্থা আমাদের? আলগা তুষারে ডুবে যাওয়ার ভয়ে পাহাড় থেকে নামার সাহস পাচ্ছি না। তাছাড়া একটু পরপরই দু-একটা ছোট ছোট আলগা পাথরের চাঁই গড়িয়ে নেমে আসছে ওপর থেকে। ছোট হলেও একেকটার আয়তন ছোটখাটো মানুষের সমান। গায়ে লাগলে ইয়াকটার যে দশা হয়েছে আমাদেরও তা ছাড়া অন্য কি হবে না। কিন্তু না নেমেই বা কি করবো? এই চূড়ার ওপর কতক্ষণ না খেয়ে আতঙ্কিত অবস্থায় বসে থাকবো?

ইয়াকটার চামড়া ছাড়াই এসো, হঠাৎ বলে উঠলো লিও। এরকম হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকার চেয়ে কিছু করা ভালো। তাছাড়া রাতে যদি এখানেই থাকতে হয়, চামড়াটা কাজে লাগবে।

মনটা সায় দিতে চাইছে না। এত দিনের সাথী। মরে গেছে বলেই আজ ওকে এভাবে নিজেদের প্রয়োজন মেটানোর হাতিয়ার বানাবো? কিন্তু এছাড়া উপায়-ই বা কি? ওর চামড়া না পেলে তো আমরাও মরবো। ধীরে ধীরে উঠে হাত লাগালাম লিওর সাথে। মনে মনে ক্ষমা চাইলাম জন্তুটার আত্মার কাছে। আমরা এখানে নিয়ে এসেছিলাম বলেই তো এমন অপঘাতে মরতে হলো বেচারাকে।

যা হোক, মনে মনে যা-ই ভাবি না কেন শেষ পর্যন্ত ওর মাংসও খেতে হলো। কাঁচা। খানিকটা তুষার মেখে চোখ বুজে খেয়ে ফেললাম। প্রাণ বাঁচাতে হবে, সে জন্যে শক্তি দরকার। না খেলে শক্তি আসবে কোত্থেকে? কাঁচা মাংস খাওয়ার সময় জংলী জংলী একটা অনুভূতি হলো মনে। কিন্তু এছাড়া কি-ইবা করার ছিলো। আমাদের?

.

০৫.

অবশেষে দিন শেষ হলো। এখনও আমরা নামার সাহস সঞ্চয় করে উঠতে পারিনি। সন্ধ্যায় আরও কয়েক টুকরো ইয়াকের মাংস খেয়ে গুটিসুটি হয়ে আশ্রয় নিলাম চামড়ার নিচে। ভাগ্য ভালো, আমাদের সব পোশাক-আশাক গায়েই ছিলো। না হলে তাবুটার মতো অবস্থা হতো ওগুলোর-ও। সেক্ষেত্রে আজ রাতে ঠাণ্ডায় জমে মরা কেউ ঠেকাতে পারতো না।

হোরেস, ভোরে লিও বললো, আর হাত-পা কোলে করে বসে থাকতে রাজি নই আমি। মরতে যদি হয়-ই, চলতে চলতে মরবো; তবে আমার মনে হয় না আমরা মরবো।

বেশ, তাহলে চলো রওনা হই। এখনও যদি তুষার আমাদের ভার সইতে না পারে কোনো দিনই পারবে না।

ইয়াকের চামড়া আর কম্বলগুলো ভাঁজ করে বেঁধে পিঠে তুলে নিলাম। ঠাণ্ডায় জমে যাওয়া ইয়াকের মাংসও নিলাম খানিকটা। তারপর শুরু করলাম নামতে।

.

হিমধসের সঙ্গে আসা ছোট বড় নানা আকারের পাথর প্রচুর পরিমাণে জমে আছে ছোট্ট পাহাড়টার গোড়ায়। ফলে ওঠার সময় যে জায়গাগুলো প্রায় খাড়া দেখেছিলাম সেগুলো এখন সহনীয় ঢলের রূপ নিয়েছে। নামতে অসুবিধা হলো না। রাতের ঠাণ্ডায় গুঁড়ো গুঁড়ো তুষার ভালো মতোই জমেছে। পা পিছলে যাচ্ছে। বা ভর দিতে সমস্যা হচ্ছে না।

প্রায় নেমে এসেছি। এপর্যন্ত ভালোই চলেছে সব। আর বিশ পা নামলেই পাদদেশে পৌঁছে যাবো। এমন সময় আলগা ধুলো আর গুঁড়ো তুষারের একটা স্কুপের মুখোমুখি হলাম। এটা পার হতেই হবে। পুরো পাহাড়টাকে চারদিক থেকে ঘিরে রেখেছে চওড়া স্তূপটা। লিও দিব্যি পার হয়ে গেল। আমি ওর গজ দুয়েক ডান দিয়ে নামছি, দু-পা যেতেই আচমকা অনুভব করলাম পায়ের নিচে শক্ত স্তরটা ঝুর ঝুর করে ভেঙে গেল। পরমুহূর্তে কোমর সমান ধুলো আর তুষারের ভেতর আবিষ্কার করলাম নিজেকে। ডুবে যাচ্ছি। কয়েক সেকেণ্ড পর সম্পূর্ণ তলিয়ে গেলাম আমি তুষারের নিচে।

আমার সে মুহূর্তের অনুভূতি কল্পনা করা সম্ভব নয়, যার অভিজ্ঞতা আছে সে-ই কেবল উপলব্ধি করতে পারবে। ক্রমশ নিচে, আরও নিচে চলে যাচ্ছি। অবশেষে, মনে হলো একটা পাথরের কাছে পৌঁছুলাম। আমার নিম্নাভিমুখী গতি রুদ্ধ হলো। তারপর অনুভব করলাম, আমি নিচে নেমে আসার সময় উপরে যে শূন্য স্থান তৈরি হয়েছিলো তা পূর্ণ হয়ে যাচ্ছে চেপে আসা তুষারে। সেই সঙ্গে নেমে আসছে অন্ধকার। একটু পরে নিচ্ছিদ্র আঁধার গ্রাস করলো আমাকে। কেমন একটা শ্বাসরুদ্ধকর অনুভূতি। যেন আমার গলা চেপে ধরেছে কেউ। চেতনা লুপ্ত হয়ে আসতে চাইছে। হঠাৎ একটা বুদ্ধি খেলে গেল মাথায়। তাড়াতাড়ি দুপাশে ছড়িয়ে থাকা হাত দুটো নরম তুষারের ভেতর দিয়ে টেনে নিয়ে এলাম মাথার কাছে। তারপর মুখের উল্টো দিকের তুষারে আস্তে আস্তে চাপ দিতে থাকলাম। ছোট্ট একটা গর্ত মতো হলো আমার মুখের সামনে। কিছুক্ষণের ভেতর খুব ধীরে ধীরে পরিশ্রুত বাতাস এসে জমতে লাগলো গর্তে। পরিপূর্ণ ভাবে না হলেও অনেকক্ষণ পর পর একবার শ্বাস টেনে প্রাণটাকে টিকিয়ে রাখলাম আমি।

কয়েক বার এমন শ্বাস নেয়ার পর বুঝতে পারলাম, এভাবে চলবে না। বাতাসের পরিমাণ এত কম যে খুব বেশিক্ষণ এখানে শ্বাস নেয়া সম্ভব নয়। তার ওপর আছে নিশ্বাসের সাথে বেরিয়ে আসা কার্বন ডাই অক্সাইড। আশা ছেড়ে দিলাম আমি। বুকের নিচে পাথরটায় হাত বাধিয়ে একবার চেষ্টা করলাম, ওপরে উঠে যাওয়ার। পারলাম না। অগত্যা মৃত্যুর জন্যে তৈরি হয়ে গেলাম মনে মনে। কিন্তু কি আশ্চর্য, মৃত্যু পথযাত্রী মানুষ যেমন দেখে তেমন নিজের জীবনের অতীত স্মৃতি আমার মনের পর্দায় ভেসে উঠলো না। আমার মন চলে গেল আয়শার কাছে। স্পষ্ট দেখলাম সেই অনিষ্টসুন্দর মুখ। ওর পাশে এক পুরুষ। অন্ধকার এক পাহাড়ী খাদে পড়ে আছি আমি। কিনারে দাঁড়িয়ে ঝুঁকে আমাকে দেখছে আয়শা। ওর পরনে সেই দীর্ঘ কালো আংরাখা। চোখ দুটোয় ভয়। ওকে অভিবাদন জানানোনার জন্যে আমি উঠে দাঁড়াতে গেলাম। কিন্তু সে তীক্ষ্ণ্ণ কণ্ঠে চেঁচিয়ে উঠলো-কি সর্বনেশে কাণ্ড! তুমি বেঁচে আছো, আমার প্রভু লিও কোথায়? বলো, কোথায় লুকিয়ে রেখেছো আমার প্রভুকে? বলো–না হলে মরবে!

জবাব দেয়ার জন্যে আবার উঠে দাঁড়াতে গেলাম। কিন্তু পারলাম না। মিলিয়ে গেল আয়শার মুখ।

তারপর আবার আলো দেখলাম আমি। আরেকটা কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম। এবার লিওর!

হোরেস! হোরেস, শক্ত করে ধরে রাইফেলের বাঁটটা!

কিছু একটা ঠেকলো আমার ছড়িয়ে থাকা হাতে। প্রাণপণে আঁকড়ে ধরলাম ওটা। সঙ্গে সঙ্গে টান অনুভব করলাম হাতে। কিন্তু এক চুল নড়লো না আমার শরীর। তারপর আচমকা বাঁচার আকাঙক্ষা জেগে উঠলো আমার মনে। সর্বশক্তিতে হাত-পা ছুঁড়ে উঠে বসার চেষ্টা করলাম, অবশ্যই হাত দিয়ে যেটা আঁকড়ে ধরেছি সেটা না ছেড়ে। আবার টান অনুভব করলাম হাতে। আবার হাত পা ছুঁড়লাম। অকস্মাৎ প্রচণ্ড একটা ওজন নেমে গেল শরীর থেকে। শেয়াল যেমন তড়াক করে লাফিয়ে বেরিয়ে আসে গর্তের ভেতর থেকে তেমনি তুষার ভ্রুপের নিচ থেকে বেরিয়ে এসেছি আমি।

ফুঁপিয়ে উঠে শ্বাস নিলাম। কিছু একটার সঙ্গে ধাক্কা খেলো আমার শরীর। পর মুহূর্তে চোখ মেলে দেখলাম ছিটকে মাটিতে পড়ে যাচ্ছে, এক পাশে লিও অন্য পাশে রাইফেলটা।

ধীরে ধীরে তুষার মোড়া শক্ত মাটির ওপর বসলাম আমি। হাপরের মতো ওঠা নামা করছে বুক। নাক মুখ দিয়ে সমানে টেনে নিচ্ছি মুক্ত বাতাস।

লিও-ও উঠলো। রাইফেলটা কুড়িয়ে এনে বসলো আমার পাশে।

কতক্ষণ ছিলাম ওর নিচে? হাঁপাতে হাঁপাতে জিজ্ঞেস করলাম আমি।

জানি না। মনে হয় বিশ মিনিটের কাছাকাছি।

বিশ মিনিট! মনে হচ্ছিলো বিশ শতাব্দী। কি করে বের করলে আমাকে?

শক্ত তুষারের ওপর ইয়াকের চামড়া বিছিয়ে শুয়ে হাত দিয়ে সুড়ঙ্গ কেটে এগিয়ে গিয়েছিলাম। কোথায় পড়েছিলে তা তো দেখেছিলাম। খুব বেশি দূরে নয়। একেবারে নিচে পৌঁছে তোমার আঙুলগুলো দেখলাম। তাড়াতাড়ি রাইফেলের বাটটা এগিয়ে দিলাম। ভাগজিলো ওটা ধরার মতো শক্তি তখনও ছিলো তোমার।

ধন্যবাদ, বুড়ো ছোকরা। আর কিছু আমি বলতে পারলাম না।

আমাকে ধন্যবাদ দিচ্ছো কেন? মৃদু হেসে জিজ্ঞেস করলো লিও। তুমি কি ভেবেছিলে বাকি পথটুকু আমি একাই যাবো? দম নেয়া হয়েছে? তাহলে ওঠো, দেরি করে লাভ নেই। বেশ কিছুক্ষণ বরফের বিছানায় ঘুমিয়ে নিয়েছে, এবার একটু ব্যায়াম দরকার তোমার। জানো, আমার রাইফেলটা ভেঙে গেছে, তোমারটা তুষারের নিচে। ভালোই হয়েছে, কি বলো? কার্তুজগুলোর ভার আর বইতে হবে না। শুকনো হাসি ওর মুখে।

আবার আমরা রওনা হলাম। সামনে যাওয়া অর্থহীন। সুতরাং সেই আগের পাথরটার কাছেই আবার ফিরে এলাম। আমাদের নিজেদের এবং হতভাগ্য ইয়াকটার পায়ের ছাপ চোখে পড়লো। এখনও তেমনি আছে। আগের মতোই নির্দয় নিরাবেগ ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে থাম দুটো-একটা খাদের এপাশে, অন্যটা ওপাশে। খাদটাও আগের মতোই খাড়া নেমে গেছে পাতালের দিকে। অগম্য।

ওদিকে সেই হিম-স্তরের কাছে চলো, বললো লিও।

নিঃশব্দে এগিয়ে চললাম আমি ওর পেছন পেছন। ওখানে পৌঁছে সময় নষ্ট করলো না লিও। ঝুঁকে পরীক্ষা করলো হিমশিরার গোড়ার দিকটার অবস্থা। আমিও উঁকি দিলাম। আগেরবার যা দেখেছিলাম তার চেয়ে বেশি কিছু দেখতে পেলাম না। শ-চারেক ফুট গভীর খাদ। তার কিনার দিয়ে নেমে গেছে সরু, মোটা নানা ধরনের বরফের থাম বা শিকড়। একটা জলপ্রপাত আচমকা জমে বরফ হয়ে গেলে যেমন দেখতে হবে ঠিক তেমন। শিকড়গুলোর কোনোটা সরু হতে হতে তল পর্যন্ত পৌঁছেছে কিনা সেটাই জানতে চাইছি আমরা। কিন্তু বোঝা গেল না। নিশ্চিত যদি জানতাম তল পর্যন্ত পৌঁছেছে কোনোটা তাহলে সেটা বেয়ে নামার চেষ্টা করা যেতো। হতাশা, কালো হতাশা ছাড়া আর কিছু দেখছি না চোখে।

কি করবো আমরা? অবশেষে জিজ্ঞেস করলাম আমি। সামনে মৃত্যু, পেছনে মৃত্যু-পাহাড় পেরিয়ে ফিরে যাবো সে উপায় নেই, খাবার নেই এক বিন্দু। শিকার করে খাবার যোগাড় করবো তারও উপায় নেই। বন্দুক একটা হারিয়েছি, অন্যটা অকেজো। এখানে বসে থেকে না খেয়ে মরা ছাড়া আর কোনো উপায় দেখছি না। একমাত্র অলৌকিক কোনো ঘটনাই আমাদের বাঁচাতে পারে।

অলৌকিক ঘটনা! জবাব দিলো লিও। আর কি ঘটবে বলো? ছোট পাহাড়টায় উঠেছিলাম কেন? ওটায় উঠেছিলাম বলেই তো বেঁচে গেছি হিমবাহের হাত থেকে; এটাকে অলৌকিক ঘটনা বলবে না? তুষারের নিচ থেকে তোমার জ্যান্ত ফিরে আসা? আমার মাথায় হঠাৎ বুদ্ধি আসা, এবং তুষারের নিচে গিয়ে তোমাকে বের করে আনা? আমি মনে করি অদৃশ্য কোনো শক্তি এতদিন আমাদের সাহায্য করেছে। আগামীতেও করবে না কেন? তুমি কি মনে করো, এই শক্তির সহায়তা না পেলে এতদিন আমরা বেঁচে থাকতাম?

থামলো ও, তারপর যোগ করলো, তোমাকে বলছি, হোরেস, সঙ্গে খাবার, বন্দুক, ইয়াক, আরও যা যা দরকার সব থাকলেও আমি ফিরে যেতাম না ফিরে গেলে কাপুরুষ প্রমাণিত হয়ে যাবো না? তখন কি ও ওর যোগ্য মনে করবে আমাকে? না, হোরেস, এগিয়ে আমি যাবোই।

কিন্তু কি করে?

ঐ পথ ধরে। খাদের পাড় থেকে স্কুলে পড়া বরফের শিকড়ের দিকে ইশারা করলো লিও!

ও তো মৃত্যুর পথ!

হোক। মৃত্যু এলে আসবে। এখানে বসে থাকলেও তো মরবো, তার চেয়ে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে মরি। আমি মনস্থির করে ফেলেছি। এবার তোমার পালা।

আমিও ঠিক করে ফেলেছি। আমরা এক সাথে যাত্রা শুরু করেছিলাম, লিও, শেষ-ও করবো এক সাথে। হয়তো আয়শা জানে আমাদের এখনকার অবস্থা। আমাদের পরীক্ষা করছে, সময় হলেই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবে। শুকনো একটু হাসলাম আমি। যদি-না চলল, খামোকা সময় নষ্ট করছি।

.

নামার জন্যে সামান্য কিছু প্রস্তুতি নিতে হলো। একটা চামড়ার কম্বল আর ইয়াকের চামড়াটা সরু ফালি করে কেটে গিট দিয়ে দড়ি মতো বানালাম। কোমরের কাছে বেঁধে নিলাম এই দড়ি। একটা প্রান্ত খোলা রইলো। এতে নামতে সুবিধা হবে।

তারপর আরেকটা কম্বল টুকরো টুকরো করে কেটে আমাদের হাঁটু এবং পাগুলো ঢেকে নিলাম। শক্ত বরফ বা পাথরের কোনা লেগে ছড়ে যাওয়ার ভয় থাকবে না। চামড়ার দস্তানাগুলো পরে নিলাম হাতে। এগুলো হয়ে যাওয়ার পর আমাদের বাকি জিনিস-পত্র সব এক সাথে করে বেঁধে ফেলে দিলাম খাদের ভেতর। আশা করছি নিচে নেমে-যদি শেষ পর্যন্ত নামতে পারি-ওগুলো ফিরে পাবো।

ব্যস, প্রস্তুতি শেষ। এবার নামতে হবে। কিন্তু তবু আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলাম আমরা। ভয়ানক একটা কাজ করতে চলেছি। সফল না হওয়ার সম্ভাবনা শতকরা নিরানব্বই ভাগ। একটু মানসিক প্রস্তুতির প্রয়োজন আছে।

লিওর দিকে তাকালাম। আমার লিও। পাঁচ বছরের ছোট্টটি, যখন আমার কাছে এসেছিলো। এখন যৌবনোত্তীর্ণ প্রায়। দীর্ঘ সময়ে কখনও আলাদা হইনি আমরা। আজ যদি মৃত্যু আসে মরণের ওপারে গিয়েও এক সাথেই থাকতে চাই।

ও-ও তাকিয়ে আছে আমার দিকে। নির্বাক। তারপর নিচু, প্রায় ফিসফিস করে বললো, এসো।

পাশাপাশি দুটো বরফের খুঁটি ধরে নামতে শুরু করলাম। প্রথম কিছুক্ষণ মোটেই কঠিন মনে হল না কাজটাকে। দিব্যি খাদের গায়ে উঁচু হয়ে থাকা পাথরে পা বাধিয়ে নেমে যাচ্ছি দুজন। যদিও জানি, কোনোভাবে একবার হাত ফস্কালে যাত্রা করতে হবে মহাপ্রস্থানের পথে। তবে আমরাও কম নই। যথেষ্ট শক্তিশালী, এবং বাওয়া-ছাওয়ার কাজে দক্ষ। তাছাড়া এধরনের পরিবেশ সম্পর্কে পূর্ব অভিজ্ঞতা আছে।

প্রায় শখানেক ফুট নেমে থামলাম আমরা। খাদের গায়ে বেরিয়ে থাকা বিরাট একটা পাথরের চাইয়ে পা ঠেকিয়ে সাবধানে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালাম নিচের দিকে। যা দেখলাম, সত্যি কথা বলতে কি, ভয়ঙ্কর বললেও কম বলা হয়। একশো কি সোয়াশো ফুট নিচে খাদের গা তীক্ষ্ণ্ণ একটা বাঁক নিয়ে ক্রমশ ঢালু হয়ে এগিয়ে গেছে মাঝখানের দিকে। ওটার জন্যে যাদের তল দেখতে পাচ্ছি না।

আবার নামতে শুরু করলাম। এবার আর আগের মতো সহজ মনে হচ্ছে না। কারণ প্রথমত, সামান্য হলেও ক্লান্ত হয়েছি, দ্বিতীয়ত, খাদের গায়ে উঁচু হয়ে থাকা পাথরের সংখ্যা কমে গেছে অনেক। পায়ের নিচে কোনো অবলম্বন পাচ্ছি না। একেকবার মুহূর্তের জন্যে হাত ফস্কে যাচ্ছে, সড়সড় করে নেমে যাচ্ছি কয়েক ফুট; আঁতকে উঠে শক্ত করে আঁকড়ে ধরছি বরফের খুঁটি বা ভাগ্যক্রমে পায়ের নিচে পেয়ে যাচ্ছি কোনো পাথর। কোমরে বাধা দড়ি খুব সাহায্য করছে। পাথর বা বরফের খাজে ওটার আলগা মাথা বাঁধিয়ে নামছি। অন্য একটা পাথরে পৌঁছে টেনেটুনে ছাড়িয়ে নিচ্ছি মাথাটা, তারপর আবার আরেকটা খাঁজে বাধিয়ে দিয়ে নেমে যাচ্ছি।

অবশেষে পৌঁছুলাম বাকটার কাছে। অর্থাৎ প্রায় আড়াই শো ফুট নেমে আসতে পেরেছি। ধারণা করছি আর শ দেড়েক ফুট নামতে পারলেই তলে পৌঁছে যাবো। কিন্তু সত্যি কি দেড়শো ফুট, না আরও বেশি? কি করে জানা যায়?

দেখতে হবে, বললো লিও।

বুঝলাম, কিন্তু কি করে? একটাই মাত্র উপায় আছে, বিপজ্জনক ঢালু কিনারে গিয়ে উঁকি দেওয়া। একই সাথে ব্যাপারটা অনুধাবন করলাম দুজন। যাওয়ার জন্যে পা বাড়ালাম আমি।

না, বাধা দিলো লিও, আমার বয়েস কম, শক্তিও তোমার চেয়ে বেশি। আমিই যাবো। এসো, আমাকে সাহায্য করো। কোমরের দড়িটা শক্ত করে একটা পাথরের কোনার সাথে বাঁধলো ও। তারপর বললো, এবার ধরো আমার গোড়ালি।

ব্যাপারটা পাগলামি মনে হলো আমার কাছে। কিন্তু উপায়ও নেই এছাড়া। সুতরাং সময় নষ্ট না করে ছোট্ট একটা খুঁজে পা আটকে বসলাম। তারপর লিওর গোড়ালি দুটো ধরে ধীরে ধীরে শরীর ঝুঁকিয়ে দিলাম। হাত প্রসারিত করে দিলাম যতদূর যায়। বুকে ভর দিয়ে একটু একটু করে এগিয়ে গেল লিও। সামনের দিকে মুখ। একটু পরে ওর শরীরের অর্ধেকটা চলে গেল বাঁকের কিনারার আড়ালে।

তারপর হঠাৎ, দড়ি ছুটে গেল বলে না লিওর হাত ফস্কে গেল বলে জানি না, ওর সম্পূর্ণ শরীরের ওজন অনুভব করলাম আমার হাতে। হ্যাচকা এক টানে আমার হাত ছুটে গেল ওর গোড়ালি থেকে। আতঙ্কে হিম হয়ে গেলাম আমি। গলা চিরে তীক্ষ্ণ্ণ আর্তনাদের মত বেরিয়ে এলো একটা শব্দ: লিও!

লিও-ও-ও! আবার চিৎকার করলাম আমি। পরমুহূর্তে অস্পষ্ট একটা আওয়াজ ভেসে এলো আমার কানে-এসো। (পরে জেনেছিলাম, আসলে লিও বলতে চেয়েছিল, এসো না।)।

এক ঝটকায় সোজা হয়ে বসলাম। তারপর আর কোনো ভাবনা চিন্তার ধার ধেরে এগিয়ে যেতে লাগলাম ঘষটে ঘষটে। দুসেকেণ্ডের মাথায় বাকের কিনারে পৌঁছুলাম। তিনের মাথায় টপকে ওপাশে।

অপ্রশস্ত একটা বরফের ঢল নেমে গেছে বাঁকের কিনার থেকে। খুব খাড়া নয়। লম্বায় ফুট পনেরো হবে। ক্রমশ সরু হতে হতে সংকীর্ণ, খুব বেশি হলে মানুষের হাতের সমান মোটা একটা শৈল-তাকে গিয়ে শেষ হয়েছে ঢালটা। যে গতিতে কিনারে এসেছি সেই একই গতিতে পিছলে নেমে যেতে লাগলাম। নিজের অজান্তেই হাত দুটো ছড়িয়ে গেল দুপাশে। মুহূর্ত-পরে পা ঠেকলো শৈল-তাকে। হুমড়ি খেয়ে পড়ে যাচ্ছি, এমন সময় ছড়িয়ে থাকা দুহাতের নিচে অনুভব করলাম কর্কশ কিছু একটা সম্ভবত বরফ, পাথরও হতে পারে। খপ করে খামচে ধরলাম সেটা। কোনোমতে রোধ করতে পারলাম পতনটা।

তারপর দেখতে পেলাম সব। আমার শিরা উপশিরার ভেতর রক্ত জমাট বেঁধে গেল যেন! চামড়ার দড়ির প্রান্তটা আটকে গেছে শৈল-তাকের একটা খাঁজে। চার পাঁচ ফুট নিচে শূন্যে ঝুলছে লিও। ধীর অলস ভঙ্গিতে পাক খাচ্ছে ওর শরীর। নিচে হাঁ করে আছে অন্ধকার গহুর। কত নিচে যে এর তল বুঝতে পারলাম না। শুধু দেখলাম অন্ধকার যেখানে শেষ হয়েছে তারও বহু নিচে সাদা কি যেন। বরফই হবে হয়তো। কিন্তু হায়! কিছুই করার নেই আমার। যদি এক চুল নড়ি বা হাত আলগা করি ঐ গহ্বরে উল্টে পড়বো আমি নিজে। অন্যদিকে কোনোক্রমে যদি চামড়ার রশিটা খাঁজ থেকে ছুটে যায় পড়ে যাবে লিও। আমি এখন কি করবো? ওহ্, ঈশ্বর! বলো বলো, আফ্রিকি করবো?

.

সময় যেন থেমে গেছে। কতক্ষণ হয়েছে জানি না, সেই একই অবস্থায় আছি আমি। চারদিক নিস্তব্ধ। সামর্নে খাদের প্রায় কালো গা। শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি। তারপর, হঠাৎ একটা ঝলকানি দেখতে পেলাম কালোর ভেতর, এবং মৃদু একটা শব্দ নিস্তব্ধতার ভেতর। ঝলকটা ছোরার। কোমরের খাপ থেকে খুলে এনেছে লিও। শব্দটাও বেরিয়েছে লিওর মুখ থেকেই। তীব্র আক্রোশে দুর্বোধ্য একটা চিৎকার করে চামড়ার দড়িতে ছোরা চালাচ্ছে ও। তৃতীয় পোঁচেই কেটে গেল চামড়ার সরু ফালি।

আমি দেখলাম, দুটুকরো হয়ে গেল ওটা। এক অংশ লিওকে নিয়ে চলে গেল সর্বগ্রাসী অন্ধকারের দিকে। অন্য অংশটা সৎ করে উঠে গেল ওপরে। তারপর একবার নিচে একবার ওপরে লাফাতে লাগলো দুলে দুলে।

এক সেকেণ্ড পর নিচ থেকে ভেসে এলো ভারি কিছু পতনের আওয়াজ। পেঁতলে গেল লিওর শরীর! সেই মুহূর্তে আমি অনুভব করলাম লিও আমার কাছে কি ছিলো। লিও নেই মনে হতেই সারা শরীর শিথিল হয়ে এলো আমার। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে সংবিৎ ফিরলো। শরীর টান করে দাঁড়ালাম। আকাশের দিকে তাকালাম একবার চিষ্কার করে উঠলাম, আসছি, লিও! মাথার ওপর দুহাত তুলে সাঁতারু যেভাবে পানিতে ঝাঁপ দেয় সেই ভঙ্গিতে লাফিয়ে পড়লাম কালো খাদের ভেতর।

০৬-১০. শূন্যের ভেতর দিয়ে পড়ছি

০৬.

শূন্যের ভেতর দিয়ে পড়ছি। এখনও সম্পূর্ণ সচেতন আমি। যে কোনো মুহূর্তে কঠিন কিছুর ওপর আছড়ে পড়বে আমার দেহ। তারপর সব শেষ!

ঝপাং! কেন ঝপাং কেন? শব্দ তো হওয়ার কথা ধপ্ বা ধুপ! কি আশ্চর্য! আমি এখনও বেঁচে আছি! কি করে তা সম্ভব?

একটাই উত্তর, পানিতে পড়েছি।

হ্যাঁ, তাই। পানিতে পড়েছি আমি। বরফের মতো ঠাণ্ডা পানি চারপাশ থেকে পেঁচিয়ে ধরেছে। আর আমি ক্রমশ নিচে চলে যাচ্ছি। আরও নিচে, আরও নিচে। মনে হলো আর কখনোই বোধহয় উঠতে পারবো না এই অতল পানির তল থেকে। কিন্তু না, পারলাম শেষ পর্যন্ত। বাতাসের অভাবে ফুসফুস যখন ফেটে যাবে ঠিক তার আগের মুহূর্তে পানির ওপর ভেসে উঠলো আমার মাথা।

ওহ! সে মুহূর্তের আনন্দ আমি কি করে প্রকাশ করবো? নিশ্চিত মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে এলে মানুষের মনের অবস্থা কেমন হতে পারে? কিন্তু-কিন্তু, লিও কোথায়? আমি যেমন বেঁচে গেছি ওর-ও তো তেমনি বেঁচে যাওয়ার কথা! পা দিয়ে পানি কাটতে কাটতে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালাম চারদিকে।

মাত্র দশ গজ দূরে দেখতে পেলাম লিওকে। ওর সোনালি চুল আর দাড়ি থেকে পানি গড়িয়ে পড়ছে। বেঁচে আছে লিও! কি অপার স্বস্তি যে অনুভব করলাম বুকের ভেতর! ও-ও আমাকে দেখেছে। হাঁ হয়ে গেছে ধূসর চোখ দুটো। এক্ষুণি কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসবে যেন।

দুজনই তাহলে বেঁচে আছি এখনও! উৎফুল্ল কণ্ঠে চিৎকার করে উঠলো ও। খাদ উধাও! বলেছিলাম না, অদৃশ্য শক্তি পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে আমাদের।

হ্যাঁ, কিন্তু কোথায়? বললাম আমি। তারপরেই সচেতন হলাম, আমরা একা নই। নদীর পাড়ে, আমাদের গজ তিরিশেক দূরে দাঁড়িয়ে আছে দুটো মূর্তি একজন পুরুষ, লম্বা একটা লাঠিতে ভর দিয়ে ঝুঁকে আছে সামনের দিকে, আর এক রমণী। লোকটা বৃদ্ধ, অত্যন্ত বৃদ্ধ, তুষারের মতো সাদা চুল দাড়ি নেমে এসেছে কাঁধ আর বুকের ওপর। ছোট খাটো কুঁজো দেহটা মোমের মতো হলুদ। সন্ন্যাসীদের মতো দীর্ঘ আলখাল্লা পরনে। লাঠিতে ভর দিয়ে মূর্তির মত অনড় দাঁড়িয়ে আছে সে। আমাদের দেখছে। রমণী দীর্ঘদেহী। হাত উঁচিয়ে ইশারা করছে আমাদের দিকে।

এখন আমরা যেখানে আছি সেখানে নদী মোটামুটি শান্ত। অথচ তীরের কাছাকাছি মনে হচ্ছে স্রোত খুব বেশি। আন্দাজ করলাম নদী তলের অস্বাভাবিক গঠনের কারণে এমনটা হচ্ছে। দুজনে খুব কাছাকাছি থেকে পাড়ের দিকে সাঁতরাতে শুরু করলাম আমরা, যেন প্রয়োজন হলে একে অপরকে সাহায্য করতে পারি। সামান্য কয়েক গজ যাওয়ার পরই বুঝতে পারলাম প্রয়োজনটা কি প্রচণ্ড। তীরের কাছাকাছি স্রোত বেশি বুঝতে পারছিলাম, কিন্তু এতটা যে, কল্পনা করিনি। বন্যার তোড়ের মতো ভাসিয়ে নিয়ে যেতে লাগলো আমাদের।

লিও চিৎকার করে উঠলো, রশিটা ধরো, আমি ডুব দিচ্ছি।

ওর কোমরে বাঁধা দড়িটা খপ করে ধরলাম আমি। প্রাণপণ চেষ্টায় ডুব সাঁতার দিয়ে তীরের দিকে যেতে লাগলো লিও। আমিও ডুব দিয়েছি। এক হাতে যতটা সম্ভব জল কেটে এগোনোর চেষ্টা করছি। কিন্তু বেশিক্ষণ সুবিধা করতে পারলাম না। আমাদের গায়ের কাপড় ভিজে ভারি হয়ে উঠেছে। সীসার মতো টানছে নিচের দিকে। সেই সাথে ভয়ানক বেগে ভেসে চলেছি স্রোতের টানে।

দম শেষ হয়ে যেতেই ভেঙে উঠতে বাধ্য হলাম আমরা। একেবারে হতাশাজনক মনে হলো না পরিস্থিতি। বেশ খানিকটা চলে এসেছি তীরের দিকে। এমন সময় অবাক হয়ে দেখলাম সেই থুত্থুরে বুড়ো আশ্চর্য দ্রুত ছুটে এলো পাড়ের একেবারে কিনারে। তার দীর্ঘ লাঠিটা বাড়িয়ে ধরলো আমাদের দিকে।

সর্বশক্তিতে চেষ্টা চালালো লিও। ধরে ফেলতে পারলো লাঠির এক প্রান্ত। মুহূর্তে মন্দীভূত হয়ে এলো আমাদের গতি। শ্বাস নিলাম লম্বা করে। এক হাতে লাঠি, অন্য হাতটা বাড়িয়ে দিয়েছে বৃদ্ধ আমার দিকে। এমন সময় আবার দুর্ভাগ্য। মট করে ভেঙে গেল লাঠিটা। স্রোতের প্রবল টান অনুভব করলাম শরীরে। বৃদ্ধের হাত ধরার জন্যে হাত বাড়িয়ে দিলাম আমি। ধরতে পারলাম না। মুহূর্তের জন্যে দুটো হাত ছোঁয়াছুঁয়ি হলো শুধু। এই সময় অদ্ভুত এক কাজ করলো রমণী। ইতিমধ্যে সে-ও এসে দাঁড়িয়েছে বৃদ্ধের পাশে। লাঠিটা ভেঙে যেতেই ঝাঁপিয়ে পানিতে নেমে এলো সে। বিদ্যুৎগতিতে হাত বাড়িয়ে এক হাতে ধরে ফেললো লিওর চুল, অন্য হাতে আঁকড়ে ধরলো বৃদ্ধের একটা বাহুঁ। এই সময় ক্ষণিকের জন্যে পায়ের নিচে মাটি পেলো লিও। সঙ্গে সঙ্গে ও হাত বাড়িয়ে ধরে ফেললো মেয়েটার ক্ষীণ কটি, অন্য হাতে আমাকে। তারপর কিছুক্ষণ ধস্তাধস্তি। অবশেষে তীরে উঠলাম আমরা। মাটিতে শুয়ে পড়ে হাপাতে লাগলাম হাপরের মতো।

শ্বাস-প্রশ্বাস একটু স্বাভাবিক হতে মুখ তুলে তাকালাম আমি। দাঁড়িয়ে আছে মেয়েটা। কাপড় থেকে পানি ঝরে পড়ছে টপ টপ করে। লিওর দিকে তাকিয়ে আছে সে। চোখে স্বপ্নাচ্ছন্নের দৃষ্টি। কপালের কোনায় একটা কাটা দাগ, একটু আগে ধস্তাধস্তির সময় হয়েছে। রক্ত গড়িয়ে পড়ছে তা থেকে। তবু তার সৌন্দর্য আমার চোখ কাড়লো। সংবিৎ ফিরলো মেয়েটার। চকিতে একবার তাকাল তার ভরাট শরীরের সাথে সেঁটে থাকা পোশাকের দিকে। সঙ্গীকে কি যেন বলে দ্রুত ছুটে চলে গেল একটা পাহাড়ের আড়ালে।

আমরা শুয়ে আছি। ক্লান্ত, বিধ্বস্ত। পাশে বসে আছে বৃদ্ধ। ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালো সে। ভাষাহীন দৃষ্টি আমাদের ওপর নিবদ্ধ। মৃদু স্বরে কিছু বললো। ভাষাটা বুঝতে পারলাম না আমরা। এরপর অন্য একটা ভাষায় কথা বললো সে। এবারও তা দুর্বোধ্য শোনালো আমাদের কানে। তৃতীয়বার চেষ্টা করলো বৃদ্ধ। সাথে সাথে কান খাড়া হয়ে উঠল আমাদের। গ্রীক! হ্যাঁ, মধ্য এশিয়ার এক অজ এলাকায় গ্রীক-এ কথা বলছে অশীতিপর এক বৃদ্ধ! খুব বিশুদ্ধ নয় যদিও, তবু গ্রীক।

তোমরা কি যাদুকর? বললো সে, জ্যান্ত পৌঁছেছে এদেশে!

না, জবাব দিলাম আমি, একই ভাষায়। তা-ই যদি হতো তাহলে অন্য রাস্তায় আসতাম।

প্রাচীন ভাষাটা জানে ওরা! পাহাড়ের ওপর থেকে যা বলে দেয়া হয়েছে তার সাথে মিলে যাচ্ছে! নিজের মনে বিড়বিড় করলো বৃদ্ধ। তারপর জিজ্ঞেস করলো–

কি চাও তোমরা, বিদেশী?

সাথে সাথে কোনো জবাব দিলাম না আমি। ভাবছি কি বলবো সত্যি কথা বললে যদি আবার ঠেলে ফেলে দেয় ঐ ভয়ঙ্কর নদীতে! কিন্তু লিও অত ভাবনা চিন্তার ধার ধারলো না।

আমরা খুঁজছি, সরাসরি বললো ও। আমরা খুঁজছি অগ্নি-পর্বত, যার চূড়া জীবনের প্রতীক দিয়ে শোভিত।

নিষ্পলক চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো লোকটা। তার মানে তোমরা জানো! কাকে চাও ওখানে?

উঠে বসলো লিও। ঝাঁঝের সঙ্গে জবাব দিলো, রানীকে।

আমার ধারণা পূজারিণী বা দেবী বোঝাতে চেয়েছে লিও, কিন্তু গ্রীক-এ রানী ছাড়া আর কোনো শব্দ আসেনি ওর মাথায়।

ও! তোমরা একজন রানীকে খুঁজছে…তারমানে তোমাদের ওপর নজর রাখার জন্যেই আমাদের পাঠানো হয়েছে! না,..কি করে আমি নিশ্চিত হবো?

এটা একটা জিজ্ঞাসাবাদের সময় হলো? রেগে গেলাম আমি। আগে আমার একটা প্রশ্নের উত্তর দিন: আপনি কে?

আমি? শোনো বিদেশীরা, আমার পদবী হলো তোরণের অভিভাবক, আর আমার সাথে যে মহিলাকে দেখলে সে হচ্ছে কালুন-এর খানিয়া।

এই সময় হঠাৎ মাথা ঘুরে উঠল লিওর। টলে উঠে পড়ে যেতে লাগলো। লাফিয়ে উঠে ধরলাম আমি ওকে।

লোকটা দেখি অসুস্থ! ব্যস্ত কণ্ঠে বলল বৃদ্ধ। চলো চলো, এক্ষুণি আশ্রয় দরকার তোমাদের।

দুপাশ থেকে দুজন ধরে আস্তে আস্তে হাঁটিয়ে নিয়ে চললাম লিওকে। নদীর পাড়ে সামান্য একটু ফাঁকা জায়গা। তারপর পাহাড়ী এলাকা। সরু আঁকাবাঁকা একটা গিরিপথ চলে গেছে দুই পাহাড়ের মাঝ দিয়ে। সেই পথে চলতে লাগলাম আমরা।

গিরিপথ যেখানে শেষ হয়েছে, সেখানেই এক বনের শুরু। বন পেরিয়ে দেখতে পেলাম তোরণটা। খুব দুর্বল লাগছে বলে ভালো করে খেয়াল করতে পারলাম না ওটা। শুধু মনে আছে, দুদিকে বিস্তৃত বিরাট এক পাথুরে দেয়ালের মাঝখানে একটা গর্ত। তার ভেতর দিয়ে চলে গেছে পথ। এই গর্তের এক পাশে একটা সিঁড়ি। প্রায় অচেতন লিওকে নিয়ে অতিকষ্টে সিঁড়ির প্রথম ধাপটা উঠলাম। তারপর পুরোপুরি অজ্ঞান হয়ে একটা পুটুলির মতো বসে পড়লো লিও।

কি করা যায় ভাবছি এমন সময় পদশব্দ শুনে ওপর দিকে তাকালাম। দেখলাম সেই রমণী সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসছে। তার পেছনে ঢিলে ঢালা পোশাক পরা দুজন মানুষ। আকর্ষণীয় কিন্তু ভাবলেশহীন চেহারা তাদের। হলদেটে ত্বক, ছোট ছোট চোখ। আমাদের দেখে বিন্দুমাত্র আশ্চর্য হলো না তারা, যেন জানাই ছিলো আমরা আসবো। ওদের দিকে তাকিয়ে কিছু বললো মহিলা। লিওর ভারি দেহটা তুলে নিলো তারা। সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেল ওপরে।

অনুসরণ করে একটা কামরায় পৌঁছুলাম আমরা। তোরণের ওপরে পাথর খোদাই করে তৈরি ঘরটা। এখানে আমাদের রেখে চলে গেল খানিয়া নামের সেই রমণী। এই কামরা থেকে আরও কয়েকটা ঘরের ভেতর দিয়ে গিয়ে অন্য একটা কক্ষে পৌঁছুলাম। দেখে মনে হলো শোয়ার ঘর। দুটো কাঠের খাট পাতা। ওপরে জাজিম, কম্বল, বালিশ। একটা খাটে শুইয়ে দেয়া হল লিওকে। বৃদ্ধ অভিভাবক ভৃত্যদের একজনের সহযোগিতায় ওর সব কাপড়-চোপড় খুলে ফেললো, আমাকেও ইশারায় বললো আমারগুলো খুলে ফেলতে। তারপর শিস বাজালো একবার।

অন্য এক ভৃত্য পাত্রভর্তি গরম পানি নিয়ে এলো। ভালো করে রগড়ে গা ধুয়ে ফেললাম আমি। লিওকে ধুইয়ে দিলো বৃদ্ধ নিজে। তারপর এক ধরনের মলম লাগিয়ে পট্টি বেঁধে দিলো আমাদের ক্ষতগুলোয়। কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লাম আমি। লিওকেও কম্বল চাপা দেয়া হল। এরপর খাওয়ার জন্যে সুরুয়া মতো এক ধরনের জিনিস এলো। বৃদ্ধ ওষুধ মেশালো তাতে। অর্ধেক একটা বাটিতে ঢেলে আমার দিকে এগিয়ে দিলো, বাকিটা লিওর মাথা হাঁটুর ওপর নিয়ে ওর গলায় ঢেলে দিলো সে। মুহূর্তে অদ্ভুত এক উষ্ণতা বয়ে গেল আমার শরীর বেয়ে। যন্ত্রণাকাতর মস্তিষ্কটা হালকা হয়ে যেতে লাগলো। তারপর আর কিছু মনে নেই।

একটানা কয়েক সপ্তাহ কাটলো কখনও অচেতন, কখনও অর্ধচেতন ভাবে। সম্পূর্ণ সচেতন একবারও হইনি এই সময়ে। যে সময়গুলোয় অর্ধচেতন ছিলাম তখনকার স্মৃতি কিছু কিছু মনে আছে। এছাড়া আর সব শূন্য, অন্ধকার।

একদিনের কথা একটু একটু মনে পড়ে। হলদে মুখো সেই বুড়ো বুকে আছে আমার ওপর, জানালা দিয়ে চাঁদের আলো এসে পড়েছে তার মুখে। সাদা চুল দাড়িতে অশরীরী আত্মার মতো লাগছে তাকে। তীক্ষ্ণ্ণ চোখে তাকিয়ে আছে আমার চোখের দিকে, আমার মনে যত গোপন কথা সবুয়েন জেনে নেবে।

এরাই সেই লোক, বিড়বিড় করে বললো সে। কোনো সন্দেহ নেই, এরাই। তারপর জানালার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। আকুল নয়নে তাকিয়ে রইলো। আকাশের দিকে।

আরেক দিনের কথা মনে আছে, নারীকণ্ঠের আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেল আমার—সেই আগের মতো ঘুম ভাঙা, তন্দ্রাচ্ছন্ন ভাব, যেন স্বপ্ন দেখছি। চোখ মেলে দেখলাম আমাদের বাঁচিয়েছিলো যে, সেই রমণী। ভারি একটা আলখাল্লা পরনে, দাঁড়িয়ে আছে আমার পাশে। আমার মুখের দিকে তাকালো। বিতৃষ্ণায় কুঁচকে উঠলো তার ভুরু। মুখ ফিরিয়ে অভিভাবককে কি যেন বললো। সম্ভবত আমার কুৎসিত চেহারার কথা। তারপর লঘু পায়ে গিয়ে দাঁড়ালো লিওর বিছানার পাশে। খটখটে একটা কাঠের টুল টেনে বসলো। ভয়ঙ্কর একাগ্রতায় তাকিয়ে রইলো ওর দিকে।

অনেক, অনেকক্ষণ দেখলো সে লিওকে। তারপর উঠে পায়চারি করতে লাগল কামরার এমাথা ওমাথা। হাত দুটো ভাজ করে রাখা বুকের ওপর, কুঁচকে আছে ভূদুটো, মুখে তীব্র এক আকুতি; যেন কিছু একটা মনে করার চেষ্টা করছে, পারছে না।

কোথায়, কখন? নিজের মনে ফিসফিস করলো সে। ওহ! কোথায়, কবে?

এই দৃশ্যের শেষে কি ঘটেছিলো জানে না। কারণ আবার ঘুমিয়ে পড়েছিলাম আমি।

আবার, কঘণ্টা বা কত দিন পরে জানি না, একটু সজাগ হলাম আমি। তখন রাত। শুধু মাত্র চাঁদের আলোয় সামান্য আলোকিত ঘরটা। লিওর বিছানায় সরাসরি পড়েছে আলো। সেই আলোয় দেখলাম, বিছানার পাশে বসে আছে মেয়েটা। তাকিয়ে আছে লিওর মুখের দিকে।

অনেকক্ষণ কেটে গেল এভাবে। ও দেখছে লিওকে, আমি দেখছি ওকে। হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে চুপি চুপি আমার বিছানার দিকে এগিয়ে আসতে লাগলো মেয়েটা। ঘুমের ভান করে চোখ বুজে ফেললাম আমি।

সম্পূর্ণ সজ্ঞান না হলেও কৌতূহল জেগেছে আমার মনে। কে এই নারী, তোরণের অভিভাবক যাকে বলেছে কালুন-এর খানিয়া? আমরা যাকে খুঁজছি এ-কি সে-ই? কেন নয়? কিন্তু…আয়শাকে দেখলে সঙ্গে সঙ্গে তো চিনতে পারার কথা ছিলো আমাদের। ওর সেই মুখ কি ভোলা যায়?

আবার লিওর বিছানার কাছে চলে গেল সে। হাঁটু গেড়ে বসলো। আগের মতোই অপলক নেত্রে তাকিয়ে রইলো ওর মুখের দিকে। নিঃশব্দে কেটে গেল কিছুক্ষণ। তারপর সে কথা বলতে শুরু করলো। খুব নিচু স্বরে, মঙ্গোলিয়ানের মিশেল দেয়া গ্রীকে।

আমার স্বপ্নের পুরুষ, ফিসফিস করে বললো সে। কোত্থেকে এসেছো? কে তুমি? হেসা কেন আমাকে আদেশ দিলো তোমার সাথে দেখা করার? এর পরের কয়েকটা বাক্য আমি বুঝতে পারলাম না। তারপর আবার, তুমি ঘুমিয়ে আছে। ঘুমের ভেতর তোমার চোখ খুলে গেছে। আমার কথার জবাব দাও, আমি জানতে চাইছি, তোমার আর আমার মাঝে কিসের বন্ধন? কেন আমি তোমাকে স্বপ্নে দেখেছি? কেন তোমাকে আমার চেনা চেনা মনে হয়। কেন? মিষ্টি কণ্ঠস্বরটা মিলিয়ে গেল ধীরে ধীরে।

ঝুঁকে পড়ল সে লিওর ওপর। এক গুচ্ছ চুল মূল্যবান মণিখচিত ফিতের বাঁধনচ্যুত হয়ে পড়ল ওর মুখে। জেগে উঠলো লিও। আমি যেমন জেগে, আধো ঘুম আধো জাগরণ, তেমন। ও হাত বাড়িয়ে ছুঁলো চুলের গোছাটা। তারপর ইংরেজিতে বললো–কোথায় আমি? ও, মনে পড়েছে, ওঠার চেষ্টা করতেই রমণীর চোখে চোখ পড়লো ওর। তখন আবার গ্রীকে বললো, তুমিই তো আমাকে খরস্রোতা নদী থেকে বাঁচিয়েছিলে। বলো, তুমিই কি সেই রানী যাকে আমি এদিন ধরে খুঁজছি?

জানি না, কাঁপা কাঁপা মৃদু মিষ্টি স্বরে জবাব দিল রমণী। এটুকু জানি, আমিও রানী-অবশ্য খানিয়াকে যদি রানী বলা যায়।

তাহলে বলো, রানী, আমাকে মনে আছে তোমার?

স্বপ্নে আমাদের দেখা হয়েছিলো, সে বললো, আমার মনে হয় দূর অতীতে কোনো এক সময় আমাদের দেখা হয়েছিলো। হা, নদীর কূলে যখন প্রথম তোমাকে দেখি, তখনই জেনেছিলাম-বিদেশী, অপরিচিত কিন্তু মুখটা চেনা চেনা লাগছিলো। বলো, তোমার নাম কি?

লিও ভিসি।

মাথা নাড়ল রমণী। না, এ নাম তো আমার পরিচিত নয়, তবু আমি তোমাকে চিনি।

তুমি আমাকে চেনো? কেমন করে? ভারি, জড়িত গলায় বলেই আবার ঘুমিয়ে গেল লিও।

গভীর মনোযোগের সাথে আবার কিছুক্ষণ দেখলো ওকে খানিয়া। তারপর হঠাৎ আস্তে আস্তে নেমে যেতে লাগলো তার মুখ। লিওর ঠোঁটের সাথে ঠোঁট লাগলো। হাত দুটো উঠে এলো আলিঙ্গনের ভঙ্গিতে। পরমুহূর্তে ছিটকে সরে এলো সে। চুল পর্যন্ত লাল হয়ে গেছে লজ্জায়।

এবার আমার দিকে চোখ পড়লো তার।

কখন যে সম্মোহিতের মতো উঠে বসেছি আমি নিজেও টের পাইনি। এস্ত পায়ে আমার পাশে এসে দাঁড়ালো সে।

তোমার এত সাহস? তীব্র বিদ্বেষ ভরা ফিসফিসে গলায় বললো রমণী। দ্রুত হাতে কোমরের কাছ থেকে টান দিলো কি যেন। পরক্ষণে দেখলাম, তার হাতে চক চক করছে একটা ছোরা। যে-কোনো মুহূর্তে ছুটে আসবে আমার হৃৎপিণ্ড লক্ষ্য করে। বিপদ বুঝতে বিলম্ব হলো না আমার। ওকে এগোতে দেখেই কম্পিত হাত বাড়িয়ে দিলাম সামনে।

ও! দয়া করো, দয়া করো। হাতের মতো গলাটাও কাঁপালাম নিখুঁত ভাবে। আমাকে একটু পানি দাও! জ্বর! জ্বলে যাচ্ছে ভেতরটা! উদভ্রান্তের মত চাইলাম চারপাশে। একটু চড়লো আমার গলা। কই, একটু পানি দাও! অভিভাবক, কই তুমি, একটু পানি দাও, পানি। তারপর ধপাস করে পড়ে গেলাম চিৎ হয়ে।

থেমে দাঁড়ালো খানিয়া। ছোরাটা খাপে পুরলো। পাশের একটা টেবিল থেকে এক বাটি দুধ নিয়ে এসে দাঁড়ালো আমার বিছানার পাশে। ঝুঁকে আমার ঠোঁটের কাছে ধরলো বাটিটা। ঘাড়টা সামান্য তুলে বুভুক্ষের মতো খেয়ে নিলাম দুধটুকু। দুধের স্বাদ এর চেয়ে খারাপ আর কোনোদিন লাগেনি আমার কাছে।

তুমি দেখি কাপছে! বললো সে। দুঃস্বপ্ন দেখেছো?

হ্যাঁ, বন্ধু। দেখলাম, ঐ ভয়ানক অন্ধকার খাদের ভেতর পড়ে যাচ্ছি আমি।

আর কিছু?

আর কি দেখব? নদীতে পড়ার আগেই ঘুম ভেঙে গেল।

সত্যি বলছো, আর কিছু দেখনি?

শপথ করে বলছি, রানী।

তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে জ্ঞান হারানোর ভান করলাম।

সত্যিই আমি আবার অচেতন হয়ে গেছি মনে করে জোরে জোরে কথা বলতে শুরু করলো বানিয়া।

ওহ কি শান্তি, বললো সে, লোকটা অন্য কোনো স্বপ্ন দেখেনি। না হলে মুশকিলই হতো-ওর জন্যেও, আমার জন্যেও। অত দূরের পথ পাড়ি দিয়ে এসেছে বেচারা, মরণ-শ্যপদের হাতে তুলে দিতে খারাপই লাগতো আমার। বুড়ো আর কুশ্রী হলেও মনে হয় জ্ঞানী লোকটা।

মরণ-শ্বাপদ জিনিসটা কি বুঝলাম না, তবু কথাটা শুনে কেমন একটা শিরশিরানি অনুভূতি হলো আমার শরীরে। ভয়ে শক্ত হয়ে রইলাম। এমন সময় সিঁড়িতে অভিভাবকের পদশব্দ শুনে স্বস্তি ফিরে এলো মনে। চোখ সামান্য ফাঁক করে দেখলাম, ঘরে ঢুকে রমণীকে কুর্নিশ করলো সে।

অসুস্থ দুজনের অবস্থা এখন কেমন, ভাতিঝি? শীতল কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো বৃদ্ধ।

এখনও অচেতন। দুজনই।

তাই নাকি? আমি তো ভেবেছিলাম ওরা বুঝি জেগে উঠেছে।

কি শুনেছো তুমি, শামান (অর্থাৎ যাদুকর)? আচমকা প্রশ্ন করে বসলো খানিয়া, গলার স্বর কঠোর।

আমি? কি আবার শুন্বো। খাপের ভেতর ছুরি ঢোকানোর শব্দ শুনলাম একবার, তারপর দূরে মরণ-শ্বাপদের ডাক।

আর, কি দেখেছো তোমার ঐ তোরণের ভেতর দিয়ে?

আশ্চর্য দৃশ্য, খানিয়া, ভাইঝি। অচেতন অবস্থায় উঠে বসে মানুষ!

হ্যাঁ। সুতরাং ঘুমিয়ে থাকতে থাকতেই এটাকে অন্য কামরায় নিয়ে যাও। অন্যজনের একটু বিশুদ্ধ বাতাস দরকার।

চোখের কোণ দিয়ে দেখলাম, অদ্ভুত এক অভিব্যক্তি ফুটে উঠেছে অভিভাবকের মুখে। একটু আগে ওর উপস্থিতিতে যে স্বস্তিটুকু পেয়েছিলাম তা উবে গেল।

কোন্ কামরায়, খানিয়া? অর্থপূর্ণ ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করলো সে।

আমার মনে হয় স্বাস্থ্যকর কোনো একটায়; যেখানে ও দ্রুত আরোগ্য লাভ করবে। লোকটা বুদ্ধিমান। তাছাড়া পাহাড়ের নির্দেশ, ওর কোনো ক্ষতি হলে বিপদ হবে।

দরজার কাছে গিয়ে শিস বাজালো অভিভাবক। তক্ষুণি ভৃত্যদের পদশব্দ শোনা গেল সিঁড়িতে। বৃদ্ধ কিছু একটা নির্দেশ দিলো তাদের। আলগোছে আমাকে সুদ্ধ জাজিমটা তুলে নিলো ওরা। বেশ কিছুক্ষণ হেঁটে, সিঁড়ি দিয়ে উঠে, নেমে, আবার হেঁটে অবশেষে আরেকটা বিছানায় নামিয়ে রাখলো আমাকে। বৃদ্ধ শামান আমার নাড়ী দেখলো। তারপর সত্যি সত্যিই ঘুমিয়ে গেলাম আমি।

ঘুম যখন ভাঙলো তখন পুরো দিন। যথেষ্ট ভালো বোধ করছি। মাথা পরিষ্কার, শরীর ঝরঝরে। বহু দিন এত ভালো বোধ করিনি। আগের রাতের সব কথা মনে পড়ে গেল। সাবধানে মনে মনে যাচাই করলাম সেগুলো। সব শেষে সিদ্ধান্তে এলাম, আমার বিপদ এখনও কাটেনি। হয়তো শুরু হয়েছে মাত্র।

.

অনেকগুলো প্রশ্নের জবাব পেলাম না। মরণ-শ্বাপদের ডাক মানে কি? আমাদের উদ্দেশ্য কি সিদ্ধির পথে? এই মহিলা-মানে খানিয়া-ই কি আয়শা? কেন ও আলিঙ্গন করলো লিওকে? নিঃসন্দেহে মেয়েটা দুশ্চরিত্রা নয়, তাছাড়া দুশ্চরিত্রা হলেও জীবন-মৃত্যুর মাঝামাঝি অবস্থান করছে এমন এক অপরিচিত লোককে আলিঙ্গন করা বোধহয় কোনো মেয়ের পক্ষেই সম্ভব নয়। যা ও করেছে, সত্যি সত্যি অবদমিত আবেগের উচ্ছাসেই করেছে। তাহলে?

নাকি খুবিলগান কোউ-এন-এর কথাই ঠিক? আইসিসের পূজারী ক্যালিক্রেটিস যার সঙ্গে পালিয়েছিলো সেই মিসরীয় রাজকন্যা আমেনার্তাস পুনর্জন্ম নিয়ে এসেছে? আমেনার্তাস আর এই নিয়া যদি একই নারী হয় তাহলে কি এবার অশুভের খেলা শুরু হবে? জানি না। কিছুই বুঝতে পারছি না। সত্য জানতে হবে আমাকে। কিন্তু কি ভাবে।

দরজা খুলে গেল। বৃদ্ধ যাদুকর ঢুকলো ঘরে কৃত্রিম একটা হাসি লেগে আছে ঠোঁটে। আমার সামনে এসে দাঁড়ালো।

.

০৭.

কেমন আছো, বিদেশী? জিজ্ঞেস করলো শামান।

ভালো, জবাব দিলাম। অনেক ভালো—কিন্তু আপনার নামটা তো এখনও জানা হলো না।

সিমব্রি। আর আমার পদবী তো আগেই বলেছি, তোরণের অভিভাবক। বংশানুক্রমে আমরা এই পদবীর অধিকারী। পেশায় চিকিৎসক।

চিকিৎসক! আমি তো মনে করেছিলাম আপনি যাদুকর।

অদ্ভুত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালো সিমব্রি। না, যাদুকর না, চিকিৎসক। তোমাদের ভাগ্য ভালো, এ বিষয়ে আমার কিছু পারদর্শিতা আছে, না হলে আজ পর্যন্ত বেঁচে থাকতে না। যাক, তোমার নামটা এবার বলো।

হলি।

আহ, হলি!

আপনি কি আগেই টের পেয়েছিলেন আমরা আসবো, তাই খানিয়াকে নিয়ে গিয়েছিলেন ঐ ভয়ঙ্কর নদীর পাড়ে? এ ছাড়া তো আর কোনো কারণ দেখছি না। সে জন্যেই মনে হলো আপনি হয়তো যাদুকর, গণাপড়া করে আগেই ভবিষ্যৎ। জেনে যান। অবশ্য নিছক মাছ ধরার জন্যেও গিয়ে থাকতে পারেন, ঠিক জানি না।

নিশ্চয়ই ধরার জন্যে গিয়েছিলাম—তবে মাছ নয় মানুষ। দুটো ধরেছিও।

আগে থাকতেই জানতেন আমরা আসবো?

অনেকটা। অতি সম্প্রতি আমাকে জানানো হয়েছে তোমরা আসছে। দিনক্ষণ অবশ্য বলা হয়নি। তোমাদের অপেক্ষাতেই আমরা ছিলাম ওখানে। এখন বলো তো, ঐ দুর্গম পথ পেরিয়ে এলে কি করে?

ধরুন আমরা যাদু জানি।

জানি না। জানতেও পারো। কিন্তু কি খুঁজছে তোমরা? তোমার সঙ্গী এক রানীর কথা বলছিলো…।

সত্যিই? ও বলছিলো? আশ্চর্য! এক রানীর খোঁজ তো ও পেয়েই গেছে। আমাদের যে বাঁচিয়েছে সে নিশ্চই রানী, ন।

হ্যাঁ। খুব বড় রানী। আমাদের দেশে খানিয়া মানেই রানী। কিন্তু, বন্ধু হলি, অচেতন একজন মানুষ একথা জানলো কি করে বুঝতে পারছি না। আর আমাদের ভাষা-ই বা তোমরা শিখলে কোথায়?

খুব সোজা, ভাষাটা প্রাচীন। আমাদের দেশে এখনও এর চর্চা হয়। গ্রীসের মানুষ এখনও এ ভাষায় কথা বলে। কিন্তু আমি অবাক হচ্ছি, এই দুর্গম এলাকায় এ ভাষা এলো কি করে?

বলছি শোনো, শুরু করলো বৃদ্ধ। অনেক অনেক পুরুষ আগে এ-ভাষায় কথা বলে এমন এক জাতির মাঝে মহান এক দিগ্বিজয়ীর জন্ম হয়েছিলো। দেশ জয় করতে করতে আমাদের দেশের দক্ষিণ অঞ্চল পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিলেন তিনি। এর পর ভাগ্যদেবী বিমুখ হলেন। স্থানীয় এক জাতির কাছে পরাজিত হলেন তিনি। কিন্তু তার-ই এক সেনাপতি—এই সেনাপতি অবশ্য অন্য এক গোত্রের লোক, অন্যপথে এসে জয় করে নিলেন দেশটা। সেই সাথে তার প্রভুর ভাষাও এলো। এদেশে এক নতুন রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করলেন তিনি। মরুভূমি আর দুর্গম পাহাড়ে ঘেরা বলে বাইরের দুনিয়ার সাথে কোনো যোগাযোগ রইলো না দেশটার। এখনও নেই।

হ্যাঁ, এ গল্প আমি জানি। দিগ্বিজয়ীর নাম আলেকজাণ্ডার তাই না?

হ্যাঁ। আর সেই সেনাপতির নাম র‍্যাসেন, মিশর নামের এক দেশের লোক তিনি। তারই বংশধররা এখনও শাসন করছে এ দেশ।

এই সেনাপতি, যার নাম বলছেন র‍্যাসেন, তিনি আইসিস নামের এক দেবীর উপাসক ছিলেন না?

না, জবাব দিলো বৃদ্ধ শামান সিমব্রি। সেই দেবীর নাম হেস।

হ্যাঁ, হ্যাঁ, আইসিসেরই আরেক নাম হেস। একটা কথা বলুন তো, এখনও কি তার উপাসনা হয় এদেশে? জানতে চাইছি, কারণ, আইসিসের নিজের দেশ মিশরেই এখন তাঁর পূজা বন্ধ হয়ে গেছে।

ওদিকের ঐ নিঃসঙ্গ পাহাড়ে একটা মন্দির আছে। ঐ মন্দিরের পূজারী পূজারিণীরা কিছু প্রাচীন অনুশাসনের চর্চা করে। কিন্তু সাধারণ মানুষের প্রকৃত দেবতা র‍্যাসেনের বিজয়ের আগে যা ছিলো এখনও তা-ই আছে—ঐ পাহাড় থেকে বেরিয়ে আসা আগুন।

ওখানে এক দেবী আছেন না?

শীতল চোখে আমার মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো বৃদ্ধ। তারপর জবাব দিলো, কোনো দেবীর কথা আমি জানি না। ওটা পবিত্র পাহাড়। ওর রহস্য জানতে চাওয়া মানে মৃত্যু। এসব কথা কেন জিজ্ঞেস করছো?

প্রাচীন ধর্মমতগুলোর ব্যাপারে আমার একটু কৌতূহল আছে তাই।

ভালো কথা। কিন্তু এক্ষেত্রে তোমাকে পরামর্শ দেবো, কৌতূহল দমন করো। নইলে অহেতুক মরণ-শ্বাপদ বা জংলীদের বল্লমের মুখে প্রাণ হারাবে।

মরণ-শ্বাপদটা আবার কি?

এক ধরনের কুকুর। যারা খানের ইচ্ছার বিরুদ্ধে যায় আমাদের সনাতন প্রথা অনুযায়ী তাদের ছেড়ে দেয়া হয় ঐ কুকুরের মুখে।

খান! আপনাদের এই খানিয়ার স্বামী আছে তাহলে?

হ্যাঁ। ওরই চাচাতো ভাই। দেশের অর্ধেকের শাসক ছিলো ও। এখন ওরা এক, ওদের রাজ্যও এক। কিন্তু যথেষ্ট কথা বলে ফেলেছো, আর না। তোমার খাবার তৈরি। চলে যাওয়ার জন্যে ঘুরে দাঁড়ালো বৃদ্ধ।

আর একটা প্রশ্ন, বন্ধু সিমব্রি। আমি এঘরে এলাম কি করে? আর আমার সঙ্গী-ই বা কোথায়?

যখন ঘুমিয়ে ছিলে তখন তোমাকে নিয়ে আসা হয়েছে এখানে। দেখতেই পাচ্ছো তাতে তোমার উপকার হয়েছে। কিছু মনে নেই তোমার?

একেবারেই না। আমার বন্ধু কোথায় বললেন না?

ভালোই আছে। খানিয়া আতেন ওর সেবা-শুশ্রুষা করছে।

আতেন! এ নাম তো প্রাচীন মিশরে প্রচলিত ছিলো। এ নামের এক মহিলার কথা পড়েছি, হাজার হাজার বছর আগে সৌন্দর্যের জন্যে বিখ্যাত ছিলো।

আমার ভাইঝি আতেন কি সুন্দরী নয়?

কি করে বলবো? কয়েক মুহূর্তের জন্যে মাত্র দেখেছি। তা-ও কি অবস্থায় তা নিশ্চয়ই আপনার মনে আছে? আমার এ প্রশ্নের জবাব না দিয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল শামান সিমব্রি। ভৃত্যরা আমার খাবার নিয়ে এলো। একটু পরে আবার দরজা খুলে গেল। খানিয়া আতেন ঢুকলো ঘরে। সঙ্গে কোনো রক্ষী নেই। ওকে দেখেই সন্ত্রস্ত হয়ে উঠলাম আমি। মনে পড়ে গেল কাল রাতের কথা। আমার মনের ভাব যেন বুঝতে পারলো সে। বললো-শুয়ে থাকো, ভয়ের কিছু নেই। অন্তত এই মুহূর্তে আমি তোমার কোনো অনিষ্ট করবো না। এখন বলো, ঐ লোকটা, লিও, তোমার কে? ছেলে? উঁহু,বলতে হচ্ছে বলে দুঃখিত, অন্ধকার থেকে আলোর জন্ম হতে পারে না।

আমি অবশ্য তা-ই ভেবে এসেছি সারাজীবন। যা হোক, আপনার ধারণাই ঠিক, খানিয়া। ও আমার পালিত পুত্র।

এখানে কি জন্যে, কি খুঁজতে এসেছো? জিজ্ঞেস করলো খানিয়া।

আমরা খুঁজছি–আঁ.., ঐ পাহাড়ে ভাগ্য আমাদের যা পাইয়ে দেয়।

একটু ফ্যাকাসে হয়ে গেল আতেনের মুখ। তবু শান্তগলায় বললো, ওখানে শাস্তি ছাড়া কিছু পাবে না, অবশ্য যদি ও পর্যন্ত পৌঁছুতে পারো। আমার ধারণা তার আগেই জংলীদের হাতে মারা পড়বে। জংলীরা ঐ পাহাড়ের ঢাল পাহারা দেয়। হেস-এর মঠ ওখানে। ঐ মঠের পবিত্রতা ক্ষুণ্ণ করার একমাত্র শাস্তি মৃত্যু, অনন্ত আগুনে ছুঁড়ে ফেলে দেয়া হবে।

ঐ মঠের প্রধান কে, খানিয়া? এক পূজারিণী?

হ্যাঁ, এক পূজারিণী, তার মুখ আমি কখনও দেখিনি। ও এত বুড়ি যে সব সময় ঘোমটা টেনে মুখ ঢেকে রাখে।

আঁ! ঘোমটা টেনে রাখে! অনুভব করছি শিরায় শিরায় রক্ত চলাচল দ্রুত হয়ে উঠছে আমার। বেশ ঘোমটা টানুক আর না-ই টানুক, আমরা যাবো ওঁর কাছে। আশাকরি উনি আমাদের স্বাগত জানাবেন।

না, তোমরা যাবে না, কাটা কাটা গলায় বললো আতেন। সেটা বেআইনী। তাছাড়া, আমি তোমাদের রক্তে হাত রাঙাতে চাই না।

কে বেশি ক্ষমতাবান? ওর কথায় গুরুত্ব না দিয়ে আমি জিজ্ঞেস করলাম, আপনি খানিয়া, না ঐ পাহাড়ের পূজারিণী?

আমিই বেশি ক্ষমতাবান, হলি-তা-ই তো তোমার নাম না কি? প্রয়োজনের মুহূর্তে আমি ষাট হাজার যোদ্ধাকে জড়ো করতে পারি, কিন্তু ওর কিছু জংলী আর সন্ন্যাসী ছাড়া কিছু নেই।

তলোয়ারই পৃথিবীর একমাত্র শক্তি নয়, খানিয়া। এখন বলুন, এই পূজারিণী কখনও আপনাদের কালুন-এ এসেছেন?

না। বহু শতাব্দী আগে মঠ আর সমভূমির মানুষদের ভেতর এক যুদ্ধ হয়েছিলো। একটা চুক্তির মধ্য দিয়ে সে যুদ্ধের শেষ হয়। চুক্তিতে বলা হয়েছিলো ও কখনও নদীর এপারে আসবে না, কোনো খান বা খানিয়াও ওর পাহাড়ে উঠবে না। যে কোনো পক্ষ চুক্তি ভঙ্গ করার সঙ্গে সঙ্গে যুদ্ধ শুরু হয়ে যাবে আমাদের ভেতর।

তাহলে কে আসল প্রভু? কালুনের খান, না ঐ মঠের প্রধান? আবার জিজ্ঞেস করলাম আমি।

ধর্মীয় বা ঐশী ব্যাপার-স্যাপারে হেস-এর পূজারিণী, আর জাগতিক ব্যাপারে কালুনের খান।

খান। তার মানে আপনি বিবাহিত?

হ্যাঁ! তীব্র রোষে জ্বলে উঠলো আতেনের চোখ! এবং এর মধ্যে নিশ্চয়ই জেনে ফেলেছে ও একটা পাগল। ওকে আমি ঘৃণা করি।

আঁ,…শেষেরটা একটু আন্দাজ করেখানিয়া।

অন্তর্ভেদী দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালো আতেন।

কে? আমার চাচা শামান বলেছে? না, আমি ঠিকই ভেবেছিলাম, তুমি দেখেছো। তোমাকে হত্যা করাই উচিত ছিলো। ওহ! আমার সম্পর্কে কি ভেবেছে তুমি?

কি জবাব দেবো ভেবে পেলাম না।

নিশ্চয়ই তুমি বিশ্বাস করে বসেছে আমি পুরুষ দেখলেই লালায়িত হই, বলে চললো সে। কিন্তু না আমি-আমি পুরুষদের ঘৃণা করি। আমি কালুনের খানিয়া, ওরা নাম দিয়েছে বরফ-হৃদয়, হ্যাঁ, বলতে লজ্জা নেই, আমি তা-ই। দুহাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে উঠলো আতেন।

না, আমি বললাম, অমন কিছু আমি ভাবিনি। সত্যিই যদি আপনি তেমন কিছু করে থাকেন, আমার ধারণা তার পেছনে যথার্থ কারণ আছে।

একটু শান্ত হলো খানিয়া। হ্যাঁ, বিদেশী, কারণ আছে। অনেক কিছু তুমি জেনে ফেলেছো, এটুকুই বা বাকি থাকবে কেন? শোনন, আমার ঐ স্বামীর মতো আমিও পাগল হয়ে গেছি। তোমার সঙ্গীকে যখন প্রথম দেখি তখনই পাগলামি ঢুকে পড়েছে আমার ভেতরে। এবং আমি—আমি—

ওকে ভালোবেসে ফেলেছেন, এই তো? এটা কোনো পাগলামি নয়। যে কোনো সুস্থ মানুষের স্বাভাবিক আচরণ হলো ভালোবাসা।

না না, তুমি বুঝতে পারছে না, এ নিছক ভালোবাসা নয়, আরও বেশি কিছু। কি করে তোমাকে বোঝাবো? নিয়তি আমাকে বাধ্য করেছে–আমি ওর, একমাত্র ওর। হ্যাঁ, আমি ওর, এবং শপথ করে বলছি, ও আমার হবে।

বলেই দ্রুত পায়ে ঘর থেকে চলে গেল খানিয়া আতেন। আর আমি শুয়ে শুয়ে ভাবতে লাগলাম, কে এই খানিয়া? এর সাথে লিওর আচরণ কি হবে?

.

তিন দিন পেরিয়ে গেছে। এর ভেতরে খানিয়াকে আর দেখিনি। শামান সিমব্রির কাছে শুনেছি, সে নাকি রাজধানীতে গেছে, রাজকীয় অতিথি হিসেবে বরণ করবে আমাদের। লিওর সাথে দেখা করিয়ে দেয়ার অনুরোধ করেছিলাম বৃদ্ধকে। মৃদু অথচ দৃঢ়স্বরে সে জানিয়ে দিয়েছে, আমাকে ছাড়াই ভালো আছে আমার পালিত পুত্র। শেষে পকেট হাতড়ে এক টুকরো কাগজ পেয়ে তাতে একটা চিরকুট লিখে লিওর কাছে পাঠানোর চেষ্টা করেছি। ভৃত্যদের কেউ সেটা স্পর্শ করতেও রাজি হয়নি। অবশেষে তৃতীয় রাতে সিদ্ধান্ত নিলাম, যা থাকে কপালে, দেখা করার চেষ্টা করবো ওর সাথে।

ইতিমধ্যে আমি পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠেছি। মাঝরাতে, চাঁদ যখন মাথার ওপর উঠে এসেছে, পা টিপে টিপে বিছানা থেকে নেমে কাপড়-চোপড় পরে নিলাম। আমার কাপড়ের ভেতর ছুরিটা এখনও আছে দেখে বেশ স্বস্তি পেলাম মনে। নিঃশব্দে বেরিয়ে এলাম দরজা খুলে।

লিও আর আমাকে প্রথমে যে ঘরে রাখা হয়েছিল সেখান থেকে যখন বয়ে আনা হয় তখন চোখ বুজে আমি পথের নিশানা মনে গেঁথে নিয়েছিলাম। মনে আছে, আমার এখানকার ঘর থেকে বেরিয়ে তিরিশ পা (বাহকদের পদক্ষেপ গুনেছিলাম) যাওয়ার পর বাঁ দিকে মোড় নিতে হয়। তারপর আরও দশ পা গিয়ে একটা সিঁড়ির পাশ দিয়ে ডান দিকে মোড় নিলেই আমাদের পুরনো ঘর।

দীর্ঘ বারান্দা ধরে হেঁটে চললাম আমি। নিচ্ছিদ্র অন্ধকার, তবু বায়ের মোড়টা খুঁজে পেতে অসুবিধা হলো না। গুণে গুণে দশ পা গিয়ে ডানে মোড় নিলাম। পর মুহূর্তে ছিটকে পিছিয়ে আসতে হলো আমাকে। লিওর দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে খানিয়া নিজে। এক হাতে প্রদীপ, অন্য হাতে তালা লাগাচ্ছে দরজায়।

প্রথমেই আমার চিন্তা হলো, ছুটে চলে যাই নিজের ঘরে। পরমুহূর্তে বুঝতে পারলাম, লাভ হবে না। পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলেও ধরা পড়ে যাবে। তার চেয়ে পরিস্থিতির মুখোমুখি হওয়া ভালো। সত্যি কথাই বলবো, কেমন আছে জানার জন্যে লিওর সাথে দেখা করতে এসেছিলাম।

দেয়ালের সাথে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম আমি। এগিয়ে আসছে খানিয়া। পদশব্দ শুনতে পাচ্ছি! এবং তারপর-হ্যাঁ, এদিকে না এসে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে শুরু করলো সে।

এখন কি করবো? লিওর কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা বৃথা। ফিরে যাবো? না, খানিয়াকে অনুসরণ করবে। ধরা পড়লে একই অজুহাত দেখাবো। কিছু হয়তো জানা যাবে, অথবা—অথবা, বুকে গেঁথে বসবে ছোরা।

কয়েক সেকেণ্ড পর মোড় নিয়ে আমি উঠতে শুরু করলাম সিঁড়ি বেয়ে। সিঁড়ির মাথায় পৌঁছে এক পাশে একটা দরজা দেখলাম। বন্ধ। অত্যন্ত প্রাচীন। জায়গায় জায়গায় ক্ষয়ে গেছে। ফাটল দিয়ে আলো এসে পড়েছে বাইরে। দরজায় কান লাগাতেই শুনতে পেলাম সিমব্রির কণ্ঠস্বর: কিছু জানতে পারলে, ভাইঝি?

সামান্য। খানিয়া আতেনের জবাব। খুব সামান্য।

হঠাৎ করেই সাহস বেড়ে গেল আমার। ঝুঁকে চোখ রাখলাম দরজার এক ফাটলে। ছাদ থেকে ঝোলানো একটা বড় লণ্ঠনে আলোকিত ঘরটা। টেবিলের সামনে বসে আছে সিমব্রি। খানিয়া দাঁড়িয়ে আছে। এক হাতে ভর দিয়েছে টেবিলের কোনায়। গোলাপী রঙের রাজকীয় আলখাল্লায় সত্যিই অপরূপা লাগছে তাকে। ভুরুর একটু উপরে ছোট্ট একটা সোনার মুকুট। তার নিচ থেকে কোঁকড়া চুলগুলো ঢেউয়ের মতো নেমে এসেছে কাঁধে বুকে, পিঠে। তার দিকে তাকিয়ে আছে শামান সিমব্রি; চোখে ভয়, সন্দেহ।

কি আলাপ হলো তোমাদের? জিজ্ঞেস করলো বৃদ্ধ।

ওরা কেন এসেছে জিজ্ঞেস করলাম, ও জবাবে বললো, খুব সুন্দরী এক মহিলার খোঁজে এসেছে–আর কিছু বললো না। সেই মহিলা আমার চেয়ে সুন্দরী কিনা জানতে চাইলাম, তখন ওঁ জবাব দিলো, তা বলা শক্ত, তবে সে নাকি অন্য রকম। নিশ্চয়ই ভদ্রতা করে এই জবাব দিয়েছে ও। যা হোক, তারপর আমি, বললাম আমার চেয়ে সুন্দরী কোনো নারী কালুনে নেই, তাছাড়া আমি এদেশের রানী এবং আমিই ওকে বাঁচিয়েছি পানি থেকে। আমি আরও বলেছি, সে যাকে খুঁজছে আমিই সে।

বেশ বেশ, অস্থির ভাবে বললো সিমব্রি। তারপর?

তারপর ও বললো, তুমি কখনও আগুনের ভেতর দিয়ে এসেছো?

আমি বললাম,যা, আত্মার আগুনে আমি স্নান করেছি।

ও তখন বললো, তোমার চুল দেখাও তো আমাকে।

আমি আমার একগুচ্ছ চুল তুলে দিলাম ওর হাতে। সঙ্গে সঙ্গে ও ফেলে দিল ওগুলো। গলার সঙ্গে ঝোলানো ছোট একটা চামড়ার থলে থেকে আরেক গুচ্ছ চুল বের করলো—ওহ! সিমব্রি, কাকা, অমন সুন্দর চুল আমি আর কখনও দেখিনি। রেশমের মতো কোমল, মসৃণ; লম্বায় আমার এই মুকুট থেকে পা পর্যন্ত হবে।

তোমার চুল সুন্দর, ও বললো, কিন্তু দেখ, এগুলোর মতো নয়।

আমি বললাম, এমনও তো হতে পারে, এ চুল কোনো নারীর নয়।

ও জবাব দিলো, ঠিক বলেছো, আমি যাকে খুঁজছি সে নারীর চেয়েও বেশি।

তারপর—তারপর, আমি নানা ভাবে চেষ্টা করলাম, কিন্তু ও আর একটা কথাও বললো না। এদিকে ঐ অজানা মেয়ে মানুষটাকে এমন ঘৃণা করতে শুরু করেছি যে শেষে কি বলতে কি বলে ফেলি ঠিক নেই, তাই ভয় পেয়ে চলে এসেছি। এখন তোমার ওপর আমার নির্দেশ, খুঁজে বের করো এই মহিলাকে। শামান সিমব্রি, দরকার হলে তোমার সকল জ্ঞান দিয়ে খুঁজবে। তারপর জানাবে আমাকে। যদি পারি, আমি খুন করবো তাকে!

আচ্ছা, সে দেখা যাবে, জবাব দিলো শামান। এখন, এই চিঠিটার ব্যাপারে কি করবে? টেবিলের ওপর পার্চমেন্টের ছোটখাটো একটা স্কুপ থেকে বিশেষ একটা বেছে নিলো বৃদ্ধ। কদিন আগে অরোস-এর কাছ থেকে যেটা এসেছে?

আরেকবার পড়ো তো, বললো আতেন। আবার শুনতে চাই, কি লিখেছে।

পড়তে শুরু করলো সিমব্রি : কালুনের খানিয়ার কাছে অগ্নিগৃহের হেসা।

বোন–এই মর্মে আমার কাছে সতর্কসংকেত পৌঁছেছে যে, পশ্চিমা বর্ণের দুই আগন্তুক আমার আশীর্বাণী লাভের আশায় তোমার দেশে আসছে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে আমি নির্দেশ দিচ্ছি, পরবর্তী চাঁদের প্রথম দিনে তুমি আর তোমার জ্ঞানী চাচা তোরণের অভিভাবক শামান সিমব্রি গিরিখাতের যে জায়গায় প্রাচীন সড়ক শেষ হয়েছে তার নিচে নদীর তীরে গিয়ে অপেক্ষা করবে। ঐ পথেই আসবে আগন্তুকরা। তুমি ওদের সর্বতোভাবে সাহায্য করবে, এবং পথ দেখিয়ে নিরাপদে আমার পাহাড়ে নিয়ে আসবে। ওরা যদি ঠিক মতো এখানে না পৌঁছায় তাহলে তার সকল দায়-দায়িত্ব বহন করতে হবে তোমাদের দুজনকে। আমি নিজেই ওদের আনতে যেতে পারতাম, কিন্তু তা অতীতে সম্পাদিত চুক্তির পরিপন্থী। তাই তোমাদের ওপর দায়িত্ব দিতে হচ্ছে। আশাকরি দায়িত্ব সঠিকভাবে পালিত হবে।

হেসা অপেক্ষা করছে! পার্চমেন্টটা নামিয়ে রাখতে রাখতে সিমব্রি বললো। তারমানে নিছক ঘুরতে ঘুরতে আসেনি ওরা।

হ্যাঁ, নিছক ঘুরতে ঘুরতে আসেনি ওরা, আমার হৃদয়ও অপেক্ষা করছে ওদের এক জনের জন্যে। ও যে নারীর কথা বলছে সে হেসা নয়।

অনেক নারী আছে ঐ পাহাড়ে, তাদের কারও কথাও বলে থাকতে পারে।

যার কথাই বলুক না কেন, ও-পাহাড়ে যাচ্ছে না।

যা ভাবছো তার চেয়ে অনেক অনেক বেশি ক্ষমতা রাখে হেসা। এই নরম কথাগুলোর আড়ালে ভয়ানক এক হুমকি রয়েছে, বুঝতে পারছো না?

হুমকি থাক আর না থাক ও যাচ্ছে না। অন্যজন ইচ্ছে হলে যেতে পারে।

আতেন, স্পষ্ট করে বলো তো, তোমার ইচ্ছা কি? প্রেমিক হিসেবে চাও লিও নামের লোকটাকে?

বৃদ্ধ শামানের চোখে চোখে তাকালো খানিয়া। দৃঢ় গলায় জবাব দিলো—

না, আমি চাই ও আমার স্বামী হবে।

সেক্ষেত্রে প্রথম কথা হলো, ওকেও তোমাকে স্ত্রী হিসেবে চাইতে হবে। ওর ভেতর তো তেমন কোনো ইচ্ছা দেখা যাচ্ছে না। আর—আর, একজন স্ত্রীলোকের দুটো স্বামী থাকে কি করে?

বৃদ্ধের কাঁধে হাত রাখলো আতেন। তুমি ভালো করেই জানো, সিমব্রি, আমার কোনো স্বামী নেই। নামমাত্র যেটা আছে সেটা-ও থাকবে না, যদি তুমি আমার সহায় হও।

মানে! খুন করতে চাও ওকে? না, আতেন, এবার আর আমি তোমার সহায় হবো না। তোমার সহায় হতে গিয়ে বহু পাপের বোঝা চেপেছে আমার কাঁধে, আর না। যা করার তোমাকেই করতে হবে। যদি না পারো লোকটাকে চলে যেতে দাও পাহাড়ে।

অসম্ভব! কিছুতেই তা আমি হতে দেবো না। কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো আতেন। অবশেষে বললো, তুমি না কি বিরাট শামান, যাদুকর, ভবিষ্যৎ বক্তা। গণা-পড়া করে বললো আমাদের ভবিষ্যৎ।

তুমি বলার আগেই অনেকখানি সময় আমি ব্যয় করেছি একাজে, ফলাফল শুভ নয়, আতেন। এটা ঠিক, তোমার আর ঐ লোকটার নিয়তি একসূত্রে গাঁথা, কিন্তু বিশাল এক দেয়াল মাথা তুলেছে দুজনের মাঝে। যতদিন এই পৃথিবীতে আছো সে দেয়াল সরবে না তোমাদের মাঝ থেকে। তবে আমি আর যেটুকু জানতে পেরেছি, মৃত্যুর মাঝ দিয়ে আবার তোমরা খুব কাছাকাছি আসবে একে অন্যের।

মৃত্যুই আসুক তাহলে, গর্বিত ভঙ্গিতে মাথা উঁচু করে বললো খানিয়া। সেখানে তো আর কেউ আমার ইচ্ছায় বাধা দিতে পারবে না।

অত নিশ্চিন্ত হয়ো না, জবাব দিলো সিমব্রি। আমার ধারণা, মৃত্যু-সাগরের ওপারেও তোমাদের অনুসরণ করবে সেই অদৃশ্য শক্তি। আমার মাঝে মাঝে মনে হয়, হেস-এর নিধুম চোখ ছুরির ফলার মতো চিরে চিরে দেখছে আমাদের গোপন আত্মাগুলোকে।

তাহলে মায়ার ধুলো দিয়ে অন্ধ করে দাও সে চোখ। কালই হেসার কাছে চিঠি দিয়ে দূত পাঠাও যে, দুজন বৃদ্ধ আগন্তুক এসেছে—খেয়াল কোরো, বৃদ্ধ–তারা এখন খুবই অসুস্থ, খাদের ওপর থেকে পড়ে হাত-পা ভেঙে গেছে, তিন মাসের আগে সুস্থ হবে না। বেটি হয়তো তোমার কথা বিশ্বাস করবে।…এবার আমি ঘুমোবো। সেই ওষুধটা দাও, সিমব্রি, যেটা খেলে স্বপ্নহীন ঘুমে রাত শেষ হয়ে যায়।

দ্রুত অথচ নিঃশব্দ পায়ে আমি সরে এলাম সেখান থেকে। সিঁড়ির কোনায় অন্ধকারে গিয়ে দাঁড়ালাম।

.

০৮.

পরদিন সকাল দশটা কি আরও পরে শামান সিমব্রি এলো আমার ঘরে। জিজ্ঞেস করলো, কেমন ঘুমিয়েছি রাতে।

মরার মতো, আমি জবাব দিলাম। ঘুমের ওষুধ খেয়েও মানুষ এমন নিচ্ছিদ্র ঘুম ঘুমাতে পারে না।

তবু, বন্ধু হলি, বেশ ক্লান্ত দেখাচ্ছে তোমাকে।

তাহলে বোধহয় দুঃস্বপ্ন দেখেছি। মাঝে মাঝে অমন হয় আমার। কিন্তু, বন্ধু সিমবি, আপনার মুখ দেখে তো মনে হচ্ছে, সারারাতে একটুও ঘুমাতে পারেননি।

হ্যাঁ, সারারাত আমাকে তোরণ পাহারা দিতে হয়েছে।

কোন্ তোরণ? আমরা যেটা দিয়ে ঢুকেছি আপনাদের রাজ্যে?

না, অতীত আর ভবিষ্যতের তোরণ। যেখান দিয়ে…থাক, অত কথায় দরকার নেই; আমি যা বলতে এসেছি, এক ঘণ্টার ভেতর রাজধানীর পথে রওনা হতে হবে তোমাকে। তোমাদের স্বাগত জানানোর জন্য ওখানে অপেক্ষা করছেন। খানিয়া আতেন।

নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই, আমি এখন সম্পূর্ণ সুস্থ। কিন্তু আমার পালিত পুত্রের কি অবস্থা?

ও-ও সুস্থ হয়ে উঠেছে। সময় হলেই ওর দেখা পাবে। খানিয়ার ইচ্ছে তাই। এই যে, ক্রীতদাসরা তোমার কাপড়-চোপড় নিয়ে এসেছে। তৈরি হয়ে নাও।

বেরিয়ে গেল সিমব্রি। ভৃত্যদের সহায়তায় কাপড় পরতে শুরু করলাম। প্রথমে চমৎকার পরিষ্কার লিনেনের অন্তর্বাস, তারপর পশমের মোটা ট্রাউজার্স ও গেঞ্জি এবং সব শেষে ফারের কিনারা লাগানো কালো রং করা উটের পশমের আলখাল্লা, দেখতে অনেকটা লম্বা ঝুল কোটের মতো। কাঁচা চামড়ার একটা টুপি আর এক জোড়া বুটের মাধ্যমে শেষ হলো আমার বেশ বিন্যাস।

পোশাক পরা শেষ হতে না হতেই হাজির হলো হলদেমুখো ভৃত্যরা। আমার হাত ধরে সিঁড়ি দিয়ে নেডে, বারান্দা পেরিয়ে নিয়ে চললো তোরণ গৃহের দরজার দিকে। সেখানে পৌঁছে সবি আঁয়ে দেখলাম সিমব্রির সাথে দাঁড়িয়ে আছে লিও। মুখটা একটু ফ্যাকাসে। না হলে বলতে পারতাম সম্পূর্ণ সুস্থ স্বাভাবিক দেখাচ্ছে। ওকে। আমার মতোই পোশাক পরেছে। পার্থক্য একটাই, ওর স্কুল কোটটা সাদা। আমাকে দেখে এক লাফে এগিয়ে এলো ও। আনন্দে চকচক করে উঠেছে দুচোখ। কেমন আছি, এই কদিন কোথায় ছিলাম এসব নিয়ে একের পর এক প্রশ্ন করে চললো।

সিমব্রির সামনে যেগুলোর জবাব দিলে অসুবিধা নেই সেই প্রশ্নগুলোরই জবাব দিলাম শুধু। বাকিগুলো পরে কোনো এক ফাঁকে দিতে পারবো। আপাতত কিছুক্ষণ অন্তত এক সাথে থাকছি আমরা।

এর পর অদ্ভুত এক ধরনের পালকি নিয়ে এলো ওরা। মানুষের বদলে ঘোড়ায় বহন করে ওগুলো। সামনে পেছনে দুটো লম্বা দণ্ডের সাথে জুড়ে দেয়া হয় একটা করে দুটো টাটু ঘোড়া। আমরা উঠে বসতেই সিমব্রি ইশারা করলো। সামনের টাটুর লাগাম ধরে টেনে নিয়ে চললো দাসরা। পেছনে পড়ে রইলো বিষণ্ণ প্রাচীন তোরণগৃহ।

পথের প্রথম মাইলখানেক গেছে আঁকাবাকা এক গিরিখাতের মাঝ দিয়ে। তারপর আচমকা একটা মোড় নিলো গিরিপথ। সামনে ভেসে উঠলো কালুনের বিস্তৃত সমভূমি। কয়েক মাইল দূরে একটা নদী। সেদিকেই যাচ্ছি আমরা। নদীটা সরু কিন্তু খরস্রোতা। ওপাশেজাবার সমভূমি। যতদূর চোখ যায় ফাঁকা আর ফাঁকা। একটাই মাত্র ব্যতিক্রম এই একঘেয়ে বিস্তারের মাঝে—সেই পাহাড়টা, স্থানীয়রা যার নাম দিয়েছে অগ্নি-গৃহ। এখান থেকে অনেক দূরে সেটা। একশো মাইলেরও বেশি হবে। এতদূর থেকেও পাহাড়টার গাম্ভীর্যপূর্ণ অবয়ব টের পেতে অসুবিধা হয় না। চূড়াটা কমপক্ষে বিশ হাজার ফুট উঁচু। উজ্জ্বল সাদা।

হ্যাঁ, সেই চূড়ার ওপরে দাঁড়িয়ে আছে বিশাল একটা স্তম্ভ, তার ওপরে তেমনি প্রকাণ্ড একটা পাথুরে আংটা। এক দৃষ্টিতে আমরা তাকিয়ে আছি ওটার দিকে। যেন আমাদের সব আশা আকাক্ষা মূর্ত হয়ে উঠেছে ওটার চেহারায়। খেয়াল করলাম, আমাদের সঙ্গীরা সবাই পাহাড়টা দেখা মাত্র মাথা নুইয়ে সম্মান জানালো, সেই সাথে ডান হাতের তর্জনী বাঁ হাতের তর্জনীর ওপর আড়াআড়িভাবে রেখে একটা ভঙ্গি করলো। (পরে জেনেছিলাম, পাহাড়টার অশুভ প্রভাব থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যে এ ভঙ্গি করে ওরা)। শামান সিমব্রিও বাদ গেল না।

আপনি কখনও গেছেন ওই পাহাড়ে? বৃদ্ধকে জিজ্ঞেস করলো লিও।

মাথা নাড়লো সিমব্রি। সমভূমির মানুষরা ওখানে যায় না। প্রথম কারণ হিংস্র জংলীরা। ওদের সাথে লড়াই না করে ওখানে যাওয়ার উপায় নেই। দ্বিতীয়ত, পাহাড়টার যখন প্রসববেদনা ওঠে গলিত পাথরের লাল স্রোত নেমে আসে ঢাল বেয়ে। গরম ছাই ছিটকে পড়ে চূড়া থেকে। কে যাবে ঐ ভয়ঙ্কর জায়গায়?

আপনাদের এলাকায় কখনও ছাই পড়ে না?

কখনও দেখিনি পড়তে, তবে শুনেছি পাহাড়ের আত্মা যখন ক্রুদ্ধ থাকে তখন পড়ে, সেজন্যেই আমরা ভয় করি ওটাকে।

কে এই আত্মা? উৎসুক কণ্ঠে প্রশ্ন করল লিও।

আমি জানি না, অস্থিরভাবে বলল সিমব্রি। মানুষ কি আত্মা দেখতে পারে?

সবাই না পারুক আপনি যে পারেন তা আপনার চেহারা দেখেই বুঝতে পারছি।

সত্যিই তাই, বুড়োর দৃষ্টি এখন আর আগের মতো স্থির, নির্লিপ্ত নয়। কিছু একটা যেন ভেতরে ভেতরে খেচাচ্ছে তাকে।

তুমি আমাকে সম্মান করো তাই একথা বলছো, জবাব দিলো সিমব্রি। আসলে আমার ক্ষমতা অত দূরগামী নয়। যাকগে, আমরা ঘাটে পৌঁছে গেছি, বাকি পথ নৌকায় যেতে হবে।

বেশ বড়সড় আরামদায়ক নৌকাগুলো। পাল খাটানোর ব্যবস্থা আছে তবে মূলত গুণ টেনে চালানোর উপযোগী করেই তৈরি। লিও আর আমি উঠলাম বড়টায়। আনন্দের সাথে লক্ষ করলাম হালের লোকটা ছাড়া আর কেউ উঠলো না। এ নৌকায়। সিমব্রি আর বাকি লোকজন উঠলো পেছনেরটায়। পালকিটাও ভাঁজ করে উঠিয়ে দেয়া হলো পেছনের নৌকায়। লম্বা চামড়ার দড়ি বেঁধে টাট্টু দুটোকে জুড়ে দেয়া হলো দুই নৌকার সঙ্গে। এতক্ষণ পালকি বয়েছে, এবার নৌকা টেনে নিয়ে যাবে ওরা। নদীর তীর ঘেঁষে সুন্দর বাঁধানো পথ, খালগুলোর ওপরে কাঠের সেতু। সুতরাং নৌকা টানতে অসুবিধে হবে না ওদের।

ওহ! অবশেষে আবার আমরা একসাথে হয়েছি, বললো লিও। মনে আছে, হোরেস, ঠিক এমনি নৌকায় করে আমরা পৌঁছেছিলাম কোর-এর সমভূমিতে? সেই একই ঘটনা আবার ঘটতে চলেছে।

হ্যাঁ, সেই একই ঘটনা আবার ঘটতে চলেছে। কিন্তু, লিও, বলো তো এখানে আসার পর যা ঘটেছে তার কতটুকু মনে আছে তোমার?

আঁ…, সেই মহিলা আর বুড়ো আমাদের নদী থেকে টেনে তুললো। তারপর…তারপর যা মনে আছে তা হলো ঘুম। জাগি, ঘুমাই, কিন্তু কতক্ষণ ঘুমের পর কতক্ষণ জেগেছি কিছুই মনে নেই। তারপর একবার, ঘুম ভাঙতেই দেখলাম অপূর্ব সুন্দরী এক মহিলা ঝুঁকে আছে আমার ওপর। প্রথমে আমি ভাবলাম বুঝি– কার কথা বলছি বুঝতে পারছো তো? ঝুঁকে আমাকে চুমো খেলো সে। লাল হয়ে উঠলো লিওর মুখ। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আবার বললো, ব্যাপারটা স্বপ্নও হতে পারে।

না স্বপ্ন নয়, আমি দেখেছি। তারপর?

তারপর আর কি? পরে আরও অনেকবার ওকে দেখেছি—ঐ খানিয়াকে, আলাপ করেছি গ্রীকে। কিন্তু, সম্পূর্ণ অপরিচিত একজনের ব্যাপারে ও এমন উৎসাহী হয়ে উঠলো কেন বুঝতে পারছি না। কে ও, হোরেস?

কি আলাপ করেছে আগে বলো, তারপর আমি বলবো কে ও।

বেশ, বলছি শোনো-আগের আলাপগুলো এমন টুকরো টুকরো আর বিচ্ছিন্ন, প্রায় কিছুই মনে নেই—কাল রাতের ঘটনাটা স্পষ্ট মনে আছে, সেটাই বলি। রাতের খাওয়া শেষ করেছি সবেমাত্র। এটো বাসন পেয়ালা নিয়ে চলে গেছে বুড়ো যাদুকর। শুয়ে পড়ার কথা ভাবছি। এমন সময় ঘরে ঢুকলো খানিয়া। একা। রানীর মতো সাজ পোশাক। সত্যি বলছি, রূপকথার রাজকন্যার মতো লাগছিল ওকে। মাথায় মুকুট, কালো চুলের ঢল নেমেছে ঘাড় ছাড়িয়ে।

তারপর, হোরেস, ও সরাসরি প্রেম নিবেদন করলো আমাকে। আমার চোখে চোখে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, আমরা নাকি দূর অতীতে একে অপরকে চিনতাম। তারপর বললো, ও চায় আমাদের পুরনো পরিচয় নূতন করে ঝালিয়ে নিতে। নানাভাবে ওকে আমি বোঝাতে চেষ্টা করলাম, তা সম্ভব নয়। কিন্তু ও কি শোনে?

শেষ পর্যন্ত বলতে বাধ্য হলাম আমি আমার হারিয়ে যাওয়া স্ত্রীকে খুঁজছি। যা-ই হোক, আয়শা আমার স্ত্রী, তাই না, হোরেস? ও মৃদু হেসে কি বললো জানো? আমার সেই হারিয়ে যাওয়া স্ত্রীকে খুঁজে পাওয়া গেছে, ও-ই সে, এবং সেজন্যেই ও নদী থেকে বাঁচিয়েছিলো আমাকে। এমন ভাবে ও বলছিলো যে শেষ দিকে আমি প্রায় বিশ্বাসই করে ফেলেছিলাম কথাগুলো। এমনও তো হতে পারে, আয়শার চেহারা বদলে গেছে।

হঠাৎ মনে পড়লো সেই চুলের গোছাটার কথা, বুকের কাছে চামড়ার থলেটা স্পর্শ করলো লিও। ওটা বের করে খানিয়ার চুলের সাথে মেলালাম। চুলগুলো দেখার সাথে সাথে কেমন হিংসুটের মতো হয়ে গেল ওর চেহারা। ভয় দেখাতে লাগলো আমাকে। ওগুলো ওর চুলের চেয়ে লম্বা তাই কি?

ওর এই চেহারা দেখে আমি বুঝে ফেললাম ও আয়শা হতে পারে না। চুপ করে শুয়ে রইলাম আমি। ও অনেক কথা বলে গেল। ভয় দেখালো। শেষে দুপদাপ পা ফেলে চলে গেল ঘর থেকে। বাইরে থেকে দরজায় তালা লাগিয়ে দেয়ার আওয়াজ শুনলাম। ব্যস, এটুকুই আমার গল্প।

বেশ, আমি বললাম, এবার চুপ করে বোসো। চমকে উঠো না বা জোরে কথা বলে ফেলো না, হালের লোকটা গুপ্তচর হতে পারে, হয়তো তোমার আমার আচরণ সব পরে জানাবে সিমব্রিকে।

এরপর গিরিখাতের মাঝামাঝি বাঁক থেকে ওর পড়ে যাওয়ার পর এ-পর্যন্ত যা যা ঘটেছে সব বললাম। হাঁ করে শুনলো লিও।

কী বিস্ময়কর কাহিনি! অবশেষে স্বর বেরোলো ওর গলা দিয়ে। কে এই। হেসা, আর খানিয়াই বা কে?

তোমার কি মনে হয়? কে হতে পারে?

আমেনার্তাস? ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলো ও। আমার-মানে ক্যালিক্রেটিসের স্ত্রী? মিসরীয় রাজকন্যা আমেনার্তাস পুনর্জন্ম নিয়ে এসেছে?

মাথা ঝাকালাম আমি। আমার তা-ই মনে হয়। বুড়ো বুদ্ধ সন্ন্যাসী কেউ এন যদি হাজার বছর আগের স্মৃতি মনে করতে পারে, যাদুকর চাচা সিমব্রির সাহায্য নিয়ে খানিয়া কেন পারবে না? প্রথম দর্শনে সম্পূর্ণ অপরিচিত এক লোকের প্রেমে পড়ে যাওয়ার এ ছাড়া আর কোনো কারণ তো দেখি না।

তোমার কথায় যুক্তি আছে, হোরেস। আর তা যদি হয়, খানিয়ার জন্যে সত্যিই আমি দুঃখিত। বেচারা ইচ্ছে থাক না থাক জড়িয়ে গেছে এতে।

হ্যাঁ। কিন্তু তুমি যে আবার ফাঁদে পড়তে যাচ্ছো সে খেয়াল আছে? নিজেকে সামলাও, লিও, নিজেকে সামলাও। আমার বিশ্বাস, এটা একটা পরীক্ষা তোমার জন্যে। হয়তো সামনে এমন আরও পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হবে তোমাকে।

জানি, বললো লিও, ভালো করেই জানি। তোমার ভয় না পেলেও চলবে। এই খানিয়া অতীতে আমার কি ছিলো না ছিলো তাতে কিছু আসে যায় না। এখন আমি আয়শাকে খুঁজছি, এবং একমাত্র আয়শাকে, স্বয়ং ভেনাসও যদি চেষ্টা করে, আমাকে প্রলোভিত করতে পারবে না।

.

কিছু বুঝে ওঠার আগেই হঠাৎ আমাদের নৌকা পাড়ের সাথে মৃদু একটা ধাক্কা খেয়ে থেমে গেল। পেছনের নৌকার দিকে তাকিয়ে দেখলাম, ওটাও তীরে ভিড়েছে। সিমব্রি নেমে আসছে। একটু পরেই আমাদের নৌকায় উঠে এলো সে। গম্ভীর মুখে আমাদের সামনে একটা আসনে বসলো।

তোমাদের নিরাপত্তার দায়িত্ব রয়েছে আমার ওপর, বললো বৃদ্ধ। রাত হয়ে আসছে, আর দূরে থাকা সমীচীন মনে করলাম না। তাছাড়া এখন একটু সঙ্গও দিতে পারবো তোমাদের।

আর পাহারাও দিতে পারবে, আমরা পালানোর চেষ্টা করি যদি, বিড়বিড় করে ইংরেজিতে বললো লিও।

আবার চলতে শুরু করলো ঘোড়াগুলো। সেই সাথে নৌকাগুলোও।

ঐ যে আমাদের রাজধানী, একটু পরে সিমব্রি বললো। ওখানেই আজ রাতে ঘুমাবে তোমরা।

সিমব্রির ইশারা অনুসরণ করে তাকালাম আমরা। মাইল দশেক দূরে শহরটা। বিশাল বলবো না, তবে বেশ বড়। সমভূমি থেকে প্রায় নয়শো ফুট উঁচু একটা মাটির স্কুপের ওপর গড়ে উঠেছে। শহরটাকে মাঝখানে রেখে দুভাগে ভাগ হয়ে এগিয়ে গেছে নদী।

কি নাম শহরটার? জিজ্ঞেস করলো লিও।

কালুন, জবাব দিলো সিমব্রি। আমার পূর্ব পুরুষরা যখন জয় করে এদেশ, দুহাজার বছর আগে, তখনও এই নাম ছিলো। প্রাচীন নামটা বদলানো হয়নি। তবে সেনাপতির ইচ্ছায় ঐ পাহাড় আর সংলগ্ন এলাকার নতুন নামকরণ করা হয়। কারণ ওটার চূড়ায় যে স্তম্ভ আর আংটা আছে তা ওদের সেনাপতির উপাস্য দেবীর প্রতীকের মতো দেখতে। সেই দেবীর নামানুসারে ঐ এলাকার নাম দেয়া হয় হেস।

এখনও নিশ্চয়ই পূজারিণীরা আছে ওখানে, বুড়োর পেট থেকে কিছু কথা বের করা যায় যদি, এই আশায় বললো লিও।

হ্যাঁ, পূজারীও আছে। বিজয়ীরা প্রতিষ্ঠা করেছিলো ঐ মঠ। স্থানীয় দেবতা পার্বত্য-অগ্নির মন্দির ছিলো ওখানে। সেই মন্দিরকেই হেস-এর মঠে রূপান্তরিত করা হয়।

এখন ওখানে কার পূজা হয়?

দেবী হেস-এর। সে রকমই ধারণা সবার। এ সম্পর্কে বেশি কিছু জানি না আমরা। আমাদের সাথে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে শক্রতা পাহাড়ের ওদের। সুযোগ পেলেই আমরা বা ওরা একে অপরকে আক্রমণ করার চেষ্টা করি। তবে চেষ্টাটা ওদের তরফ থেকেই বেশি হয়। আমরা আত্মরক্ষার চেষ্টা করি কেবল। এমনিতে আমরা শান্তিপ্রিয় জাতি। আক্রান্ত না হলে কখনও আক্রমণ করি না। চারদিকে তাকিয়ে দেখ, শান্তির দেশ মনে হয় না?

সত্যিই তাই, নদীর দুপারে শুয়ে আছে বিস্তীর্ণ সবুজ সম্ভাবনা। চারণভূমিতে চরছে গবাদি পশুর পাল, অথবা ঘোড়া খচ্চরের দল। গাছের সারি বা লাইল দিয়ে পৃথক করা চৌকোনা ফসলের খেত। গ্রামের মানুষরা মাঠের কাজ শেষে বাড়ির পথে চলেছে। ধূসর রঙের ঢোলা আলখাল্লা তাদের পরনে। অনেকে দিয়ে নিয়ে চলেছে নিজের নিজের পশুর পাল। দূরে অস্পষ্টভাবে দেখা যায়, গাছপালায় ছাওয়া ঘরবাড়ি, গ্রাম। দেখে মনে হয় সত্যিই শান্তির দেশ কালুন।

মিসরীয় সেনাপতি আর তার অধীনস্থ গ্রীক সৈনিকরা কেন এ-দেশ জয়ের পর নিছক লুটতরাজ চালিয়ে ফিরে যায়নি তা অনুমান করতে অসুবিধা হলো না। বিশাল বিস্তৃত তুষার ছাওয়া মরুভূমি আর পাহাড়ী এলাকা পেরিয়ে এসে এমন সবুজ সুন্দর দেশ দেখে ওরা বোধহয় এক স্বরে চেঁচিয়ে উঠেছিলো, আর যুদ্ধ নয়, আমরা এখানেই থেকে যাবো, এখানেই মরবো। এবং স্থানীয় মহিলাদের স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করে সত্যিই থেকে গিয়েছিলো এদেশে।…

সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। হঠাৎ দূরে অগ্নি-পাহাড়ের ওপরে ধোয়ার স্তর উজ্জ্বল কমলা রঙ ধারণ করলো। কমলা আভা তীব্র থেকে তীব্রতর হতে হতে এক সময় প্রায় সাদা হয়ে উঠলো। আগ্নেয়গিরির গর্ভ থেকে লকলক করে বেরিয়ে এলো আগুনের শিখা। স্তম্ভের ওপরে আংটার ভেতর দিয়ে দূরে প্রক্ষিপ্ত হলো উজ্জ্বল আলো। কালুন নগরী, নদী, ফসলের মাঠ, বনভূমি পেরিয়ে সোজা ছুটে গেল– হ্যাঁ, আমাদের মাথার ওপর দিয়ে। পর পর তিনবার এমন হলো। তারপর ধীরে ধীরে আবার স্তিমিত হয়ে এলো অগ্নি-পাহাড়ের আগুন। মাঝিরা এবং অন্য সবাই ভীতরে প্রার্থনার ভঙ্গিতে বিড় বিড় করে কি যেন আউড়ে চলেছে।

কি বলছে ওরা? জিজ্ঞেস করলো লিও।

প্রার্থনা করছে, ওই আলো—যার নাম হেস-এর পথ—ওদের কোনো ক্ষতি যেন না করে। ওদের বিশ্বাস এই আলো দেখা দেয়ার অর্থ অমঙ্গল নেমে আসবে দেশের ওপর।

মানে, সব সময় এই আলো দেখা যায় না?

না, খুব কম। তিন মাস আগে একবার দেখা গিয়েছিলো, আর এখন। এর আগে বেশ কয়েক বছর আর দেখা যায়নি।

একটু পরে চাঁদ উঠলো, উজ্জ্বল সাদা একটা গোলক। জ্যোৎস্নায় দেখলাম, ক্রমেই নগরের কাছাকাছি হচ্ছি আমরা। নিঃশব্দে বসে আছি। আকাশের চাঁদ আর নদীর পানিতে তার প্রতিবিম্ব দেখছি। মাঝে মাঝে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাচ্ছি দূরে আলোকিত শহরটার দিকে। জল কেটে নৌকা এগোনোর মৃদু ছলাৎ ছল ছাড়া। আর কোনো শব্দ নেই। হঠাৎ দূর থেকে ভেসে এলো, একটা চিৎকার। অস্পষ্ট হলেও বুঝতে অসুবিধা হলো না, কেউ প্রাণের ভয়েই অমন চিৎকার করছে।

ক্রমে এগিয়ে আসছে চিৎকারের শব্দ। প্রতি মুহূর্তে স্পষ্ট এবং তীব্র হয়ে উঠছে। হঠাৎ দেখলাম মাঠের ভেতর দিয়ে ছুটে আসছে অস্পষ্ট কয়েকটা মূর্তি। নদীর যে পাশ দিয়ে আমাদের টাটুগুলো দৌড়ে চলেছে তার উল্টো পাশে। একটু পরেই চমৎকার তেজী একটা সাদা ঘোড়া উঠে এলো ওপাশের বাঁধানো পথের। ওপর। তার পিঠে একজন মানুষ। চিৎকারটা সে-ই করছে। সোজা হয়ে একবার ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো লোকটা। চাঁদের আলোয় চকিতের জন্যে তার মুখ দেখতে পেলাম। স্পষ্ট আতঙ্ক আর মৃত্যুভয় যেন আঁকা রয়েছে সে মুখে।

ঝড়ের বেগে আমাদের পেরিয়ে গেল সে। তারপর, যেমন আচমকা ঘোড়াটা বেরিয়ে এসেছিলো তেমনি অকস্মাৎ বিশাল এক লাল কুকুর উঠে এলো পাড়ের নিচের অন্ধকার থেকে। ভয়ঙ্কর বেগে ছুটছে সেটা ঘোড়সওয়ারের পেছন পেছন। এক সেকেণ্ড পর আরেকটা কুকুর উঠে এলো বাঁধানো পথের ওপর। তারপর আরও একটা, তারপর অনেকগুলো।

মরণ-শ্বাপদ! লিওর হাত আঁকড়ে ধরে বিড় বিড় করে বললাম আমি।

হ্যাঁ! বললো ও। হতভাগা লোকটাকে তাড়া করছে। এই যে, শিকারী এসে গেছে।

বলতে না বলতেই দ্বিতীয় অশ্বারোহী উঠে এলো রাস্তায়। রাজকীয় ভঙ্গিতে বসে আছে ঘোড়ার পিঠে। কাঁধ থেকে ঝুলে পড়া আলখাল্লাটা বাতাসে উড়ছে। বাদুড়ের ডানার মতো। লম্বা একটা চাবুক লোকটার হাতে। আমাদের পাশ দিয়ে। যখন ছুটে যাচ্ছে এ-ও তাকালো ঘাড় ঘুরিয়ে। আমরা দেখলাম উন্মাদের দৃষ্টি তার চোখে। কোনো সন্দেহ নেই এ লোক পাগল!

খান! খান! বলে উঠলো সিমব্রি, সেই সাথে মাথা নোয়ালো কুর্নিশের ভঙ্গিতে।

কয়েক সেকেণ্ড পর দেখতে পেলাম খানের রক্ষীদের। সংখ্যায় আটজন। এদের হাতেও চাবুক। একটু পরপরই তাদের ঘোড়াগুলোর পিঠে সপাং করে বাড়ি পড়ছে।

শব্দগুলো ধীরে ধীরে দূরে মিলিয়ে গেল। আমি জিজ্ঞেস করলাম, এ সবের অর্থ কি, বন্ধু সিমব্রি?

খান তার নিজের রীতিতে বিচার করছেন, জবাব দিলো সে। যে তাঁর ক্রোধ জাগিয়েছে তাকে ছুটিয়ে নিয়ে ইঁদুরের মতো তাড়া করে অবশেষে হত্যা করবেন।

ও কে? অপরাধই বা কি?

লোকটা জমিদার। এদেশে এত বড় জমিদার খুব কমই আছে। ওর অপরাধ, ও খানিয়ার কাছে প্রেম নিবেদন করেছিলো। খানিয়াকে প্রস্তাব দিয়েছিলো, ওকে যদি বিয়ে করার প্রতিশ্রুতি দেয় তাহলে ও খানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে তাকে হত্যা করবে। আতেন রাজি হয়নি ওর প্রস্তাবে, বরং খানকে জানিয়ে দিয়েছে। ব্যাপারটা। এই হলো ঘটনা।

এমন একজন বিশ্বস্ত স্ত্রী যার তাকে ভাগ্যবান না বলে উপায় নেই! কথাটা আমি না বলে পারলাম না। বৃদ্ধ ঝট করে ফিরলো আমার দিকে, তারপর যেন কিছু শোনেনি এমন ভঙ্গিতে হাত বুলাতে লাগলো তার শ্বেতশুভ্র দাড়িতে।

একটু পরেই আবার শোনা গেল মরণ-শ্বাপদের চিৎকার। হ্যাঁ, আবার এগিয়ে আসছে তারা। এবারও মাঠের ভেতর দিয়ে প্রথমে সাদা ঘোড়াটা, তারপর শ্বাপদগুলো। দূরত্ব অনেক কমে গেছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে পরিশ্রান্ত সাদা ঘোড়াটা। আগের মতো দ্রুত ছুটতে পারছে না। কোনোমতে বাঁধানো পাড়ের ওপর উঠলো সেটা। পরমুহূর্তে দেখলাম বিশাল লাল কুকুরগুলোর একটা লাফ দিলো। হাঁ হয়ে আছে মুখ। চাঁদের আলোয় তার শ্বদন্তগুলো ঝিকিয়ে উঠলো। নিমেষে মাঝের দূরত্বটুকু অতিক্রম করে কামড় বসালো সাদা ঘোড়ার পেছনের পায়ে। তীব্র আতঙ্কে তীক্ষ্ণ্ণ চিৎকার করে দুপায়ের ওপর খাড়া হয়ে গেল। ঘোড়াটা। ছিটকে পড়ে গেল আরোহী। সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে নদীতে ঝাঁপ দেয়ার চেষ্টা করলো সে। কিন্তু তার আগেই পৌঁছে গেছে পেছনের শ্বাপদগুলো। মুহূর্তে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেললো হতভাগ্য জমিদারকে। লাগাম টেনে ঘোড়া দাঁড় করালো খান। তাকিয়ে আছে উন্মত্ত জানোয়ারগুলোর দিকে। ধীরে ধীরে পরিতৃপ্তির পৈশাচিক হাসি ফুটে উঠলো তার মুখে।

.

০৯.

একটু পরে আমরা পৌঁছে গেলাম গন্তব্যে দ্বীপের যেখানটায় নদী দুভাগ হয়েছে সেই বিন্দুতে। পাথরের একটা জেটিতে নৌকা ভিড়লো। আমরা নেমে এলাম। একদল রক্ষী আমাদের স্বাগত জানানোর জন্যে অপেক্ষা করছিলো। তাদের পেছন পেছন এগিয়ে গেলাম নগর-তোরণের দিকে।

আর দশটা প্রাচীন মধ্য এশীয় নগরের মতো দেখতে কালুন শহর। উঁচু দেয়াল দিয়ে ঘেরা। স্থাপত্যশৈলীতে সৌন্দর্যের ছাপ বিশেষ নেই। খুব একটা বড়ও নয় নগরটা। সরু সরু পাথর বাঁধানো রাস্তা, আর সমতল ছাদওয়ালা বাড়িঘর-ব্যস।

তোরণ পেরিয়ে এগিয়ে চলেছি আমরা। একটু পরে দ্বিতীয় একটা ফটকের সামনে পৌঁছুলাম। ভেতর থেকে বন্ধ। সিমব্রি এগিয়ে গিয়ে ধাক্কা দিলো দরজায়। ওপাশ থেকে দুর্বোধ্য ভাষায় সাড়া দিলো কেউ। একই ভাষায় কিছু একটা জবাব দিলো সিমব্রি। প্রায় সাথে সাথে খুলে গেল ফটকের ভারি কপাট। ভেতরে ঢুকলাম আমরা। দুপাশে বাগান, মাঝখান দিয়ে এগিয়ে গেছে পথ।

বাগান পেরিয়ে বিরাট একটা দালান বা প্রাসাদের সামনে পৌঁছলাম। দালানটার এখানে সেখানে এলোমেলোভাবে মাথা তুলে আছে নিরেট পাথরের উঁচু উঁচু চূড়া। দেখলেই বোঝা যায় প্রাচীন মিশরীয় রীতিতে তৈরির চেষ্টা হয়েছিলো, কিন্তু কারিগরদের সাধ্যে কুলায়নি।

প্রাসাদের দরজা পেরিয়ে একটা বারান্দা ঘেরা উঠান। এই উঠান থেকে অনেকগুলো ছোট ছোট গলিপথ চলে গেছে বিভিন্ন কামরায়। এগুলোরই একটা ধরে অবশেষে পৌঁছুলাম আমাদের জন্যে নির্ধারিত বাসস্থানে। একটা বসার আর দুটো শোবার ঘর নিয়ে গড়ে উঠেছে ওটা। তিনটে ঘরই জমকালো আসবাবপত্রে ঠাসা, সবই প্রাচীন ঢংয়ের। তেলের লণ্ঠন জ্বলছে ঘরগুলোয়।

আমাদের রেখে বিদায় নিল সিমব্রি। যাওয়ার আগে বলে গেল, রক্ষীদলের প্রধান বাইরের ঘরে অপেক্ষা করবে। আমরা তৈরি হয়ে বেরোলেই সে আমাদের খাওয়ার ঘরে নিয়ে যাবে।

শোয়ার ঘরে ঢুকে দেখি কয়েকজন ভৃত্য, সম্ভবত ক্রীতদাস, অপেক্ষা করছে আমাদের জন্যে। আচার ব্যবহারে কেতাদুরস্ত। এদের সহায়তায় ভ্রমণের পোশাক ছেড়ে সাদা স্কারের নতুন ফ্রক কোট গায়ে চাপালাম। অন্য পোশাকগুলোও বদলে নিতে হলো। অবশেষে ভৃত্যরা মাথা নুইয়ে জানালো, আমাদের বেশ বিন্যাস সমাপ্ত।

বাইরের ঘরে এলাম। রক্ষীপ্রধান বিনীত ভঙ্গিতে পথ দেখিয়ে নিয়ে চললো। অনেকগুলো ছোট বড় ঘর পেরিয়ে, বাক নিয়ে অবশেষে পৌঁছুলাম খাওয়ার ঘরে। বিশাল একটা হলকামরা। অনেকগুলো লণ্ঠনের আলোয় উজ্জ্বল আলোকিত। দেয়ালে দেয়ালে কারুকাজ করা পর্দা। ঘর গরম রাখার জন্যে এক ধারে বড় একটা চুল্লীতে পিট কয়লা পুড়ছে।

কামরার এক প্রান্তে একটা বেদীমতো। তার ওপরে সরু, লম্বা একটা কাপড়ঢাকা টেবিল। টেবিলে রুপোর ঝকঝকে বাসন পেয়ালা সাজানো। কোনো মানুষ নেই এ-ঘরে। রক্ষী-প্রধানের সাথে অপেক্ষা করতে লাগলাম আমরা। একটু পরে এক ধারের পর্দা সরিয়ে ঘরে ঢুকলো খানসামারা। তাদের পেছনে রূপার ঘণ্টায় বাড়ি দিতে দিতে একজন লোক; তারপর দশ বারোজন সভাসদের একটা দল, প্রত্যেকে আমাদের মতো সাদা পোশাক পরা। তাদের পেছন পেছন এলো সমসংখ্যক রমণী। বেশিরভাগই যুবী, সুন্দরী। আমাদের সামনে এসে মাথা নুইয়ে অভিবাদন জানালো তারা। আমরা জবাব দিলাম, একই ভঙ্গিতে।

নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে আছি আমরা। ওরাও। পরস্পরকে পরীক্ষা করছি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। অবশেষে তীক্ষ্ণ্ণস্বরে শিঙা বেজে উঠলো কোথাও। নকীব এসে ঘোষণা করলো–কালুনের মহামান্য খান ও খানিয়া আসছে! পর্দার ওপাশে একটা আলোকিত সরু পথে দুটো মূর্তি দেখা গেল—খান এবং খানিয়া। তাদের পেছনে শামান সিমব্রি ও কয়েকজন রাজপুরুষ।

হলঘরে প্রবেশ করলো খান। কেউ মুখ তুলে তাকালো না। সবার চেহারায় কেমন একটা অস্বস্তির ভাব চেপে বসেছে। খানের পরনেও সাদা পোশাক। পার্থক্য একটাই, আমরা বা পারিষদরা যেগুলো পরে আছি তার চেয়ে ওগুলো অনেক মূল্যবান, কাটছাটেও অন্যরকম। প্রথমেই আমার চোখ পড়লো ওর সেই উন্মত্ত চোখ দুটোর ওপর। এখনও তেমনি ভয়ঙ্কর পৈশাচিক দৃষ্টি তাতে। এমনিতে লোকটা দেখতে খারাপ না। চমৎকার স্বাস্থ্য। কেবল ঐ চোখ দুটো-ভয়ঙ্কর ক্রোধে জ্বলছে যেন সবসময়। আর খানিয়া-তোরণ-গৃহে যেমন দেখেছিলাম এখনও তেমন। সুন্দর। কেবল একটু দুশ্চিন্তার ছাপ পড়েছে চেহারায়। আমাদের দেখা মাত্র একটু লাল আভা ধারণ করলো তার গাল। তবে মুহূর্তের জন্যে। তারপরই আমাদের এগোনোর ইশারা করে স্বামীকে বললো-প্রভু, এরা সেই আগন্তুক, এদের কথাই বলেছিলাম তোমাকে।

আমার ওপরেই প্রথমে পড়লো খানের চোখ। একটু যেন মজা পেলো আমার চেহারা দেখে। অভদ্রের মতো হেসে উঠলো জোরে। তারপর স্থানীয় ভাষার মিশেল দেয়া জঘন্য গ্রীকে বললো

কি অদ্ভুত একটা বুড়ো জন্তু! আগে কখনও দেখিনি তোমাকে, তাই না?

না, মহানুভব খান, আমি জবাব দিলাম, তবে আমি আপনাকে দেখেছি। আজ সন্ধ্যায়ই। আপনি শিকারে বেরিয়েছিলেন। পেলেন কিছু?

সঙ্গে সঙ্গে সজাগ হলো সে। হাত ঘষতে ঘষতে জবাব দিলোপেয়েছি মানে? দারুণ জিনিস। দৌড়ে পালালেঞ্জিচেষ্টা করেছিলো, কিন্তু আমার কুকুরগুলো শেষ পর্যন্ত ওকে ধরে ফেলতে পেয়েছিলো। তারপর–

তোমার এসব নিষ্ঠুর কথাবার্তা থামাও তো! চিৎকার করলো খানিয়া।

আতেনের কাছ থেকে একটু সরে এলো খান। লিওর দিকে তাকালো।

সোনালি দাড়িওয়ালা বিশালদেহী লিওকে এই প্রথম ভালো করে লক্ষ করলো সে। অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ।

তুমি নিশ্চয়ই খানিয়ার অপর বন্ধু? অবশেষে কথা ফুটলো তার মুখে। এতক্ষণে বুঝতে পারছি, কেন অত কষ্ট স্বীকার করে ও পার্বত্য-তোরণের কাছে গিয়েছিলো! ভালো কথা, তুমি কিন্তু সতর্ক থেকো, না হলে তোমাকেও শিকার হতে হবে।

শুনেই রেগে গেল লিও। জবাব দেয়ার জন্য মুখ খুলতে যাবে, বাধা দিলাম আমি। ইংরেজিতে বললাম, উহুঁ, কিছু বোলো না, লোকটা পাগল।

পাগল হোক আর যা-ই হোক, গরগরিয়ে উঠলো লিও, আমার ওপর ওই অভিশপ্ত কুত্তাগুলোকে লেলিয়ে দেয়ার চেষ্টা করলে আমি ওর ঘাড় ভেঙে ফেলবো।

আমি আর কিছু বলার আগেই খানিয়া ইশারায় তার পাশে বসতে বললো ওকে। অন্যপাশে বসালো আমাকে, ও আর ওর চাচা অভিভাবকের মাঝখানে। আর খান বসলো কয়েকটা চেয়ার পরে সুন্দরী দুই রমণীর মাঝখানে।

খাবার পরিবেশন করা হলো। মাছ, ভেড়ার মাংস, মিষ্টি। সবই অত্যন্ত সুস্বাদু। তারপর দেয়া হলো কড়া পানীয়। পথে কষ্ট হয়েছে কিনা—এই ধরনের দু’একটা প্রশ্ন করলো খানিয়া আমাকে। বাকি সময়টুকু লিওর সাথে গল্প করে গেল সে। আর আমি আলাপ জমালাম বৃদ্ধ শামান সিমব্রির সাথে। তার কাছ থেকে যা যা জানতে পারলাম তা হলো—

বাণিজ্য ব্যাপারটা সম্পূর্ণ অপরিচিত কালুনের মানুষদের কাছে। এর প্রধান কারণ বাইরের দুনিয়ার সাথে ওদের কোনো যোগাযোগ নেই। দেশটা বড় এবং ঘনবসতিপূর্ণ হলেও চারদিক দিয়ে দুর্গম পাহাড় ঘেরা বলে বাইরে থেকে কেউ আসতে পারে না, এখান থেকেও কেউ যায় না বাইরে। যাওয়ার প্রয়োজনও বোধ করে না। নিজেরা যা উৎপাদন করে তা নিয়েই খুশি সবাই। প্রয়োজনীয় প্রতিটি জিনিস নিজেরাই তৈরি করে নেয়। ধাতুশিল্পেও মোটামুটি উন্নত কালুন। টাকা পয়সার কোনো অস্তিত্ব নেই। বিনিময়ই ব্যবসার একমাত্র মাধ্যম। রাজস্বের মাধ্যমও তাই।

প্রাচীনকালে যে বিদেশী জাতি স্থানীয়দের পদানত করেছিলো সংখ্যায় খুব কম হলেও এখনও তারাই শাসন করছে দেশটা। শাসক শাসিত বা বিজয়ী বিজিত কোনো পক্ষই রক্তের বিশুদ্ধতা রক্ষার ব্যাপারে মনোযোগী নয়-কোনো কালেই ছিলো না। ফলে একটা প্রায় অসভ্য আর একটা সুসভ্য জাতির সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে এই জাতি। তবে শাসন ক্ষমতা শেষ পর্যন্ত রয়ে গেছে বিদেশ থেকে আসা লোকদের হাতেই।

সংখ্যায় যখন ওরা এত অল্প, সংখ্যাগরিষ্ঠ স্থানীয়রা ওদের শাসন মেনে নিচ্ছে কেন? জিজ্ঞেস করলাম আমি।

কাঁধ ঝাঁকালো সিমব্রি। স্থানীয়রা মোটেই উচ্চাকাঙ্ক্ষী নয়, তাই ব্যাপারটা। সম্ভব হয়েছে। তাছাড়া বর্তমান খানিয়াকে দুপক্ষই পছন্দ করে। বিশেষ করে দরিদ্ররা। আর দরিদ্রের সংখ্যাই এদেশে বেশি। অবশ্য খানিয়াকে সবাই যেমন পছন্দ করে খানকে তেমন করে অপছন্দ। জনসাধারণ তো মাঝে-মধ্যে। খোলাখুলিই বলে, অত্যাচারী খান মরলে তারা খুশি হয়, সেক্ষেত্রে খানিয়া নতুন একজন স্বামী বেছে নিতে পারবে। পাগল হলেও খান এসব কথা জানে। সেজন্যে দেশের প্রতিটা গণ্যমান্য লোককে ও সন্দেহ করে, ঈর্ষা করে।

ঈর্ষা কেন বলছেন, আমি বললাম, সত্যি সত্যি ও হয়তো স্ত্রীকে ভালোবাসে।

হয়তো। কিন্তু আতেন তো ওকে ভালোবাসে না। ওর সভাসদ, মানে এখানে যারা আছে তাদেরও কাউকে না।

সত্যিই তাই, এসব লোককে পছন্দ করা প্রায় অসম্ভব। ঘণ্টাখানেকও হয়নি খেতে এসেছে, এর ভেতরে সবাই পুরোপুরি মাতাল হয়ে গেছে। মেয়েরাও বাদ যায়নি। খানের অবস্থা সবচেয়ে খারাপ। চেয়ারে হেলান দিয়ে হেঁড়ে গলায় চিৎকার করছে। এক হাতে জড়িয়ে ধরেছে সুন্দরী এক সঙ্গিনীর গলা। অন্য এক সুন্দরী সোনার পেয়ালায় করে মদ ঢেলে দিচ্ছে তার গলায়।

দেখ, লিওকে বললো খানিয়া, বিরক্তিতে কুঁচকে উঠেছে চোখ-মুখ, দেখ আমার সঙ্গীদের অবস্থা দেখ। কালুনের খানিয়া মানে কি তা বোঝো!।

রাজসভা থেকে এদের বিদায় করে দেন না কেন? জিজ্ঞেস করলো লিও।

বিদায় করলে রাজসভা বলেই কিছু থাকবে না যে। এদের চেয়ে ভালো স্বভাবের মানুষ এদেশে কই? নিরীহ গরীব মানুষের কঠোর শ্রমে উপার্জিত সম্পদে ফুর্তি করে এরা। ছি! হঠাৎ যেন সংবিৎ ফিরল খানিয়ার। যাকগে, তোমরা নিশ্চয়ই খুব ক্লান্ত? যাও বিশ্রাম করোগে। কাল আমরা একসাথে ঘোড়ায় চড়তে বেরোবো। একজন রাজপুরুষকে ডেকে আমাদের পৌঁছে দেয়ার নির্দেশ দিলো সে।

মাথা নুইয়ে অভিবাদন জানিয়ে বিদায় নিলাম আমরা। সিমব্রি-ও যাচ্ছে আমাদের পৌঁছে দেয়ার জন্যে। বিশাল হলঘরটার দরজার কাছে পৌঁছে গেছি, এমন সময় পেছন থেকে শোনা গেল খানের কণ্ঠস্বর–

আমাদের খুব ফুর্তিবাজ মনে হলো, না? কেন হবে না? কদিন বাঁচবো কেউ বলতে পারে? কিন্তু তুমি, এই হলদে-চুলো ব্যাটা, আতেনকে অমন করে তাকাতে দিয়ো না তোমার দিকে। ও আমার বউ। আর কখনও যদি দেখি ও অমন ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে আছে তোমার দিকে, তাহলে, বলে দিচ্ছি, নির্ঘাৎ তোমাকে শিকার করবো আমি।

হো-হো করে উঠলো অন্য মাতালগুলো। ঘুরে দাঁড়াতে গেল লিও। কিন্তু তার আগেই সিমব্রি ওর হাত ধরে বের করে নিয়ে গেল ঘর থেকে।

বাইরে বেরিয়েই লিও সিমব্রিকে বললো, বন্ধু, তোমাদের খান আমাকে হত্যার হুমকি দিচ্ছে।

ভয় পাওয়ার কিছু নেই, জবাব দিলো অভিভাবক। খানিয়া যতক্ষণ হুমকি দিচ্ছে না ততক্ষণ ভয়ের কিছু নেই। আসলে তো দেশের শাসনকর্তা আতেন, আমি ওকে সহায়তা করি।

তাহলে আপনাকেই বলছি, বললো লিও, ঐ মাতাল লোকটার কাছ থেকে দূরে রাখবেন আমাকে। আমি যদি আক্রান্ত হই তাহলে কিন্তু আত্মরক্ষার চেষ্টা করবো।

সেক্ষেত্রে কে তোমাকে দোষ দেবে? সূক্ষ্ম, রহস্যময় একটা হাসি হেসে বললো সিমব্রি।

ইতিমধ্যে আমরা পৌঁছে গেছি আমাদের থাকার জায়গায়। বিদায় নিলো বৃদ্ধ শামান। দুটো বিছানাই এক ঘরে এনে শুয়ে পড়লাম আমি আর লিও। এক ঘুমেই রাত শেষ। ভোরে মরণ-শ্বাপদের চিৎকারে ঘুম ভাঙলো আমাদের।

.

দুপুরের একটু পরে খানিয়া আতেনের সাথে বেড়াতে বের হলাম। পেছন পেছন আসছে খানিয়ার দেহরক্ষী বাহিনীর একদল সৈনিক। প্রথমেই সে আমাদের নিয়ে গেল মরণ-শ্বাপদদের যেখানে রাখা হয় সেখানে। লোহার বেড়া দিয়ে ঘেরা প্রশস্ত একটা উঠানে দুধরনের কুকুর দেখলাম। লাল আর কালো। কাল রাতেরগুলোর মতোই বিরাট একেকটা। আমাদের দেখামাত্র চঞ্চল হয়ে উঠলো তারা। রক্ত হিম করা স্বরে চেঁচাচ্ছে আর লাফাচ্ছে, পারলে এক্ষুণি বেরিয়ে এসে টুটি টিপে ধরে আমাদের। ভাগ্য ভালো, বেড়া যথেষ্ট মজবুত, তেমন কিছু করতে পারলো না ওরা।

এরপর খানিয়া নগর দেখাতে নিয়ে গেল। কাল রাজপ্রাসাদে ঢোকার আগে যেটুকু দেখেছিলাম তার চেয়ে বেশি কিছু দেখার ছিলো না। সুতরাং একটু পরে যখন আতেন নদীর ওপর উঁচু একটা সেতু পেরিয়ে আমাদের ফসলের মাঠে নিয়ে গেল তখন মোটেই দুঃখ পেলাম না। কৃষকদের দেখলাম, মাঠে কাজ করছে। খানিয়াকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম, এরা সবাই স্থানীয় বাসিন্দাদের বংশধর। কৃষিকাজই এদের একমাত্র জীবিকা। জমির তুলনায় মানুষ বেশি বলে চাষবাস ছাড়া অন্য কাজে এক ইঞ্চি মাটিও এরা নষ্ট করে না। অদ্ভুত এক সেচের পদ্ধতি গড়ে তুলেছে দেশজুড়ে। সরু সরু খাল কেটে পানি নিয়ে আসা হয়েছে নদী থেকে মাঠের গভীর পর্যন্ত। অনেক স্ত্রীলোককেও দেখলাম খেতে কাজ করতে।

কোনো বছর যদি খরা বা অতিবৃষ্টি হয় তাহলে কি ঘটে আপনাদের এখানে? জিজ্ঞেস করলো লিও।

দুর্ভিক্ষ, গম্ভীর মুখে জবাব দিলো খানিয়া। হাজার হাজার মানুষ তখন না খেয়ে মরে।

এ বছরটা কেমন? ভালো না মন্দ? আমি জিজ্ঞেস করলাম।

খুব সম্ভব মন্দ। এখনও নদীর পানি যথেষ্ট বাড়েনি। বৃষ্টিও হয়নি খুব বেশি। এ-অবস্থা চললে কদিন পরে সেচের পানি পাওয়া যাবে না। কাল সন্ধ্যায় আবার অগ্নি-পর্বতের চূড়ায় আগুন দেখা গেছে। ওটা অশুভ সংকেত। যে বছর ঐ চূড়ায় আগুন দেখা দেয় সে বছর খরা হয়।

সেক্ষেত্রে এখনই ঐ পাহাড়ে গিয়ে আশ্রয় নেয়া উচিত আমাদের, একটু হেসে লিও বললো।

মানে? তোমরা মৃত্যুর মাঝে আশ্রয় চাও? মুখ কালো করে বললো খানিয়া। বিদেশী অতিথি, শুনে রাখো, আমি বেঁচে থাকতে ওখানে যেতে পারবে না তুমি।

কেন নয়, খানিয়া?

আমার ইচ্ছা, প্রভু লিও। এদেশে আমার ইচ্ছাই আইন। চলো ফেরা যাক।

.

১০.

এরপর দীর্ঘ তিনটে মাস আমাদের কাটাতে হলো কালুন নগরীতে। ভয়ঙ্কর, জঘন্য, ঘৃণিত তিনটে মাস। জীবনে আর কখনও এত বাজে সময় কাটেনি আমাদের। একদিকে খানের হুমকি, অন্যদিকে খানিয়ার। খানিয়া শুধু হুমকি নয়, মাঝে মাঝে অস্বাভাবিক ভালো ব্যবহার করে, সেটা আরও অসহ্য লাগে আমার কাছে। লিওর কাছেও। দেশের জনসাধারণ মোটেই ভাল দৃষ্টিতে দেখছে না। আমাদের। খানিয়ার কথাই সত্যি হয়েছে ভয়ঙ্কর খরা এবং অনাবৃষ্টি শুরু হয়েছে কালুনে। সবচেয়ে আশ্চর্য ব্যাপার জনগণ সেজন্যে দুই বিদেশী আগন্তুককেই দায়ী করছে। আমরা বাইরে বেরোলে ওরা দল বেঁধে দেখতে আসে। দু’একজন বলাবলিও করে, ওদের এই দুরবস্থার জন্যে আমরাই দায়ী। শেষে এমন . হলো, বাইরে বেরোনোই বন্ধ হয়ে গেল আমাদের। মাঝে মাঝে দু’একবার যা বেরোই তা খানিয়ার সঙ্গে। ব্যাপারটা আরও ব্রিতকর। খানিয়ার উদ্দেশ্য আমরা জানি তাই চেষ্টা করি ওকে এড়িয়ে চলার। তবু ওর ইচ্ছায় ওর সাথে যখন বেরোতে হয়, আমাদের, বিশেষ করে লিওর মনের অবস্থা কেমন হয়, সহজেই অনুমেয়।

এক রাতে সিমব্রি তার প্রাসাদচূড়ার ঘরে আমাদের খাওয়ার আমন্ত্রণ জানালো। খাওয়া-দাওয়ার পর দেখলাম, গম্ভীর হয়ে গেছে লিও। কি যেন ভাবছে।

বন্ধু সিমব্রি, হঠাৎ বলে উঠলো সে, আপনার কাছে একটা অনুগ্রহ চাইবো–খানিয়াকে একটু বলবেন, দয়া করে যেন আমাদের পথে চলে যেতে দেয়। আমাদের।

বুড়ো শামানের চতুর মুখটা মুহূর্তে যেন পাথরে গড়া হয়ে গেল।

তুমি নিজেই তো একথা বলতে পারো খানিয়াকে। আমার মনে হয় না ও অস্বীকার করবে।

বলেও যে লাভ হয়নি তা বোধহয় আমার চেয়ে আপনি ভালো জানেন। ফালতু কথা বাদ দিয়ে আসুন বাস্তব অবস্থাটা বিশ্লেষণ করে দেখা যাক-আমার মনে হয়েছে খানিয়া আতেন তার স্বামীকে নিয়ে সুখী নয়।

তোমার দৃষ্টি খুব প্রখর।

আমার আরও মনে হয়েছে, বলতে বলতে একটু লাল হলো লিওর মুখ, আমার প্রতি, সত্যি কথা বলতে কি, অযাচিত ভাবেই একটু বেশি সৌজন্য দেখাচ্ছে খানিয়া।

তোরণ-গৃহের সেই স্মৃতি স্মরণ করে বলছো তো?

না, শুধু তোরণ-গৃহে না, এখানে আসার পরও কিছু স্মৃতির জন্ম হয়েছে।

দাড়িতে হাত বুলাতে বুলাতে শামান বললো, তারপর?

তারপর আর বিশেষ কিছু না। সিমব্রি, আমি চাই না আপনার দেশের প্রথম রমণীর নামে কলঙ্ক রটুক।

কিছু এসে যায় না, কিছু এসে যায় না। তুমি যাকে কলঙ্ক বলছে তা নিয়ে এদেশের মানুষ খুব একটা মাথা ঘামায় না। যাহোক, কলঙ্ক ছাড়াই যদি সব ব্যাপার গুছিয়ে নেয়া যায়? যদি, ধরো, খানিয়া নতুন একটা স্বামী পছন্দ করে?

তা কি করে সম্ভব? এক স্বামী জীবিও আঁকতে আর এক স্বামী কি করে গ্রহণ করবে ও!

এখনকার স্বামী যদি আর বেঁচে থাকে? মরতে কতক্ষণ? খান র‍্যাসেন যে হারে মদ গিলছে আজকাল!

মানে লোকটাকে খুন করা হবে! ভয়ানক হয়ে উঠেছে লিওর চেহারা। না, শামান সিমব্রি, এ ধরনের কাজ আমার দ্বারা হবে না।

এমন সময় পেছনে একটা খসখস আওয়াজ শুনে আমি ঘাড় ফিরিয়ে তাকালাম। ঘরটার আয়তন দ্বিগুণ হয়ে গেছে। আমার একটু পেছনেই একটা পর্দা ঝুলছিলো। ভেবেছিলাম, ওটা বুঝি দেয়ালে ঝুলছে। এখন বুঝলাম, না, ঐ পর্দা দিয়ে ঘরটাকে দুভাগ করা হয়েছিলো। পর্দার ওপাশের অংশে শামানের শোয়ার জায়গা। মেঝেতে, বিছানায় পড়ে আছে তার যাদুবিদ্যার যন্ত্রপাতি, রাশিচক্র ইত্যাদি। আর পর্দা ধরে দাঁড়িয়ে আছে মূর্তির মতো খানিয়া আতেন।

অপরাধের কথা বললো কে? শীতল গলায় প্রশ্ন করলো সে। তুমি, প্রভু লিও?

চেয়ার থেকে উঠে খানিয়ার মুখোমুখি হলো লিও।

হয়তো আপনি আহত হয়েছেন, খানিয়া, কিন্তু আমি খুশি, আপনি আমার কথা শুনে ফেলেছেন।

কেন, আহত হবো কেন? অন্তত একজন সৎ সত্যবাদী লোকের দেখা পেলাম জীবনে। না, আমি তোমার কথায় মোটেই দুঃখ পাইনি। কিন্তু, লিও ভিনসি, নিয়তির লিখন খণ্ডানো কারও পক্ষেই সম্ভব নয়। যা একবার লেখা হয়ে গেছে তা, মোছা সম্ভব নয়।

নিঃসন্দেহে, খানিয়া; কিন্তু কি লেখা হয়ে গেছে?

ওকে বলো, শামান।

পর্দার ওপাশে চলে গেল সিমব্রি। একটা তুলোট কাগজের টুকরো নিয়ে এসে পড়তে লাগলো: স্বর্গ তার অনির্বাণ সংকেতের মাধ্যমে ঘোষণা করছে যে, পরবর্তী নতুন চাঁদের আগেই খান র‍্যাসেন মারা যাবে। দুর্গম পাহাড় পেরিয়ে যে আগন্তুক প্রভু এসেছে তার হাতে সে নিহত হবে।

স্বর্গ তাহলে মিথ্যা ঘোষণা করেছে, বললো লিও।

তা তোমার মনে হতে পারে, জবাব দিলো আতেন, কিন্তু যা পূর্ব নির্ধারিত তা ঘটবেই। আমার হাতে নয়, আমার কোনো ভৃত্যের হাতে নয়, তোমার হাতেই মরবে ও।

কিন্তু, আমার হাতে কেন? কেন হলির হাতে নয়? তবু, অমন কিছু যদি ঘটেই, খানের শোকাতুর স্ত্রী নিশ্চয়ই প্রতিশোধ নেবেন?

ঠাট্টা করছো, লিও ভিসি, আমার এই স্বামীকে আমি কি চোখে দেখি তা জানার পরও?

বুঝতে পারছি প্রকৃত সংকটের মুহূর্ত উপস্থিত। লিও-ও বুঝতে পেরেছে। ও বললো-আপনার উদ্দেশ্য কি পরিষ্কার করে বলুন, খানিয়া। আমাদের দুজনের জন্যেই তা মঙ্গলজনক হবে।

হ্যাঁ, বলবো, প্রভু। এই নিয়তি নির্ধারিত ব্যাপারের শুরু কোথায় আমি জানি না। যেখান থেকে জানতে শুরু করেছি সেখান থেকেই বলছি। শোনো, লিও ভিনসি, আমি যখন শিশু তখন থেকেই তুমি হানা দিয়ে চলেছে আমার মনে। প্রথম যখন তোমাকে নদীর পাড়ে দেখি, তোমার মুখ আমার অপরিচিত মনে হয়নি। বরং মনে হয়েছে, যেন কতদিনের চেনা। স্বপ্নের ভেতর তোমার সাথে আমার এই পরিচয়। আমি তখন খুব ছোট, নদীর তীরে ফুলের ভেতর শুয়ে ছিলাম একদিন, তুমি সেদিন প্রথম এলে আমার স্বপ্নে—বিশ্বাস না হয় আমার চাচাকে জিজ্ঞেস করে দেখ, সত্যি বলছি কিনা। তুমিও তখন খুব ছোট। তারপর বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে একটা নির্দিষ্ট সময় পরপর তুমি এসেছো আমার ঘুমের ভেতর। অবশেষে আমি বুঝতে শিখেছি তুমি আমার। আমার হৃদয়ের যাদুই আমাকে এ জ্ঞান দিয়েছে।

তারপর অনেক বছর কেটে গেছে, তুমি আরও কাছাকাছি হয়েছে আমার; ধীরে, খুব ধীরে কিন্তু প্রতি মুহূর্তেই কাছে এসেছে। অবশেষে বহু প্রতীক্ষিত দিনটি এলো। পাহাড় পেরিয়ে, মরুভূমি তুষার পেরিয়ে সশরীরে তুমি এলে আমার সামনে (তিন চাঁদ আগে এক রাতে চাচা শামানের সঙ্গে বসে ছিলাম আমি এই ঘরে, যাদুবিদ্যার পাঠ নিচ্ছিলাম। সেই সময় হঠাৎ অলৌকিক এক দৃশ্য ভেসে, উঠলো আমার মনের পর্দায়।

তোমাকে দেখলাম-হা, স্বপ্নে নয়, জেগে জেগে। দেখলাম, তুমি আর তোমার সঙ্গী কোনোমতে ঝুলে আছে সেই গিরিখাতের মাঝামাঝি এক ভাঙা বরফের কানায়। দেরি না করে চাচাকে নিয়ে চলে গেলাম সেখানে। বুকের ভেতর দুরু দুরু করছিলো, হয়তো এরমধ্যে ঐ ভয়ানক জায়গা থেকে পড়ে মরে গেছে তোমরা।

তারপর, যখন আমরা অপেক্ষা করছি, হঠাৎ দেখতে পেলাম ছোট দুটো মূর্তি, অনেক উপরে, বিপজ্জনকভাবে নেমে আসছে বরফের থাম বেয়ে। বাকিটুকু তোমরা জানো। রুদ্ধশ্বাসে আমরা দেখলাম, তুমি পড়ে গিয়ে ঝুলতে লাগলে রশি বাঁধা অবস্থায়। হ্যাঁ, তারপর তোমার সাহসী সঙ্গীকে দেখলাম, তোমার পেছন পেছন ঝাঁপ দিলো।

কিন্তু, শেষ পর্যন্ত কে উদ্ধার করলো তোমাকে? চাচা লাঠি এগিয়ে দিয়েছিলো। কোনো লাভ হয়েছিলো তাজে আসলে সব নিয়তির বিধান, তুমি আমি চাইলেই কি খণ্ডাতে পারবো?

শেষ করলো আতেন। একটু ঝুঁকে বসলো টেবিলে। লিওর দিকে চোখ।

আপনি আমাকে বাঁচিয়েছেন, লিও বললো, সেজন্যে আবার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। কিন্তু যা বললেন তা যদি সত্যি হয় আরেকজনকে বিয়ে করলেন কেন?

এবার যেন কুঁকড়ে গেল খানিয়া।

ওহ! সেজন্যে আমাকে দোষ দিও না। দেশের স্বার্থে পাগলটাকে বিয়ে করতে হয়েছে। সবাই এমনভাবে ধরেছিলো। হ্যাঁ, তুমিও, চাচা সিমব্রি। কেন? জনগণের স্বার্থে র‍্যাসেন আর আমার রাজ্যের ভেতর যুদ্ধ বন্ধ করা দরকার। ওকে বিয়ে করলেই তা নাকি সবচেয়ে সহজে সম্ভব। হায়রে জনগণ! হায়রে আমার দেশ!

বুঝলাম আপনার দোষ নেই, বললো লিও। কিন্তু ইচ্ছায় হোক, অনিচ্ছায় হোক ঐ লোকটাকে বিয়ে করে যে গেরো আপনি দিয়েছেন, ওর প্রাণ হরণ করে আমি কেন তা কাটতে যাবো? তাছাড়া স্বর্গের ঘোষণা আর অলৌকিক দর্শনের যে কথা আপনি বলছেন তা আমি এক বিন্দু বিশ্বাস করিনি। আপনি আমাদের উদ্ধার করতে গিয়েছিলেন, কারণ মহাশক্তিমতি হেসা, অগ্নিপর্বতের আত্মা আপনাকে  সেরকমই নির্দেশ দিয়েছিলেন।

তড়াক করে লাফিয়ে উঠলো আতেন। তুমি কি করে জানলে একথা?

যেমন করে আরও অনেক কিছু জেনেছি। দেখুন, আমার মনে হয় আপনি সত্যি বললেই ভালো করবেন।

কালো হয়ে গেল আতেনের মুখ। থুতনি ডুবে গেল বুকে। তীব্র ক্রোধে ফিসফিস করে উঠলো, কে বললো এ কথা? শামান, তুমি? ছোবল দিতে উদ্যত ফনিনীর মতো চাচার দিকে তাকালো সে।

আতেন, আতেন! মিনতি ভরা কণ্ঠস্বর সিমব্রির। শান্ত হও! তুমি ভালো। করেই জানো, আমি বলিনি।

তাহলে তুই, বানরমুখো ভবঘুরে, শয়তানের তল্পিবাহক, তুই-ই বলেছিস! ওহ! কেন তোকে প্রথমেই খুন করলাম না? ঠিক আছে, ভুলটা শুধরে নেবার সময় এখনও শেষ হয়ে যায়নি।

এই যে, ভদ্রমহিলা, অত্যন্ত মসৃণ গলায় আমি জবাব দিলাম, তোমার চাচার মতো আমাকেও কি যাদুকর ভেবেছো?

আচমকা আমার মুখে তুমি সম্বোধন শুনে একটু থমকালো খানিয়া। কিন্তু মুহূর্তের জন্যে। তারপর বললো, হ্যাঁ, আমবিশ্বাস তুই-ও যাদুকর। আর ঐ পাহাড়ের আগুনের ভেতর থাকে তোর জর্নিবানি, যে তোকে শিখিয়েছে এই বিদ্যা।

ছি ছি, খানিয়া, তোমার মতো একজন মহিলার মুখে এমন কুৎসিত ভাষা! যাকগে, এখন বলো, আমরা আসার পর যে সংবাদ পাঠিয়েছে তার জবাবে হেসা কি বলেছেন?

শোনো, ও জবাব দেয়ার আগেই লিও বলে উঠলো, ও-ও এখন তুমি করে সম্বোধন করছে খানিয়াকে। আমি একটা দৈব প্রশ্নের জবাব পাওয়ার জন্যে ঐ পাহাড়ে যাবো, তারপর তোমরা মীমাংসা কোরো কে বেশি ক্ষমতাবান, কালুনের খানিয়া না অগ্নি-গৃহের হেসা।

শুনলো আতেন। নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইলো কয়েক মুহূর্ত। তারপর একটু হেসে বললো-এ-ই তোমার ইচ্ছা? কিন্তু, আমার মনে হয় না ওখানে এমন কেউ আছে যাকে তুমি বিয়ে করতে চাইতে পারো। ওখানে আগুন আর নির্লজ্জ অশুভ আত্মা ছাড়া তো কিছু নেই, গভীর দুঃখে উচ্চারণ করছে এমন ভঙ্গিতে ধীরে ধীরে বললো খানিয়া।

আমার দেশের কিছু গোপন ব্যাপার আছে, একই রকম শীতল গলায় বলে চললো সে, কোনো বিদেশীকেই সেসব জানতে দেয়া হবে না। আমি আবার তোমাকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি, আমি বেঁচে থাকতে ওই পাহাড়ে যেতে তুমি পারবে না। আরও শুনে রাখো, লিও ভিনসি, আমি তোমার সামনে আমার হৃদয় মেলে দিয়েছি, জবাবে কি শুনেছি?-আমার খোঁজে তুমি আসোনি। এসেছো এক ডাইনীর খোঁজে। শুনে রাখো, লিও ভিনসি, ওকে তুমি কখনোই পাবে না। আমি তোমাকে আর কিছু বলবো না। তবে তুমি খুব বেশি জেনে ফেলেছে। আর সময় দেয়া যায় না, কাল সূর্যাস্তের ভেতর তোমাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, আতেনের প্রতিশোধ স্পৃহার শিকার হবে, না তার প্রেমের মর্যাদা দেবে। আমি চাই না। আমার দেশের মানুষ বলাবলি করার সুযোগ পাক, তাদের খানিয়া এক বিদেশীকে প্রেম-নিবেদন করে প্রত্যাখ্যাত হয়েছে।

ধীরে ধীরে, গাঢ় অথচ অনুচ্চ স্বরে ও বলে গেল কথাগুলো। প্রতিটা শব্দ যেন বিন্দু বিন্দু রক্ত হয়ে ঝরে পড়লো ওর ঠোঁট থেকে। দৃশ্যটা কখনও ভুলবো না আমি। নিশাচর পাখির মতো মিটমিটে চোখে তাকিয়ে আছে বৃদ্ধ যাদুকর, পাশে রাজকীয় ভঙ্গিতে দাঁড়ানো কালুনের দীর্ঘদেহী তন্বী রানী আতেন। দুজনেরই দৃষ্টি লিওর বিরাট অবয়বটার দিকে। একজনের চোখে ভয় মেশানো প্রশ্ন, অন্যজনের দৃষ্টিতে জিঘাংসা। বুঝতে পারছি এখন কিছু একটা বলা দরকার, কিন্তু কি, ভেবে পাচ্ছি না। আমিও ওদের মতোই নির্বাক তাকিয়ে আছি ওদের দিকে।

হঠাৎ খসখস একটা শব্দ হলো পেছনে। ঘাড় ফিরিয়ে তাকালাম আমি। অন্ধকার কোণে দাঁড়িয়ে আছে দীর্ঘ এক ছায়া মূর্তি। আমার সাথে চোখাচোখি হওয়া মাত্র সামনে এগিয়ে আসতে লাগলো সে। আলোর ভেতর চলে এলো। তারপর তীব্র শব্দে ফেটে পড়লো বুনো অট্টহাসিতে।

ছায়ামূর্তি আর কেউ নয়, খান।

মুখ তুলতেই আতেনও দেখতে পেলো তাকে। ভয়ানক ক্রোধে জ্বলে উঠলো খানিয়ার চোখ।

এখানে কি করছো, র‍্যাসেন? গর্জে উঠলো সে। আমার পেছনে উঁকি মারতে এসেছো? যাও, তোমার রাজসভার মদ আর মেয়েমানুষের কাছে ফিরে যাও!

এখনও হেসে চলেছে লোকটা, হায়েনা যেমন হাসে।

কি শুনেছো তুমি? জিজ্ঞেস করলো আতেন, যে এত খুশি হয়ে উঠেছো?

কি শুনেছি? ওহহ! আমি শুনেছি, খানিয়া, আমার স্ত্রী, আমার প্রিয়তমা স্ত্রী, আমার সভার মেয়েমানুষদের দেখলে ঘেন্নায় যার নাক কুঁচকে ওঠে, আমার সেই স্ত্রী আমাকে কেন বিয়ে করেছিল। আমি শুনেছি, আমার সেই প্রিয়তমা স্ত্রী এক হলদে দাড়িওয়ালা বিদেশীর কাছে প্রেম নিবেদন করেছে, আর সেই বিদেশী তাকে প্রত্যাখ্যান করেছে হা-হা-হি-হি-হি… তীব্র তীক্ষ্ণ্ণ হয়ে উঠলো তার হাসির শব্দ। এমনভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে, আমি আমার প্রাসাদের সবচেয়ে নিকৃষ্ট মেয়েটাকেও অমনভাবে প্রত্যাখ্যান করতে পারতাম না।

আমি আরও শুনেছি একটা জানা কথা—আমি পাগল। বিদেশীরা, শোনো, আমি পাগল, কারণ জানো? ঐ—ঐ নরকের কীট, ইদুরের বাচ্চা, হাত তুলে সিমব্রির দিকে ইশারা করলো সে, বিয়ের ভোজে আমার মদের সাথে ওষুধ মিশিয়ে দিয়েছিলো। ভালোই কাজ করেছে ওর ওষুধ। সত্যি কথা বলছি, খানিয়া আতেনের চেয়ে বেশি ঘৃণা আমি কাউকে করি না। ওর স্পর্শে আমার গা গুলিয়ে ওঠে, বাতাস বিষিয়ে যায় ওর উপস্থিতিতে।

হলদে-দাড়ি, তোমারও নিশ্চয়ই তেমন হয়েছে? ঐ বুড়ো ইঁদুরের কাছে প্রেম জাগানিয়া ওষুধ, চাও, পারবে দিতে, দেখবে কত সুন্দর, মিষ্টি-মোহনীয় লাগছে ওকে। কয়েকটা মাস পরম আনন্দে কাটিয়ে যেতে পারবে। আবার সেই তীক্ষ্ণ্ণ তীব্র হাসি হেসে উঠলো র‍্যাসেন।

নিঃশব্দে, পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুনলো আতেন। তারপর ঘুরে দাঁড়িয়ে কুর্নিশ করলো আমাদের।

অতিথিরা, বললো সে, আমার সম্পূর্ণ অনিচ্ছায় ঘটে যাওয়া এই ঘটনার জন্যে আমি ক্ষমা চাইছি। কি করবে বলো দুর্নীতির পঙ্কে নিমজ্জিত অশুভ এক দেশে তোমরা এসেছে। খান র‍্যাসেন, তোমার নিয়তি নির্ধারিত হয়ে গেছে, আমি তাকে ত্বরান্বিত করতে চাই না। কারণ, সামান্য সময়ের জন্যে হলেও অন্তত একবার আমরা সত্যিই কাছাকাছি এসেছিলাম। চাচা সিমব্রি, আমার সাথে চলো। আমার এখন অবলম্বন দরকার, তুমি ছাড়া আর কে আছে আমার?

উঠে দাঁড়িয়ে পায়ে পায়ে এগোলো বৃদ্ধ শামান। খানের সামনে পৌঁছে থামলো একটু। স্থির চোখে তার পা থেকে মাথা পর্যন্ত দৃষ্টি বুলালো। তারপর বললো-আমার চোখের সামনে তোমার জন্ম, র‍্যাসেন, অশুভ এক মেয়েমানুষের গর্ভে, আমি ছাড়া আর কেউ জানে না তোমার বাপের পরিচয়। সে রাতে অগ্নি পর্বতের চূড়ায় আগুন লকলকিয়ে উঠেছিলো, তারারা মুখ লুকিয়েছিলো লজ্জায়। তোমাকে বড় হয়ে উঠতে দেখেছি আমি, র‍্যাসেন, তোমার লাম্পট্যও দেখেছি, তোমারই বিয়ের ভোজ থেকে তুমি উঠে গিয়েছিলে এক স্বৈরিণীর গলা জড়িয়ে ধরে। চাষীদের উর্বরা চাষের জমি কেড়ে নিয়ে তুমি বাগান বানিয়েছে। যাদেরটা নিলে তারা বাঁচলো কি মরলো দেখারও প্রয়োজন বোধ করেনি। ভেবেছো এসবের প্রতিফল তুমি পাবে না? অবশ্যই পাবে, খান র‍্যাসেন, কি ভয়ঙ্কর প্রতিফল তুমি কল্পনাও করতে পারবে না। শিগগিরই তুমি মরবে, র‍্যাসেন, যন্ত্রণাদায়ক রক্তাক্ত মৃত্যু তোমাকে গ্রাস করবে। তোমার চেয়ে যোগ্য কেউ তখন তোমার জায়গা দখল করবে। দেশে স্বস্তি ফিরে আসবে।

ভয়ে কাঁটা হয়ে শুনছি আমি। প্রতি মুহূর্তে মনে হচ্ছে, এই বোধহয় খান তলোয়ার বের করে দুটুকরো করে ফেললো বৃদ্ধকে। কিন্তু আশ্চর্য, তেমন কিছু করলো না র‍্যাসেন, বরং কুঁকড়ে গেল যেন। পা পা করে পিছিয়ে গেল তার সেই কোনায়। দৃষ্টি নেমে এসেছে মাটিতে, থুতনি ঠেকেছে গলায়।

আতেনের পাশে গিয়ে তার হাত ধরলো সিমব্রি। দরজার কাছে পৌঁছে ঘুরে দাঁড়ালো আবার। একই রকম নিরুদ্বেগ, নিষ্কম্প গলায় বললো, খান র‍্যাসেন, আমি তোমাকে তুলেছি, আমিই তোমাকে নামিয়ে আনবো। রক্তাক্ত অবস্থায় যখন মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাবে তখন স্মরণ কোরো আমার কথা।

ওদের পায়ের শব্দ মিলিয়ে গেল ধীরে ধীরে। কোনা থেকে বেরিয়ে এলো রাসেন।

গেছে ওরা? হাত দিয়ে ঘেমে ওঠা ভুরু মুছতে মুছতে সে জিজ্ঞেস করলো।

হ্যাঁ, জবাব দিলাম আমি।

আমাকে কাপুরুষ ভাবছো? কাঁপা কাঁপা গলায় বললো সে। সত্যি বলছি, আমি ওদের ভয় পাই, হলুদ-দাড়ি, সময় হলে তোমাকেও পেতে হবে। উহ! কি ভয়ানক মেয়েমানুষ। স্বামী হিসেবে ওর শোয়ার ঘরে ঢোকার চেয়ে রাঁধুনী হিসেবে রান্নাঘরে ঢুকলেই ভালো করতাম। প্রথম থেকেই আমাকে ঘৃণা করে। এবং যতই আমি গভীরভাবে ভালোবাসতে চেয়েছি ততই ও ঘৃণা করেছে আমাকে। এখন আমি বুঝতে পারছি, কেন, ভুরু কুঁচকে লিওর দিকে তাকালো র‍্যাসেন। বুঝতে পারছি কেন ও সব সময় অমন শীতল থেকেছে—কারণ, একজন মানুষ। এমন একজন মানুষ যার মনের বরফ গলানোর জন্যে ও তুলে রেখেছিলো ওর হৃদয়ের উষ্ণতা, আমাকে বা কাউকে বিতরণ করেনি একবিন্দু।

এতক্ষণ চুপচাপ শুনছিলো লিও। এবার এগিয়ে এলো দুপা। জিজ্ঞেস করলো, একটু আগের কথাবার্তায় আপনার কি মনে হয়েছে, খান? বরফ গলতে শুরু করেছে?

না—অবশ্য আমার ধারণা, তার কারণ আগুন এখনও ভালো করে জ্বলে ওঠেনি। আতেনকে আমি চিনি, এত সহজে ও শান্ত হবে না।

এবং বরফ যদি আগুনের ওপর গিয়ে পড়তে চায়? শুনুন, খান, ওরা বলছে আমি নাকি আপনাকে হত্যা করবো, কিন্তু আমার তেমন কোনো ইচ্ছে নেই। আপনি হয়তো ভাবছেন, আপনার স্ত্রীকে আমি ভাগিয়ে নিয়ে যাবো, সত্যি বলছি তেমন কোনো ইচ্ছেও আমার নেই। আমি আর আমার এই সঙ্গী যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পালাতে চাই আপনাদের এই শহর ছেড়ে। দিন রাত যেভাবে আমাদের পাহারা দিয়ে রাখা হয়েছে, একমাত্র আপনিই পারেন আমাদের মুক্ত করে দিতে। তাতে আপনিও বাঁচবেন আমরাও বাঁচবো।

ধূর্ত চোখে তাকালো ওর দিকে খান। ধরো আমি দিলাম মুক্ত করে, তখন তোমরা কোথায় যাবে? যে পথে এসেছে সে পথে যেতে পারবে না, একমাত্র পাখিদের পক্ষেই সম্ভব ঐ গিরিখাদের ওপরে ওঠা। তাহলে?

আমরা যাবো অগ্নি-পর্বতে। ওখানে কাজ আছে আমাদের।

স্থির চোখে ধান কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো লিওর দিকে। পাগল আমি না তোমরা? অগ্নি-পর্বতে যেতে চাও! আমি তোমাদের বিশ্বাস করি না। কিন্তু… একটু যেন ভাবনায় পড়ে গেল সে, কিন্তু যদি তোমরা যাও, নিশ্চয়ই ফিরেও আসবে একদিন। তখন যে ওখান থেকে দলবল নিয়ে আসবে না তার নিশ্চয়তা কি? আমার বউকে তো নেবেই দেশটাও নেবে।

না, না, ব্যগ্রভাবে বললো লিও। সত্যিই বলছি অমন কোনো উদ্দেশ্য আমাদের নেই। আপনার স্ত্রীর এক বিন্দু হাসি বা আপনার দেশের এক কণা জমিও আমরা চাই না। ব্যাপারটা বুঝতে চেষ্টা করুন, তা যদি চাইতাম, প্রথম দিনই খানিয়ার প্রস্তাবে রাজি হয়ে যেতাম। আমাদের চলে যেতে দিন, আপনি নির্বিঘ্নে রাজত্ব করুন, স্ত্রীকে বশ মানান।

চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো খান। একটা হাত আনমনা ভঙ্গিতে দুলছে শরীরের পাশে। হঠাৎ অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো সে। আমি ভাবছি, হাসি থামিয়ে বললো, আতেন যখন জানবে পাখি পালিয়েছে, তখন কি করবে? আমার ওপর খেপে উঠবে, তোমার খোঁজে তোলপাড় করে ছাড়বে সারা দেশ।

উহুঁ, আমার মনে হয় না যতটুকু রেগেছে তার চেয়ে বেশি রাগার কিছু আছে, আমি বললাম। আপনি সামাদের একটা রাত সময় দেবেন শুধু, আর দেখবেন খোঁজ শুরু করতে যেন একটু দেরি হয়। ব্যস আর চিন্তা নেই, আমাদের খুঁজে পাবে না।

তুমি ভুলে গেছো, ঐ বুড়ো ইদুর যাদু জানে। কোন পথে তোমরা আসবে তা যখন জানতে পেরেছে, কোথায় খুঁজতে হবে তা-ও জানতে পারবে। তবু, তবু ওর চেহারা কেমন হয় দেখার লোভ আমি সামলাতে পারছি না, ও, হলদে-দাড়ি, তুমি কোথায়, হলদে-দাড়ি? ফিরে এসো, হলদে-দাড়ি, তোমার বরফ গলাতে দাও। শেষের কথাগুলো আতেনের স্বর নকল করে বলে গেল সে। তারপর আবার হেসে উঠলো হা-হা করে। আচমকা হাসি থামিয়ে জিজ্ঞেস করলো, কতক্ষণের ভেতর তৈরি হতে পারবে তোমরা?

আধ ঘণ্টা, আমি জবাব দিলাম।

বেশ, তোমাদের ঘরে চলে যাও। তৈরি হতে লাগো, আমি এক্ষুণি আসছি।

১১-১৫. শূন্য কামরা পেরিয়ে বারান্দায়

১১.

শূন্য কামরা পেরিয়ে বারান্দায়, এলাম। বারান্দা থেকে উঠানে। খান পথ দেখাচ্ছে। উঠানে পৌঁছুতেই সে ফিসফিস করে বললো, ছায়ায় ছায়ায় এসো।

আকাশে পূর্ণ চাদ। স্পষ্ট আলোয় হাসছে চারদিক। এখনও কাউকে দেখিনি, আমাদেরও কেউ দেখেনি বলেই মনে হয়। তবু ভেবে পেলাম না, শেষ পর্যন্ত প্রাসাদ ফটুক বা নগর তোরণ পেরোবো কি করে। ওসব জায়গায় খানিয়ার নির্দেশে প্রহরীর সংখ্যা দ্বিগুণ করা হয়েছে।

দরজার দিকে গেল না খান। ওটাকে ডানে রেখে সরু একটা পথ ধরে প্রাসাদের প্রাচীরের কাছে নিয়ে এলো আমাদের। জায়গাটা ঝোপঝাড়ে ছাওয়া। ঝোপের পেছনে ছোট একটা গুপ্ত দরজা। পকেট থেকে চাবি বের করে তালা খুললো র‍্যাসেন। দরজা পেরিয়ে দেখলাম সামনে প্রাসাদের বাইরের দেয়াল ঘেরা বাগান। ফটকের দিকে এগিয়ে চললাম আমরা খানের পেছন পেছন।

আর সামান্য গেলেই প্রাসাদ ফটক। এই সময় একটা অন্ধকার ঝোপ দেখিয়ে আমাদের অপেক্ষা করতে বলে চলে গেল খান। একটু ভয় ভয় করতে লাগলো আমাদের। এখন যদি খান চার-পাঁচজন বিশ্বস্ত লোক নিয়ে এসে আমাদের ওপর চড়াও হয়? খুন করে লাশ গুম করে ফেলে?

কিন্তু না, তেমন কিছু ঘটলো না। দুটো সাদা ঘোড়া নিয়ে ফিরে এলো র‍্যাসেন একটু পরেই।

উঠে পড়ো, ফিসফিস করে সে বললো, আমার মতো মুখ ঢেকে নাও আলখাল্লা দিয়ে।

বিনাবাক্যব্যয়ে নির্দেশ পালন করলাম আমরা।

এবার এসো আমার পেছন পেছন, বলে দৌড়াতে শুরু করলো খান। প্রাচীনকালের অভিজাত বা জমিদারদের আগে আগে যেমন দৌড়বিদ দৌড়াতো তেমন। আমরাও ঘোড়া ছোটালাম। কেউ বাধা দেয়ার আগেই পেরিয়ে গেলাম উঁচু পাচিল ঘেরা বাগানের ফটক। রক্ষীরা পিছু নিলো না; সম্ভবত ভাবলো কালুনের দুই অভিজাত ব্যক্তি খান বা খানিয়ার কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছে।

শহরের প্রধান সড়ক ছেড়ে অলিগলি দিয়ে আমাদের নিয়ে চললো র‍্যাসেন। রাত এখন অনেক। পথে খুব একটা লোকজনের সাথে দেখা হলো না। একটু পরে নগর প্রাচীর পেরোলাম। সামনে নদী। আসার সময় যেখানে নৌকা থেকে নেমেছিলাম সেদিকে গেল না খান। অন্য একটা পথ ধরে ছোট একটা জেটির কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। লাগাম টেনে ধরলাম আমরা। জেটির সঙ্গে বাঁধা একটা খেয়া নৌকা।

ঘোড়াসুদ্ধ এই খেয়ায় চড়ে নদী পেরোতে হবে তোমাদের, বললো র‍্যাসেন। পুলগুলো সব পাহারা দিচ্ছে রক্ষীরা। নিজেকে প্রকাশ না করে ওগুলোর কোনোটা দিয়ে তোমাদের পার করে দিতে পারবো না।

একটু কষ্ট হলো, তবে শেষ পর্যন্ত ঘোড়া দুটোকে ওঠাতে পারলাম নৌকায়। আমি লাগাম ধরে দাঁড়িয়ে রইলাম, দাঁড় তুলে নিলো লিও।

নদীর মাঝামাঝি পৌঁছুইনি তখনও, জেটির ওপর থেকে ভেসে এলো অট্টহাসির শব্দ। তারপর র‍্যাসেনের কণ্ঠস্বর-পালাও, বিদেশীরা, জলদি পালাও, পেছনেই আসছে মৃত্যু, হা-হা-হা-হা… ঘুরে দাঁড়ালো সে। পেছনে আলখাল্লা উড়িয়ে দ্রুত নেমে গেল জেটি থেকে।

অশুভ আশঙ্কায় পূর্ণ হয়ে উঠলো আমাদের অন্তর। কিছু একটা ফন্দি এঁটেছে খান। কিন্তু কি, বুঝতে পারছি না।

বেয়ে চলো, লিও, দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম।

নদীতে স্রোত প্রবল বলে সরাসরি ওপারে গিয়ে পৌঁছুতে পারলাম না। নৌকা তীরে নিতে নিতে স্রোতের টানে ভাটির ঠিকে বেশ খানিকটা চলে গেলাম। অবশেষে তীরে নামলাম আমরা। ঘোড়া দুটোকে নামালাম। তারপর ওদের পিঠে উঠে ছুটিয়ে দিলাম দূরে পাহাড়-চূড়ার গনগনে আভা লক্ষ্য করে।

প্রথম কিছুক্ষণ বেশি দ্রুত এগোতে পারলাম না, কারণ কোনো পথ খুঁজে পেলাম না। মাঠের ভেতর দিয়ে এগিয়ে চলেছি। অবশেষে একটা গ্রামের কাছে পৌঁছে পথের দেখা পাওয়া গেল। এবার একটু জোরে ঘোড়া ছোটাতে পারলাম।

সারারাত একটানা ছুটে চললাম। ভোরের কিছু আগে চাঁদ ডুবে গেল। অন্ধকার হয়ে গেল চারদিক। দূরে অগ্নি-পর্বতের চূড়ায় লাল একটা আভা ছাড়া আর কোনো আলো দেখতে পাচ্ছি না। পথে কোথাও খানাখন্দক আছে কিনা জানি না। আপাতত কিছুক্ষণ যাত্রা বিরতি করার সিদ্ধান্ত নিলাম। নিজেদের, এবং ঘোড়াগুলোকেও একটু বিশ্রাম দিতে হবে।

একটু পরে ধূসর হয়ে এলো আকাশ। পথের পাশে ক্ষেতে নামিয়ে দিলাম ঘোড়া দুটোকে। বেশিক্ষণ লাগলো না ওদের পেট ভরতে। কিছু দূরে একটা খালে নিয়ে গিয়ে পানি খাওয়ালাম। তারপর আবার ছুটে চলা।

সূর্য ওঠার কিছুক্ষণের ভেতর মাঠের এখানে ওখানে দেখা যেতে লাগলো কৃষকদের। সাত সকালে চলে এসেছে কাজ করতে। আমাদের ওপর দৃষ্টি পড়া মাত্র হাঁ করে চেয়ে রইলো ওরা, কালুন নগরীর লোকরা যেমন তাকিয়ে থাকতো তেমন। দেখার সঙ্গে সঙ্গে ওরা বুঝে ফেলেছে আমরা কারা। অনেকেই চিৎকার করে বললো, তোমরা যাও, আমাদের বৃষ্টি ফিরিয়ে দাও। এক গ্রামের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় গ্রামবাসীরা লাঠিসোটা নিয়ে আক্রমণই করে বসলো। তীর বেগে ঘোড়া ছুটিয়ে সেযাত্রা রক্ষা পেলাম আমরা।

সন্ধ্যা নাগাদ ধারণা করলাম, কালুনের শেষ সীমায় পৌঁছে গেছি। এমন ধারণার কারণ, এক জায়গায় বেশ দূরে দূরে কয়েকটা পর্যবেক্ষণ চূড়া দেখতে পেলাম। তবে কোনো সৈনিক বা রক্ষী দেখলাম না। সম্ভবত প্রাচীনকালে, কালুনের খানরা যখন বহিঃশত্রুর আক্রমণ আশঙ্কা করতো তখন তৈরি করা হয়েছিলো চূড়াগুলো। এখনকার শাসকশ্রেণী বাইরের আক্রমণ আশঙ্কা করে না, তাই পাহারা রাখারও প্রয়োজন বোধ করেনি।

পর্যবেক্ষণ চূড়াগুলো পেরিয়ে কিছুদূর আসার পর সূর্য ডুবে গেল। ঘোড়াগুলোকে একটু বিশ্রাম দেয়ার জন্যে থামলাম আমরা। চাঁদ উঠলেই আবার রওনা হবো।

জিন খুলে নিয়ে ঘোড়া দুটোকে ছেড়ে দিলাম চরে বেড়ানোর জন্যে। আশেপাশে পানি নেই। তবে ও নিয়ে ভাবলাম না। ঘণ্টাখানেক আগে পথের পাশের এক জলা থেকে ওদের পানি খাইয়ে নিয়েছি। আপাতত পানি না খেলেও চলবে। কাল রাতে প্রাসাদ ছেড়ে বেরোনোর আগে কিছু খাবার সংগ্রহ করতে পেরেছিলাম, তার খানিকটা খেয়ে নিলাম আমরা। সারারাত এবং দিনের ছুটে চলা শেষে খাবারটুকুর সত্যিই খুব প্রয়োজন বোধ করছিলাম। কিছুক্ষণ ঘাস খেলে ঘোড়াগুলো। তারপর ক্লান্তি দূর করার জন্যে গড়াগড়ি করতে লাগলো; পিঠ মাটিতে, পা-গুলো আকাশে। আমরা ঘাসের ওপর বসে দেখতে লাগলাম ওদের গড়াগড়ি খাওয়া।

একটু একটু করে আঁধার হয়ে আসছে চারদিক। ঘোড়াগুলোর গড়াগড়ি শেষ। ধীরে ধীরে পা নামিয়ে আনলো ওরা। প্রথমে আমার ঘোড়াটা। লিও বসে ছিলো ওটার কাছেই।

আরে ওর খুরগুলো অমন লাল কেন? বিস্মিত কণ্ঠে প্রশ্ন করলো ও। কেটে গেছে নাকি?

দিন শেষের অস্পষ্ট আলোয় আমিও এবার খেয়াল করলাম লাল দাগগুলো। উঠে গেলাম পরীক্ষা করার জন্যে। স্মরণ করার চেষ্টা করলাম লাল মাটির কোনো এলাকা দিয়ে এসেছি কিনা। মনে পড়লো না। বসে এক হাতে তুলে নিলাম ঘোড়াটার এক পা। বিশ্রী একটা গন্ধ ঝাঁপটা মারলো নাকে। কস্তুরী এবং গরম মসলার সঙ্গে রক্ত মেশালেই কেবল এমন গন্ধ ছুটতে পারে।

আশ্চর্য! অবশেষে বললাম আমি। দেখি, লিও, তোমার ঘোড়ার পা–।

এক অবস্থা এটারও। উৎকট গন্ধওয়ালা কোনো জিনিসে চুবিয়ে নেয়া হয়েছিলো খুরশুলো।

খুব বেশি চাপ পড়লেও খুরের যেন ক্ষতি না হয় সেজন্যে স্থানীয়দের কোনো পদ্ধতি বোধহয়, বললো লিও। আমরা যেমন নাল ব্যবহার করি অনেকটা তেমন আর কি।

এক মুহূর্ত ভাবলাম। ভয়ঙ্কর একটা চিন্তা উঁকি দিয়ে গেল আমার মনে।

না, লিও, আমার তা মনে হয় না। আমি তোমাকে ঘাবড়ে দিতে চাই না, তবে—তবে আমার মনে হচ্ছে, এক্ষুণি রওনা হয়ে গেলেই আমরা ভালো করবো।

কেন?

আমার ধারণা এটা ঐ খানেরই কীর্তি।

খানের কীর্তি! কি কারণে ও এমন করবে? ঘোড়াগুলোকে খোড়া করে দিতে চায়?

না, লিও, ও চায় ওরা ছোটার সময় শুকনো মাটিতে তীব্র গন্ধ রেখে যাক।

চমকে উঠলো লিও। মানে–মানে তুমি বলতে চাও, ঐ কুকুরগুলো?

মাথা ঝাঁকালাম আমি। এবং কথা বলে আর এক মুহূর্তও নষ্ট না করে জিন চাপালাম ঘোড়ায়। শেষ ফিতেটা সবে বাঁধা হয়েছে কি হয়নি, দূর থেকে ভেসে এলো অস্পষ্ট আওয়াজ।

শুনেছো? বললাম আমি। আবার এলো শব্দ। এবং এবার কোনো সন্দেহ রইলো না, ওগুলো কুকুরের ডাক।

ও ঈশ্বর। মরণ-শ্বাপদ! চিৎকার করলো লিও।

হ্যাঁ, আমাদের পরম বন্ধু খান শিকারে বেরিয়েছে। এতক্ষণে বুঝতে পারছি ওর সেই হাসির মর্ম।

এখন কি করবো আমরা? ঘোড়াগুলো রেখে হেঁটে যাবো?

পাহাড়টার দিকে তাকালাম। ওটার পাদদেশের সবচেয়ে কাছের অংশ এখনও বহু বহু মাইল দূরে।

উঁহুঁ, পায়ে হেঁটে অত দূর যেতে পারবো না,,পারলেও সে সুযোগ বোধহয় পাওয়া যাবে না। প্রথমে ঘোড়াগুলোকে ছিঁড়ে খাবে কুকুরের পাল, তারপর বিড়াল যেমন ইঁদুর ধরে তেমনি করে ধরবে আমাদের। না, লিও, ঘোড়ায় চড়েই যেতে হবে।

লাফ দিয়ে জিনের ওপর চড়ে বসলাম। লাগামে টান দেয়ার আগে একবার ঘাড় ফিরিয়ে চাইলাম। সন্ধ্যার অস্পষ্ট আলোয় দূরে দেখতে পেলাম এক দঙ্গল খুদে খুদে অবয়ব। সেগুলোর মাঝে এক অশ্বারোহী। লাগাম ধরে অন্য একটা ঘোড়া ছুটিয়ে আনছে পেছন পেছন।

পুরো পাল নিয়ে আসছে, গম্ভীর ভাবে বললো লিও। বদলি ঘোড়াও আছে সঙ্গে।

ঘোড়া ছুটিয়ে দিলাম আমরা।

.

মৃদু ঢালের একটা চূড়া অতিক্রম করলাম। তারপরই শুরু হলো উঁচু নিচু পাথুরে, জমি। ধীরে ধীরে ঢালু হয়ে একটা নদীতে গিয়ে মিশেছে। মাঝে মাঝে ছোট বড় ঝোপঝাড়। কয়েক মাইল নিচে দেখতে পাচ্ছি পাহাড়ের পাদদেশ ঘেঁষে বয়ে যাওয়া নদীটা। দুঘণ্টা একটানা ছুটিয়ে নিয়ে চলেছি ঘোড়াগুলোকে। ঘোড়ায়। চড়ার যতরকম কৌশল জানা আছে সব প্রয়োগ করে যথাসম্ভব গতিবেগ আদায় করার চেষ্টা করছি। কিন্তু লাভ হচ্ছে না। ক্রমশ কমছে তাড়া করে আসা শ্বাপদের পালের সঙ্গে আমাদের ব্যবধান। এখন অনেক কাছ থেকে শোনা যাচ্ছে কুকুরের ঘেউ ঘেউ। আধ মাইল দূরে কিনা সন্দেহ।

ঢাল বেয়ে কিছুদূর নামার পর বিরাট দুটো পাথরের স্কুপের মাঝ দিয়ে যাওয়ার জন্যে এক দিকে মোড় নিতে হলো সেই মুহূর্তে দেখতে পেলাম কুকুরের পালটা খুব বেশি হলে তিনশো গজ পেছনে রয়েছে। শ্বাপদের সংখ্যা অনেক কমে গেছে অবশ্য। সম্ভবত ছুটতে ছুঁটতে ক্লান্ত হয়ে পথের মাঝে থেমে পড়েছে কয়েকটা। তবে এখনও যে আছে তা-ও কম নয়। তার ওপর ওদের সামান্য পেছনেই ঘোড়া ছুটিয়ে আসছে খান। তার বদলী ঘোড়াটা নেই, বোধহয় সেটার পিঠেই এখন ও বসে আছে, অন্যটাকে বিশ্রাম নেয়ার জন্যে ছেড়ে দিয়ে এসেছে কোথাও।

আমাদের ঘোড়াগুলোও দেখলো ওদের। সঙ্গে সঙ্গে পাখা পেলো যেন ওরা। এখন আর আমাদের তাড়ায় নয়, প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে ছুটছে ওরা। বেশ কিছুক্ষণ স্থির রইলো কুকুরের পাল আর আমাদের মাঝের ব্যবধান। আর সামান্য গেলেই নদীর পাড়ে পৌঁছে যাবে। এই সময় আবার কমতে শুরু করলো ব্যবধান। কিছুতেই কি ক্লান্ত হয় না শ্বাপদগুলো?

দূরত্ব কমে দুশো গজেরও নিচে চলে এসেছে। প্রতি মুহূর্তে আরও কমে আসছে। সামনে ছোটখাট একটা বন দেখতে পেয়ে চিৎকার করলাম আমি লিও, সামনে দিয়ে ঘুরে ওই বনের ভেতর ঢুকে পড়ো।

বনটার ভেতর ঢুকে মাত্র ঘোড়া থেকে নেমেছি কি নামিনি, তীব্র চিৎকার করতে করতে আমাদের পঞ্চাশ গজের কম দূর দিয়ে চলে গেল কুকুরের পাল।

গন্ধ শুঁকে শুঁকে এক্ষুণি চলে আসবে ওরা, চেঁচালাম আমি, দৌড়াও, লিও, ঐ পাথরের আড়ালে আশ্রয় নিতে হবে। বলেই ছুটলাম শখানেক গজ দূরে,প্রকাণ্ড পাথরের চাঙড়টার দিকে।

ঘোড়র পায়ের ছাপ অনুসরণ করে এখন বনের দিকেই আসছে কুকুরগুলো। ভাগ্য ভালো আমাদের, ওরা এসে পড়ার আগেই পাথরটার আড়ালে চলে যেতে পারলাম। ইতিমধ্যে প্রাণভয়ে দিগ্বিদিক জ্ঞান হারিয়ে ছুটতে শুরু করেছে ঘোড়া দুটো। তাদের ধাওয়া করে চলেছে শ্বাপদের পাল। এবারও ভাগ্য সহায়তা করলো আমাদের, আমরা যেখানে আছি তার উল্টোদিকে ছুটছে ঘোড়াগুলো। তার মানে আপাতত কিছুক্ষণের জন্যে আমরা নিরাপদ।

কুকুরগুলো বন পেরিয়ে যেতেই আবার ছুটলাম আমরা, নদীর দিকে। যতখানি সম্ভব এগিয়ে যেতে চাই। দৌড়াতে দৌড়াতে ঘাড় ফিরিয়ে তাকালাম একবার। চাঁদের আলোয় দূরে দেখতে পেলাম, মাঠের ভেতর দিয়ে ছুটে চলেছে আমাদের ঘোড়াদুটো। পেছন পেছন ছুটছে কুকুরগুলো। এখনও ওদের ভেতর ব্যবধান বেশ, কিন্তু কতক্ষণ থাকবে বুঝতে পারছি না। খানকেও দেখতে পেলাম, ঝোপের সামনে দাঁড়িয়ে ফেরানোর চেষ্টা করছে শাপদগুলোকে। পারছে না। ঘোড়া দুটোর পেছনে ছুটতেই বেশি উৎসাহ বোধ করছে ওরা।

এদিকে সামান্য একটু দৌড়েই হাঁপাতে শুরু করেছি আমি। যৌবন পেরিয়ে এসেছি অনেক আগে, এমনকি প্রৌঢ়ত্বও। একটু শক্ত-পোক্ত, কিন্তু বৃদ্ধ বই তো নই, এ বয়সে কত ধকল সহ্য করতে পারে শরীর? কাল মাঝ রাত থেকে একটু আগ পর্যন্ত বলতে গেলে ঘোড়ার পিঠেই কেটেছে। এর ভেতর খেয়েছি মাত্র একবার, তাও না খাওয়ার মতো।

পেছনে আবার শুনতে পেলাম মরণ-শ্বাপদের চিৎকার। ঘাড় ফিরিয়ে দেখলাম, ঘোড়ার পিঠে ঋজু হয়ে বসে আছে খান র‍্যাসেন। ডাকাডাকি করে গোটা তিনেক কুকুরকে ছুটিয়ে আনতে পেরেছে ঘোড়াগুলোর লেজ থেকে। এখন আমাদের ওপর লেলিয়ে দিচ্ছে। প্রভুর মুখের দিকে তাকিয়ে কয়েক সেকেণ্ড ঘেউ ঘেউ করলো কুকুরগুলো, তারপর লেজ উঁচিয়ে ছুটে আসতে লাগলো আমাদের দিকে।

কিন্তু আমি আর পারছি না। পাথরের মতো ভারি মনে হচ্ছে পা দুটো। কোমর ধরে গেছে, শিরদাঁড়া টনটন করছে। মনে হচ্ছে এক্ষুণি বসে পড়ি। এবার বোধহয় সাঙ্গ হলো সাধের জীবন! দাঁড়িয়ে পড়লাম আমি।

দৌড়াও, দৌড়াও, লিওর দিকে তাকিয়ে বললাম। আমি এখানে রইলাম, কয়েক মিনিট অন্তত ওদের ঠেকিয়ে রাখতে পারবো। এই ফাঁকে তুমি চলে যাও, নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ো।

দাঁড়িয়ে পড়লো লিও। আস্তে কথা বলো, ওরা শুনে ফেলবে, নিচুস্বরে বলতে বলতে আমার পাশে এসে দাঁড়ালো। আমার হাত ধরে নিয়ে চললো টানতে টানতে।

নদীর মোটামুটি কাছে পৌঁছে গেছি আমরা। চাঁদের প্রতিফলন দেখতে পাচ্ছি পানিতে। কুকুরের শব্দও কাছে এসে গেছে। এখন আর শুধু ঘেউ ঘেউ নয়, শুকনো মাটিতে ওদের পা ফেলার আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি, খানের ঘোড়ার খুরের শব্দও

এখন আমরা যে জায়গায় পৌঁছেছি সেখানে ছড়িয়ে আছে ছোট বড় নানা আকারের অসংখ্য পাথরের চাই। পথ বলতে কিছু নেই। নদীর প্রান্ত এখনও কয়েকশো গজ দূরে। এমন জায়গার ওপর দিয়ে দৌড়ে যাওয়া অত্যন্ত বিপজ্জনক। হোঁচট খেয়ে পড়ে দাঁত-মুখ ভাঙার সম্ভাবনা ষোলা আনা। আস্তে আস্তে যেতে হবে। আর আস্তে গেলে তীরে পৌঁছানোর আগেই ধরে ফেলবে শ্বাপদগুলো। আমার মতো লিও-ও বুঝতে পেরেছে ব্যাপারটা। লাভ নেই হোরেস, বলে উঠলো ও, পারবো না আমরা। তারচেয়ে দাঁড়াও, দেখি শেষ পর্যন্ত কি ঘটে।

থেমে মুখোমুখি হলাম আমরা র‍্যাসেন আর তার কুকুরদের। বিরাট একটা চাঙড়ে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়ালাম। হা এসে গেছে ওঁরা। সোজা আমাদের লক্ষ্য করে ছুটে আসছে তিনটে প্রকাণ্ড লাল কুকুর সত্যিই এত বড় কুকুর আমি জীবনে দেখিনি। কয়েক গজ পেছনেই খান। এখনও সেই ঋজু ভঙ্গিতে বসে আছে ঘোড়ার পিঠে। আশ্চর্য প্রাণশক্তি লোকটার! আমাদের মতোই একটানা ছুটে আসছে কালুন থেকে, কিন্তু ক্লান্তির কোনো ছাপ নেই অভিব্যক্তিতে।

পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারতো, বললো লিও। পুরো পালটাই থাকতে পারতো। বলতে বলতে কোমর থেকে বড় হান্টিং নাইফটা খুলে হাতে নিলো ও। অন্য হাতে পিঠ থেকে খুলে নিলো ছোট্ট একটা বল্লম। সিমব্রির ঘর থেকে বেরিয়ে আসার সময় দুটো বল্লম নিয়ে এসেছিলাম আমরা। খান জিজ্ঞেস করেছিলো, এগুলো দিয়ে কি করবো। জবাবে বলেছিলাম, অগ্নি-পর্বতের জংলীরা আক্রমণ করলে আত্মরক্ষার চেষ্টা করতে পারবো। এখন জংলী নয় কালুনের খানের আক্রমণ ঠেকানো কাজে লাগছে ওগুলো। আমিও এক হাতে আমার হান্টিং নাইফ আর অন্য হাতে বল্লম নিয়ে তৈরি হয়ে দাঁড়ালাম।

আর মাত্র কয়েক গজ দূরে কুকুরগুলো। তীব্র চিৎকারে কানে তালা ধরে যাওয়ার অবস্থা। একেবারে সামনের কুকুরটা লাফ দিলো আমাকে লক্ষ্য করে। স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, ভয়ানক আতঙ্কে আমার কলজেটা গলার কাছে উঠে আসতে চাইলো—সিংহের মতো আকার একেকটা কুকুরের। তবে হ্যাঁ, আতঙ্কে বোধশক্তি লুপ্ত হলো না। কুকুরটা লাফ দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমিও বল্লমধরা হাতটা বাড়িয়ে দিলাম। শরীরের পুরো ওজন নিয়ে বল্লমের ফলার ওপর পড়লো ওটা। সামনের দুপায়ের মাঝ বরাবর গেঁথে গেল ফলা। প্রবল ধাক্কায় চিৎ হয়ে পড়ে যাওয়ার অবস্থা হলো আমার। হাত থেকে ছুটে গেল বল্লমের আঁটি। অনেক কষ্টে তাল সামলে যখন সোজা হলাম তখন বুকে বল্লম গাঁথা অবস্থায় মাটিতে গড়াগড়ি যাচ্ছে কুকুরটা, সেই সঙ্গে রক্ত হিম করা স্বরে মরণ আর্তনাদ।

অন্য দুটো কুকুর এক সঙ্গে আক্রমণ করেছে লিওকে। কিন্তু ওর গায়ে দাঁত বসাতে পারেনি এখনও। পোশাকের বেশ খানিকটা ছিঁড়ে নিয়ে গেছে একটা। বোকার মতো সেটার দিকে বল্লম চালালো লিও। ফস্কে গেল আক্রমণটা। বল্লমের ফলা গভীরভাবে গেঁথে গেল মাটিতে। সেই মুহূর্তে আর আক্রমণ করলো না কুকুর দুটো। হয়তো এক সঙ্গীর মৃতদেহ দেখে থমকে গেছে। একটু দূরে দাঁড়িয়ে দাঁত মুখ খিচিয়ে চিৎকার করতে লাগলো ওরা। দুটো বল্লমই হাত ছাড়া হয়ে গেছে, তাই কিছু করতে পারলাম না আমরা।

ইতিমধ্যে স্থান পৌঁছে গেছে। অদ্ভুত এক পৈশাচিক হাসি ফুটে উঠেছে তার মুখে। প্রথমে ভাবলাম হামলা করার সাহস পাবে না। কিন্তু ওর চোখে চোখ পড়তেই বুঝলাম, হামলা করবেই। ঘৃণা, ঈর্ষা, আর শিকারের উত্তেজনায় বদ্ধ উন্মাদ হয়ে গেছে আধপাগল লোকটা। ওর দৃষ্টিই বলে দিচ্ছে, ও এসেছে হয় মারবে নয় মরবে বলে। ঘোড়া থেকে নেমে তলোয়ার বের করলো সে। শিস বাজিয়ে কুকুর দুটোর দৃষ্টি আকর্ষণ করে তলোয়ার উঁচিয়ে ইশারা করলো আমার দিকে। মুহূর্তে লাফিয়ে উঠলো জন্তুদুটা। লিওর দিকে ছুটে গেল সে নিজে।

আমার হান্টিং নাইফ বাট পর্যন্ত ঢুকে গেল একটা কুকুরের পেটে। শূন্য থেকে মাটির ওপর আছড়ে পড়ে স্থির হয়ে রইলো সেটা। কিন্তু অন্যটা কামড়ে ধরলো আমার হাত, কনুইয়ের খানিকটা নিচে। হাড়ের সাথে কুকুরটার দাঁতের ঘষা খাওয়ার শব্দ হলো। তীব্র যন্ত্রণায় ককিয়ে উঠলাম আমি। হাত থেকে খসে পড়ে গেল ছোরা।

ভয়ঙ্কর জন্তুটা হাত কামড়ে ধরে আছে আমার। সামনে ঝাকাচ্ছে আর টানছে। সর্বশক্তিতে ওটার পেটে একটা লাথি মারা ছাড়া আর কিছু আমি করতে পারলাম না। বলশালী শ্বাপদের প্রবল ঝাঁকুনির মুখে হাঁটু গেড়ে বসে পড়তে হলো। এখনও কুকুরটা ঝাকাছে আমাকে, ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলার চেষ্টা করছে। এমন সময় আমার মুক্ত হাতটা একটা পাথরের ওপর পড়লো। সঙ্গে সঙ্গে আঁকড়ে ধরলাম কমলার চেয়ে সামান্য বড় পাথরটা। তুলে এনে সর্বশক্তিতে ঘা মারলাম জন্তুটার মাথায়। আশ্চর্য! বিন্দুমাত্র শিথিল হলো না কুকুরের কামড়।

ধস্তাধস্তি করছি আমি আর কুকুরটা। একবার এদিকে ঘুরতে হচ্ছে একবার ওদিকে। একবার কুকুরটা টানছে, একবার আমি। আমি চেষ্টা করছি কুকুরটাকে নিচে ফেলে ওপরে উঠে বসার, তাহলে হয়তো একটু সুবিধা করতে পারবো। কিন্তু কিছুতেই বাগে আনতে পারছি না ওটাকে। হাতটা যদি মুক্ত করতে পারতাম কোনো ভাবে!

ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ছি আমি। এখনও এক বিন্দু শিথিল হয়নি কুকুরের কামড়। মাথার ভেতর আঁ আঁ করছে। এবার মুখ থুবড়ে পড়বো। হ্যাচকা এক টানে আমাকে এক দিকে ঘুরিয়ে দিলো কুকুরটা। মনে হলো লিও আর খানকে মাটিতে পড়ে ধস্তাধস্তি করতে দেখলাম যেন। একটু পরেই আরেক পাক ঘোরার। সময় দেখলাম, একটা পাথরে হেলান দিয়ে বসে আছে খান, আমার দিকে চোখ। নিজের এই ভয়ানক বিপদের মধ্যেও তড়াক করে লাফিয়ে উঠলো হৃৎপিণ্ডটা। মেরে ফেলেছে লিওকে! এখন কুকুরটা আমাকে কি করে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো। করে তাই দেখছে তারিয়ে তারিয়ে!

এরপর বেশ কিছুক্ষণ অন্ধকার। কিছু মনে নেই আমার। হঠাৎ হাতের তীব্র যন্ত্রণাকাতর টান শিথিল হয়ে এলো। যেন ঘুমের ঘোরে চমকে চোখ মেললাম। আমি। সেই মুহূর্তে দেখলাম বিশাল শ্বাপদটা আকাশে উঠে যাচ্ছে। তারপর আরও আশ্চর্য, শূন্যে পাক খাচ্ছে ওটা! ভালো হাতটা দিয়ে চোখ ডললাম। হ্যাঁ! শূন্যে পাক খাচ্ছে জানোয়ারটা, লিও তার পেছনের এক পা ধরে মাথার ওপর তুলে ঘোরাচ্ছে আর এগিয়ে যাচ্ছে একটা বড় পাথরের দিকে।

ঠক! পাথরের ওপর আছড়ে দিলো। লিও কুকুরটার মাথা। তারপর ছেড়ে দিলো ওর পা। নিষ্পন্দ পড়ে রইলো সেটা মাটির ওপর।

অচেতন হয়ে পড়তে পড়তেও কি করে যেন সজ্ঞান হলাম আমি। সম্ভবত কুকুরের কামড় থেকে হাত মুক্ত হয়ে যাওয়ায় আচমকা যে ব্যথা ঝাঁপিয়ে পড়লো তা-ই আমাকে সজ্ঞান করে দিয়েছে।

আর চিন্তা নেই, হোরেস, হাঁপাতে হাঁপাতে বললো লিও। শামানের ভবিষ্যদ্বাণী সত্য হয়েছে। তবু একবার দেখি চলে, নিশ্চিত হয়ে নেয়া যাক।

লিওর পেছন পেছন এগিয়ে গেলাম আমি। মরণ-শ্বাপদের সঙ্গে যুঝতে যুঝতে যেমন দেখেছিলাম তেমনি পাথরে হেলান দিয়ে বসে আছে খান। নিঃশেষিত চেহারা। পাগলামির কোন চিহ্ন নেই চোখে। অসুস্থ শিশুর মতো বিষণ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।

তোমরা খুব সাহসী, দুর্বল গলায় বললো সে। শক্তিশালীও। আমার কুকুরগুলোকে হত্যা করেছে, আমার মেরুদণ্ড ভেঙে দিয়েছে। অবশেষে বুড়ো ইঁদুরের ভবিষ্যদ্বাণীই সত্য হলো। আমি ভুল করেছি। তোমাদের নয়, আতেনকেই শিকারের চেষ্টা করা উচিত ছিলো। যাহোক, আতেন রইলো। আমার মৃত্যুর প্রতিশোধ ও নেবে। আমার নয়, ওর নিজের স্বার্থেই নেবে। হলদে-দাড়ি, পারলে ওর হাতে পড়ার আগেই পাহাড়ে চলে যাও। অবশ্য তোমার আগেই আমি সেখানে পৌঁছাবো।

আর কিছু বলতে পারলো না র‍্যাসেন। ওর থুতনিটা ঝুলে পড়লো বুকের ওপর।

.

১২.

খুব একটা ক্ষতি হলো না পৃথিবীর, হাঁপাতে হাঁপাতে বললাম আমি।

যা-ই হোক, বললো লিও, হতভাগ্য লোকটা মরে গেছে, ওর সম্পর্কে খারাপ কিছু আর না বলাই ভালো। সত্যিই হয়তো বিয়ের আগে ও সুস্থ ছিলো।

কি করে ওর এ দশা করলে?

তলোয়ারের নিচে দিয়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরেছিলাম। তারপর তুলে নিয়ে ছুঁড়ে দিয়েছিলাম ঐ পাথরটার ওপর। ভাগ্য ভালো সময় মতো ওকে কায়দা করতে পেরেছিলাম, নইলে তোমার অবস্থা শোচনীয় হয়ে যেতো। খুব বেশি ব্যথা পেয়েছে, হোরেস?

আমার একটা হাত চিবিয়ে মণ্ড বানিয়ে দিয়েছে, আর কিছু না! চলো, তাড়াতাড়ি নদীর কাছে চলে, পিপাসায় বুক ফেটে যাচ্ছে। তাছাড়া অন্য কুকুরগুলোও এসে পড়তে পারে।

আমার মনে হয় না ওরা আসবে। ঘোড়া দুটোকে শেষ করার আগে অন্য কোথাও যাবে না। একটু দাঁড়াও, আমি আসছি।

খানের তলোয়ার আর আমাদের বল্লম ও ছুরি দুটো কুড়িয়ে নিয়ে এলো লিও। ভবিষ্যতে কাজে লাগতে পারে। এরপর কোন ঝামেলা ছাড়াই ধরে ফেললো র‍্যাসেনের ঘোড়াটা। কাছেই ঘাড় নিচু করে দাঁড়িয়ে ছিলো বেচারা। ক্লান্ত বিধ্বস্ত।

উঠে পড়া, বুড়ো, বললো লিও। আর হাঁটা ঠিক হবে না তোমার। .

ওর সাহায্য নিয়ে উঠলাম আমি ঘোড়ার পিঠে। লাগাম ধরে টেনে নিয়ে চললো লিও। তিন চারশো গজের বেশি হবে না নদীর তীর, কিন্তু ব্যথা আর ক্লান্তির কারণে এই পথটুকুই অসম্ভব দীর্ঘ মনে হতে লাগলো আমার।

অবশেষে পৌঁছুলাম নদীতীরে। ব্যথা, ক্লান্তি সব ভুলে ঘোড়া থেকে নেমে ঝাঁপিয়ে পড়লাম পানিতে। আমার পেছন পেছন সিও। চেঁ-চো করে পানি খেলাম, মুখ ধুলাম, তারপর আবার পানি খেলাম। পানির স্বাদ যে এমন অপূর্ব হতে পারে আগে কখনও বুঝিনি। মুখ, মাথা ডুবিয়ে দিলাম পানির ভেতর। একটু পরে প্রাণ ঠাণ্ডা হতে উঠলো লিও। জিজ্ঞেস করলোএবার? বেশ চওড়া নদী, মনে হচ্ছে একশো গজের বেশিই হবে। গভীরতা কেমন কে জানে? এখনই পার হওয়ার চেষ্টা করবো, না সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করবো?

জানি না, দুর্বল গলায় জবাব দিলাম আমি। আমি আর এক পা-ও যেতে পারবো না।

তীর থেকে গজ তিরিশেক দূরে ছোট্ট একটা দ্বীপ। ঘাস আর নলখাগড়ার ঝোপে ছাওয়া।

ওখানে বোধহয় পৌঁছুতে পারবো, বললো লিও। তুমি আমার পিঠে ওঠো, দেখি চেষ্টা করে।

বিনাবাক্যব্যয়ে ওর নির্দেশ পালন করলাম। আস্তে আস্তে, পা দিয়ে নদীর তলা অনুভব করে করে চলতে লাগলো লিও। পানি খুব গভীর নয়। হাঁটুর ওপরে একবারও উঠলো না। কোনো রকম ঝামেলা ছাড়াই দ্বীপটার কাছে পৌঁছে গেলাম। আমাকে শুইয়ে দিয়ে লিও আবার চলে গেল তীরে। র‍্যাসেনের ঘোড়া আর অস্ত্রগুলো নিয়ে ফিরে এলো।

এরপর ও বসলো আমার ক্ষত পরিষ্কার করতে। পোশাকের হাতা অনেক পুরু হওয়া সত্ত্বেও মাংস ঘেঁতলে গেছে। একটা হাড় ভেঙে গেছে বলেও মনে হলো। নদী থেকে পানি এনে ক্ষতস্থানটা ধুয়ে দিলো লিও, রুমাল পেঁচিয়ে তার, ওপর দুর্বা ঘাসের প্রলেপ দিয়ে আবার একটা রুমাল পেঁচিয়ে বেঁধে দিলো। ও যখন এসব করছে সে সময় কখন যে আমি ঘুমিয়ে গেছি বা জ্ঞান হারিয়েছি জানি না।

.

হাতের অসহ্য যন্ত্রণা আমার ঘুম ভেঙে দিলো। চোখ মেলে দেখলাম ভোর হচ্ছে। কুয়াশার পাতলা একটা স্তর জমে আছে নদী এবং দ্বীপের ওপর। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলাম, আমার পাশেই গভীর ঘুমে নিমগ্ন লিও। একটু দূরে র‍্যাসেনের কালো ঘোড়াটা ঘাস খাচ্ছে। আবার চোখ বুজলাম। ঠিক সেই মুহূর্তে জলের কুলকুল আওয়াজ ছাপিয়ে একটা শব্দ হলো। মানুষের কণ্ঠস্বর; কিন্তু লিওর নয়! চমকে উঠে বসলাম আমি। নলখাগড়ার ফাঁক ফোকর দিয়ে দেখতে পেলাম পাড়ের ওপর দুটো অশ্বারোহী মূর্তি। একজন নারী, একজন পুরুষ। এমন ভাবে মাটির দিকে তাকিয়ে আছে, বুঝতে অসুবিধে হলো না, আমাদের পায়ের ছাপ পরীক্ষা করছে ওরা।

ওঠো! লিওর কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললাম, ওঠো, কারা যেন এসেছে।

এক লাফে দাঁড়িয়ে পড়লো লিও। ছোঁ মেরে একটা বর্শা তুলে নিয়েছে। পাড়ের ওরা দেখতে পেলো ওকে। কুয়াশার ভেতর দিয়ে মিষ্টি একটা গলা ভেসে এলো—অস্ত্র রেখে দাও, অতিথি, তোমার কোনো ক্ষতি করতে আমরা আসিনি।

খানিয়া আতেনের কণ্ঠস্বর! তার সাথের লোকটা বুড়ো শামান সিমব্রি।

এখন কি করবো আমরা, হোরেস? আর্তনাদের মতো শোনালো লিওর গলা।

আপাতত কিছুই না, বললাম আমি। আমরা কি করবো তা নির্ভর করছে ওরা কি করে তার ওপর।

এখানে এসো, জলের ওপর দিয়ে ভেসে এলো খানিয়ার গলা। আমি শপথ করে বলছি, তোমাদের ক্ষতি করতে আসিনি। দেখছে না আমরা একা?

জানি না, বললো লিও, তোমরা একা না পেছনে আরও লোক আছে? কিন্তু, যেখানে আছি সেখান থেকে নড়ছি না আমরা।

ফিসফিস করে সিমব্রিকে কিছু একটা বললো খানিয়া। মাথা নেড়ে নিষেধ করলো সিমব্রি। তর্ক করার ভঙ্গিতে আবার কিছু বললো আতেন। এই নদী অগ্নি পর্বতের সীমানা। এটা অতিক্রম করা ঠিক হবে কিনা সম্ভবত তা নিয়ে আলাপ করছে ওরা। একটু পরে সিমব্রির ঘন ঘন মাথা নাড়া সত্ত্বেও ঘোড়া নদীতে নামিয়ে দিলো খানিয়া। পানি ভেঙে এগিয়ে আসছে দ্বীপের দিকে। অগত্যা শামানও আসতে লাগলো পেছন পেছন। সে

দ্বীপে উঠে ঘোড়া থেকে নামলো আতেন। বললো, শেষবার দেখা হওয়ার পর অনেক দূর চলে এসেছো তোমরা। অশুভ এক পথ বেছে নিয়েছে। ওখানে, পাথরের মাঝে একজন মরে ড়ে আছে। গায়ে কোনো আঘাতের চিহ্ন দেখলাম না, কি করে মারলে ওকে?

এগুলো দিয়ে, দুহাত সামনে মেলে দিলো লিও।

আমি জানতাম। অবশ্য এজন্যে তোমাকে দোষ দিচ্ছি না। অমোঘ নিয়তিই নির্ধারণ করে দিয়েছে ওর মৃত্যুর উপায়। তার নড়চড় তো হতে পারে না। তবু এমন লোক আছে যারা এ মৃত্যুর কৈফিয়ত চাইতে পারে। এবং একমাত্র আমিই পারি তাদের হাত থেকে তোমাদের রক্ষা করতে।

নাকি তাদের হাতে তুলে দিতে? খানিয়া, কি চাও তুমি?

সেই প্রশ্নের জবাব। কাল সূর্যাস্তের আগেই যা তোমার দেয়ার কথা ছিলো।

ঐ পাহাড়ে চলো, জবাব পাবে, অগ্নি-পর্বতের দিকে হাত তুলে লিও বললো। ওখানে আমি খুঁজবো আমার…

মৃত্যুকে। মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেছে, কিন্তু বলতে ছাড়লো না আতেন। আগেই তো বলেছি, বিদেশী, ও জায়গা পাহারা দেয় জংলীরা; দয়া, মায়া বলতে তাদের কিছু নেই।

হোক। মৃত্যুই আসুক তাহলে। চলো, হোরেস, দ্রলোকের সাথে মোলাকাত করতে যাই।

আমি শপথ করে বলছি, আবার বললো খানিয়া, তোমার স্বপ্নের নারী ওখানে নেই। আমি সেই নারী, হা, আমিই, যেমন তুমি আমার স্বপ্নের পুরুষ।

বেশ, ঐ পাহাড়েই তাহলে প্রমাণ হবে।

ওখানে কোনো মেয়েমানুষ নেই, ব্যস্তভাবে বললো আতেন। কিছুই নেই। খালি আগুন আর একটা কণ্ঠস্বর।

কার কণ্ঠস্বর?

কারও না। অলৌকিক। আগুন থেকে বেরোয়। সেই স্বরের মালিককে কেউ কখনও দেখেনি, দেখবেও না।

এসো, হোরেস, বলে ঘোড়ার দিকে এগোলো লিও।

থামো! এবার কথা বললো বৃদ্ধ শামান, মৃত্যুর মুখে এগিয়ে যাবেই তোমরা? শোনো তাহলে, আমি গিয়েছি ঐ ভূতুড়ে জায়গায়। নিয়ম অনুযায়ী খানিয়া আতেনের পিতাকে সমাহিত করার জন্ধে যেতে হয়েছিলো। আমার তখনকার অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, ভুলেও যেও না ওখানে।

আর আপনার ভাইঝি বলছে ওখানে কেউ যেতে পারে না, আমি মন্তব্য করলাম।

বুড়োকে কিছু বলার সুযোগ না দিলে লিও বলে উঠলো, সাবধান করে দেয়ার জন্যে ধন্যবাদ। হোরেস, আমি ঘোড়ায় জিন চাপাচ্ছি, তুমি নজর রাখো ওদের দিকে।

অক্ষত হাতে একটা বল্লম তুলে নিয়ে দাঁড়ালাম আমি। কিন্তু ওরা কিছু করলো না। যেমন ছিলো তেমন দাঁড়িয়ে রইলো ঘোড়ার লাগাম ধরে।

কয়েক মিনিটের ভেতর র‍্যাসেনের ঘোড়ায় জিন চাপানো হয়ে গেল। আমাকে উঠতে সাহায্য করলো লিও। তারপর বললো, আমরা চললাম। ভাগ্যে যা নির্ধারিত হয়ে আছে ঘটবে। কিন্তু, খানিয়া, যাওয়ার আগে তোমাকে ধন্যবাদ। জানাতে চাই, যথেষ্ট সদয় ব্যবহার করেছে আমাদের সাথে। আমি চাইনি তবু তোমার স্বামীর রক্তে আমার হাত রঞ্জিত হয়েছে। আমার ধারণা এই একটা, ঘটনাই আমাদেরকে চির বিচ্ছিন্ন রাখার জন্যে যথেষ্ট। তুমি ফিরে যাও। যদি কখনও কষ্ট দিয়ে থাকি, জানবে দিয়েছি অনিচ্ছায়। আমাকে ক্ষমা কোরো। বিদায়।

মাথা নিচু করে শুনলো, আতেন। শেষে বললো, তোমার নম্র কথার জন্যে ধন্যবাদ। কিন্তু, লিও ভিসি, এত সহজে তো আমরা আলাদা হতে পারি না। তুমি আমাকে পাহাড়ে যেতে বলেছো, হ্যাঁ, আমি যাবো ওখানে। তোমার পেছন। পেছন আমিও যাবো এখানে। ঐ পাহাড়ের আত্মার সাথে সাক্ষাৎ করবো। আমার সমস্ত শক্তি এবং যাদুবিদ্যা প্রয়োগ করবো। দেখি কে জয়ী হয়।

আর কিছু না বলে এক লাফে ঘোড়ায় উঠলো আতেন। জল ঝাঁপিয়ে চলে গেল পাড়ের দিকে। অনুসরণ করলো বৃদ্ধ সিমব্রি।

কি বললো ও, বুঝলে কিছু? জিজ্ঞেস করলো লিও।

না, তবে আশা করা যায় শিগগিরই বুঝবো। এখন চলো, আমরা রওনা হই।

নিরাপদে নদীর ওপারে পৌঁছুলাম। নদীর এ অংশেও পানি হাঁটু ছাড়িয়ে উঠলো না। কাল রাতের মতো হেঁটে পার হয়ে গেলাম। পাড় থেকে সামান্য একটু যাওয়ার পরই শুরু হলো জলাভূমি। খুব বেশি গভীর নয়। নদী যেভাবে পেরিয়েছি সেভাবেই পেরোতে লাগলাম এ জায়গা। যথাসম্ভব দ্রুত এগোনোর চেষ্টা করছি আমরা। তাড়াতাড়ি পাহাড়ে পৌঁছানোর ইচ্ছা ছাড়াও এর পেছনে যা কাজ করছে তা হলো, খানিয়ার ভয়। কেন যেন মনে হচ্ছে রক্ষীদের আনতে গেছে আতেন। কাছাকাছি কোথাও লুকিয়ে থাকতে বলে এসেছে, এখন গিয়ে ডেকে আনবে অবাধ্য বিদেশীদের শায়েস্তা করার জন্যে।

জলা পেরিয়ে সামান্য ঢালু একটা সমভূমিতে পৌঁছুলাম। তিন-চার মাইল দূরে পাহাড়ের প্রথম ঢাল পর্যন্ত বিস্তৃত সেটা। ঢিপ ঢিপ করছে বুকের ভেতর। প্রতি মুহূর্তে মনে হচ্ছে এই বুঝি হা-হা করতে করতে হাজির হলো জংলীরা। এতবার এতভাবে ওদের ভীতিজনক আচরণের কথা শুনেছি যে কিছুতেই ভয়টা তাড়াতে পারছি না মন থেকে।

হঠাৎ বেশ দূরে শাদা কিছু একটা পড়ে থাকতে দেখলাম। কি হতে পারে ভাবছি, কিন্তু কিছুতেই বুঝতে পারছি না। একটু পরে আরও অনেকগুলো একই রকম জিনিস পড়ে থাকতে দেখলাম। তারপর আরও অসংখ্য। কৌতূহল বেড়ে উঠলো আমাদের। চলার গতি আপনা থেকেই কখন যে বেড়ে গেছে খেয়াল করিনি।

. অবশেষে পৌঁছুলাম সেখানে। জিনিসগুলো দেখলাম। প্রথমে বিশ্বাস হইতে চাইলো না। ভুল দেখছি না যে? কিন্তু তা কি করে হয়? স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, সাদা জিনিসগুলো নরকঙ্কাল। তারমানে এই উপত্যকা বিশাল এক কবরখানা ছাড়া আর কিছু নয়। মনে হয় বুড়সড় এক সেনাবাহিনী এখানে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিলো।

বিষণ্ণ মনে এগিয়ে চললাম ছড়িয়ে থাকা কঙ্কালের মাঝ দিয়ে। পাহাড়ের চূড়ায় ওঠার পথ খুঁজছি, কিন্তু পাচ্ছি না। চারদিকে কেবল হলদেটে সাদা রঙের হাড় আর হাড়, খুলি আর খুলি। দিনে দুপুরেও গা ছমছম করে উঠতে চায়। ঘোড়াটাও কেমন যেন অস্বস্তি বোধ করছে। ঘনঘন সশব্দে নাক টানছে। একটু পরে হাড়ের একটা স্কুপের কাছে পৌঁছুলাম। এই হাড়গুলো এমন টিবি করে রাখলো কে? আশ্চর্য, স্কুপের ওপর ছোট আরেকটা স্থূপ! হাড়েরই মনে হচ্ছে। কেন? পটার এমন চেহারা দিলো কে?

শিগগিরই এখান থেকে বেরোনোর পথ না পেলে পাগল হয়ে যাবো! চারপাশে তাকাতে তাকাতে চিৎকার করলাম আমি।

কথাগুলো আমার মুখ থেকে সম্পূর্ণ বেরোতে পারেনি, চোখের কোণ দিয়ে দেখলাম, নড়ে উঠেছে স্তূপের উপরের পটা। আতঙ্কে হিম হয়ে আসতে চাইলো আমার শরীর। হ্যাঁ, নড়ে উঠেছে ছোট পটা। ভাঁজ হয়ে থাকা একটা মূর্তি উঠে দাঁড়াচ্ছে। প্রথম দর্শনে মনে হলো নারী মূর্তি—আমি নিশ্চিত নইমাথা থেকে পা পর্যন্ত শাদা কাপড়ে মোড়া যেন কাফন পরা মৃতদেহ। চোখের কাছটায় দুটো গোল গোল গর্ত। হাড়ের স্তূপের ওপর থেকে নেমে এলো ওটা। মমির মতো সাদা হাত উঁচু করলো ইশারার ভঙ্গিতে। ঘোড়াটা আতঙ্কে চি-হি-হি করে খাড়া হয়ে গেল দুপায়ের ওপর।

কে তুমি? চেঁচিয়ে উঠলো লিও। দূরের পাহাড় থেকে প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে এলো ওর কণ্ঠস্বর। কিন্তু কোনো জবাব দিলো না মূর্তি। আবার ইশারা করলো।

চোখের ভুল কিনা, নিশ্চিত হওয়ার জন্যে লিও এগিয়ে গেল ওটার দিকে। সঙ্গে সঙ্গে দ্রুত, প্রায় হাওয়ায় ভেসে হাড়ের স্তূপের পেছনে চলে গেল মূর্তি। দাঁড়িয়ে রইলো প্রেতাত্মার মতো। আবার এগোলো লিও। বোধহয় স্পর্শ করে দেখতে চায় সত্যিই ভূত না অন্য কিছু। কাছাকাছি পৌঁছুতেই আবার হাত উঁচু করলো মূর্তি। আলতো করে চুলো লিওর বুক। তারপর আবার হাত গুটিয়ে নিয়ে ইশারা করলো প্রথমে উপরে চূড়ার দিকে, তারপর আমাদের সামনে কিছুদূরে পাথরের দেয়ালটার দিকে।

ফিরে এলো লিও। কি করবো আমরা?

ওর পেছন পেছন যাবো, বললাম আমি। ওপর থেকে বোধহয় পাঠানো হয়েছে আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্যে।

নাকি নিচে থেকে? বিড় বিড় করলো ও। একদম ভালো লাগছে না ওর ভাবভঙ্গি, চেহারা।

তবু ওকে ইশারায় এগোতে বললো লিও। দ্রুত অথচ একেবারে নিঃশব্দে পাথর আর কঙ্কালের মাঝ দিয়ে এগিয়ে চললো মূর্তি। আমরা অনুসরণ করছি। কয়েকশো গজ যাওয়ার পর নিচু একটা ঢালের মাথায় পৌঁছুলো ওটা। পর মুহূর্তে অদৃশ্য হয়ে গেল।

নিশ্চয় ওটা ছায়া! সন্দেহ লিওর কঠে।

গাধা, আমি বললাম, ছায়া মানুষকে স্পর্শ করতে পারে? এগোও।

ঘোড়ার লাগাম ধরে চুড়ার কাছে পৌঁছুলো লিও। ওখানে তীক্ষ্ণ্ণ একটা বাঁক নিয়েছে ঢাল। মোড় ঘুরতেই দেখতে পেলাম মূর্তিটাকে। আমাদের জন্যে অপেক্ষা করছে। আবার এগিয়ে চললো এটা। পেছন পেছন আমরা। কিছুদূর যাওয়ার পর ছোট একটা সুড়ঙ্গের কাছে পৌঁছুলাম। দেখে মনে হলো, সুড়ঙ্গটা মানুষের হাতে তৈরি।

মূর্তির পেছন পেছন ঢুকে পড়লাম প্রায়ান্ধকার সুড়ঙ্গে। লাগাম ধরে হেঁটে চলেছে লিও। ঘোড়ার পিঠে আমি। সুড়ঙ্গ থেকে বেরিয়ে জমাট বাঁধা লাভার একটা ঢাল বেয়ে উঠে যেতে লাগলাম আমরা। অসংখ্য ছোট বড় লাভার চাঙড় ছড়িয়ে আছে চারপাশে। একটু দূরে কুল কুল করে বয়ে যাচ্ছে একটা পাহাড়ী ঝরনা।

মাইল খানেক যাওয়ার পর আচমকা তীক্ষ্ণ্ণ একটা শিসের আওয়াজ শুনলাম। সঙ্গে সঙ্গে চাঙড়গুলোর আড়াল থেকে লাফ দিয়ে বেরিয়ে এলো একদল লোক। জনাপঞ্চাশেক তো হবেই, বেশিও হতে পারে। প্রত্যেকের চেহারায় অসভ্য এক অভিব্যক্তি। লালচে চুল-দাড়ি তাদের। গায়ের রঙ কালোর ধার ঘেঁষে। পরনে সাদা ছাগলের চামড়া। প্রত্যেকেরই হাতে রয়েছে বর্শা আর ঢাল। আবার শিস বাজাল ওদের কেউ একজন। তীক উল্লসিত চিৎকার করে উঠলো পুরো দলটা। তারপর ঘিরে ফেললো আমাদের।

বিদায়, হোরেস, কোনোমতে বলেই খানের তলোয়ারটা বের করলো লিও।

খানিয়া আর বুড়ো শামার কথাই তাহলে ঠিক হলো! পাহাড়ের-প্রথম ঢাল অতিক্রম করার আগেই মরতে চলেছি আমরা! দুর্বল গলায় বললাম, বিদায়, লিও।

বল্লম উঁচিয়ে এগিয়ে আসছে বর্বররা। ইতিমধ্যে আমাদের পথপ্রদর্শক অদৃশ্য হয়েছে কোনো একটা চাঙড়ের আড়ালে, আমরা খেয়াল করিনি। অনুশোচনায় দগ্ধ হতে লাগলো মন। আমিই লিওকে পরামর্শ দিয়েছিলাম মূর্তিটার পেছন পেছন আসার। কিন্তু না, অসভ্যরা যখন মাত্র কয়েক গজ দূরে তখন উঁচু একটা চাঙড়ের ওপরে দেখা গেল তাকে। কোনো কথা উচ্চারণ করলো না। হাত দুটো ছড়িয়ে দিলো শুধু।

সঙ্গে সঙ্গে আশ্চর্য এক ঘটনা ঘটলো। মুখ মাটিতে দিয়ে শুয়ে পড়লো বুনন লোকগুলো। প্রত্যেকে। বজ্রপাত হয়েছে যেন ওদের মাথায়। ধীরে ধীরে হাত নামিয়ে আনলো মূর্তিটা। তারপর কাছে ডাকার ভঙ্গিতে ইশারা করলো। বিশালদেহী এক লোক, সম্ভবত দলনেতা, উঠে এগিয়ে গেল। হাঁটার ভঙ্গিটা অত্যন্ত বিনীত, মার খাওয়া কুকুরের মতো। মূর্তির ইশারা ও দেখলো কি করে বুঝলাম না, নিশ্চয়ই মুখ নিচের দিকে থাকলেও চোখ টেরিয়ে উঁকি দিচ্ছিলো। হাত দুটো আড়াআড়িভাবে একটার ওপর অন্যটা একবার রেখে আবার সরিয়ে এনে আরেকটা ইশারা করলো মূর্তি। এবারও কোনো শব্দ উচ্চারণ করতে শুনলাম না। দলনেতা বুঝতে পারলো ইশারার মর্ম। দুর্বোধ্য ভাষায় কিছু একটা বললো সে। তারপর আবার সেই তীক্ষ্ণ্ণ শিস। মুহূর্তে উঠে দাঁড়ালো বর্বরের দল। পড়িমরি করে ছুটে পালালো যে যেদিকে পারলো সেদিকে।

এবার আবার আমাদের দিকে ফিরলো পথ প্রদর্শক। ইঙ্গিতে নির্দেশ দিলো এগোনোর।

দুঘণ্টা একটানা চললাম আমরা। লাভার ঢাল শেষ। ঘাসে ছাওয়া একটা সমান জায়গায় পৌঁছে ঝরনাটার উৎসমুখ দেখতে পেলাম কিছু দূরে। তারপর আশ্চর্য হয়ে দেখলাম আগুন জ্বলছে এক পাশে। তার ওপর ঝুলছে একটা মাটির পাত্র। কিছু একটা সেদ্ধ হচ্ছে তাতে। কোনো মানুষ দেখলাম না আশেপাশে।

আমাকে ঘোড়া থেকে নামার নির্দেশ দিলো মৃর্তি—অবশ্যই ইশারায়। তারপর ইঙ্গিতে পারে পদার্থটুকু খেয়ে নিতে বললো আমাদের। খুব খুশি মনেই আমি খেতে লেগে গেলাম। প্রচণ্ড খিদেয় রীতিমতে অস্থির লাগছিলো এতক্ষণ। শুধু আমাদের নয়, ঘোড়াটার জন্যেও খাবারের বন্দোবস্ত রয়েছে দেখলাম।

গরম গরম খেয়ে নিয়ে (জিনিসটা কি জানি না, তবে স্বাদ মন্দ নয়) ঝরনার উৎসমুখের কাছে গিয়ে পানি খেয়ে এলাম। ঘোড়াটাকেও খাইয়ে নিলাম। কিন্তু মূর্তি কিছু খেলো না। পানি পর্যন্ত না। ভদ্রতা করে আমরা একবার সাধলাম ইশারায়। নিরাসক্ত ভঙ্গিতে প্রত্যাখ্যান করলো সে।

খাওয়ার পর আমার হাতের ক্ষত পরিষ্কার করে আবার বেঁধে দিলো লিও। এদিকে ভরপেট খাওয়ার সাথে সাথে ঝিমুনি এসে গেছে আমার। কিন্তু ঘুমানোর সুযোগ দিলো না পথপ্রদর্শক। হাত তুলে ইশারা করলো প্রথমে সূর্যের দিকে তারপর ঘোড়াটার দিকে। যেন বোঝাতে চাইলো এখনও অনেক দূর যেতে হবে আমাদের। সুতরাং আবার রওনা হলাম।

দিন শেষে ঘাসে ছাওয়া এলাকা পেরিয়ে গেলাম। তারপর আবার শুরু হলো পাথুরে ঢাল। মাঝে মাঝে মাথা তুলেছে দু’একটা খর্বাকৃতির ফার গাছ।

সূর্য ডুবে গেল। গোধূলির আলোয় এগিয়ে চললাম সেই অদ্ভুত মূর্তির পেছন পেছন। চারদিক অন্ধকার হয়ে এলো। তবু চলছি আমরা। পাহাড় চূড়ার লাল আভা আবছাভাবে এসে পড়েছে। সেই সামান্য আলোয় পথ দেখে এগোচ্ছি। কয়েক পা সামনে মূর্তিটাকে সত্যিই ভূতের মতো লাগছে এখন। একবারও পেছনে না তাকিয়ে, একটাও কথা না বলে এগিয়ে চলেছে সে। একটু পরপরই বাঁক নিচ্ছে, একবার এদিকে একবার ওদিকে। কিছুক্ষণের ভেতর পথের দিশা  হারিয়ে ফেললাম। এখন যদি একা ফিরে যেতে বলা হয়, কিছুতেই পারবো না।

চাঁদ উঠলো। সরু একটা গিরিখাতের ভেতর পৌঁছুলাম। এঁকে বেঁকে এগিয়ে চললাম তার ভেতর দিয়ে। একটু পরে এমন এক জায়গায় পৌঁছুলাম, যার সঙ্গে কেবল গ্রীক অ্যামফিথিয়েটারেরই তুলনা চলে। পার্থক্য একটাই, এটা মানুষের তৈরি নয়, প্রাকৃতিক। অত্যন্ত সংকীর্ণ তার প্রবেশ পথ। একজন মানুষ কোনোরকমে ঢুকতে বা বেরোতে পারে। তার ওপাশে একটা ফাঁকা জায়গায় পাহাড়ের গায়ে দাঁড়িয়ে আছে অনেকগুলো ছোট ছোট পাথরের ঘর। চাঁদের আলোয় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে ঘরগুলোর সামনে বড় একটা চত্বর। সেখানে জড় হয়েছে কয়েকশো নারী পুরুষ। অর্ধবৃত্তাকারে দাঁড়িয়ে কিছু একটা ধর্মীয় আচার পালন করছে।

তাদের সামনে, অর্ধবৃত্তের ঠিক কেন্দ্রস্থলে দাঁড়িয়ে এক লোক। বিশালদেহী, লাল দাড়িওয়ালা। কোমরে এক টুকরো চামড়া জড়ানো, বাকি শরীর উলঙ্গ। সামনে পেছনে দুলছে সে; হাত দুটো নিতম্বের ওপর স্থির। দুলুনির তালে তালে চিৎকার করে বলছে হো-হাহা-হো! সে যখন দর্শকদের দিকে ঝুঁকছে অমনি দর্শকরাও একসাথে ঝুঁকে আসছে তার দিকে। সোজা হওয়ার সময় সবাই তার শেষের আওয়াজটার ধুয়া ধরে চেঁচিয়ে উঠছে হো! চারপাশের পাহাড়ী দেয়াল থেকে প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে আসছে শব্দটা। লোকটার দীর্ঘ চুলওয়ালা মাথার ওপরে বসে আছে বড় একটা সাদা বিড়াল। দুলুনির তালে তালে মৃদু মৃদু লেজ নাড়ছে সেটা।

চাঁদনী রাত, চারপাশে পাহজ, তার মাঝে এমন একটা দৃশ্য আর আওয়াজ! অদ্ভুত এক স্বপ্নের মতো মনে হলো আমার কাছে।

যে চত্বরে জংলীগুলো এই অদ্ভুত আচরণ বা উপাসনার কাজ করছে তার চারপাশে প্রায় ছফুট উঁচু একটা দেয়াল। দেয়ালের এক জায়গায় একটা দরজা। সেটার দিকে এগিয়ে চললাম আমরা সবার অলক্ষ্যে। দরজার কয়েক গজ দূরে পৌঁছে আমাদের থামতে ইশারা করলো মূর্তি। সে এগিয়ে গেল দেয়ালের নিচু একটা অংশের দিকে। অনাকাক্ষিত কিছু একটা দেখছে এমন ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলো কয়েক মুহূর্ত। তারপর ফিরলো আমাদের দিকে। যেখানে আছি সেখানেই থাকার ইশারা করে মুখ ঢাকলো হাত দিয়ে। পরমুহূর্তে চলে গেল সে। কোথায়, কিভাবে, বলতে পারবো না। শুধু দেখলাম, যেখানে ছিলো সেখানে সে নেই।

এখন কি করবো আমরা? ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলো লিও।

কি আর? যতক্ষণ না ও ফিরে আসে বা কিছু ঘটে ততক্ষণ অপেক্ষা করাই উচিত আমার মনে হয়।

অপেক্ষা করছি আর দেখছি জংলীদের কাণ্ড-কারখানা। একটাই দুশ্চিন্তা, ঘোড়াটা না ডাক ছেড়ে ওঠে। সেক্ষেত্রে ধরা পড়ে যাব অসভ্যদের কাছে। তারপর কি ঘটবে জানি না।

দেখছি জংলীদের অদ্ভুত আচরণ। এখন আর উপাসনা মনে হচ্ছে না, মনে হচ্ছে বিচার সভা। হ্যাঁ, একটু পরে হঠাৎ মন্ত্রোচ্চারণ থেমে গেল। বিড়াল মাথায় লোকটার সামনের মানুষগুলো দুভাগ হয়ে সরে গেল দুপাশে। একই সঙ্গে তার পেছন থেকে ধোঁয়ার একটা কুণ্ডলী উঠলো, যেন সাজিয়ে রাখা চিতায় আগুন দেয়া। হয়েছে। সামনের মানুষগুলো আরেকটু সরে দাঁড়ালো। পেছনের ঘরগুলোর একটা থেকে পিছমোড়া করে বাঁধা সাতজন লোককে নিয়ে আসা হলো। নিম্নাঙ্গে এক টুকরো চামড়া জড়ানো, উর্ধাঙ্গ অনাবৃত সব কজনের। নারী-পুরুষ দুরকম মানুষই আছে তাদের ভেতর। দীর্ঘাঙ্গী, চমৎকার দেহসৌষ্ঠবের অধিকারিনী একটা মেয়েকে দেখলাম। মনে হয় সবে কৈশোর পেরিয়েছে। একজন বৃদ্ধকেও দেখলাম। এক সারিতে দাঁড় করানো হলো সাতজনকে! ভয়ে কাঁপছে সবাই। বৃদ্ধ তো বসেই পড়লো কাঁপতে কাঁপতে। মহিলারা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। কিছুক্ষণ অমনি রইলো ওরা। ইতিমধ্যে কয়েকজনে ভালো করে জ্বালিয়ে ফেলেছে অগ্নিকুণ্ডটা। কমলা রঙের লকলকে শিখা উঠেছে মানুষগুলোর মাথা ছাড়িয়ে।

সবকিছু তৈরি। একজন একটা কাঠের বারকোশ এনে দিলো লাল দাড়িওয়ালা পুরোহিতের হাতে। একটু আগে বিড়ালটাকে কোলে করে একটা টুলের ওপর বসেছে সে। বারকোশটার হাতল ধরে বিড়ালের দিকে তাকিয়ে কিছু বললো। সঙ্গে সঙ্গে লাফিয়ে গিয়ে বারকোশের মাঝখানে বসে পড়লো বিড়ালটা।

গভীর নিস্তব্ধতার ভেতর উঠে দাঁড়ালো পুরোহিত। বিড়বিড় করে কিছু মন্ত্র পড়লো। মনে হলো বিড়ালটার উদ্দেশ্যেই-ওটা এখন তার মুখোমুখি বসে। এরপর বারকোশটা ঘুরিয়ে ধরলো সে। বিড়ালের পেছনটা চলে এলো তার সামনে। ধীর পায়ে এগিয়ে গেল লোকটা বন্দীদের দিকে।

একেবারে বাঁয়ের বন্দীর সামনে গিয়ে দাঁড়ালো পুরোহিত। বারকোশ উঁচু করে ধরলো। বিড়ালটা এবার উঠে দাঁড়ালো। ধনুকের মতো পিঠ বাঁকিয়ে থাবা নাড়তে লাগলো উপরে নিচে। পরের বন্দীর সামনে চলে এলো পুরোহিত। একই ভঙ্গিতে বারকোশ উঁচু করে ধরলো। একই ভঙ্গিতে এবারও বিড়ালটা থাবা নাড়লো। তৃতীয়, চতুর্থ, অবশেষে পঞ্চম জনের সামনে এলে পুরোহিত। এ হচ্ছে সেই দীর্ঘাঙ্গীনী মেয়েটা। বারকোশ উঁচু করে ধরতেই খ্যাক-ম্যাক করে চেঁচাতে, গর্জাতে শুরু করলো বিড়ালটা। তারপর হঠাৎ থাবা তুলে আঁচড়ে দিলো মেয়েটার মুখ। রাতের নিস্তব্ধতা খানখান করে তীব্র, জী আর্তনাদ করে উঠলো মেয়েটা। দর্শকরাও সবাই হৈ-চৈ করে উঠলো। একটামাত্র শব্দ বারবার আওড়াচ্ছে তারা। কালুনের লোকদের মুখে বহুবার শুনেছি শব্দটা—ডাইনী! ডাইনী! ডাইনী!

জল্লাদরা অপেক্ষা করছিলো। এবার তৎপর হয়ে উঠলো তারা। মেয়েটাকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে চললো আগুনের দিকে। সর্বশক্তি দিয়ে চেষ্টা করলো মেয়েটা নিজেকে মুক্ত করার। হাত পা ছুঁড়ে, শরীর মুচড়ে, আঁচড়ে, কামড়ে, চিৎকার করে সে ছুটে যেতে চাইলো জল্লাদদের হাত থেকে। পারলো না। দুদিক থেকে দুজন দুই বাহু ধরে শূন্যে তুলে ফেললো তাকে। দর্শকরা মহা উল্লাসে চিৎকার করে উঠলো আবার।

এ-তো খুন! সন্ত্রস্ত গলায় বললো লিও। ঠাণ্ডা মাথায় খুন! আমি এ হতে দিতে পারি না, বলতে বলতে তলোয়ার বের করলো ও।

আমি কিছু বলার জন্যে মুখ খুলতে গেলাম। কিন্তু তার আগেই খোলা তলোয়ার হাতে প্রাচীর দরজার দিকে ছুটেছে লিও, সেই সাথে চিৎকার। অগত্যা আমি ঘোড়া ছোটালাম ওর পেছন পেছন। দশ সেকেণ্ডের মাথায় অসভ্যদের মাঝখানে পৌঁছে গেলাম আমরা।

অবাক বিস্ময়ে তাকালো ওরা আমাদের দিকে। প্রথম দর্শনে অপদেবতা বা ভূত জাতীয় কিছু মনে করলো বোধহয়। সেই সুযোগে জল্লাদদের একেবারে কাছে। চলে গেলাম আমরা।

ওকে ছেড়ে দাও, বদমাশের দল! ভয়ঙ্কর গলায় চিৎকার করে উঠে এক জল্লাদের হাতে কোপ বসিয়ে দিলো লিও।

মেয়েটার হাত ছেড়ে দিয়ে পিছিয়ে গেল লোকটা। জনতার দিকে তাকিয়ে অক্ষত হাতটা নাড়তে নাড়তে চিৎকার করে বলে চললো কিছু একটা। এই ফাঁকে হতভম্ব অন্য জল্লাদদের হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে অন্ধকারের দিকে ছুটলো দীর্ঘাঙ্গিনী মেয়েটা। এদিকে পুরোহিতও এক লাফে উঠে দাঁড়িয়েছে। বারকোশটা এখনও তার হাতে, বিল্লিটাও বসে আছে বারকোশে। লিওর দিকে তাকিয়ে হিংস্র কণ্ঠে দাত মুখ খিচিয়ে চিৎকার করতে লাগলো সে। লিও-ও সমানে চেচিয়ে চলেছে ইংরেজি এবং আরও অনেকগুলো ভাষায়। তার বেশির ভাগই অকথ্য গালাগাল।

হঠাৎ বিড়ালটা, সম্ভবত চিৎকার চেঁচামেচিতে ভয় পেয়ে, লাফ দিলো বারকোশ থেকে, সোজা লিওর মুখ লক্ষ্য করে। মুখে থাবা পড়ার আগেই বাঁ হাতে শূন্যেই ওটাকে ধরে ফেলে লিও সর্বশক্তিতে আছাড় মারলো মাটিতে পড়ে আর নড়তে পারলো না বিড়ালটা। দলামোচা পাকিয়ে মিউ মিউ করতে লাগলো। তারপর, হঠাৎ মনে পড়ে গেছে এমন ভঙ্গিতে আবার ওটাকে তুলে নিলো লিও। এবং ছুঁড়ে দিলো আগুনের ভেতর।

এই জংলীগুলোর উপাস্য দেবতা ঐ বিড়াল। ওটার এহেন দশা দেখে খেপে উঠলো ওরা। সমস্বরে ভয়ানক চিৎকার করতে করতে সাগরের ঢেউয়ের মতো ধেয়ে এলো আমাদের দিকে। একটা লোকের ধড় থেকে মাথা নামিয়ে দিলো লিও। পর মুহূর্তে দেখলাম, আমি আর ঘোড়ার পিঠে নেই। বুনো উল্লাসে একদল অসভ্য টানতে টানতে আমাকে নিয়ে চলেছে আগুনের দিকে। পাথর খুঁড়ে গভীর একটা গর্ত করা হয়েছে, তার ভেতর জ্বলছে আগুন। টেনে হিচড়ে আমাকে গর্তের কিনারে নিয়ে ফেললো ওরা। ঘাড় ফিরিয়ে চকিতের জন্যে দেখলাম সাত-আট জন জংলীর সাথে একা লড়ছে লিও। কিছুতেই এঁটে উঠতে পারছে না। তার মানে আর আশা নেই আমার।

টানা হ্যাচড়ায় কুকুরে কামড়ানো হাতটার যন্ত্রণা দ্বিগুণ হয়ে উঠেছে। তবু গর্তটার ভেতর চোখ পড়তেই ভুলে গেলাম সে যন্ত্রণার কথা। আগুনের শিখা আমার মাথা ছাড়িয়ে উঠেছে। ভেতরটা লাল, গন গন করছে। তীব্র আঁচ গায়ে এসে লাগছে। আমাকে ঠেলে ফেলে দেয়ার জন্যে তৈরি হলো ওরা। চোখ বুজলাম আমি। জীবনের সমস্ত মধুর স্মৃতি মুহূর্তে ভেসে গেল চোখের সামনে দিয়ে। তারপর হঠাৎ, শক্ত হয়ে চেপে বসা জান্তব হাতগুলো ঢিলে হয়ে গেল। না, আগুনে নয়, মাটির ওপর চিৎ হয়ে পড়ে গেছি আমি। তাকিয়ে আছি উপর দিকে।

যা দেখলাম, কল্পনাতীত! আগুনের সামনে দাঁড়িয়ে আছে আমাদের সেই প্রেত-দর্শন পথপ্রদর্শক। তীব্র ক্রোধে কাঁপছে সে। এক হাত উঁচু করা বিশালদেহী পুরোহিতের দিকে। এখন আর একা নয়, সাদা আলখাল্লা পরা জনা বিশেক তলোয়ারধারী রয়েছে তার সঙ্গে। কালো চোখ সব কজনের, এশীয় চেহারা; গাল, মাথা পরিষ্কার করে কামানো।

একটু আগেই খ্যাপা ষাঁড়ের মতো গর্জাচ্ছিলো জংলীগুলো, এখন ছুটে পালাচ্ছে যে যেদিকে পারছে সেদিকে, যেন ভেড়ার পালে নেকড়ে পড়েছে। সাদা আলখাল্লাধারী পুরোহিতদের একজন, সম্ভবত দলনেতা, সামনে এগিয়ে এলো। জংলী পুরোহিতের দিকে তাকিয়ে ধমকাতে লাগলো সে। ভাষাটা কিছু কিছু বুঝতে পারলাম আমি।

কুকুর, শান্ত মাপা মাপা স্বরে সে বললো। অভিশপ্ত কুকুর, জানোয়ারের উপাসক, পাহাড়ের সর্বশক্তিময়ী মায়ের অতিথিদের কি করতে যাচ্ছিলি? এজন্যেই কি তোদের এতদিন বাচিয়ে রাখা হয়েছে? জবাব দে, কিছু বলার আছে তোর? তাড়াতাড়ি বল! তোর সময় ঘনিয়ে এসেছে!

ভীত একটা আর্তনাদ বেরোলো লাল, দাড়িওয়ালা বিশালদেহীর গলা চিরে। ছুটে গিয়ে হাঁটু গেড়ে বসলো-প্রধান পূজারীর সামনে নয়, আমাদের পথ-প্রদর্শক প্রেত-দর্শন মূর্তির সামনে। হাউমাউ করে আউড়ে চললো সে ক্ষমা ভিক্ষার আবেদন।

থাম! বলে উঠলো প্রধান পুরোহিত। উনি মায়ের প্রতিনিধি, বিচারের মালিক। আমি কান এবং কণ্ঠস্বর, যা বলার আমাকে বল! যাদেরকে দ্রভাবে সহৃদয়তার সাথে স্বাগত জানাতে বলা হয়েছিলো তাদের হত্যা করতে গিয়েছিলি কি না? উহুঁ, মিথ্যে বলে লাভ হবে না, আমি সব দেখেছি। তোকে ফাঁসানোর জন্যেই ফাঁদ পেতেছিলাম আমরা। অনেক দিন বলেছি, ওসব বর্বর রীতি ছাড়, শুনিসনি। এবার তার মূল্য দে।

তবু বেচারা ক্ষমা ভিক্ষা করে চললো।

দূত, প্রধান পুরোহিত বললো, আপনার মাধ্যমেই শক্তির প্রকাশ ঘটে। রায় দিন।

ধীরে ধীরে হাত তুললো আমাদের পথপ্রদর্শক। আগুনের দিকে ইশারা, করলো। মুহূর্তে ছাইয়ের মতো সাদা হয়ে গের লোকটার মুখ। আর্তনাদ করে পিছিয়ে গেল।

জংলীদের সবাই পালিয়ে যায়নি। দু-একজন রয়ে গিয়েছিলো। তাদের দিকে তাকিয়ে কাছে আসার ইঙ্গিত করলো পূজারী। ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে এক পা দুপা করে এগিয়ে এল তারা।

দেখ, বললো সে, মা হেস-এর বিচার দেখ। মা-র অবাধ্য হলে, তোদর বেলায়ও এমন হবে। এখন তুলে আন তোদের সর্দারকে।

কয়েকজন এগিয়ে এসে নির্দেশ পালন করলো।

ফেলে দে ঐ গর্তে। অপরকে পোড়ানোর জন্যে যে আগুন জ্বেলেছিস তাতে নিজেই পুড়ে মর।

এবারও নিঃশব্দে নির্দেশ পালন করলো ওরা। মাংস, চামড়া পোড়ার উৎকট গন্ধ ছুটলো কয়েক সেকেণ্ড তারপর সব আবার আগের মতো।

শোন তোরা, পুরোহিত বললো, ওর পাওনা শাস্তি ও পেয়েছে। এই বিদেশীরা যে মেয়েটাকে বাঁচিয়েছে তাকে কেন ও খুন করতে চেয়েছিলো জানিস? তোরা ভাবছিস ডাইনী বলে। শুনে রাখ, তা নয়। মেয়েটিকে ও স্বামীর কাছ থেকে কেড়ে নিতে চেয়েছিলো। পারেনি, তাই প্রতিশোধ নেয়ার জন্যে এ কাজ করতে যাচ্ছিলো। কিন্তু চোখ দেখেছে, কান শুনেছে, কণ্ঠস্বর কথা বলেছে, এবং দূত বিচার করেছেন।

পর্বত গর্ভের অগ্নিসিংহাসনে বসে এমনি চুলচেরা বিচার করেন হেসা।

.

১৩.

একে একে প্রায় পা টিপে টিপে চলে গেল আতঙ্কিত জংলীরা।

প্রভু, কালুন রাজসভার পারিষদরা যেমন বলে তেমন বিকৃত গ্রীকে বললো প্রধান পুরোহিত, আপনি আঘাত পেয়েছেন কিনা জিজ্ঞেস করবো না। কারণ, জানি পবিত্র নদীতে পা রাখার মুহূর্ত থেকে অদৃশ্য এক শক্তি রক্ষা করছে আপনাদের। তবু অপবিত্র হাত আপনাদের ওপর পড়েছে, মায়ের নির্দেশ, আপনারা চাইলে ওদের  প্রত্যেককে আপনাদের সামনে হত্যা করা হবে। বলুন, তা-ই চান?

না, জবাব দিলো লিও। ওর বর্বর, অন্ধ। আমরা চাই না আমাদের জন্যে আরও রক্ত ঝরুক। আমরা চাই, বন্ধু-কি বলে ডাকবো আপনাকে?

অরোস।

বন্ধু অরোস, আপাতত আমরা চাই খাবার আর আশ্রয়। তারপর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পৌঁছুতে চাই আপনি যাকে যা বলছেন, যার খোঁজে আমরা এত দূরের পথ পাড়ি দিয়ে এসেছি তার কাছে।

মাথা নুইয়ে অবোস জবাব দিলো, খাবার এবং আশ্রয় তৈরি। বিশ্রাম নিন। কাল সকালে যেখানে চাইবেন সেখানে নিয়ে যাবো। সেরকমই নির্দেশ দেয়া হয়েছে আমাকে।

গজ পঞ্চাশেক দূরে পাহাড়ের গায়ে একটা দালানের কাছে আমাদের নিয়ে গেল অরোস। ভেতরে ঢুকে মনে হলো অতিথিশালা, অন্তত এ মুহূর্তে ঘরটাকে সেভাবেই সাজিয়ে গুছিয়ে রাখা হয়েছে। প্রদীপ জ্বলছে। ঘর গরম রাখার জন্যে আগুন জ্বালানো হয়েছে। দুটো কামরা বাড়িটায়। প্রথমটার ভেতর দিয়ে দ্বিতীয়টায় যেতে হয়। এই দ্বিতীয় ঘরটাতেই আমাদের শোয়ার বন্দোবস্ত করা হয়েছে।

ভেতরে যান, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হয়ে নিন, বললো আরোস। আমার দিকে ফিরে যোগ করলো, তারপর আপনার কুকুরে কামড়ানো হাতের চিকিৎসা হবে।

আমার হাত কুকুরে কামড়েছে আপনি জানলেন কি করে!? আমার কণ্ঠে বিস্ময়।

জবাবটা এড়িয়ে গেল অরোস। শুধু বললো, জেনেছি, এবং সেমতো ব্যবস্থাও করা হয়েছে। চলুন দয়া করে।

ঘরের ভেতর লোহার পাত্রে কুসুম গরম পানি রাখা ছিলো। হাত মুখ ধুয়ে নিলাম। ধবধবে সাদা চাদর পাতা বিছানার ওপর পরিষ্কার কাপড়, আগে থাকতেই রেখে দেয়া হয়েছে আমাদের জন্যে। পরে নিলাম। তারপর আমার হাতের চিকিৎসা করলো অরোস। লিওর বেঁধে দেয়া পট্টি খুলে ফেলে মলম লাগিয়ে নতুন পট্টি বেঁধে দিলো। বাইরের ঘরে এসে দেখি খাবার সাজানো। খেয়ে নিয়ে আবার ঢুকলাম শোবার ঘরে। বিছানায় শুতে না শুতেই ঘুম।

গভীর রাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল আমার। কোনো শব্দ পাইনি, তবু কেন যেন মনে হচ্ছে কেউ এসেছে ঘরে। চোখ মেললাম। হ্যাঁ, যা ভেবেছি তাই। ছোট্ট একটা প্রদীপ মিটমিট করে জ্বলছে। তাতে অন্ধকার দূর হওয়ার চেয়ে আরও গাঢ় হয়েছে যেন। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে অস্পষ্ট প্রেতের মতো একটা মূর্তি। প্রথমে ভাবলাম সত্যিই বুঝি ভূত। তারপর মনে পড়লো আমাদের কাফন মোড়া লাশের মতো পথপ্রদর্শকের কথা। হ্যাঁ সে-ই। লিওর বিছানার দিকে তাকিয়ে আছে।

কিছুক্ষণ স্থির দাঁড়িয়ে রইলো সে। তারপর হঠাৎ আকুল কণ্ঠে বিলাপ করে উঠলো।

তাহলে যা ভেবেছিলাম তা-ই! কাফনের মতো পোশাকের আড়ালে ওটা নারী! আর ও বোবাও নয়, দিব্যি কথা বলতে পারে! আরে, পুরু কাপড়ে ঢাকা হাত দুটো মোচড়াচ্ছে! যেন অকথ্য যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে চাইছে। একটু পরে দেখলাম ঘুমন্ত লিও–ও যেন ওর উপস্থিতির প্রভাব অনুভব করতে শুরু করেছে। ঘুমের ঘোরে নড়েচড়ে উঠে স্পষ্ট গলায় আরবীতে ডাকলো সে–আয়শা! আয়শা!

অত্যন্ত লঘু পায়ে, প্রায় হাওয়ায় ভর করে এগিয়ে এলো মূর্তি। উঠে বসলো লিও। চোখ বোজা, অর্থাৎ এখনও ঘুমে অচেতন। আলিঙ্গনের ভঙ্গিতে দুহাত বাড়িয়ে দিয়ে আবার বললো-আয়শা! আমার আয়শা! জীবন মৃত্যুর ভেতর দিয়ে কতদিন ধরে খুঁজছি তোমাকে। এসো, দেবী, আমার আকাক্ষিতা, আমার কাছে এসো।

আরেকটু কাছে এগুলো মূর্তি। স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি সে কাঁপছে। এবার তার হাত দুটো প্রসারিত হলো।

লিওর বিছানার পাশে গিয়ে থামলো সে। যেমন উঠেছিলো তেমনি ঘুমের ঘোরে শুয়ে পড়লো লিও। ওর গায়ের কম্বলটা পড়ে গেছে। উক্ত বুকের ওপর পড়ে আছে চামড়ার থলেটা। আয়শার চুল রয়েছে তার ভেতর। স্থির চোখে তাকিয়ে রইল মূর্তি থলেটার দিকে। তারপর একটু একটু করে এগিয়ে গেল তার হাত। থলের মুখ খুললো। কোমল হাতে বের করে আনলো চকচকে চুলের গোছাটা। অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইলো সেটার দিকে। তারপর আবার চুলগুলো রেখে থলের মুখ বন্ধ করে দিলো সে। ফুঁপিয়ে উঠে কাঁদলো একটু। এই সময় আবার হাত বাড়িয়ে দিলো লিও। গভীর আবেগে বলে উঠলো—

এসো, কাছে এসো, প্রিয়তমা, আমার বুকে এসো।

অনুচ্চ ভীত স্বরে একবার চিৎকার করে ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল মূর্তি। যখন নিশ্চিত হলাম, সত্যিই ও চলে গেছে তখন সশব্দে শ্বাস টানলাম আমি। একটা চিন্তাই তখন মাথার ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছে: কে এই নারীমূর্তি? আয়শা? পুরোহিত অবোস বলছিলো আমাদের পথপ্রদর্শক নাকি প্রতিনিধি এবং তরবারি; অর্থাৎ রায় কার্যকর করে। কিন্তু কার রায়? ওর নিজের? ওকি মানুষ, না অশরীরী? ভাবতে ভাবতে ক্লান্ত হয়ে কখন যে ঘুমিয়ে গেছি নিজেও জানি না।

.

পরদিন যখন ঘুম ভাঙলো তখন প্রায় দুপুর। পুরোহিত অরোস দাঁড়িয়ে আছে আমার বিছানার পাশে। লিও এখনও ওঠেনি। পুরোহিত ফিসফিস করে জানালো, আমার হাতে নতুন করে ওষুধ লাগিয়ে দেয়ার জন্যে সে এসেছে। তারপর ঘুমন্ত লিওর দিকে তাকিয়ে যোগ করলো–

ওঁকে জাগানোর দরকার নেই। এতদিন অনেকৃষ্ট করেছেন, সামনে আবার কি আছে কে জানে? তারচেয়ে ভালো করে ঘুমিয়ে নিতে দিন। ঘণ্টাখানেকের ভেতর আপনাদের রওনা হতে হবে।

এর অর্থ কি, বন্ধু অরোস? তীক্ষ্ণ্ণকণ্ঠে প্রশ্ন করলাম আমি। কালই না আপনি বললেন এখানে আমরা নিরাপদ?

এখনও বলছি, বন্ধু—

আমার নাম হলি।

হ্যাঁ, বন্ধু হলি, এখনও বলছি শারীরিক দিক থেকে আপনারা নিরাপদ। কিন্তু শুধুই কি শরীর নিয়ে মানুষ? মন, আত্মা আছে না? সেগুলোও জখম হতে পারে।

চিন্তিত ভঙ্গিতে মাথা দোলালাম আমি। অবোস আমার হাতের পট্টি খুলতে লাগলো।

দেখুন প্রায় ভালো হয়ে গেছে আপনার হাত, খোলা শেষ হতে বললো সে। এখন আরেকবার মলম লাগিয়ে পট্টি বেঁধে দিচ্ছি, কয়েক দিনের ভেতর পুরোপুরি ভালো হয়ে যাবে, খান র‍্যাসেনের কুকুর যে কোনোদিন কামড়েছিলো তা বুঝতেই পারবেন না। ও হ্যাঁ, খুব শিগগিরই আবার ওর দেখা পাবেন, সঙ্গে থাকবে ওর সুন্দরী স্ত্রী।

আবার ওর দেখা পাবো! এ পাহাড়ে এলে কি মরা মানুষ বেঁচে ওঠে?

না। এখানে ওকে সমাহিত করতে আনা হবে। কালুনের শাসকরা অনেকদিন ধরে এই সুবিধাটুকু ভোগ করে আসছে। এই যে আপনার সঙ্গী উঠে গেছেন। তৈরি হয়ে নিন।

.

ঘণ্টাখানেক পরে আবার শুরু হলো আমাদের উধ্বমুখী যাত্রা। এবারও আমি খানের ঘোড়ায় চেপে চলেছি। আহার আর বিশ্রাম পেয়ে আবার তাজা হয়ে উঠেছে ঘোড়াটা। লিওর জন্যে একটা পালকির ব্যবস্থা করতে চাইলো অরোস। প্রত্যাখ্যান করলো লিও, মেয়ে মানুষের মতো পালকিতে চড়ে যাবে না ও। একেবারে সামনে আমাদের পথপ্রদর্শক সেই নারীমূর্তি। তার পেছনে অরোস। তারপর ঘোড়ার পিঠে আমি, পাশে পায়ে হেঁটে চলেছে লিও। সবশেষে সাদা আলখাল্লা পরা পূজারীবাহিনী।

চত্বর পেরিয়ে সেই ছোট্ট দরজা দিয়ে দেয়ালের বাইরে এলাম। কাল রাতে যে ঝরনার পাশ দিয়ে গ্রামটার কাছে এসেছিলাম সেখানে পৌঁছুলাম। তারপর উঠে যেতে লাগলাম পাহাড়ের ঢাল বেয়ে।

দুপাশে পাহাড়ের দেয়াল খাড়া উঠে গেছে, মাঝখান দিয়ে চলেছি আমরা। হঠাৎ সমবেত কণ্ঠের সুরেলা একটা ধর্মসঙ্গীত কানে ভেসে এলো। একটা বাঁক নিলো পথ। মোড় ঘুরে দেখলাম ধীর গম্ভীর একটা মিছিল এগিয়ে আসছে আমাদের দিকে। তার পুরোভাগে ঘোড়ার পিঠে আছে সুন্দরী খানিয়া, পেছনে তার চাচা বৃদ্ধ শামান, তারপর একদল সাদা আলখাল্লা পরা ন্যাড়া মাথা পূজারী। একটা শববাহী খাঁটিয়া বহন করেছে তারা। খাঁটিয়ায় শুয়ে আছে খান র‍্যাসেনের দেহ, কালো কাপড়ে আচ্ছাদিত।

আমাদের পথপ্রদর্শকের সাদা অবয়বটা দেখা মাত্র ভয়ঙ্কর বেগে ঘোড়া ছুটিয়ে এলো খানিয়া। চিৎকার করে উঠলো-কে তুই, কাফন পরা ডাইনী, খানিয়া আতেন আর তার মৃত স্বামীর পথ জুড়ে দাঁড়িয়ে আছিস? তারপর লিওর দিকে ফিরে, দেখতে পাচ্ছি কুসংসর্গে পড়েছে তোমরা, ওর সঙ্গে কোথায় যাচ্ছো? পরিণতি শুভ হবে না। ও যদি স্বাভাবিক নারীই হবে অমন মুখ লুকিয়ে রেখেছে কেন? কিসের লজ্জা ওর?

ইতিমধ্যে সিমব্রিও এগিয়ে এসেছে। পোশাকের হাতায় টান দিয়ে আতেনকে থামানোর চেষ্টা করলো সে। আর পূজারী অরোস, বিনীত ভঙ্গিতে মাথা নুইয়ে বললো, দয়া করে চুপ করুন; অমন অশুভ কথা বলবেন না।

কিন্তু চুপ করল না আতেন। ঘৃণার ছাপ আরও গভীর ভাবে এঁটে বসলো তার মুখে। আগের চেয়ে কঠোরস্বরে চিৎকার করলো, কেন, চুপ করবো কেন? ডাইনী, তোর ঐ কাফন খুলে ফেল, মরা লাশই অমন কাপড় পরে থাকে। সাহস থাকে

তো মুখ দেখা; আমরা বুঝি, সত্যিই তুই কি।

থামুন, আমি মিনতি করছি, থামুন, আবার বললো অরোস, এখনও আগের মতো শান্ত তার গলা। উনি প্রতিনিধি, আর কেউ নন, ক্ষমতা ওঁরই সাথী।

আমি কালুনের খানিয়া, আমার বিরুদ্ধে ওর ক্ষমতা কোনো কাজে আসবে না। ক্ষমতা, হা! দেখাতে বলল ওর ক্ষমতা।

ভাইঝি, আতেন, চুপ করো! সন্ত্রস্ত গলায় বললো বৃদ্ধ শামান। আতঙ্কে সাদা হয়ে গেছে তার মুখ।

আবার কিছু বলার জন্যে মুখ খুললো আতেন। সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যুৎগতিতে হাত। উঁচু করলো আমাদের পথপ্রদর্শক, জংলীদের পুরোহিতকে মৃত্যুদণ্ড দেয়ার সময় যেমন করেছিলো তেমন। এক বিন্দু নড়েনি সে, একটা শব্দ করেনি, কেবল হাত উঁচু করেছে, যেন ইশারা করছে। আতেনের হাঁ মুখটা হাঁ হয়েই রইলো কিছুক্ষণ তারপর ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে গেল।

এদিকে মূর্তিকে হাত উঁচু করতে দেখেই এস্তভঙ্গিতে দুহাত তুলেছে অবোস। প্রার্থনার সুরে বলছে, ও দয়াময়ী মা, দয়ার সাগর, করুণার সিন্ধু, তুমি সব শুনেছো, সব দেখেছো, আমি ভিক্ষা চাই তোমার কাছে, এই রমণীর উন্মাদলুলভ আচরণ ক্ষমা করে দাও দয়া করে। শত হলেও ও এই অগ্নিগিরির অতিথি, ওর রক্তে তোমার দাসের হাত কলঙ্কিত কোরো না, এ আমার একান্ত মিনতি।

একটা ব্যাপার খেয়াল করলাম, হাত ওপরে ওঠানো থাকলেও অরোসের চোখ দুটো স্থির আমাদের পথপ্রদর্শকের ওপর।

অরোসের প্রার্থনার গুণেই কিনা জানি না, আস্তে আস্তে নেমে এলো মূর্তির হাত। অদৃশ্য কোনো শক্তির প্রভারে যেন খানিয়া আতেন ভয়ানক এক খোঁচা দিলো ঘোড়ার পেটে। মুহূর্তে ঝড়ের বেগে ছুটতে শুরু করলো ঘোড়াটা। শামান সিমব্রিও ঘোড়া ছুটিয়ে দিলো পেছন পেছন।

আবার রওনা হলাম আমরা। শিগগিরই খান রাসেনের শব বহনকারী মিছিলটা পেরিয়ে গেলাম। সূর্যের আলোয় ধোয়া উপত্যকার ওপর দিয়ে এগিয়ে চলেছি শ্বেতশুভ্র উজ্জ্বল চুড়ার দিকে। কিছুক্ষণ পর ঘন একগুচ্ছ পাইন গাছের কাছে পৌঁছুলাম। পাইনের ছায়ায় পৌঁছুলো আমাদের পথপ্রদর্শক, তারপর হঠাৎ আর দেখলাম না তাকে।

কোথায় গেলেন উনি? অরোসকে জিজ্ঞেস করলাম, খানিয়ার সাথে বোঝাঁপড়া করতে?

না? মৃদু হেসে বললো পুরোহিত। আমার ধারণা, হেসার অতিথিরা প্রায় এসে পড়েছেন এই খবর দেয়ার জন্যে এগিয়ে গেছেন উনি।

আশ্চর্য হলাম জবাবটা শুনে। পাহাড়ের শূন্য ঢাল উঠে গেছে চূড়া পর্যন্ত, মানুষ দূরে থাক একটা ইদুরও আমাদের চোখ এড়িয়ে ওখান দিয়ে যেতে পারবে না। ও গেল কি করে? আর কিছু বললাম না আমি। অরোসের পেছন পেছন উঠে যেতে লাগলাম।

বাকি দিনটুকু এক ভাবে উঠে গেলাম আমরা। ক্রমশ তুষারের কাছাকাছি হচ্ছি।

.

সূর্যাস্তের সামান্য আগে চূড়ার তুষার ছাওয়া এলাকার ঠিক নিচে বিশাল এক প্রাকৃতিক পেয়ালার কাছে এলাম। তলাটার আয়তন কয়েক হাজার একর। পাথর নয়, চমৎকার উর্বরা মাটি দিয়ে গঠিত। ওখানে চাষাবাদ করে মন্দিরের পুরোহিতেরা। চোখ জুড়ানো ফসল ফলে আছে। নিচে থেকে কিছুই দেখা যায় না, পেয়ালার মতো দেখতে উপত্যকাটার অস্তিত্বই টের পাওয়া যায় না। প্রাকৃতিক একটা ফটক দিয়ে ঢুকলাম আমরা সেখানে।

বাগানের মতো সবুজ এলাকা পেরিয়ে ছোট্ট একটা শহর। লাভা পাথরের তৈরি সুন্দর ছিমছাম শহরটায় পূজারীরা থাকে। উপজাতীয়দের কাউকে বা কোনো আগন্তুককে আসতে দেয়া হয় না এখানে।

শহরের প্রধান সড়ক ধরে এগিয়ে উঁচু একটা পাহাড়ী দেয়ালের কাছে পৌঁছুলাম। সামনে বিরাট একটা দরজা। লোহার ভারি পাল্লাগুলো লাগানো। এখান থেকে বিদায় নিলো আমাদের রক্ষী পুরোহিতেরা। আমার ঘোড়াটাও নিয়ে গেল ওরা। অবোস, আমি আর লিও কেবল রইলাম।

নিঃশব্দে খুলে গেল বিশাল দরজাটা। বাঁধানো একটা পথ ধরে এগিয়ে চললাম। কিছুক্ষণ পর অনেক উঁচু আরেকটা দরজার সামনে এলাম। এটাও লোহার। আগেরটার মতোই খুলে গেল নিঃশব্দে, কোনো সংকেত বা নির্দেশ দিতে হলো না বাইরে থেকে। পরমুহূর্তে ভেতরের উজ্জ্বল আলোয় চোখ ধাধিয়ে গেল আমাদের।

পাঠক, আপনার দেখা সবচেয়ে বড় গির্জার কথা স্মরণ করুন; তার দ্বিগুণ বা তিনগুণ আয়তনের একটা মন্দিরের ভেতর ঢুকেছি আমরা। কোনো কালে হয়তো নিছক পাহাড়ী গুহা ছিলো, কে বলতে পারে? কিন্তু এখন এর উঁচু খাড়া দেয়াল, বিশাল স্তম্ভসমূহে ভর করে থাকা ছাদ প্রমাণ করছে হাজার হাজার বছর আগে অগ্নি-উপাসক মানুষদের কি কঠোর পরিশ্রম করতে হয়েছিলো এটা তৈরি করতে।

বিস্ময়কর এক পদ্ধতিতে আলোকিত করা হয়েছে মন্দিরটাকে। মেঝে থেকে উঠে এসেছে উঁচু মোটা অগ্নিস্তম্ভ। গুণে দেখলাম আঠারোটা। নির্দিষ্ট দূরত্ব পর পর দুই সারিতে উজ্জ্বল সাদা আলো বিকিরণ করে জ্বলছে সেগুলো। ছাদের সামান্য নিচে শেষ হয়েছে অগ্নি-স্তম্ভগুলোর মাথা। কোনো গন্ধ বা ধোয়া তৈরি হচ্ছে না। সবচেয়ে আশ্চর্য, এক বিন্দু তাপ ছড়াচ্ছে না সেগুলো। বাইরের মতো শীতল পরিবেশ মন্দিরের ভেতরেও। মৃদু একটা হিস হিস শব্দ হচ্ছে শুধু।

মন্দির জনশূন্য।

আপনাদের এই মোমবাতি কখনও নেভে না? জিজ্ঞেস করলো লিও।

কি করে নিভবে? জবাব দিলো অরোস। এই মন্দিরের নির্মাতারা যার পূজা করতো সেই অনন্ত আগুন থেকে উঠে আসছে ওগুলো। আদি থেকে জ্বলছে এ আলো, অন্ত পর্যন্ত জ্বলবে। তবে ইচ্ছে করলে কিছুক্ষণের জন্যে আমরা বন্ধ করে দিতে পারি কোনো একটা বা সবগুলো। যাক, চলুন, আরও বড় জিনিস দেখার আছে।

নিঃশব্দে এগিয়ে গেলাম আমরা। অবশেষে মন্দিরের শেষ মাথায় পৌঁছলাম। সামনে একটা কাঠের দরজা, আগেরগুলোর মতোই বিরাট। ডান বা দুদিকে দুটো গলি মতো চলে গেছে। আমাদের থামতে ইশারা করলো অরোস। একটু পরেই দুপাশের গুলি থেকে ভেসে এলো সমবেত কণ্ঠের ধর্ম-সঙ্গীত। একবার এদিকে একবার ওদিকে তাকালাম। সাদা আলখাল্লাধারীদের দুটো মিছিল এগিয়ে আসছে আমাদের দিকে।

ধীর পায়ে এগিয়ে আসছে ওরা। ডান দিকের মিছিলটা পূজারীদের, বা দিকেরটা পৃজারিনীদের। সব মিলে একশো জনকি তার বেশি হবে। আমাদের সামনে এসে সারি বেঁধে দাঁড়ালো তারা। পূজারিনীরা দাঁড়ালো পেছনের সারিতে। চুপ সবাই।

অরোস একটা ইশারা করতেই আবার গেয়ে উঠলো তারা। এবার একটু দ্রুত লয়ের একটা সঙ্গীত। সামনের কাঠের দরজাটা খুলে গেল। আবার এগোলাম আমরা। পেছন পেছন সারি বেধে এলো পূজারী-পূজারিনীরা। তারপর যেমন খুলেছিলো তেমনি নিঃশব্দে আমাদের পেছনে বন্ধ হয়ে গেল দরজা। উপবৃত্তাকার একটা কামরায় পৌঁছেছি। এতক্ষণে বুঝলাম, পাহাড়ের চূড়ায় যে আঙটাওয়ালা স্তম্ভ আছে সেটার আদলে তৈরি করা হয়েছে মন্দিরটার দৈর্ঘ্যে প্রস্থে দুটো সমান। এই কামরায়ও মেঝে থেকে অগ্নি-স্তম্ভ উঠেছে। এছাড়া কামরাটা ফাঁকা।

না, পুরোপুরি ফাঁকা নয়, উপবৃত্তের শেষ প্রান্তে একটা উঁচু চৌকো বেদীমতো। একটু কাছাকাছি হতে দেখলাম, রুপোর সরু সুতো দিয়ে তৈরি পর্দা ঝুলছে সেটার সামনে। বেদীর ওপর বসানো রয়েছে বড় একটা রুপোর প্রতিমা। অগ্নি-স্তম্ভের উজ্জ্বল আলো তার ওপর পড়ে ঝকমকিয়ে উঠছে।

দেখতে সুন্দর হলেও জিনিস্টার ঠিক ঠিক বর্ণনা দেয়া দুষ্কর। মূর্তিটা ডানাওয়ালা পরিণত বয়সের এক মহিমাময়ী রমণীকে প্রতীকায়িত করছে যেন। একটা ডানা বেঁকে এসে ঢেকে দিয়েছে তার সামনেটা। ডানার আড়াল থেকে উঁকি দিচ্ছে একটা বাচ্চা ছেলের মুখ। বাঁ হাতে সে ধরে আছে নারীমূর্তির এক স্তন, ডান হাতটা উঁচু হয়ে আছে আকাশের দিকে। এক পলক দেখলে যে কেউ বুঝতে পারবে মূর্তিটা মাতৃত্বের প্রতিরূপ।

আমরা যখন মুগ্ধ বিস্ময়ে দেখছি তখন পূজারী আর পূজারিনীরা ডানে-বাঁয়ে নড়ে চড়ে নতুন একটা সারি তৈরি করে দাঁড়িয়ে গেছে। একজন পুরুষের পাশে একজন নারী এভাবে দাঁড়িয়েছে তারা। গম্ভীর অথচ সুরেলা কণ্ঠের গান চলছে। উপবৃত্তাকার কামরাটা এত বড় যে দেয়ালে দেয়ালে প্রতিধ্বনি তুলছে তার আওয়াজ। সব মিলিয়ে গভীর গাম্ভীর্যময় এক পরিবেশ। কথা বলা দূরে থাক, হাত পা নাড়তে পর্যন্ত ভয় হচ্ছে, পাছে অবমাননা হয় এই গাম্ভীর্যের। নৈঃশব্দ্যই যেন এর একমাত্র সাথী, আর সব কিছু এখানে বেমানান।

শেষ পূজারী তার জায়গা নেয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করলো অরোস। তারপর ফিরলো আমাদের দিকে। মৃদু, বিনীত কণ্ঠে বললো, এবার কাছে আসুন, প্রিয় বিদেশী পথিক, মা-কে প্রণতি জানান।

কই তিনি? ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলো লিও। কাউকে তো দেখছি না। হেসা ওখানেই থাকেন। প্রতিমার দিকে ইশারা করলো অবোস। তারপর আমাদের দুজনের হাত ধরে এগিয়ে চললো বেদীর দিকে।

যত আমরা এগোচ্ছি ততই উঁচুগ্রামে উঠছে পূজারীদের কণ্ঠস্বর। বিশাল শূন্য কামরার পরিবেশ আরও গমগমে হয়ে উঠেছে। সেই সাথে আমার মনে হলো–হয়তো এটা নেহায়েতই মনে হওয়া-অগ্নি স্তম্ভের উজ্জ্বলতাও যেন বাড়ছে।

অবশেষে আমরা পৌঁছুলাম সেখানে। আমাদের হাত ছেড়ে দিয়ে তিনবার মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করলো অরোস। তারপর উঠে আমাদের পেছনে এসে দাঁড়িয়ে রইলো; মাথা নিচু, আঙুলগুলো ভাজ করা। আমরাও দাঁড়িয়ে রইলাম। অরোসের মতোই নিঃশব্দে। আশা-নিরাশার দোলায় দুলছে আমাদের হৃদয়। অবশেষে কি সব পরিশ্রমের শেষ হলো?

.

১৪.

ধীরে ধীরে সরে গেল রুপোর পর্দা। একটা কুঠুরি মত দেখতে পেলাম বেদীর নিচে। সে কুঠুরির কেন্দ্রস্থলে একটা সিংহাসন। সিংহাসনে আসীন এক মূর্তি। তুষার শুভ্র ঢেউ নেমে এসেছে তার মাথা থেকে বাহু ছাড়িয়ে মর্মরের মেঝে পর্যন্ত। বস্ত্রাবৃত হাতে রত্নখচিত আংটাওয়ালা দণ্ড-সিসট্রাম!

হঠাৎ কি যে হলো আমাদের, মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে প্রণতি জানালাম মূর্তিকে, অরোস যেমন করেছিলো। এবং তারপর সেখানেই বসে রইলাম হাঁটু গেড়ে, মুখ নিচু করে। অনেক অনেকক্ষণ পর ছোট্ট ঘণ্টাগুলোর মৃদু টুং টাং আওয়াজ শুনে মুখ তুলে দেখলাম, দণ্ড ধরা হাতটা আমাদের দিকে প্রসারিত। তারপর সরু কিন্তু স্পষ্ট একটা কণ্ঠস্বর, আমার মনে হলো সামান্য যেন কাঁপছে, বিশুদ্ধ খ্রীকে বললো স্বাগতম পথিকেরা। অন্য ধর্মাবলম্বী হয়েও দীর্ঘ বন্ধুর পথ পাড়ি দিয়ে এই প্রাচীন দেবায়তনে এসেছে, সেজন্যে তোমাদের অভিনন্দন। ওঠো, আমাকে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আমিই তো তোমাদের আহ্বান করেছি। সে জন্যে কি দূত এবং ভৃত্যদের পাঠাইনি? তাহলে আর ভয় কেন?

উঠলাম আমরা। নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইলাম। কি বলবো বুঝতে পারছি না।

আমি তোমাদের অভিনন্দন জানাই, আবার শোনা গেল সেই কণ্ঠস্বর। এখন বলল,লিওর দিকে ঘুরলো দণ্ডটা-কি বলে সম্বোধন করা হয় তোমাকে?

আমার নাম লিও ভিনসি।

লিও ভিনসি! চমৎকার নাম! তোমাকেই মানায়। আর তুমি? আমাকে করা হলো প্রশ্নটা।

আমি হোরেস হলি।

আচ্ছা। এবার বলো, লিও ভিনসি, হোজেস হলি, কিসের খোঁজে এসেছ এত দূরে?

একে অন্যের দিকে তাকালাম আমরা। আমি জবাব দিলাম, সে এক আশ্চর্য, দীর্ঘ কাহিনি—কিন্তু আপনাকে কি বলে সম্বোধন করবো আমরা?

যা আমার নাম, হেস।

হ্যাঁ, সে এক দীর্ঘ কাহিনি, হেস।

হোক দীর্ঘ, তবু আমি শুনতে চাই। আগ্রহ তার গলায়। না, এখনই সবটা নয়, আমি জানি তোমরা ক্লান্ত, এখন কিছুটা বলল, বাকিটা পরে শুনবো। তুমি বলো, লিও, যথাসম্ভব সংক্ষেপে।

পূজারিনী, স্বভাবসুলভ চটপটে ভঙ্গিতে বললো লিও, আপনার আদেশ শিরোধার্য। বহু বছর আগে, আমি যখন যুবক, আমার বন্ধু এবং পালক পিতা হোরেস হলি আর আমি প্রাচীন কিছু তথ্য প্রমাণের ভিত্তিতে বুনো এক দেশে গিয়েছিলাম। সেখানে স্বর্গীয় এক নারীর সাথে সাক্ষাৎ হয় আমাদের। সময়কে জয় করতে সক্ষম হয়েছিল সে।

অর্থাৎ সেই রমণীর বয়স ছিল বেশি, দেখতেও নিশ্চয় কুৎসিত?,

পূজারিনী, আমি বলেছি, সে সময়কে জয় করেছিলো সহ্য করেছিলো নয়। সে ছিলো অনন্ত যৌবনের অধিকারী, আর সৌন্দর্য? ওর তুলনা একমাত্র ও-ই। পৃথিবীর কোনো সৌন্দর্যের সাথে সে সৌন্দর্যের তুলনা চলে না।

তাহলে, বিদেশী, আর দশটা পুরুষের মত তুমিও নিছক সৌন্দর্যের খাতিরেই ওকে পূজা করেছো?

উঁহুঁ, আমি ওকে পূজা করিনি, ভালোবেসেছি। প্রেম আর পূজা নিশ্চয়ই এক জিনিস নয়? পূজারী অরোস আপনাকে পূজা করে, সেজন্যে মা ডাকে। আমি ঐ অনন্ত যৌবনা রমণীকে ভালোবেসেছিলাম।

তাহলে তো এখনও ওকে তোমার ভালোবাসা উচিত। নইলে বলতে হয়, খাদ ছিলো তোমার প্রেমে।

আমি এখনও ওকে ভালোবাসি, বললো লিও। ও মরে গেছে তবু।

তা কি করে সম্ভব? এই না বললে সে অমর।

এখনও আমি তা-ই বিশ্বাস করি। তবে আমার মানবীয় বোধ হয়তো বুঝতে পারছে না, ভাবছে ও মরে গেছে, হয়তো ও রূপ বদলেছে। মোট কথা, আমি ওকে হারিয়েছি, এবং সেই হারানো ধনই আমি খুঁজে ফিরছি এত বছর ধরে।

বুঝলাম, কিন্তু আমার পাহাড়ে কেন?

কারণ এক অলৌকিক দর্শন আমাকে এই পাহাড়ের দৈববাণীর পরামর্শ নিতে বলেছে। আমার হারানো প্রিয়তমার খবর পাবো সেই আশায় এখানে এসেছি।

আর তুমি, হলি? তুমিও কি অমন এক অমর নারীকে ভালোবাসো, যার অমরত্ব মৃত্যুর পায়ে মাথা নোয়ায়?

না, পূজারিনী, আমার দায় অন্যখানে। আমার পালিত পুত্র যেখানেই যায় আমিও ওর সঙ্গে সঙ্গে যাই। ও সৌন্দর্যেপছনে ছুটছে, আমি ওর–

তুমি ওর পেছন পেছন ছুটছো। তার মানে তোমরা দুজনই যুগ যুগ ধরে মানুষ অন্ধের মতো, পাগলের মতো যা করেছে তা-ই করছে–সৌন্দর্যের পেছনে ছুটছে।

না, আমি বললাম, ওরা যদি অন্ধ হতো সুন্দরকে দেখতে পেতো না, আর পাগল হলে বুঝতে পারতো না কোনটা সুন্দর কোনটা অসুন্দর। জ্ঞান এবং চোখ দুটোই স্বাভাবিক মানুষের আয়ত্তাধীন অনুভব।

হুঁ, বেশ গুছিয়ে কথা বলতে পারো তুমি, হলি, অনেকটা সেই- থেমে গেল সে। তারপর হঠাৎ জিজ্ঞেস করলো, আচ্ছা, আমার দাসী কালুনের খানিয়া তোমাদের যথাযথ সমাদর করেছে তো? যেমন নির্দেশ দিয়েছিলাম সেই মতো এখানে আসার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলো?

আমরা জানতাম না ও আপনার দাসী, বললাম আমি। সমাদর? হ্যাঁ, তা পেয়েছি মোটামুটি। তবে এখানে আসার ব্যাপারে ওর চেয়ে ওর স্বামী, খানের মরণ-শ্বাপদগুলোর অবদান বেশি। আচ্ছা, পূজারিনী, আমাদের আসা সম্পর্কে কি জানেন আপনি?

খুব বেশি কিছু না, তাচ্ছিল্যের সঙ্গে জবাব দিলো সে। তিন চাঁদেরও কয়েকদিন আগে আমার গুপ্তচররা তোমাদের দেখতে পায় দূরের ঐ পাহাড়ে। এক রাতে লুকিয়ে লুকিয়ে তোমাদের তাঁবুর খুব কাছে গিয়ে তোমাদের ভ্রমণের উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানতে পারে। তারপরই ঝটপট ফিরে এসে আমাকে জানায় সব। তখন আমি খানিয়া আতেন আর তার যাদুকর চাচাকে নির্দেশ দিই কালুনের প্রাচীন রাজ্যতোরণের কাছে গিয়ে যেন অপেক্ষা করে এবং তোমরা পৌঁছুলে সমাদরের সাথে অভ্যর্থনা জানিয়ে দ্রুত এখানে পাঠানোর ব্যবস্থা করে। কিন্তু দেখছি কালুন থেকে এপর্যন্ত আসতে তোমাদের তিন মাসেরও বেশি লেগে গেছে।

যথাসম্ভব দ্রুত আসার চেষ্টা করেছি আমরা, বললো লিও; আপনার গুপ্তচররা যখন ওই দূরের পাহাড়ে গিয়ে আমাদের আসার সংবাদ আনতে পারে। আমাদের দেরি হওয়ার কারণও নিশ্চয়ই তারা বলতে পারবে। আমার প্রার্থনা, এ সম্পর্কে আর কিছু জিজ্ঞেস করবেন না আমাদের।

হ্যাঁ, আমি আতেনকেই জিজ্ঞেস করবো, শীতল গলায় জবাব দিলো হেসা। অবোস, খানিয়াকে নিয়ে এসো এখানে। তাড়াতাড়ি করবে।

চলে গেল পুরোহিত প্রধান।

আমার দিকে তাকালো লিও। ইংরেজিতে বললো, এখানে আসা ঠিক হয়নি। এবার বোধহয় ঝামেলা হবে।

আমার মনে হয় না। যদি হয়ও ঝামেলার ভেতর দিয়ে সত্যই বেরিয়ে আসবে। থেমে গেলাম আমি। মনে পড়লো, পাহাড়ে থাকতে ইংরেজি ছাড়া আর কিছু বলিনি আমরা। তবু সামনে বসা এই অদ্ভুত মহিলার চররা আমাদের কথা বুঝেছিলো। এই মহিলাও নিশ্চই বোঝে।

এক সেকেণ্ড পরেই আমার কথা সত্যি প্রমাণিত হলো।

তুমি অভিজ্ঞ লোক, হলি, বললো সে, ঠিকই বলেছো, ঝামেলার ভেতর দিয়েই সত্য বেরিয়ে আসে।

.

দরজা খুলে গেল। কালো পোশাক পরা একদল মানুষ ঢুকলো প্রায় বৃত্তাকার কামরাটায়। পুরোভাগে রয়েছে শামান সিমব্রি। তার পেছনেই খানের শববাহী খাঁটিয়া বয়ে আনছে আটজন পূজারী। তারপর খানিয়া আতেন, মাথা থেকে পা। পর্যন্ত কালো আলখাল্লায় মোড়া। সবশেষে আরেক দল পূজারী। বেদীর সামনে নামিয়ে রাখা হলো খাঁটিয়াটা। পূজারীরা পিছিয়ে গেল। আতেন আর তার চাচা কেবল রইলো মৃতদেহের কাছে।

আমার দাসী, কালুনের খানিয়া কি চায়? শীতল কণ্ঠে প্রশ্ন করলো হেসা।

এগিয়ে হাঁটু গেড়ে বসলো আতেন। প্রণাম করলো, তবে খুব বিনীত ভঙ্গিতে নয়।

মা, আমার পূর্ব-পুরুষদের মতো আমিও এসেছি আপনার চরণে আমার ভক্তি নিবেদন করতে, আবার প্রণাম করলো সে। মা, এই মৃত মানুষটা আপনার এই

পবিত্র পাহাড়ের আগুনে সমাহিত হওয়ার অধিকার চায়।

এটা আবার চাওয়ার কি হলো? যুগ যুগ ধরে তো এ নিয়মই চলে আসছে, খান পরিবারের সদস্যরা মারা যাওয়ামাত্র এখানে সমাহিত হওয়ার অধিকার লাভ করে। তোমার মৃত স্বামীর বেলায় ব্যতিক্রম হবে কেন? যখন সময় আসবে তোমার বেলায়ও হবে না।

ধন্যবাদ, ও হেস, আমার প্রার্থনা, নির্দেশটা লিখিতভাবে রাখা হোক। বয়সের তুষার স্তরে স্তরে জমেছে আপনার পূজনীয় দেহের ওপর। শিগগিরই হয়তো সাময়িকভাবে আমাদের ছেড়ে বিদায় নেবেন আপনি। তারপর নতুন যে হেসা আমাদের শাসন করবেন তার সময়ে যেন এর অন্যথা না হয়।

থামো! গর্জে উঠলো হেসা। বন্ধ করো তোমার এই লাগামহীন কথাবার্তা! নির্বোধ, কার সামনে বসে কি বলছো খেয়াল নেই? সৌন্দর্য আর যৌবন নিয়ে তোমার যে অহঙ্কার তা কালই আগুনের খোরাক হতে পারে জানো না? বাজে কথা রেখে বলো, কি করে মরেছে তোমার স্বামী? ১

ঐ বিদেশীদের জিজ্ঞেস করুন।

আমি ওকে হত্যা করেছি, বললো লিও। প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে এ কাজ করতে হয়েছে। আমাদের ওপর ও হিংস্র কুকুরের পাল লেলিয়ে দিয়েছিলো। এই যে তার প্রমাণ, আমার হাতের দিকে ইশারা করলো ও। পূজারী অরোসও জানেন, উনি ঐ ক্ষত চিকিৎসা করছেন।

কি করে এ সম্ভব? আতের্নের দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করলো হেসা।

আমার স্বামী উন্মাদ ছিলো, দৃঢ় গলায় বললো খানিয়া। নিষ্ঠুর হলেও ব্যাপারটাকে ও খেলা হিসেবে নিয়েছিলো।

আচ্ছা! তোমার স্বামী বোধহয় একটু ঈর্ষাকাতরও হয়ে উঠেছিলো, তাই না? উই, মিথ্যে বলার চেষ্টা কোরো না। লিও ভিনসি, তুমি বলোনা, যে নারী তোমার কাছে প্রেম নিবেদন করেছে তার সম্পর্কে তোমাকে জিজ্ঞেস করবো না। হলি, তুমি বলো, সত্যি বলবে।

খানিয়া আতেন আর শামান সিমব্রি আমাদের উদ্ধার করার পর থেকে এ পর্যন্ত যা যা ঘটেছে সংক্ষেপে বলে গেলাম আমি। নিঃশব্দে শুনলো হেসা। তারপর বললো— বলছো, খানিয়া তোমার পালিত পুত্রের প্রেমে পড়েছিলো। কিন্তু পালিত পুত্রের অবস্থা কি? ও প্রেমে পড়েনি?

তা আমি সঠিক বলতে পারবো না। তবে যতটুকু জানি, খানিয়ার হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যে পাগল হয়ে উঠেছিলো লিও।

হুঁ। দাসী আতেন! কি বলার আছে তোমার?

সামান্য, জবাব দিলো, আতেন, একটুও কাঁপছে না ওর গলা। ঐ পাগল বর্বরটার সাথে থাকতে থাকতে হাঁপিয়ে উঠেছিলাম। এমন সময় এলো এই বিদেশী। একে অন্যকে দেখলাম আমরা। তারপর প্রকৃতির খেয়াল, আমি কি করবো?-পরস্পরের প্রতি আসক্ত হলাম দুজন। পরে ব্ল্যাসেনের প্রতিশোধের ভয়ে কালুন ছেড়ে পালানোর চেষ্টা করে ওরা। নেহায়েত দৈবক্রমেই এদিকে চলে এসেছিলো। এটুকুই আমার বক্তব্য। এবার দয়া করে অনুমতি দিন, বিশ্রাম নিতে যাই, ভীষণ ক্লান্ত বোধ করছি।

দাঁড়াও, আতেন! কঠোর কণ্ঠে বললো হেসা। তুমি বলছে, প্রকৃতির খেয়ালে তুমি আর ঐ লোকটা একে অন্যের প্রেমে পড়েছিলে। ওর বুকের কাছে ছোট্ট একটা থলেতে এক গোছা চুল আছে। বলো, সেটা কি তোমার প্রেমের নিদর্শন?

ওর বুকের কাছে কোনো থলে আছে কিনা বা সেই থলেতে কোনো কিছু লুকানো আছে কিনা, আমি জানি না, শান্ত নিরাবেগ গলায় বললো খানিয়া।

তোমার তোরণ-গৃহে যখন অসুস্থ হয়ে পড়ে ছিলো তখন ও ঐ গোছাটা তোমার চুলের সাথে মিলিয়ে দেখেনি ব চাও?—ভালো করে মনে করে দেখ।

ওহ! আমাদের সব গোপন কথা ফাঁস করে দিয়েছে! ঘৃণার দৃষ্টিতে লিওর দিকে তাকালো আতেন। অনেক পুরুষই প্রেয়সীর স্মৃতিচিহ্ন বুকে করে রাখতে চায়, ও-ও রেখেছে।

না। এ সম্পর্কে আমি ওঁকে কিছুই বলিনি, খানিয়া! শান্তকণ্ঠে বললো লিও।

না, তুমি বলোনি; আমার অলৌকিক ক্ষমতাই আমাকে জানিয়েছে। নিজেকে তুমি কি মনে করো, আতেন? সর্বজ্ঞ সর্বদশী হেমার কাছে সত্য গোপন করবে, এতই সহজ? আমি সব জানি, আতেন, বিদেশীরা অসুস্থ বলে মিথ্যা সংবাদ দিয়েছিলে আমাকে। আমার অতিথিদের বন্দী করেছিলে। যে তোমার প্রেম প্রত্যাখ্যান করেছিলো তার কাছ থেকে জোর করে ভালোবাসা আদায় করতে চেয়েছিলে? থামলো হেসা। তারপর হিম শীতল কণ্ঠে বলে গেল, তোমার পাপের পেয়ালা পূর্ণ হয়েছে, আতেন। এত কিছুর পরও আমার আশ্রমে, আমার সামনে বসে মিথ্যা বলেছে তুমি।

হলোই বা, তাতে কি? তাচ্ছিল্যের সাথে বললো খানিয়া। আপনি নিজে কি ওই লোকটাকে ভালোবাসেন? না, সে-তো দানবীয় ব্যাপার! উহুঁ, হেস, অত রেগে যাবেন না, আপনার অশুভ ক্ষমতার কথা আমি জানি, এ-ও জানি আমি আপনার অতিথি, অতিথির রক্তে আপনি আপনার হাত কলঙ্কিত করবেন না। তাছাড়া, আমার ধারণা, আমার ক্ষতি করা আপনার সাধ্যের বাইরে। অতিলৌকিক ক্ষমতার দিক থেকে আমি আপনি দুজনেই সমান।

আতেন, মাপা গলায় জবাব দিলো হেস, ইচ্ছে করলে এ মুহূর্তে তোমাকে ধ্বংস করতে পারি। তবে, তুমি ঠিকই বলেছো, করবো না। কিন্তু এই অতিথিদের সম্পর্কে আমার স্পষ্ট নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও তা লঙ্ঘন করার সাহস দেখালে কি করে?

তাহলে শুনুন, স্পর্ধা, ব্যঙ্গ সব দূর হয়ে গেছে আতেনের গলা থেকে। ওর অন্তর থেকে যেন উঠে এলো কথাগুলো। আমি আপনার নির্দেশ অমান্য করেছি কারণ, ঐ মানুষটা আপনার নয়, আমার, এবং একমাত্র আমার; অন্য কোনো নারীর নয়! আমি ওকে ভালোবাসি, জন্ম-জন্মান্তর ধরে ভালোবাসি। হ্যাঁ, আমাদের আত্ম প্রথম যখন দেহের খাঁচায় বন্দী হয়েছে তখন থেকেই আমি ওকে ভালোবাসি, যেমন ও ভালোবাসে আমাকে। আমার হৃদয় আমাকে বলেছে একথা, আমার চাচার ঐন্দ্রজালিক ক্ষমতা আমাকে বলেছে একথা, যদিও কখন, কোথায় এ প্রেমের সূচনা তা আমি জানি না। জানার জন্যেই এসেছি আপনার কাছে, মা। অতীতের কোনো রহস্যই আপনার অজ্ঞাত নয়, আপনি বলুন, সত্য প্রকাশ করুন। জানি নিজের বেদীতে বসে আপনি মিথ্যে বলতে পারবেন না। জবাব দিন আমার প্রশ্নের-কে এই লোক। কেন ওকে দেখার সঙ্গে আমার অন্তর পেয়ে গেছে ওর দিকে? অতীতে ওর সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক ছিলো? আপনার কাছে কেন এসেছে ও? বলুন, ও মহিমাময়ী মা সব গোপনীয়তার অবসান হোক। আমি আদেশ করছি, বলুন, পরে আমাকে হত্যা করতে চান করবেন, কিন্তু আগে সত্য প্রকাশ করুন।

হ্যাঁ, বলুন! বলুন! আতেন থামতেই বলে উঠলো লিও। আমিও জানতে চাই। আশা-নিরাশায় হাবুডুবু খাচ্ছে আমার মন, আমাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে স্মৃতি। বলুন আপনি!

আমিও প্রতিধ্বনি করলাম, বলুন!

চুপ করে আছে হেসা। একটা দুটো করে সেকেণ্ড পেরিয়ে যাচ্ছে।

লিও ভিনসি, অবশেষে বললো সে, তোমার কি মনে হয়? আমি কে হতে পারি?

আমার বিশ্বাস, শান্ত গলায় জবাব দিলো লিও, তুমি আয়শা। কোর-এর। গুহায় দুহাজার বছরেরও বেশি আগে যার হাতে আমি নিহত হয়েছিলাম সেই আয়শা। হ্যাঁ, আমার বিশ্বাস, তুমি আয়শা। কোর-এর সেই একই গুহায় বিশ বছর আগে আবার ফিরে আসার শপথ নিয়ে যাকে মারা যেতে দেখেছিলাম তুমি সেই আয়শা।

শুনে খুব মজা পেলো যেন খানিয়া। বললো, শোনো পাগল কি বলে! বিশ বছর নয়, আশি গ্রীষ্ম আগে আমার দাদা, তখন উনি যুবক, মায়ের এই সিংহাসনে বসে থাকতে দেখে গিয়েছিলেন এই পূজারিনীকে।

তোমার কি মনে হয়, হলি? আমি কে হতে পারি? অ্যাতেনের কথা যেন শুনতেই পায়নি এমন ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করলো হেসা।

লিওর যা বিশ্বাস আমারও তাই। অবশ্য আসলে আপনি কি তা একমাত্র আপনিই বলতে পারেন।

হ্যাঁ, আমিই বলতে পারি আসলে আমি কি। কাল ঐ মৃতদেহ সত্ত্বারের জন্যে যখন উপরে নিয়ে যাওয়া হবে তখন এ নিয়ে আবার আলাপ করবো আমরা। ততক্ষণ তোমরা বিশ্রাম নাও, আর প্রস্তুতি নাও সেই ভয়ঙ্কর সত্যের মুখোমুখি হওয়ার।

হেসার কথা শেষ হওয়ার আগেই, রুপালি পর্দা সরে এলো আগের জায়গায়। কালো পোশাক পরা পুরোহিতরা ঘিরে ধলো আতেন আর তার চাচা শামানকে। মন্দির থেকে বেরিয়ে গেল তারা। পূজারী-প্রধান অবোস ইশারায় তার পেছন পেছন যেতে বললো আমাদের। আমরাও বেরিয়ে এলাম মন্দির থেকে। অন্য পূজারী পূজারিনীরাও বেরিয়ে এলো। কেবল খান র‍্যাসেনের মৃতদেহ পড়ে রইলো যেখানে ছিলো সেখানে।

চমৎকার আসবাবপত্র সজ্জিত একটা বাড়িতে আমাদের নিয়ে এলো অরোস। অদ্ভুত এক পানীয় খেতে দিলো স্বপ্নাচ্ছন্নের মতো বিনা প্রতিবাদে খেয়ে নিলাম আমি আর লিও। তারপর আর কিছু মনে নেই।

ঘুম ভাঙতে দেখলাম, বিছানায় শুয়ে আছি। চমৎকার ঝরঝরে লাগছে শরীর। এখনও রাত শেষ হয়নি। তার মানে খুব বেশিক্ষণ হয়নি ঘুমিয়েছি। পাশ ফিরে আবার ঘুমানোর চেষ্টা করলাম। কিন্তু ঘুম এলো না। কিছুক্ষণ এপাশ ওপাশ করার। পর মনের ভেতর ভীড় করে এলো একরাশ চিন্তা। বিশেষ করে হেসার শেষ কথাগুলো প্রস্তুতি নাও ভয়ঙ্কর সত্যের মুখোমুখি হওয়ার!

কি সেই ভয়ঙ্কর সত্য? যদি দেখা যায় ও আয়শা নয়, সত্যিই ভয়ঙ্কর কিছু, তাহলে? শেষ দিকে অত মনোবল কোথায় পেলো, খানিয়া? ভাবতে ভাবতে উঠে বসলাম আমি। দেখলাম, একটা মূর্তি এগিয়ে আসছে। চিনতে পারলাম। অরোস।

অনেক ঘুমিয়েছেন, বন্ধু হলি, সে বললো, এবার উঠুন, তৈরি হয়ে নিন।

অনেক ঘুমিয়েছি! এখনও দেখছি অন্ধকার রয়েছে!

বন্ধু, এ অন্ধকার নতুন একটা রাতের। পুরো একরাত একদিন ঘুমিয়েছেন। আপনি।

আচ্ছা, একটা কথা–।

না, বন্ধু, কোনো কথা নয়। আমি কিছুই বলবো না। এখন খানের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় যোগ দেবেন, সেখানে ভাগ্যে থাকলে আপনার প্রশ্নের জবাব পেয়ে যেতেও পারেন।

দশ মিনিট পরে খাওয়ার ঘরে নিয়ে গেল আমাকে অবোস। লিও আগে থাকতেই সেখানে বসে আছে। ওকে কাপড়-চোপড় পরিয়ে এখানে রেখে আমার কাছে গিয়েছিলো পূজারী-প্রধান। খাওয়া শেষে বেরিয়ে এলাম ঘর থেকে।

.

প্রথমেই মন্দিরে নিয়ে গেল আমাদের অরোস। অগ্নি স্তম্ভের আলোয় আলোকিত দীর্ঘ কামরা পেরিয়ে উপবৃত্তাকার কক্ষে ঢুকলাম। একদম ফাঁকা এখন জায়গাটা। এমন কি খানের মৃতদেহটাও নেই। বেদীর ওপর প্রতিমা তেমনই আছে কিন্তু নিচের কুঠুরিতে কিছু নেই। রুপালি পর্দা খোলা।

মতকে সম্মান দেখানোর জন্যে চলে গেছেন মা। প্রাচীনকাল থেকেই চলে আসছে এ রীতি, ব্যাখ্যা করলো অরোস।

বেদীর ওপর উঠলাম আমরা। প্রতিমার পেছনে একটা দরজা। দরজার ওপাশে একটা গলি। তার শেষে বড় একটা কামরা। কামরার চার দেয়ালে অনেকগুলো দরজা। সেগুলো দিয়ে ঢোকা যায় বিভিন্ন কক্ষে। অরোস জানালো, হেসা তার পরিচারিকাদের নিয়ে বাস করেন ঐ কক্ষগুলোয়।

গলির শেষের কামরায় পৌঁছে দেখলাম ছজন পূজারী বসে আছে। প্রত্যেকের বগলে কয়েকটা করে মশাল আর হাতে একটা প্রদীপ।

অন্ধকারের ভেতর দিয়ে যেতে হবে আমাদের, বললো অরোস। দিন হলে বাইরের তুষার ছাওয়া ঢাল বেয়ে যাওয়া যেতো, রাতে ওখান দিয়ে যাওয়া বিপজ্জনক।

এক পূজারীর কাছ থেকে তিনটে মশাল নিয়ে জ্বাললো সে। দুটো আমাদের দুজনের হাতে দিয়ে তৃতীয়টা রাখলো নিজের কাছে। কামরার শেষ প্রান্তের একটা। দরজা খুললো অবোস। অন্ধকার এক সুড়ঙ্গ দেখা গেল। পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে উঠে গেছে ওপর দিকে। মশাল হাতে উঠতে শুরু করলাম আমরা। প্রায় একঘণ্টা ওঠার পর দীর্ঘ এক সিঁড়ির গোড়ায় পৌঁছুলাম।

লিওর দিকে তাকালো অবোস। মাথা নুইয়ে অত্যন্ত বিনীতভাবে বললো, এবার একটু বিশ্রাম নিয়ে নিন, প্রভু, এই সিঁড়ি বেয়ে অনেকুদূর উঠতে হবে। এখন আমরা পাহাড়ের চূড়ার ঠিক নিচে রয়েছি। আংটাওয়ালা স্তম্ভে উঠবো এবার।

বসে রইলাম আমরা। সুড়ঙ্গের ফাঁক-ফোকর দিয়ে ঠাণ্ডা বাতাস আসছে। মশালের শিখা কেঁপে কেঁপে উঠছে। মেঘ গর্জনের মতো অদ্ভুত গুরু গুরু একটা আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি একটু পর পরই। অবোসকে জিজ্ঞেস করলাম, ওটা কিসের শব্দ। সে বললো, অগ্নিগিরির জ্বালামুখ থেকে খুব দূরে নেই আমরা। নিরেট পাথর ভেদ করে ভেসে আসছে অনন্ত আগুনের শব্দ।

কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে উঠতে শুরু করলাম আমরা। উঠছি—উঠছি—উঠছি— শেষই হয় না সিঁড়ি। প্রায় এক ফুট উঁচু একেকটা ধাপ। পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে উঠে গেছে স্তম্ভের ভেতর দিয়ে। কয়েক মিনিটের ভেতর হাঁপাতে শুরু করলাম। আবার বিশ্রাম নিলাম, আবার উঠলাম, তারপর আবার বিশ্রাম এবং আবার ওঠা। পুরো ছয়শো ধাপ টপকে স্তম্ভের মাথায় পৌঁছানো গেল। কিন্তু শেষ হলো না ওঠা। আংটার ভেতর দিয়েও উঠে গেছে সিঁড়ি। আবার খানিকক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে উঠে চললাম আমরা। অবশেষে আলো দেখতে পেলাম সামনে। আর বিশটা ধাপ টপকাতেই উঠে এলাম আংটার একেবারে মাথায় মঞ্চ মতো একটা জায়গায়।

আশি ফুট লম্বা ত্রিশ ফুট চওড়া সমতল জায়গাটা। মাথার ওপর নক্ষত্রখচিত আকাশ। শো শো করে বাতাস বইছে। প্রবল তার বেগ। মনে হচ্ছে উড়িয়ে নিয়ে যাবে। দক্ষিণে বিশ হাজার ফুট বা তারও নিচে অস্পষ্টভাবে দেখতে পাচ্ছি কালুনের সমভূমি। পুব এবং পশ্চিমে দূরে তুষার ছাওয়া পাহাড়শ্রেণী। এবং সবচেয়ে ভয়ঙ্কর, আমাদের ঠিক নিচে আগ্নেয়গিরির প্রকাণ্ড জ্বালামুখ। প্রশস্ত একটা আগুনের হ্রদ। টগবগ করে বুদবুদ উঠছে। নানান রঙের নানান চেহারার ফুলঝুরি তুলে ফাটছে একেকটা বুদবুদার নতুন করে তৈরি হচ্ছে আরেকটা।

আতঙ্কে হাত পা হিম হয়ে আসতে চাইছে আমার। হৃৎপিন্ত্রে গতি দ্রুত হয়ে গেছে। হাঁটু গেড়ে বসে পড়লাম। লিওকেও চিৎকার করে বললাম আমার মতো করতে। এবার একটু স্বস্তি পেলাম। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালাম চারপাশে। কিন্তু কিছুই দেখতে পেলাম না-না হেসাকে না খানিয়া আতেনকে, না তার মৃত স্বামীকে। অরোস আর তার সঙ্গী ছয় পুরোহিত নির্বিকার দাঁড়িয়ে আছে।

কোথায় হতে পারে ওরা ভাবছি, এমন সময় পূজারীরা ঘিরে ধরলো আমাদের। ভয়ের লেশমাত্র নেই তাদের আচরণে। ধরে ধরে মঞ্চের কিনারে নিয়ে গেল ওরা আমাকে আর লিওকে। একটা সিঁড়ি দেখতে পেলাম মশালের নিভু নিভু আলোতে। সেটা দিয়ে কয়েক ধাপ নিচে নামতেই লক্ষ করলাম আগের মতো উন্মুক্ত জায়গায় আর নেই আমরা। বাতাসের গর্জন এখন মাথার ওপরে। আরও বিশ পা মতো এগোলাম। মাথার ওপর ছাদ দেখতে পেলাম। প্রাচীনকালের সেই অগ্নিউপাসকরা বানিয়েছিলো বোধহয়। ছাদের নিচে তিন দিকে দেয়াল, একটা দিক উক্ত, যেদিক থেকে আমরা এসেছি সেদিকটা। তিন দেয়ালওয়ালা বড়সড় একটা কামরা যেন। আগ্নেয়গিরির গভীর থেকে উঠে আসা আগুন লাল পর্দার মতো মেলে আছে পেছনে। সেই আলোয় আলোকিত কামরাটা।

এবার মানুষজনের দেখা পেলাম। পাথর কুঁদে বানানো একটা চেয়ারে বসে আছে হেসা। গাঢ় লাল রঙের কারুকাজ করা একটা পোশাক তার পরনে। আগের মতোই মাথা থেকে পা পর্যন্ত ঢাকা। একটু দূরে দাঁড়িয়ে খানিয়া আতেন আর তার চাচা, বৃদ্ধ শামান। সব শেষে খান র‍্যাসেন, শুয়ে আছে তার অন্ত্যেষ্টি শয্যায়।

এগিয়ে গিয়ে মাথা নুইয়ে সম্মান জানালাম আমরা। আবরণে ঢাকা মুখটা উঁচু করলো হেসা। আমাদের দিকে চোখ রেখেই অরোসকে বললো, তাহলে নিরাপদেই নিয়ে আসতে পেরেছে ওদের! অতিথিরা, কেমন মনে হচ্ছে হেস-এর সন্তানদের সমাধি গুহা?

আমাদের ধর্মে নরক বলে একটা জায়গার কথা বলা হয়েছে, জবাব দিলো লিও, আমার ধারণা সেটা এমনই দেখতে।

না, না, নরক বলে কিছু নেই, বললো হেসা। ওগুলো সব মন গড়া কথা। লিও ভিনসি, নরক বলে সত্যিই যদি কিছু থেকে থাকে তা আছে এই পৃথিবীতেই, এখানে। হাত দিয়ে বুকের ওপর টোকা দিলো সে। আবার স্কুলে পড়লো তার মুখ, গভীর ভাবে কিছু যেন ভাবছে।

বেশ কিছুক্ষণ ওভাবে রইলো সে। তারপর আমার মুখ তুললো।

মাঝরাত পেরিয়ে গেছে। অনেক কাজ, অনেক ভোগান্তি সামনে, সব ভোরের আগে শেষ করতে হবে। হ্যাঁ, আঁধার সরিয়ে আলো আনতে হবে, নয়তো আলো সরিয়ে অনন্ত অন্ধকার।

রাজকীয় নারী, আতেনকে সম্বোধন করে বলে চললো হেসা, মৃত স্বামীকে নিয়ে এসেছো তুমি। পবিত্র আগুনে সমাহিত হওয়ার অধিকার আছে ওর। কিন্তু তার আগে, অরোস, আমার পূজারী, অভিযোগকারী আর পক্ষ সমর্থনকারী–দুজনকে ডাকো; খাতা খুলতে বলো।

মৃত্যু সভার কাজ শুরু হচ্ছে!

.

১৫.

মাথা নুইয়ে চলে গেল অরোস। হেসা ইশারায় তার ডান পাশে গিয়ে দাঁড়াতে বললো আমাদের, আতেনকে বাঁ পাশে। একটু পরেই দুপাশ থেকে পূজারী পূজারিনীর দুটো দল ঢুকলো ঘরে। সংখ্যায় প্রায় পঞ্চাশ জন। মস্তকাবরণ প্রত্যেকের মাথায়। দেয়ালের কোল ঘেঁষে সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে গেল তারা। তারপর ঢুকলো কালো আলখাল্লা পরা দুটো মূর্তি, মুখে মুখোশ আঁটা, হাতে একটা করে পার্চমেন্টের বাঁধানো খাতা। মৃতদেহের দুপাশে দাঁড়ালো তারা। আর অবোস পায়ের কাছে, হেসার দিকে মুখ।

হাতের সিসট্রামটা উঁচু করলো হেসা। অনুগত ভৃত্যের মতো কথা বলে উঠলো অবোস–

খাতা খোলা হোক।

মৃতদেহের ডান পাশে দাঁড়ানো অভিযোগকারী সীলমোহর ভেঙে খাতা খুলে পড়তে শুরু করলো। মৃত মানুষটার পাপের বিবরণী লেখা তাতে। জন্ম থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত যত দুষ্কর্ম করেছে র‍্যাসেন তার ফিরিস্তি দিয়ে গেল কালো পোশাক পরা, মুখে মুখোশ আঁটা লোকটা।

আশ্চর্য হয়ে শুনলাম আমি। জন্মের পরমুহূর্ত থেকে লোকটার ওপর কিভাবে নজর রাখা হয়েছে বুঝতে পেরে বিস্ময়ে থ হয়ে গেলাম। সবশেষে আমাদের হত্যা করার জন্যে কি ভাবে মরণ-শ্বাপদ নিয়ে তাড়া করেছিলো খান তা পড়লো লোকটা। তারপর খাতা বন্ধ করে মাটিতে রাখতে রাখতে বললো–

এই হলো বিবরণ। এবার, মা, আপনার প্রজ্ঞা দিয়ে বিচার করুন।

কোনো কথা বললো না হেসা। সিসট্রাম উঁচু করে পক্ষ সমর্থনকারীকে ইশারা করলো। খাতার সীলমোহর ভেঙে পড়তে শুরু করলো সে।

মৃত খান জীবনে কি কি ভালো কাজ করেছে তার বিবরণ দিয়ে গেল লোকটা। খারাপ কাজ যেগুলো করেছে কেন করেছে তারও ব্যাখ্যা দিলো। স্ত্রী কিভাবে তাকে প্রতারিত করেছে, কিভাবে মদে ওষুধ মিশিয়ে পাগল করা হয়েছে সব।

পড়া শেষ করে সমর্থনকারীও খাতাটা মাটিতে নামিয়ে রাখলো। বললো—

এই হলো বিবরণ। এবার, মা, আপনার প্রজ্ঞা দিয়ে বিচার করুন।

এতক্ষণ শান্ত, নিরাবেগ মুখে শুনেছে খানিয়া এবার সামনে এগিয়ে গেল কথা বলার জন্যে। পেছন পেছন গেল তার চাচা শামান সিমব্রি। কিন্তু আতেনের মুখ থেকে একটা কথাও বেরোনোর সুযোগ দিলো না হেসা। সিসট্রাম তুলে নিষেধ করলো। বললো

উঁহুঁ, তোমার বিচারের দিন এখনও আসেনি। যখন আসবে তোমার পক্ষ সমর্থনকারী তোমার হয়ে বলবে যা বলার।

ঠিক আছে, ঝাঝ মেশানো গলায় বলে পেছনে সরে এলো আতেন।

এবার পূজারী-প্রধান অরোসের পালা। মা, শুরু করলো সে, আপনি সব শুনেছেন। এবার আপনার প্রজ্ঞা, আপনার জ্ঞান দিয়ে বিশ্লেষণ করে রায় দিন; পা নিচে দিয়ে আগুনে যাবে র‍্যাসেন, যাতে আবার ও জীবনের পথে হাঁটতে পারে; নাকি মাথা নিচে দিয়ে যাবে, যার অর্থ চিরতরেই মারা গেছে ও?

নীরবতা। অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে সবাই। অবশেষে রায় দিলো হেসা।

আমি শুনেছি, চুলচেরা বিশ্লেষণ করেছি, কিন্তু বিচার করার সাধ্য আমার নেই। যে মহাশক্তি ওকে ঠেলে দিয়েছে সামনে, আবার যার কাছে ও ফিরে গেছে। সে-ই ওর বিচার করবে। মৃত লোকটা পাপ করেছে, সন্দেহ নেই, গুরুতর পাপ। করেছে, কিন্তু ওর বিরুদ্ধে করা হয়েছে আরও গুরুতর পাপ। সুতরাং, পা নিচের দিকে দিয়েই ওকে সমাহিত করবে, যাতে নির্ধারিত সময়ে আবার ও ফিরে আসতে পারে এই পৃথিবীতে।

এবার অভিযোগকারী মাটি থেকে অভিযোগের খাতা তুলে নিয়ে এগোলো সামনের দিকে। মঞ্চের কিনারে গিয়ে খাতাটা ফেলে দিলো নিচে অগ্নিগিরির জ্বালামুখের ভেতর, এবং ঘুরে দাঁড়িয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল। এর অর্থ র‍্যাসেন নামের লোকটার বিরুদ্ধে সব অভিযোগ মুছে দেয়া হলো। অন্যদিকে সমর্থনকারীও তুলে নিলো তার খাতা। সবিনয়ে তুলে দিলো পূজারী-প্রধানের হাতে। মন্দিরের সংগ্রহশালায় অনন্তকালের জন্যে সংরক্ষিত থাকবে ওটা। পূজারীরা অন্ত্যেষ্টি সঙ্গীত শুরু করলো এবার। সমবেত কণ্ঠের করুণ মূর্ছনায় পূর্ণ হয়ে উঠলো ঘরটা।

শেষ হলো সঙ্গীত। ধীর পায়ে এগিয়ে এলে কয়েকজন পুরোহিত। শববাহী খাঁটিয়া তুলে নিয়ে চলে গেল কিনারে। ঘাড় ফিরিয়ে মায়ের দিকে তাকালো তারা। হাতের দণ্ড তুলে সঙ্কেত দিলো হেসা! পা নিচের দিকে দিয়ে ফেলে দেয়া হলো র‍্যাসেনের মৃতদেহ। সব কজন ঝুঁকে তাকালো নিচে। যতক্ষণ না ওটা টগবগে লাভার সরোবরে ডুবে গেল ততক্ষণ তাকিয়ে রইলো।

.

সময় হয়েছে। নিঃশব্দে মাথা নিচু করে বসে আছে হেসা তার প্রস্তর সিংহাসনে। সে-ও জানে সময় হয়েছে। এবার সব রহস্যের সমাধান হবে।

একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে মুখ তুললো সে। সিস্ট্রাম নেড়ে ইশারা করে একটা কি দুটো কথা বললো। যেমন এসেছিলো তেমনি সারিবদ্ধভাবে বিদায় নিলো পূজারী-পূজারিনীরা। দুজন মাত্র রইলো, অবোস আর অপূর্ব চেহারার এক পূজারিনী, নাম পাপাভ। পূজারিনীদের প্রধান সে।

তোমরা শোনো, শুরু করলো হেসা, বড় কিছু ঘটনা ঘটবে, এখন। এই বিদেশীদের আগমনের সাথে সম্পর্ক আছে তার। তোমরা জানো, দীর্ঘদিন ধরে আমি এক বিদেশীর আসার অপেক্ষায় আছি। সে এসেছে। এই দুই বিদেশীরই একজন। এখন কি ঘটবে আমি বলতে পারি না। অনেক ক্ষমতা আমার, হয়তো প্রয়োজনের তুলনায় একটু বেশিই। কিন্তু একটা শক্তি থেকে আমাকে বঞ্চিত রাখা হয়েছে। ভবিষ্যৎ দর্শনের ক্ষমতা আমার নেই। সুতরাং একটু পরেই যে কি ঘটবে তা অনুমান করারও সাধ্য আমার নেই। হয়তো-হয়তো শিগগিরই শূন্য হয়ে যাবে এই সিংহাসন, অনন্ত অ গুনের খোরাক হবে আমার দেহ। না, মন খারাপ কোরো না, মন খারাপ কর কছু নেই, কারণ আমি মরবো না। যদি মরিও আমার আত্মা ফিরে আসবে আবার।

মন দিয়ে শোনো, পাপা, তুমিই একমাত্র রক্ত মাংসের মানুষ যার সামনে আমি জ্ঞানের সকল দুয়ার খুলে দিয়েছি। একটু পরে, বা কখনও যদি আমাকে চলে যেতে হয় তুমিই গ্রহণ করবে এই সুপ্রাচীন ক্ষমতার দণ্ড; পূরণ করবে আমার শূন্যস্থান। তোমাকে আমি আরও নির্দেশ দিচ্ছি, এবং তোমাকেও, অবোস, আমাকে যদি চলে যেতেই হয় অত্যন্ত যত্নের সাথে এই বিদেশীদের পৌঁছে দিয়ে আসবে এদেশের বাইরে। হ্যাঁ, কোনোরকম কষ্ট যেন না হয় ওদের। যে পথে ওরা এসেছে সে পথে বা উত্তরের পাহাড়শ্রেণী ডিঙিয়ে–যেদিক দিয়ে সুবিধা মনে করো, বা ওরা যেতে চায়, দিয়ে আসবে। খানিয়া আতেন যদি ওদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে ওদের আটকে রাখতে চায়, বা দেরি করিয়ে দিতে চায়, উপজাতীয়দের আমার নাম করে বলবে, যেন লড়াইয়ে নামে। দখল করে নেবে ওর রাজ্য। শুনেছো?

শুনেছি, মা, আপনার নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালিত হবে, এক স্বরে জবাব দিলো অরোস আর পাপাভ।

এখানেই ইতি হলো ব্যাপারটার। এবার খনিয়ার দিকে ফিরলো হেসা।

আতেন কাল রাতে তুমি আমাকে একটা প্রশ্ন করেছিলে, লিওর দিকে ইশারা করলো সে, কেন এই লোকটাকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে তোমার মনে প্রেম জাগলো। জবাব খুব সোজা। ওর মতো পুরুষকে দেখে কোন নারীর বুকে ভালোবাসা না জাগবে? তুমি আরও বলেছিলে, তোমার হৃদয় এবং তোমার চাচার ঐন্দ্রজালিক ক্ষমতা নাকি কি বলেছে তোমাকে। তাহলে অতীতের পর্দা এবার উন্মোচন করতে হয়।

নারী, সময় হয়েছে, আমি তোমার প্রশ্নের জবাব দেবো। না, তুমি আদেশ করেছে সেজন্যে নয়, আমার ইচ্ছা হয়েছে তাই। শুরুর কথা আমি কিছু বলতে পারবো না, কারণ আমি মানুষ, দেবী নই। আমি জানি না আমরা তিনজন কেন নিয়তির এ খেলায় জড়িয়ে গেলাম, জানি না কোথায় এর শেষ। সুতরাং যেখান থেকে আমার স্মৃতিতে আছে সেখান থেকেই শুরু করছি।

থামলো হেসা। কেঁপে উঠলো তার শরীর যেন প্রবল ইচ্ছাশক্তির জোরে দমন করছে উদগত আবেগ। তারপর হঠাৎ দুহাত ছড়িয়ে দিয়ে চিৎকার করে উঠলো, পেছনে তাকাও!

ঘুরে দাঁড়ালাম আমরা। প্রথমে কিছুই দেখতে পেলাম না। আগ্নেয়গিরির গর্ভ থেকে উঠে আসা আগুন কেবল পর্দার মতো ভাসছে সামনে। কিন্তু একটু পরেই দেখলাম, সেই লাল পর্দার গভীর থেকে যেন উঠে আসছে একটা কিছু। অস্পষ্ট। কিন্তু ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছে। কি আশ্চর্য! একটা ছবি! একেবারে জীবন্ত মনে হচ্ছে।

প্রশস্ত এক নদীর তীর। বালুকাবেলায় একটা মন্দির। মিসরীয় ঢংয়ের দেয়াল ঘেরা উঠানে পূজারীদের মিছিল। আসা যাওয়া। ফাঁকা হয়ে গেল উঠানটা। তারপরই দেখলাম, বাজপাখির ডানার ছায়া পড়লো সেই সূর্যালোকিত উঠানে। মাথা কামানো, খালি পা, পুরোহিতের সাদা আলখাল্লা পরা এক লোক এগিয়ে এলো দক্ষিণ পাশের একটা দরজা দিয়ে ঢুকলো উঠানে। ধীর পায়ে এগিয়ে গেল গ্রানাইটের তৈরি একটা বেদীর দিকে। বেদীর ওপর বসে আছে মিসরীয় ধাচের মুকুট পরা এক নারীপ্রতিমা। পবিত্র সিসট্রাম প্রতিমার হাতে। হঠাৎ যেন কিছু একটা শব্দ শুনে থেমে দাঁড়ালো পুরোহিত। ঘাড় ফিরিয়ে তাকালো আমাদের দিকে। কিন্তু, ও ঈশ্বর! এ কে? এ যে দেখছি লিও ভিনসি! যৌবনে ঠিক এমন। ছিলো ওর চেহারা। কোর-এর গুহায় মৃত ক্যালিক্রেটিসের যে চেহারা দেখেছিলাম তার সঙ্গেও হুবহু মিলে যায় এই পুরোহিতের চেহারা!

দেখ, দেখ! আমার হাত আঁকড়ে ধরে ঢোক গিলে বললো লিও। জবাবে আমি মাথা ঝাকালাম শুধু।

আবার হেঁটে চললো লোকটা। প্রতিমার সামনে গিয়ে হাঁটু গেড়ে বসলো। দুহাতে পা জড়িয়ে ধরে প্রার্থনা করলো। এর পরই মন্দিরের সবগুলো দরজা খুলে। গেল এক সাথে। একটা মিছিল ঢুকলো। পুরোভাগে মুখ ঢাকা এক মহিলা। পোশাক-আশাক প্রমাণ করছে মহিলা সম্ভ্রান্ত ঘরের। বেদীর পায়ে অর্ঘ্য নিবেদন করতে এসেছে। প্রতিমার পায়ের কাছে হাঁটু গেড়ে বসলো সে। হাতের জিনিসপত্রগুলো নামিয়ে রাখলো তারপর উঠে দাঁড়ালো। চলে যাচ্ছে। যাওয়ার সময় একটা হাত বুলিয়ে দিয়ে গেল পুরোহিতের হাতে। এক মুহূর্ত ইতস্তত করে রমণীর পেছন পেছন চললো পুরোহিত।

খুব ধীরে হাঁটছে রমণী। তার সঙ্গীরা এগিয়ে গেল উঠানের ফটক পেরিয়ে। এতক্ষণে উঠানের প্রান্তে এলো রমণী। ফটক না পেরিয়ে দেয়ালের কাছে দাঁড়িয়ে পড়লো। পুরোহিতও এসে দাঁড়ালো। ফিসফিস করে তাকে কিছু বললো রমণী, হাত তুলে ইশারা করলো নদীর দিকে। বিরক্তির চিহ্ন ফুটে উঠলো পুরোহিতের মুখে। প্রতিবাদ করার চেষ্টা করলো রমণীর কথার। চকিতে একবার চারদিকে দৃষ্টি বুলিয়ে নিলো রমণী, ক্রন্ত হাতে সরিয়ে আনলো মুখের কাপড়। তারপর বুকলো পুরোহিতের দিকে। মিলে গেল ওদের দুজোড়া ঠোঁট।

আর এক মুহূর্ত দেরি করলো না রমণী। ফটক পেরিয়ে ছুটলো। তার আগে আমাদের দিকে ফিরলো একবার ওর মুখ। এবং—কি আশ্চর্য! হ্যাঁ, মুখটা আতেনের। কালো চুলের মাঝ থেকে মণি-মুক্তা খচিত সোনার ঝিলিক। পুরোহিতের দিকে তাকিয়ে হাসলো একবার রমণী–ঘোর লাগা হাসি। অস্তায়মান সূর্য আর নদীর দিকে ইশারা করলো আবার। তারপর চলে গেল সে।

আমাদের পাশে দাঁড়িয়ে বহু বহু দিন আগের সেই হাসির প্রতিধ্বনি করলো আতেন। ঠিক তেমনি ঘোর লাগা হাসি হেসে চিৎকার করে উঠলো বুড়ো শামানের উদ্দেশ্যে–

ঠিকই অনুভব করেছিলো আমার হৃদয়! দেখ অতীতে কি করে আমি জিতে নিয়েছিলাম ওকে।

ঠিক তক্ষুণি আগুনে বরফ পড়লো যেন। শীতল কণ্ঠে বলে উঠলো হেসা, থামো, এখন দেখ, অতীতে কি করে তুমি হারিয়েছিলে ওকে।

আমরাও দেখলাম।

বদলে গেছে দৃশ্য। সুন্দর একটা দেহ শুয়ে আছে মনোরম পালঙ্কে। স্বপ্ন দেখছে মেয়েটা। ভয় পেয়েছে ও। ওর শরীরের ওপর আবছা ছায়া ছায়া একটা অবয়ব। মন্দিরে বেদীর ওপর দেখা সেই প্রতিমার মতো। কিন্তু এখন তার মুখে রয়েছে শকুনির মুখোশ। চমকে স্বপ্ন থেকে জেগে উঠলো মেয়েটা। চারপাশে তাকালো। মুখটা আয়শার মুখের মতো। কোর-এর গুহায় প্রথম যেদিন মুখের কাপড় সরিয়েছিলো সেদিন যেমন দেখেছিলাম ঠিক তেমন।

আবার ঘুমিয়ে গেল সে। ভয়ানক মূর্তিটা আবার ঝুঁকে পড়লো তার ওপর। ফিসফিস করে কানে কানে কিছু বললো। পরমুহূর্তে আরেকটা দৃশ্য ভেসে উঠলো। ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সাগরে একটা নৌকা। নৌকার মার্কার ওপর একে অপরকে জড়িয়ে ধরে আছে সেই পুরোহিত আর রাজকীয় নারী। হঠাৎ দেখা গেল মূর্তিমান প্রতিশোধের মতো তাদের ওপর দিয়ে ডানা মেলে আসছে এক গলাছিলা শকুনি। একটু আগে দেবীর মুখে যেমন মুখোশ দেখেছি তেমন।

ধীরে ধীরে অস্পষ্ট হয়ে গেল ছবিটা। দুপুরের আকাশের মতো শূন্য হয়ে গেল আগুনের পর্দা। তারপর আরেকটা দৃশ্য। প্রথমে বিরাট, মসৃণ দেয়ালওয়ালা একটা গুহা, বালির মেঝে, দেখা মাত্র চিনতে পারলাম আমরা। বালির ওপর পড়ে আছে সেই পুরোহিত। মৃত। এখন আর কামানো নয়, ঝাকড়া সোনালী চুল তার মাথায়। চোখ দুটো চেয়ে আছে ওপরে, জ্বল জ্বল করছে। সাদা, গায়ে ছোপ ছোপ রক্ত। তার পাশে দাঁড়িয়ে দুই নারী। একজন সম্পূর্ণ নগ্ন, দীর্ঘ চুলের রাশি কাঁধ পিঠ ছাড়িয়ে নেমে এসেছে তার গোড়ালির কাছে। অসম্ভব সুন্দরী সে। যে দেখেনি তার পক্ষে কল্পনা করা দুঃসাধ্য সে সৌন্দর্য। হাতে বর্শা। অন্য নারীর দেহ কালো আলখাল্লায় আবৃত। হাত ছুঁড়ে ছুঁড়ে বিলাপ করছে আর অভিশাপ দিচ্ছে তার প্রতিদ্বন্দীকে। এই দুই নারী আর কেউ নয়, একজন সেই ঘুমন্ত রমণী যার কানের কাছে ফিসফিস করেছিলো ছায়ামূর্তি, অন্যজন সেই মিসরীয় রাজপুরাঙ্গনা, যে মন্দিরফটকের নিচে চুমু খেয়েছিলো পুরোহিতকে।

ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল এ দৃশ্যটাও। হেসা এতক্ষণ সামনে ঝুঁকে ছিলো, এবার হেলান দিয়ে বসলো। এরপর অত্যন্ত দ্রুত, টুকরো টুকরো ভাবে এলো, গেল অনেকগুলো ছবি। বন, মানুষের দল, বিশাল বিশাল গুহা, সে সব গুহায় অনেক মানুষ; আমাদের মুখও দেখলাম তাদের ভেতর, হতভাগ্য জব, বিলালী, সেনাবাহিনী কুচকাওয়াজ করছে, বিশাল যুদ্ধক্ষেত্র, রক্তাক্ত লাশ…আরও অনেক কিছু। এই ছবিগুলোও মিলিয়ে গেল এক সময়। আগুনের আয়না আবার শূন্য।

আতেন, তোমার প্রশ্নের জবাব পেয়েছো? নিচু গলায় জিজ্ঞেস করলো হেসা।

স্বীকার করছি, মা, অদ্ভুত কিছু দৃশ্য দেখলাম। কিন্তু কি করে বুঝবো এর ভেতরে কোনো কারসাজি নেই। আপনার যাদুর প্রভাবে মূর্ত হয়ে উঠছে না এসব?

তাহলে শোনো, ক্লান্ত কণ্ঠে শুরু করলো আয়শা, অনেক অনেক যুগ আগে, তখন সবে শুরু হয়েছে আমার এ পর্যায়ের জীবন, নীলনদের তীরে বেহবিত-এ ছিলো মিসরের মহান দেবী আইসিসের মন্দির। এখন তা ধ্বংসস্তূপ। মিসর থেকে চলে গেছেন আইসিস। অবশ্য তার কর্তৃত্ব এখনও পুরোমাত্রায়ই আছে সেখানে, সারা পৃথিবীতেই আছে, কারণ তিনিই প্রকৃতি। সেই মন্দিরের প্রধান পুরোহিত ছিলো ক্যালিফ্রেটিস নামের এক গ্রীক। দেবীর সামনে দাঁড়িয়ে সে পুরোহিতের ব্ৰত গ্রহণ করে। শপথ নেয়, আজীবন দেবীর সেবা করে যাবে।

একটু আগে যে পুরোহিতকে দেখলে সে-ই সে। আর এখানে, তোমার পাশে দাঁড়িয়ে আছে পুনর্জন্ম নেয়া ক্যালিক্রেটিস।

সে সময়কার মিসরের ফারাওয়ের এক মেয়ে ছিলো, নাম আমেনার্তাস। সে প্রেমে পড়ে এই ক্যালিক্রেটিসের। যাদুবিদ্যার চর্চা করতো আমেনার্তাস। যাদুর প্রভাবে সে ক্যালিক্রেটিসকে বাধ্য করে ব্রত ভঙ্গ করে তার সাথে পালিয়ে যেতে। তুমি, আতেন, ছিলে সেই আমেনার্তাস।

সব শেষে, সেখানে বাস করতো এক আরবীয় কন্যা, নাম আয়শা। বুদ্ধিমতি, সুন্দরী এক নারী। সে তার হৃদয়ের শূন্যতা আর জ্ঞানের বেদনা নিয়ে আশ্রয় খুঁজেছিলো বিশ্বমায়ের চরণে, ভেবেছিলো প্রকৃত জ্ঞান অর্জন করবে, যে জ্ঞান কখনোই তার ভেতর থেকে লুপ্ত হয়ে যাবে না। সেই আয়শাকে, যেমন তোমরা দেখলে, স্বপ্নে আদেশ দিলেন দেবী, অবিশ্বাসীদের পেছন পেছন গিয়ে স্বর্গের প্রতিশোধ কার্যকর করে আসতে হবে। প্রতিশ্রুতি দিলেন, সাফল্য লাভ করলে দেবেন মরণ জয় করার ক্ষমতা আর এমন সৌন্দর্য যা পৃথিবীর কোনো নারীতে কেউ দেখেনি।

রওনা হয়ে গেল সে। অনেক অনেক পথ পাড়ি দিয়ে পৌঁছুলো এমন এক জায়গায় যেখানে ঘুরতে ঘুরতে হাজির হবে সেই অবিশ্বাসীরা—ক্যালিক্রেটিস আর আমেনার্তাস। সেখানে নুট নামের মহাজ্ঞানী এক ঋষির সাথে সাক্ষাৎ হলো তার। আয়শাকে সাহায্য করার জন্যে মা-ই নিযুক্ত করেছিলেন তাকে—তুমি, ও হলি, তুমিই ছিলে সেই নুট। অবিশ্বাসীদের জন্যে যখন অপেক্ষা করছে তখন মুটের কাছে আয়শা জানতে পারে অনন্ত জীবনের সৌরভ ঘূর্ণায়মান অগ্নিস্তম্ভের কথা। সেই আগুনে স্নান করলে অনন্ত সৌন্দর্য আর অমর যৌবন লাভ করে মানুষ।

অবশেষে অবিশ্বাসীরা এলো। তারপর, কি আশ্চর্য! জীবনে কখনও যে ভালোবাসেনি, ভালোবাসা কাকে বলে জানেনি, জানার চেষ্টা করেনি, সেই আয়শা দেখামাত্র কামনা করে বসলো ক্যালিক্রেটিসকে। ওদের প্রাণের আগুনের কাছে নিয়ে গেল সে, ইচ্ছা ক্যালিক্রেটিসকে আর নিজেকে অমরত্বের আবরণে জড়িয়ে নেবে। কিন্তু অন্যভাবে নির্ধারিত হয়ে ছিলো ওদের নিয়তি। দেবীর প্রতিশ্রুতি মতো অনন্ত জীবন পেলো আয়শা-কেবল আয়শা, এবং তারই হাতে প্রাণ ত্যাগ করলো তার দয়িত ক্যালিক্রেটিস।

এভাবেই দেবীর ক্রোধ পরিণতি পেলো। আয়শা অনন্ত জীবন, যৌবন নিয়ে পড়ে রইলো অনন্ত যাতনা ভোগ করার জন্যে।

দিন গড়িয়ে চললো। যুগের পর যুগ কেটে গেল, পেরিয়ে গেল শতাব্দীর পর শতাব্দী। অমর আয়শা কিন্তু তখনও অপেক্ষা করছে, পুনর্জন্ম নিয়ে আসবে তার ক্যালিক্রেটিস। অবশেষে এলো সে। কিন্তু দেবীর ক্রোধ প্রশমিত হয়নি। প্রেমিকের চোখের সামনে অপার লজ্জা আর বেদনা নিয়ে ডুবে গেল আয়শা। সুন্দর হয়ে গেল ভয়ঙ্কর কুৎসিক অমর, মনে হলো, মারা গেল।

তবু, ও ক্যালিক্রেটিস, আমি বলছি, সে মরেনি। কোর-এর গুহায় আয়শা শপথ করেনি তোমার কাছে, আবার সে আসবে? তারপর লিও ভিনসি, ক্যালিক্রেটিস, ওর আত্মা কি দেখা দেয়নি তোমার স্বপ্নে? তোমাকে দেখায়নি এই চূড়ায়, ওর কাছে ফিরে আসার পথ?

থামলো হেসা। লিওর দিকে তাকালো, যেন জবাবের অপেক্ষা করছে।

কাহিনির প্রথম অংশ, অর্থাৎ পোড়া মাটির ফলকে যা লেখা ছিলো তার বাইরের যা যা দেখলাম শুনলাম এসব সম্পর্কে আমি কিছু জানি না, বললো লিও। বাকিটুকু সম্পর্কে আমি বা আমরা বলতে পারি, সব সত্যি। এখন আমার প্রশ্ন, আয়শা কোথায়? আপনিই কি আয়শা? তাহলে গলার পর অন্যরকম কেন? তাছাড়া, আয়শা অনেক দীর্ঘাঙ্গী ছিলো। বলুন, আপনার উপাস্য দেবীর দোহাই দিয়ে বলছি, আপনিই কি আয়শা?

হ্যাঁ, আমিই আয়শা, শান্ত অচঞ্চল গলায় হেলা বললো, সেই আয়শা যার কাছে তুমি অনন্তকালের জন্যে সমর্পণ করেছিলে নিজেকে।

মিথ্যে কথা! ও মিথ্যে কথা বলছে! চিৎকার করে উঠলো আতেন। স্বামী, ও-ই না একটু আগে বললো প্রায় বিশ বছর আগে যখন তোমাদের ছাড়াছাড়ি হয় তখন ও যুবতী, সুন্দরী? তাহলে কি করে ও এই মন্দিরের পূজারিনী হলো? আমি জানি একশো বছরের ভেতর এখানে নতুন কোনো পূজারিনীর অভিষেক হয়নি, আর ও যদি কুৎসিত-ই না হবে মুখ দেখাচ্ছে না কেন?

অরোস, মা বললো, খানিয়া যে পূজারিনীর কথা বলছে তার মৃত্যুর কাহিনিটা শোনাও।

মাথা নুইয়ে স্বভাবসুলভ শান্তশ্বরে শুরু করলো পূজারী প্রধান–

আঠারো বছর আগে, এই পাহাড়ে দেবী হেস-এর পূজা শুরু হওয়ার ২৩৩৩-তম বছরের শীতকালে খানিয়া আতেন যে পূজারিনীর কথা বলছেন তিনি মারা গেছেন। আমি নিজে উপস্থিত ছিলাম, সে সময়। দীর্ঘ একশো আট বছর তিনি দায়িত্ব পালন করে গেছেন, অবশেষে বার্ধক্যজনিত কারণে তার মৃত্যু ঘটে। সে সময় তিনি সিংহাসনে বসে ছিলেন। প্রাচীন রীতি অনুযায়ী তিন ঘণ্টা পর আমরা তাঁর মৃতদেহ সমাহিত করার জন্যে প্রস্তুত করতে যাই। কিন্তু আশ্চর্য! গিয়ে দেখি, আবার বেঁচে উঠেছেন তিনি, অবশ্য চেহারা আর আগের মতো নেই।

অশুভ কোনো যাদুর খেলা ভেবে পূজারী পূজারিনীরা তাঁকে প্রত্যাখ্যান করে এবং সিংহাসন থেকে বিতাড়িত করার উদ্যোগ নেয়। আর তক্ষুণি প্রজ্জ্বলিত হয়ে ওঠে পাহাড়, ভীম গর্জনে বজ্র নেমে আসে, মন্দিরে অগ্নিস্তম্ভের আলো নিভে যায়। আমরা সবাই আতঙ্কিত হয়ে উঠি। তারপর গভীর অন্ধকারে, বেদীর ওপর যেখানে মায়ের প্রতিমা স্থাপিত সেখান দুইকৈ দেবীর কণ্ঠস্বর ভেসে এলো- ওকে গ্রহণ করো, আমিই ওকে পাঠিয়েছি তোমাদের শাসন করার জন্যে, আমার উদ্দেশ্য পূরণ করার জন্যে।

মিলিয়ে গেল কণ্ঠস্বর। আলো জ্বলে উঠলো আবার। তখন আমরা হাঁটু গেড়ে বসে আনুগত্য প্রকাশ করলাম নতুন হেসার কাছে; মা হিসেবে স্বীকার করে নিলাম। এই হলো কাহিনি, শুধু আমি নই, শত শত পূজারী পূজারিনী তার সাক্ষী।

শুনলে, আতেন, বললো হেসা। এখনও তোমার সন্দেহ আছে?

হ্যাঁ, দুর্বিনীত গলায় জবাব দিলো খানিয়া। অলরাসের একটা কথাও আমি বিশ্বাস করি না। যা বললো তা যদি মিথ্যা না হয় তা হলে বলবো ও স্বপ্নে দেখেছিলো ওসব, অথবা নিজের কল্পনার রঙে রাঙিয়ে রচনা করেছে। সত্যিই তুমি যদি সেই অনন্ত যৌবনা আয়শা হও, প্রমাণ দাও। এই দুজন অতীতে তোমাকে দেখেছে, এখনও দেখুক। তোমার ঘোমটা খুলে ফেল, ওরা দেখুক, আমিও দেখি, সত্যিই তুমি অনন্ত সৌন্দর্যের আধার। দেখে চোখ জুড়াই। নিশ্চয়ই তোমার প্রেমিক এখনও তোমার মোহ থেকে মুক্তি পায়নি, নিশ্চয়ই তোমাকে দেখেই ও চিনতে পারবে, এবং পদতলে লুটিয়ে পড়ে বলবে, এই তো আমার অমর মানসী, আর কেউ নয়। তার আগে আমি কিছুতেই বিশ্বাস করবে না এসব আজগুবি গল্প।

সামনে পেছনে দুলতে লাগলো হেসা। কাপড়ে ঢাকা রয়েছে বলে তার মুখটা দেখতে পাচ্ছি না, তবু বুঝতে পারছি, গভীর দুশ্চিন্তার ছাপ পড়েছে মুখে।

ক্যালিক্রেটিস, কাতর কণ্ঠে সে বললো, তোমারও কি তাই ইচ্ছা? যদি হয় তাহলে আমি অবশ্যই তা অপূর্ণ রাখবো না। তবু আমি তোমার কাছে মিনতি করছি, এখনই দেখতে চেয়ো না, এখনও সময় হয়নি, আমার শপথ এখনও পূরণ হয়নি। আমি বদলে গেছি, ক্যালিক্রেটিস, কোর-এর গুহায় যেদিন তোমার কপালে চুমু খেয়েছিলাম, তোমাকে আমার নিজের বলে ঘোষণা করেছিলাম, সেদিন যেমন দেখেছিলে তেমন আর নেই আমি।

হতাশ ভঙ্গিতে চারপাশে তাকালো লিও।

সরাতে বলো, প্রভু, এই সময় চিৎকার করে উঠলো আতেন, ঘোমটা সরাতে বলল। কথা দিচ্ছি, আমি ঈর্ষাকাতর হবো না।

ঠিক, বললো লিও, তা-ই বলবো একে, ভালো হোক মন্দ হোক, আর সহ্য করতে পারছি না এই উৎকণ্ঠা! যতই বদলে থাকুক আমি ওকে চিনতে পারবোই।

পুরুষোচিত কথা, জবাব দিলো হেসা। তোমার মুখেই মানায়, ক্যালিক্রেটিস। অন্তর থেকে ধন্যবাদ জানাই তোমাকে। বেশ, আমি ঘোমটা সরাবো। কিন্তু, হ্যাঁ, তারপর আর আমার হাতে কিছু থাকবে না, তোমাকেই। সিদ্ধান্ত নিতে হবে, আমার আজন্ম প্রতিদ্বন্দী ঐ নারীকে গ্রহণ করবে না আয়শাকে। ইচ্ছে হলেই আমাকে প্রত্যাখ্যান করতে পারো, কোনো ক্ষতি হবে না তোমার, বরং পাবে পৃথিবীর সব মানুষ যা চায় সেই ক্ষমতা, ধন, প্রেম। কেবল আমার স্মৃতিটুকু উপড়ে ফেলতে হবে তোমার হৃদয় থেকে।

তারপর হেস আমার দিকে ফিরলো। ওহ, হলি, আমার সত্যিকারের বন্ধু, এ ঘটনা, শুরুরও আগে থেকে আমাকে পথ দেখিয়ে আসছে, ওর পরেই আমি সবচেয়ে ভালোবাসি তোমাকে, তুমি ওকে পরামর্শ দাও, সঠিক পরামর্শ। বহু শতাব্দী আগে আমাকে পথ দেখিয়েছিলে, এখন ওকে দেখাও। হ্যাঁ, ও যদি। আমাকে শেষ পর্যন্ত প্রত্যাখ্যানই করে, আমরা চলে যাবো, এলোক ছাড়িয়ে। অন্যলোকে, যেখানে সব জাগতিক আবেগ, কামনা; বাসনা অস্পষ্ট হয়ে আসে; অনন্তকাল আমরা বাস করতে থাকবো, পরম গৌরবময় বন্ধুত্ব নিয়ে, কেবল তুমি আর আমি।

জানি তুমি আমার বন্ধুত্ব প্রত্যাখ্যান করবে না, তোমার অন্তর ইস্পাতের মতো কঠিন শুদ্ধ সত্যে পূর্ণ। ছোটখাটো লোভের স্ফুলিঙ্গ তাকে গলাতে পারবে না, বরং পরিণত হবে মরচে ধরা শিকলে, যে শিকল তোমাকে বাঁধার চেষ্টা করে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে।

ধন্যবাদ, আয়শা, আমি বললাম, এতবড় বিশেষণ আমাকে মানায় কিনা জানি না। তবে এটুকু জানি, আমি তোমার বন্ধু-এর বেশি কিছু হওয়ার কথা কোনোদিন ভাবিনি। আমি জানি, বিশ্বাস করি, তুমিই আমাদের হারানো সে।

কি বলবো ভেবে না পেয়ে এটুকুই শুধু বললাম আমি। অপার আনন্দে পূর্ণ হয়ে গেছে আমার হৃদয়, আয়শা নিজ মুখে বলেছে আমিও তার প্রিয়। এতদিন জানতাম পৃথিবীতে একজনই আমার বন্ধু; আজ জানলাম, আরেকজন আছে। এর চেয়ে বেশি আর কি চাইবে আমি?

.

একটু পিছিয়ে এলাম আমি আর লিও। নিচু স্বরে লিওর মতামত জানতে চাইলাম।

তুমিই ঠিক করো, বললো ও।তোমার সিদ্ধান্তের ফলে যা কিছুই ঘটুক না কেন, তোমাকে দোষ দেবো না, হোরেস, এটুকুই শুধু আমি বলতে পারি।

বেশ। আমি ঠিক করে ফেলেছি, বলে হেসার সামনে এগিয়ে গেলাম। আর অপেক্ষা করতে পারছি না আমরা; যে সত্য জানতেই হবে তা দেরিতে কেন? কেন এখনি নয়? আমাদের ইচ্ছা, হেস, তুমি আমাদের সামনে মুখের আবরণ সরাবে। এখানে এবং এখনি।

বেশ, পূর্ণ হবে তোমাদের ইচ্ছা, মিইয়ে যাওয়া গলায় জবাব দিলো হেসা। আমার কেবল একটাই প্রার্থনা আমাকে একটু করুণা কোরো, বিদ্রূপ কোরো না আমাকে দেখে; যে আগুন আমার হৃদয় দগ্ধ করছে আরেকটু কয়লা দিয়ো না সে আগুনে।

ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালো হেসা। হেঁটে-বলা ভালো টলতে টলতে চলে গেল ছাদহীন ফাঁকা জায়গার প্রায় কিনারে। আর কয়েক পা পরেই আগুনের অতল গহ্বর। ক্লান্ত ভঙ্গিতে মাথা নিচু করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো কিছুক্ষণ। তারপর, তীক্ষ্ণ্ণস্বরে চিৎকার করে উঠলো-এখানে এসো, পাপাভ, খুলে দাও আবরণ!

এগিয়ে গেল পাপাভ, স্পষ্ট ভীতি তার সুন্দর মুখে। কাজ শুরু করলো সে। পাপাভ মেয়েটা খুব লম্বা নয় তবু হেসার পাশে রীতিমতো একটা মিনারের মতো মনে হচ্ছে তাকে।

বাইরের সাদা কাপড়টা ধীরে সাবধানে খুলে আনলো পাপাভ। ভেতরে একই রকম আরেকটা কাপড়। সেটাও সরানো হলো। মমির মতো শীর্ণ একটা মূর্তি আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে। আরও কমে গেছে যেন ওর উচ্চতা। হাড়ের স্তূপের কাছে যে মূর্তিটা দেখেছিলাম ঠিক সেটার মতো লাগছে এখন ওকে। বুঝলাম আমাদের রহস্যময় পথপ্রদর্শক আর হেসা একই মানুষ।

একটার পর একটা সরু, লম্বা কাপড়ের ফালি খুলে আনছে পাপাভ-ওর শরীর থেকে, মুখ থেকে। এর কি শেষ নেই? কত ছোট হয়ে গেছে কাঠামোটা, আশ্চর্য! পূর্ণ বয়স্কা একজন নারী এত বেঁটে হতে পারে কল্পনাই করা যায় না। ভেতরে ভেতরে অস্বস্তি বোধ করছি আমি। শেষ ফালিটা খোলা হচ্ছে। কাঠির মতো সরু বাঁকানো দুটো হাত দেখা গেল। তারপর একই রকম দুটো পা।

একটা মাত্র অন্তর্বাস আর শেষ মুখাবরণটা ছাড়া আর কিছু এখন নেই তার শরীরে। হাত নেড়ে পাপাভকে পিছিয়ে যেতে বললো হেসা। কোনোমতে সরে এলো পূজারিনীপ্রধান। হাত দিয়ে মুখ ঢেকে মাটিতে পড়ে রইলো অচেতনের মতো। তীক্ষ্ণ্ণ একটা দুর্বোধ্য চিৎকার করে কাঠির মতো হাত দিয়ে মুখের কাপড়টা ধরলো হেসা। হ্যাচকা এক টানে সেটা ছিঁড়ে ফেলে চরম হতাশার ভঙ্গিতে ঘুরে দাঁড়ালো আমাদের দিকে মুখ করে।

ওহ! সে-না, আমি তার বর্ণনা দেবো না। দেখার সঙ্গে সঙ্গে চিনেছি, শেষবার প্রাণের আগুনের কাছে দেখেছিলাম ওকে। এবং আশ্চর্য, তখন আতঙ্কে খেয়াল করতে পারিনি, এখন দেখলাম, সেই মহামহিমাময়ী অপরূপা আয়শার সাথে কোথায় যেন একটু সাদৃশ্য আছে এই অদ্ভুত কুৎসিত বানরের মতো অবয়বটার।

.

ভয়ঙ্কর নিস্তব্ধতা মঞ্চে। আমি দেখলাম, লিওর ঠোঁট সাদা হয়ে গেছে, কাঁপছে হাঁটু দুটো। অনেক কষ্টে সামলালো ও নিজেকে। তারপর দাঁড়িয়ে রইলো সোজা, যেন তারে ঝোলানো মৃতদেহ।

আতেনকে দেখলাম, বজ্রাহতের মতো দাঁড়িয়ে আছে। প্রতিদ্বন্দ্বীর পরাভব দেখতে চেয়েছিলো সে, তবু এমন দৃশ্য সম্ভবত স্বপ্নেও কল্পনা করেনি। কেবল সিমব্রি জ্বর অরোসকে দেখলাম নির্বিকার। আমার ধারণা ওরা আগে থেকেই জানতে কি দেখতে হবে।

নীরবতা ভাঙলো, অরোস। বিড়বিড় করে কি যেন বললো। কিন্তু তার কোনো অর্থ ধরতে পারলো না আমার মস্তিষ্ক। আমার মাথার ভেতরটায় কিসে যেন কামড়াচ্ছে। খালি মনে হচ্ছে কেন মাথাটা ফেটে যাচ্ছে না, তাহলে আরও কিছু শোনার বা দেখার কষ্ট থেকে বেঁচে যেতাম।

আয়শার মমি মুখে প্রথমে সামান্য আশার ছাপ পড়লো। কিন্তু ক্ষণিকের জন্যে। তারপরই তীব্র হতাশা আর যন্ত্রণা সে আশার স্থান দখল করলো।

কিছু একটা করতে হয়, এভাবে আর চলতে পারে না। কিন্তু কে করবে? আমার ঠোঁট দুটো যেন সেঁটে গেছে একটার সাথে অন্যটা, খুলতেই পারছি না তো কথা বলবো কি? পা দুটো যেন পাথরের তৈরি! লিও এখনও তেমন দাঁড়িয়ে পাথরের মূর্তির মতো। পাপাভ তেমনি মাটিতে পড়ে। অরোস আর সিমব্রিও নির্বাক।

ওহ! ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, আতেন কথা বলছে! মুণ্ডিত মাথা জিনিসটার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো সে-তার সমস্ত সৌন্দর্য, নিখুঁত নারীত্ব নিয়ে দাঁড়ালো।

লিও ভিনসি, বা ক্যালিক্রেটিস, বললো আতেন; যে নাম খুশি তুমি নিতে পারো। তুমি হয়তো অত্যন্ত নীচ ভাবব আমাকে, কিন্তু জেনে রাখো, অন্তত প্রতিদ্বন্দীর চরম লজ্জার সময় আমি তাকে বিদ্রূপ করিনি, করতে পারিনি। ও একটা অসম্ভব গল্প শুনিয়েছে আমাদের, সত্যি না মিথ্যে জানি না। আমি নাকি দেবীর এক সেবককে চুরি করে নিয়েছি, তাই দেবী প্রতিশোধ নিয়েছেন আমার কাছ থেকে আমার প্রাণের মানুষকে কেড়ে নিয়ে! বেশ, আমরা মানুষ, অসহায়। আমাদের নিয়ে যত পারেন খেলুন দেবীরা! কিন্তু আমি, যতক্ষণ প্রাণ আছে পরিপূর্ণ আত্মমর্যাদা নিয়ে যা আমার তার ওপর স্বত্ব ঘোষণা করে যাবো।

উপস্থিত এতগুলো লোকের সামনে বলতে লজ্জা পাচ্ছি না, আমি তোমাকে ভালোবাসি। এবং সম্ভবত এই মহিলাও-বা দেবী যা-ই বলল, ভালোবাসে তোমাকে। এবং একটু আগে ও বলেছেজমাদের দুজনের ভেতর থেকে একজনকে তোমার বেছে নিতে হবে। বলেছে, ও যার প্রতিনিধি হিসেবে নিজেকে দাবি করছে আমি সেই আইসিসের কাছে পাপ করেছি। কিন্তু ও কি করছে? ও তো একজন স্বর্গের দেবী আর একজন মর্তের মানবী—দুজনের কাছ থেকে তোমাকে কেড়ে নিতে চাই। আমি যদি পাপী হই ও দ্বিগুণ পাপী নয়?

অতএব বেছে নাও, লিও ভিনসি, এবং এখানেই চুকে যাক সব। নিজের সম্পর্কে আর কিছু বলতে চাই না আমি। তুমি জানো আমি কে, কি দিতে পারি তোমাকে। অতীত, সে তো স্বপ্ন, স্মৃতি। সহজেই মুছে ফেলা যায় মন থেকে। বর্তমান নিয়ে ভাবো। তুমি কাকে নেবে, আমাকে না ওকে?

নিঃশব্দে শুনলো আয়শা। একটা কথাও বললো না। এমন কি হাতটা পর্যন্ত নাড়লো না!

লিওর ফ্যাকাসে মুখটা দেখলাম। একটু যেন আতেনের দিকে ঝুকলো। তারপর আচমকা সোজা হলো আবার। মাথা নেড়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। অদ্ভুত এক আলো যেন জ্বলে উঠেছে ওর মুখে।

যত যা-ই হোক, যেন কথা বলছে না, সশব্দে চিন্তা করছে লিও। যত যা-ই হোক, অতীত হলো স্বপ্ন। এমন এক স্বপ্ন যার সাথে কোনোই সম্পর্ক নেই আমার। বর্তমান নিয়ে ভাবতে হবে আমাকে। আয়শা দুহাজার বছর ধরে অপেক্ষা করেছে আমার জন্যে; আর আতেন ক্ষমতার লোভে বিয়ে করেছে এমন এক লোককে যাকে সে ঘৃণা করে, পরে বিষ খাইয়েছে বেচারাকে। আমাকে নিয়ে ক্লান্ত হয়ে উঠলে আমাকেও যে বিষ খাওয়াবে না এমন নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারে? আমেনার্তাসের কাছে কি শপথ করেছিলাম আমার মনে নেই, অমন কোনো নারী আদৌ ছিলো কিনা তা-ই জানি না। কিন্তু আয়শার কাছে কি শপথ করেছিলাম মনে আছে। এ জীবনেই করেছিলাম। এখন যদি তা ভঙ্গ করি মিথ্যার ওপর দাঁড়িয়ে থাকবে আমার জীবন। আমি হয়ে যাব প্রবঞ্চক। প্রেম কি বয়সের স্পর্শে মিলিয়ে যেতে পারে?

না, আয়শা কি ছিলো স্মরণ করে, কি হতে পারে কল্পনা ও আশা করে, এখনকার আয়শাকে আমি গ্রহণ করছি।

এগিয়ে গিয়ে ভয়ঙ্কর মূর্তিটার সামনে দাঁড়ালো লিও। ঝুঁকে চুমু খেলো তার কপালে।

হ্যাঁ, ও চুমু খেলো সহস্র কুঞ্চনে সংকুচিত জিনিসটাকে। মূর্তিমান আতঙ্কটাকে। আমার মনে হয় সভ্যতার শুরু থেকে মানুষ যত ভয়ঙ্কর দুঃসাহসিক কাজ করেছে তার একটা হিসেবে গণ্য হতে পারে লিওর এ কাজটা।

বেশ, লিও ভিনসি, বললো আতেন, অদ্ভুদ শান্ত, শীতল তার গলা, তোমার বুদ্ধি বিবেচনা দিয়ে তুমি বেছে নিয়েছে। আমার কিছু বলবার নেই। তোমাকে হারানোর বেদনা আমি বয়ে বেড়াবো সারাজীবন। তোমার—তোমার বধূকে গ্রহণ করো, আমি যাই।

এবারও কিছু বললো না আয়শা। একই রকম স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো কিছুক্ষণ। তারপর তার হাড়সর্বস্ব হাঁটু মাটিতে ঠেকিয়ে বসলো। উচ্চকণ্ঠে প্রার্থনা করতে লাগল—ও সর্বশক্তিমান ইচ্ছার প্রতিনিধি, তুমি শেষ বিচারের ক্ষুরধার তরবারি, প্রকৃতি নামের অলঙ্ঘনীয় আইন; মিসরীয়রা তোমাকে অভিষিক্ত করেছিলো আইসিস নামে; তুমি মায়ের বুকে সন্তান দাও, মৃতকে দাও জীবন, প্রাণবানকে করো মৃত; তুমি সুজলা সুফলা করেছো ধরিত্রীকে; তোমার মৃদু হাসি বসন্ত, অট্টহাসি সাগরের ঝঞা, ঘুম শীতের রাত্রি; হতভাগিনী সন্তানের সবিনয় প্রার্থনা শোনো:

এক সময় তুমি আমাকে তোমার নিজের শক্তি, অমর জীবন আর অনন্ত সৌন্দর্য দিয়েছিলে। কিন্তু আমি হতভাগিনী, এই মহার্ঘ প্রাপ্তির মূল্য দিতে পারিনি, গুরুতর পাপ করেছি তোমার কাছে, এবং সেই পাপের প্রতিফল ভোগ করছি শতাব্দীর পর শতাব্দী প্রাণান্তকর নিঃসঙ্গতায় কাটিয়ে। অবশেষে আমার প্রেমিকের সামনে আমার সৌন্দর্য তুমি কেড়ে নিলে, ড্রিপের পাত্রে পরিণত করলে আমাকে। তোমার নিঃশ্বাসের যে সৌরভ আমাকে আলো দিয়েছিলো তা-ই নিয়ে এলো নিঃসীম আঁধার। তুমি আমাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলে, আমি কখনও মরবো না, কিন্তু এই কুৎসিত কদাকার চেহারা নিয়ে, প্রেমিকের উপহাসের পাত্র হয়ে অনন্ত কাল বেঁচে থেকে কি লাভ? আমাকে আরেকবার সুযোগ দাও, মা, আর একটি বারের জন্যে আমাকে তুলতে দাও আমার অনন্ত সৌন্দর্যের হারানো ফুলটি। মহামহিমাময়ী মা, তোমার চরণে এই আমার প্রার্থনা। প্রেমিকের অকৃত্রিম প্রেমের কথা বিবেচনা করে আমার পাপ ক্ষমা করো। নয়তো তোমার পরম শান্তিদায়ক প্রসাদ-মৃত্যু দাও আমাকে!

 ১৬-২০. যে যেখানে ছিলাম তেমনি আছি

১৬.

যে যেখানে ছিলাম তেমনি আছি। অটুট নীরবতা চারদিকে। হতাশ চোখে লিওর দিকে তাকালাম। ও-ও তাকিয়ে আছে আমার দিকে। অসম্ভব আশা করছিলাম আমরা। ভাবছিলাম, এই সুন্দর করুণ প্রার্থনার জবাব বোধহয় দেবে প্রকৃতির। বোবা আত্মা। অলৌকিক কিছু ঘটবে। কিন্তু সময় গড়িয়ে চললো, অলৌকিক কেন, কিছুই ঘটলো না।

না, অনেক অনেকক্ষণ পর, কতক্ষণ জানি না, একটা ব্যাপার ঘটলো। ধীরে, ধীরে অস্পষ্ট হতে শুরু করলো অগ্নিগিরির জ্বালামুখ থেকে উঠে আসা আগুনের পর্দা। ক্রমশ নিচের দিকে নেমে যাচ্ছে। যেখান থেকে উঠেছিলো সেখানেই ডুবে যাচ্ছে। একটু একটু করে অন্ধকার হয়ে আসছে জায়গাটা।

কমতে কমতে একেবারে অস্পষ্ট হয়ে এসেছে আলো। আর কয়েক সেকেণ্ডের ভেতর একদম নিভে যাবে। এই সময় উঠে দাঁড়ালো আয়শা। ধীরে ধীরে এগোলো কয়েক পা। বাইরের দিকে বেরিয়ে থাকা এক টুকরো পাথরের ওপর গিয়ে দাঁড়ালো। নিচ থেকে উঠে আসা ধোঁয়াটে আভার বিপরীতে কালো প্রেতের মতো দেখাচ্ছে ওর, অবয়ব। আমার মনে হলো অসহনীয় গ্লানির হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যে ও মরণকে আলিঙ্গন করতে চাইছে। লিওর-ও সম্ভবত তাই মনে হলো। তড়াক করে লাফিয়ে উঠে ও ছুটলো ওকে ঠেকানোর জন্যে। কিন্তু পূজারী অরোস আর পূজারিনী পাপাভ এগিয়ে এসে বাধা দিলো ওকে। দুজন দুপাশ থেকে ধরে টেনে নিয়ে গেল পেছনে। পুরোপুরি আঁধার নেমে এলো সেখানে। অন্ধকারের ভেতর শুনতে পেলাম আয়শার গলা। অদ্ভুত পবিত্র সুরে কিছু একটা স্তবগান করছে।

একটু পরে একটা আগুনের ফুলকি দেখতে পেলাম। একটু একটু করে বড় হচ্ছে, আর পাখির মতো এদিক ওদিক ভাসতে ভাসতে উঠে আসছে। কিন্তু—কিন্তু–

হোরেস! ফিসফিস করে বলে উঠলো লিও, দেখেছো, বাতাসের উল্টো দিকে আসছে ওটা।

বাতাস বদলে গেছে হয়তো, বললাম আমি। জানি যা বললাম, ঠিক নয়, বরং একটু বেড়েছে বাতাসের বেগ, তবু বললাম।

ক্রমশ কাছে আসছে ওটা। এখন আরও ভালোভাবে দেখতে পাচ্ছি। পাখির ডানার মতো দুটো আগুনে ডানা দুপাশে নড়ছে, মাঝখানে রয়েছে কালো কিছু একটা, অন্ধকারে দেখতে পাচ্ছি না। উঠতে উঠতে একেবারে আয়শার সামনে। এসে পৌঁছুলো ওটা। গনগনে ডানা দুটো ঢেকে ফেললো ওর কুঁচকানো দেহটাকে। তারপর অদৃশ্য হয়ে গেল আগুন। নিকষ কালো অন্ধকার সামনে, পেছনে, উপরে, নিচে। কিছুই দেখতে পাচ্ছি না।

কিছুক্ষণ কেটে গেল। এক মিনিট হতে পারে, দশ মিনিটও হতে পারে। তারপর হঠাৎ পূজারিনী পাপাভ অদৃশ্য, অশ্রুত কোনো সঙ্কেত পেয়ে যেন পা টিপে টিপে এসে দাঁড়ালো আমার পাশে। ওর পোশাকের স্পর্শ পেলো আমার শরীর। আবার কিছুক্ষণ নীরবতা এবং নিচ্ছিদ্র অন্ধকার। টের পেলাম পাপাত চলে যাচ্ছে। ক্ষীণ একটা ফোঁপানোর আওয়াজ শুনতে পেলাম। নিঃসন্দেহে আয়শা ঝাঁপ দিয়েছে জ্বালামুখের ভেতর! বিয়োগান্তক ঘটনাটার পরিসমাপ্তি হলো বোধহয়!

ভোর হতে আর বাকি নেই। ধূসর হতে শুরু করেছে আকাশ। এমন সময় সেই আশ্চর্য সঙ্গীত ভেসে এলো নিচ থেকে। নিশ্চয়ই নিচে যে পূজারীরা রয়েছে তারা গেয়ে উঠেছে। সে-সঙ্গীতের বর্ণনা দেয়ার সাধ্য আমার নেই। পৃথিবীর অনেক ধর্মের অনেক মন্দিরে অনেক ধরনের গান আমি শুনেছি, কিন্তু এমন অদ্ভুত সুর, লয় কখনও শুনিনি। ক্রমশ উঁচগ্রামে উঠছে সঙ্গীত। উঠতে উঠতে এক সময় উচ্চতম গ্রামে পৌঁছুলো, তারপর নামতে শুরু করলো আবার। কমতে কমতে অবশেষে মিলিয়ে গেল একসময়।

তারপর, পুবদিক থেকে একটা মাত্র আলোকরশ্মি লাফিয়ে উঠলো আকাশে।

ভোর হচ্ছে, শান্ত গলা শোনা গেল অরোসের।

আমাদের মাথা ছাড়িয়ে অনেক উঁচুতে উঠে গেল আলোকরশ্মি। ক্ষুরধার তরবারির মতো অগ্নিশিখা যেন। তারপর নেমে আসতে লাগলো। নামতে নামতে সামনের ছোট্ট পাথর খণ্ডটার ওপর পড়লো আলো।

ওহ! সেখানে দাঁড়িয়ে আছে স্বর্গীয় অবয়ব। একটা মাত্র বস্ত্রে আবৃত। চোখ দুটো বন্ধ, যেন ঘুমিয়ে আছে। নাকি মরে গেছে? প্রথম দর্শনে মুখটা মৃতের। মতোই লাগলো। সূর্যের প্রথম রশি খেলা করছে ওর শরীরে, পাতলা আবরণ ভেদ করে পৌঁছে যাচ্ছে ভেতরে। চোখ দুটো খুললো। অপার বিস্ময় তাতে, নবজাত শিশুর দৃষ্টিতে যেমন থাকে। প্রাণের প্রবাহ বইতে শুরু করেছে, মুখে, বুকে, শরীরে। কালো ঢেউ খেলানো কুন্তলদল উড়ছে বাতাসে। মণিখচিত সোনার সাপ ঝিকিয়ে উঠছে কোমরে।

একি মায়া, না সত্যি আয়শা? কোর-এর গুহায় ঘূর্ণায়মান প্রাণ-আগুনে ঢোকার আগে যে আয়শাকে দেখেছিলাম সে না অন্য কেউ? আর ভাবতে পারলাম আমি; সম্ভবত লিও-ও না। একটু পরে যখন কানের কাছে নিঝরের মতো মিষ্টি একটা কণ্ঠস্বর ফিসফিস করে উঠলো তখন সচেতন হয়ে দেখলাম, আমি লিও দুজনই মাটিতে পড়ে আছি। জড়িয়ে ধরে আছি একজন অন্যজনের গলা।

এখানে এসো, ক্যালিক্রেটিস, স্বর্গীয় সঙ্গীতের মত মিষ্টি কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম, আমার কাছে এসো।

অনেক কষ্টে উঠে দাঁড়ালো লিও। মাতালের মতো টলমলে পায়ে এগোলো আয়শার দিকে। তারপর আবার বসে পড়লো হাঁটু ভেঙে।

ওঠো, বললো আয়শা, তুমি কেন? আমিই তো হাঁটু গেড়ে বসবো তোমার সামনে। লিওকে ওঠানোর জন্যে হাত বাড়িয়ে দিলো ও।

এবারও উঠতে পারলো না লিও। ধীরে ধীরে একটু একটু করে ঝুঁকে এলো। আয়শা। ঠোঁট দুটো আলতো করে ছোঁয়ালো লিওর কপালে। তারপর ইশারায় ডাকলো আমাকে। আমি গেলাম, লিওর মতোই হাঁটু গেড়ে বসলাম।

না, বললো সে, তুমি ওঠো। চাইলে এমন কি না চাইলেও প্রেমিক বা পূজারী অনেক পাবো। কিন্তু হলি তোমার মতো বন্ধু কোথায় পাবো? তারপর ঝুঁকে আমার কপালেও আলতো করে ঠোঁট ছোঁয়ালো ও,কেবল ছোঁয়ালো, আর কিছু না।

স্বীকার করতে লজ্জা নেই, সেই মুহূর্তে অদ্ভুত এক আকুলতা বোধ করলাম মনে। ওকে জড়িয়ে ধরার ইচ্ছা হলো আমার। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ে গেল। আমি বৃদ্ধত্বের কথা, এধরনের আকুলতা প্রকাশ করার দিন পেরিয়ে এসেছি অনেক। আগে। তাছাড়া আয়শা আমাকে সত্যিকারের বন্ধু হিসেবে স্বীকার করেছে, এলোক ছাড়িয়ে অন্যলোকে গিয়েও সে বন্ধুত্ব অটুট থাকবে। এর বেশি আর কি চাইবার আছে আমার?

লিওর হাত ধরে ছাদের নিচে ফিরে এলো আয়শা।

নাহ শীত লাগছে, বললো সে। পাপাভ, আমার আলখাল্লাটা দাও তো।

কারুকাজ করা লাল পোশাকটা যত্ন করে পরিয়ে দিলো ওকে পূজারিনী। রাজকীয় ভঙ্গিতে ওটা ঝুলে রইলো ওর কাঁধ থেকে, অভিষেকের পোশাক যেন।

ও প্রিয়তম, প্রিয়তম, লিওর দিকে তাকিয়ে বলে চললো সে, ক্ষমতাবানরা একবার খেচা খেলে সহজে ভুলতে পারে না। জানি না কদিন তুমি আমি এক সাথে থাকতে পারবো এপৃথিবীতে, হয়তো সামান্যক্ষণ। সুতরাং সময়টুকু হেলায় নষ্ট করবো কেন? চলো আনন্দের পেয়ালায় চুমুক দিয়ে একে গৌরবময় করে রাখি। এ জায়গা আমার কাছে অসহ্য লাগছে। এখানে যত কষ্ট, যত যাতনা সহ্য করেছি, পৃথিবীতে কোনো নারী তা কখনও করেনি। আর এক মুহূর্ত এখানে। থাকতে ইচ্ছে হচ্ছে না আমার। তারপর আচমকা শামান সিমব্রির দিকে ফিরে বললো, বলো তো, যাদুকর, আমার এখন কি মনে হচ্ছে?

বুকের ওপর দুহাত ভাঁজ করে এতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলো বৃদ্ধ শামান। জবাব দিলো, সুন্দরী, তোমার যা নেই আমার তা আছে, ভবিষ্যৎ দেখবার ক্ষমতা। আমি একটা মৃতদেহ দেখতে পাচ্ছি। পড়ে আছে- আর একটা কথা বলেছো কি, সেটা তোমার মৃতদেহ হবে! গর্জে উঠলো আয়শা। আগুন ঝরছে যেন ওর। চোখ থেকে। গর্দভ, আমাকে মনে করিয়ে দিও না আমি আমার হারানো শক্তি ফিরে পেয়েছি। ইচ্ছে করলেই এখন আমি যাদের ঘৃণা করি সেই সব পুরনো শত্রুদের ধ্বংস করে দিতে পারি।

ভয় পেয়ে পিছিয়ে গেল বুড়ো যাদুকর। পিছাতে পিছাতে দেয়ালে গিয়ে ঠেকলো তার পিঠ।

ম–মহামহিমাময়ী! এখনও আমি-আমি আপনাকে আগের মতোই ভক্তি করি, তো-তো করে বললো বৃদ্ধ। আমি-আমি শুধু বলতে চাইছিলাম, কালুনের এক ভাবী খামকে এখানে শুয়ে থাকতে দেখছি।

নিঃসন্দেহে কালুনের অনেক খানই এখানে শুয়ে থাকবে, সেটা আবার বলার মতো ব্যাপার হলো? যাক, ভয় পেয়ো না, শামান, তোমাকে কিছু বলবো না। আমার রাগ পড়ে গেছে। চলো আমরা যাই।

সূর্য এখন পুরোপুরি বেরিয়ে এসেছে দিগন্তের আড়াল থেকে। আলোর বন্যায় প্লবিত পাহাড়ের পাদদেশ, দূরে কালুনের সমভূমি। মুগ্ধ চোখে দেখলো আয়শা। লিওর দিকে তাকিয়ে বললো, পৃথিবীটা খুব সুন্দর। আমি এ-সব তোমাকে দিয়ে দিলাম।

মানে তুমি আমার রাজ্য দিয়ে দিচ্ছো ওকে, হেস, প্রীতি উপহার হিসেবে? অনেকক্ষণ পর কথা বললো আতেন। কিন্তু এত সহজে তো তা সম্ভব নয়, আগে ওটা জয় করতে হবে তোমাকে।

নিঃশব্দে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইলো আয়শা আতেনের দিকে। অবশেষে বললো, অন্য সময় হলে এই অশিষ্ট কথার জন্যে ভয়ানক শাস্তি পেতে হতো তোমাকে। কিন্তু এবারও ক্ষমা করে দিলাম। আমিও প্রতিদ্বন্দীর চরম লজ্জার সময় দুঃখ বোধ করি। যখন আমার চেয়ে সুন্দর ছিলে তখন তুমিই ওকে দিতে চেয়েছিলে তোমার রাজ্য। কিন্তু এখন কে বেশি সুন্দর? সবাই দেখ, বলো কে বেশি সুন্দর? হাসি মুখে আতেনের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো সে।

খানিয়া রূপসী সন্দেহ নেই। পৃথিবীতে এত রূপ খুব কম নারীরই আছে। তবু আয়শার স্বর্গীয় সৌন্দর্যের পাশে কি স্নান লাগছে ওকে!

আমি নিছক নারী, বললো আতেন। কিন্তু তুমি পিশাচী না দেবী তুমিই ভালো জানো, ভয়ঙ্কর ক্রোধে ফেঁপাচ্ছে ও। স্বীকার করছি তোমার আগুনের মতো রূপের কাছে আমি প্রদীপের মতোই নিস্প্রভ, আমার মরণশীল রক্ত-মাংসের সঙ্গে তোমার অশুভ গৌরবের তুলনা চলে না। পারলে সাধারণ হয়ে এসো, নারী হয়ে এসো, দেখি আমি আমার হারানো প্রেম ফিরে পেতে পারি কিনা। একটা কথা মনে রেখো, মানুষের সঙ্গেই মানুষের মিলন সম্ভব, পশু বা দেবী, বা পিশাচীর সঙ্গে নয়।

অস্থিরতার ছাপ পড়তে দেখলাম আয়শার মুখে। লাল ঠোঁট দুটোতে একটু যেন ধূসর ছোপ লাগলো, চোখ দুটো যেন চঞ্চল। পরমুহূর্তে চঞ্চলতা, শঙ্কা, অস্থিরতা দূর হয়ে গেল। রুপালি ঘণ্টার মৃদু টুং-টাং-এর মতো বেজে উঠল ওর কণ্ঠস্বর: কেন প্রলাপ বকছো, আতেন? জানো না গ্রীষ্মের ক্ষণজীবী ঝড় যতই চেষ্টা করুক, পর্বতশৃঙ্গকে টলাতে পারে না, নিজেই নিঃশেষ হয়ে যায়। এখন শোনো, খুব শিগগিরই আমি তোমার রাজধালীতে যাবো। তুমি ঠিক করো, শান্তিতে যাবো না যুদ্ধ করে যাবো।

চলো, অতিথিরা, আমরা এবার বিদায় নিই।

আতেনকে পেরিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে আয়শা, লিওর হাতটা এখনও ওর হাতে। এই সময় নড়ে উঠতে দেখলাম খানিয়াকে। পরমুহূর্তে তার হাতে ঝিক করে . উঠলো একটা ছুরি। পাগলের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে ছুরিটা সে গেঁথে দিলো আয়শার। পিঠে। স্পষ্ট দেখলাম ছুরির ফলা আমূল ঢুকে গেল ওর শরীরে। কিন্তু এ কি! আর্তনাদ তো দূরের কথা ভুরুটাও সামান্য কুঁচকালো না আয়শার। যেমন। যাচ্ছিলো তেমনি হেঁটে যেতে লাগলো।

ব্যর্থ হয়েছে বোঝার সঙ্গে সঙ্গে আবার চেষ্টা চালালো আতেন। দুহাত বাড়িয়ে ছুটে গেল আয়শাকে ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলে দেয়ার জন্যে। আশ্চর্য! আয়শাকে ও স্পর্শই করতে পারলো না। আয়শার শরীরের সামান্য দূরে থাকতে অদৃশ্য কিছুর প্রভাবে সরে গেল ওর হাত। বাতাসে ধাক্কা মারলো আতেন এবং তাল হারালো। হোচট খাওয়ার ভঙ্গিতে এগিয়ে গেল এক পা, তারপর আরও এক পা। আতেনের একটা পা এখন মাটিতে অন্য পা শূন্যে। এখনই উল্টে পড়বে। কিন্তু না, বিদ্যুৎগতিতে হাত বাড়িয়েছে আয়শা। আতেনের এক হাত ধরে অবলীলায় তুলে আনলো ওপরে।

বোকা মেয়েমানুষ! করুণা মেশানো স্বরে বললো আয়শা। পাগল নাকি, আত্মহত্যা করতে যাচ্ছিলে! আবার যখন আসবে পৃথিবীতে, সাপ হয়ে না বিড়াল হয়ে ঠিক আছে কোনো? বাকি জীবনটা ভোগ করে নাও।

এই বিদ্রূপ সইতে পারলো না আতেন। ফুঁপিয়ে উঠে বললো, তুমি মানুষ নও, কি করে তোমার সাথে আমি লড়বো? ঈশ্বরের হাতে ছেড়ে দিলাম তোমার শাস্তির ভার। মুখ গুঁজে বসে কাঁদতে লাগলো ও।

লিও সহ্য করতে পারলো না বেচারির কষ্ট। এগিয়ে গিয়ে দুহাতে ধরে তুললো ওকে। দু’একটা সান্ত্বনাবাক্য শোনালো। কয়েক সেকেণ্ড ওর হাতে মাথা রেখে দাঁড়িয়ে রইলো আতেন। তারপর ছাড়িয়ে নিলো নিজেকে। শামান সিমব্রি এসে ধরলো ভাইঝির হাত।

এখনও দেখছি তোমার সৌজন্যবোধ আগের মতোই টনটনে, প্রভু লিও, আয়শা বললো। কিন্তু উচিত হয়নি কাজটা, ওর কাপড়ের ভেতর আরও ছুরি লুকানো থাকতে পারে। যাক, চলো, অনেক বেলা হলো, এবার নিশ্চয়ই বিশ্রাম দরকার তোমাদের।

.

১৭.

নিচে নেমে এলাম আমরা। আয়শা বিদায় নিলো আপাতত। বলে গেল, অরোস তোমাদের সাথে থাকবে, সময় হলেই আবার আমার কাছে নিয়ে যাবে। ততক্ষণ আরাম করোগে যাও।

অবোস সুন্দর একটা বাড়িতে নিয়ে গেল আমাদের। সামনে আরও সুন্দর একটা বাগান। মাটি থেকে এত উঁচুতেও তরতাজা সবুজ গাছে রঙ-বেরঙের ফুল ফুটে আছে।

ওহ! ভয়ানক ক্লান্ত লাগছে। আমি এখন ঘুমাবো, লিও বললো।

বিনীত ভঙ্গিতে একটা কামরায় নিয়ে গেল আমাদের পূজারী-প্রধান। ধবধবে চাদর পাতা বিছানা সে ঘরে। প্রায় লাফিয়ে বিছানায় উঠলাম আমরা। শুতে না শুতেই ঘুমিয়ে গেলাম।

ঘুম ভাঙলো বিকেলে। উঠে স্নান করে খাওয়া-দাওয়া সেরে গিয়ে বসলাম বাগানে। আমাদের বিশেষ করে লিওর বর্তমান, ভবিষ্যত নিয়ে টুকটাক আলাপ করলাম কিছুক্ষণ। হঠাৎ দেখি অরোস আসছে। লিওর সামনে এসে কুর্নিশের ভঙ্গিতে মাথা নুইয়ে সে বললো, মন্দিরে আপনাদের উপস্থিতি আশা করছেন হেসা।

উঠে ঘরে এলাম আমরা। কয়েকজন পূজারী অপেক্ষা করছিলো। প্রথমেই আমাদের চুল দাড়ি ঘেঁটে দিলো ওরা। লিও বাধা দেয়ার চেষ্টা করলো একবার, ওরা শুনলো না। এরপর সোনার কারুকাজ করা পাদুকা পরিয়ে দিলো পায়ে। গায়ে পরিয়ে দিলো অত্যন্ত জমকালো পোশাক। আমারটার চেয়ে লিওরটা বেশি সুন্দর, সাদার ওপর সোনালি আর লাল-এ কাজ করা। সবশেষে লিওর হাতে একটা রুপোর দণ্ড ধরিয়ে দেয়া হলো আর আমাকে সাধারণ একটা ছড়ি।

ওসিরিসের দণ্ড! লিওর কানে কানে বললাম। এখন থেকে বোধইয় ওসিরিসের অভিনয় করতে হবে তোমাকে।

দেখ, বলে দিচ্ছি, কোনো উদ্ভট দেবতার অভিনয় আমি করতে পারবো না, সোজাসাপ্টা জবাব লিওর। যা হয় হবে, আমি যা বিশ্বাস করি না তা করবো না।

আমি বোঝানোর চেষ্টা করলাম ওকে, ব্যাপারটা অত গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়, কিছুক্ষণ চোখ কান বুজে থাকলেই চুকে যাবে, না হলে আয়শা হয়তো অসন্তুষ্ট হবে, তখন কি ঘটবে কেউ বলতে পারে? ধর্মসংক্রান্ত ব্যাপারে লিওর কোনো গোড়ামি নেই, ভণ্ডামিও নেই। তবু কিছুতেই ও রাজি হলো না যা বিশ্বাস করে না তার অভিনয় করতে। অবশেষে অরোসের কাছে জিজ্ঞেস করলো ও, কি হবে মন্দিরে? একটু রুক্ষ ওর কণ্ঠস্বর।

থতমত খেয়ে প্রথমে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো অরোস। তারপর বললো, বাগদান।

এবার শান্ত হলো লিও। প্রশ্ন করলো, খানিয়া আতেন থাকবে?

না। যুদ্ধ এবং প্রতিশোধের প্রতিজ্ঞা নিয়ে উনি কালুনে ফিরে গেছেন।

রওনা হলাম আমরা। উঠান, সড়ক, সিঁড়ি, বারান্দা পেরিয়ে অবশেষে পৌঁছলাম মন্দিরের সেই উপবৃত্তাকার কক্ষে। শুধু আয়শা নয়, পূজারী পূজারিনীরাও উপস্থিত সেখানে। সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে সবাই। এক সারিতে পূজারীরা, অন্য সারিতে পূজারিনী। আমাদের দেখেই সমবেত কণ্ঠে গান গেয়ে উঠলো তারা। আনন্দের গান। দুই সারির মাঝ দিয়ে এগিয়ে চললাম আমরা। সামনে অরোস, পেছনে পাশাপাশি আমি আর লিও। সারির শেষে দাঁড়িয়ে পড়লো। অরোস। আমরা এগিয়ে গিয়ে দাঁড়ালাম আয়শার মুখোমুখি।

সিংহাসনের পাশে দাঁড়িয়ে আছে আয়শা। লিওর গায়ে যেমন তেমনি জমকালো সুন্দর একটা আলখাল্লা ওরও পরনে। হাতে মণিখচিত সোনার সিস্ট্রাম। আমরা দাঁড়িয়ে পড়তেই সিস্ট্রামটা উঁচু করলো আয়শা। থেমে গেল সমবেত সঙ্গীত।

হের পছন্দের মানুষকে দেখ? জলতরঙ্গের মতো বেজে উঠলো আয়শার কণ্ঠস্বর।

সমবেত পূজারী-পূজারিনীরা সমস্বরে চিৎকার করে উঠলো, হেসার পছন্দের মানুষ, স্বাগতম!

ফাঁকা মন্দিরের দেয়ালে দেয়ালে প্রতিধ্বনি তুলে গমগম করতে লাগলো আওয়াজটা। আমাকে তার পাশে দাঁড়ানোর ইশারা করে লিওর হাত ধরলো আয়শা। কয়েক পা এগিয়ে গেল সাদা পোশাক পরা পূজারী-পূজারিনীদের দিকে। তারপর ওভাবেই লিওর হাত ধরে থেকে বলতে লাগলোহেস-এর পূজারী ও পূজারিনীরা, শোনো। এই প্রথমবারের মতো আমি আমার রূপে তোমাদের সামনে এসেছি। কেন জানো? এই লোকটাকে দেখছো, তোমরা জানো ও বিদেশী, ঘুরতে ঘুরতে ও আমাদের মন্দিরে এসে পড়েছে। কিন্তু না, ও আগন্তুক নয়। অনেক অনেক শতাব্দী আগে ও ছিলো আমার প্রভু, এখন আবার আমার প্রেমের প্রত্যাশায় এসেছে। তাই না, ক্যালিক্রেটিস?

হ্যাঁ, জবাব দিলো লিও।

হেস-এর পূজারী ও পূজারিনীরা, তোমরা জানো, আমি যে পদ অধিকার করে আছি সে-পদের অধিকারী ইচ্ছে করলে একজন স্বামী বেছে নিতে পারে। এরকমই রীতি, তাই না?

হ্যাঁ, ও হেস, ওরা জবাব দিলো।

কয়েক মুহূর্ত চুপ করে রইলো আয়শা। তারপর অপূর্ব মিষ্টি এক ভঙ্গিতে লিওর দিকে ফিরে মাথা ঝোঁকালো পর পর তিনবার। তারপর হাঁটু গেড়ে বসলো। মুখ উঁচু করে বিশাল দু’চোখ মেলে লিওর চোখে চোখে তাকালো। মৃদু মিষ্টি স্বরে বললো: বলো তুমি সমবেত সবার সামনে, এবং যাদেরকে দেখতে পাচ্ছো না তাদের সামনে, আবার তুমি আমাকে বাগদত্তা বধূ হিসেবে গ্রহণ। করছো।

হ্যাঁ, দেবী, গাঢ়, একটু কম্পিত স্বরে বললো লিও, এখন এবং চিরদিনের জন্যে।

নিঃশব্দে দেখছে সবাই। ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালো আয়শা। সিসট্রামটা পড়ে গেল ওর হাত থেকে। টুং-টাং আওয়াজ উঠলো ঘণ্টাগুলো থেকে। দুহাত বাড়িয়ে দিলো ও লিওর দিকে।

লিও-ও ঝুঁকে এলো ওর দিকে। দুজনের ঠোঁট এক হয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ আমি খেয়াল করলাম, রক্তশূন্য ফ্যাকাসে হয়ে গেছে লিওর মুখ। অদ্ভুত এক আভা বিচ্ছুরিত হচ্ছে আয়শার কপাল থেকে, সেই আভায় সোনার মতো দেখাচ্ছে লিওর উজ্জ্বল চুল। আমি দেখলাম, বাতাস লাগা পাতার মতো কেঁপে উঠলো বিশালদেহী লিও, পড়ে যাবে এক্ষুণি।

আয়শাও খেয়াল করলো ব্যাপারটা। ঠোঁট দুটো এক হয়ে যাওয়ার আগ মুহূর্তে লিওকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো ও। মুখে নেমে এসেছে ভয়ের কালো ছায়া। অবশ্য ক্ষণিকের জন্যে। তারপরেই লিওর আলিঙ্গন থেকে বেরিয়ে এসে হাত বাড়িয়ে ধরলো ওকে। ধরে রইলো যতক্ষণ না কাপুনি দূর হলো লিওর।

অবোস সিসট্রামটা আবার ধরিয়ে দিলো আয়শার হাতে। ওটা উঁচু করে সে বললো–

প্রিয়তম, তোমার নির্ধারিত আসন গ্রহণ করো। চিরদিন ঐ আসনে আমার পাশে, বসবে তুমি। ও হেস-এর প্রিয়তম প্রভু, বসো তোমার সিংহাসনে, গ্রহণ করো তোমার পূজারীদের পূজা।

না, বললো লিও, কেউ আমার সামনে হাঁটু গেড়ে বসবে না। এই প্রথম এবং শেষবারের মতো বলে দিচ্ছি, তোমাদের অদ্ভুত সব দেবতা অপদেবতা সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই আমার, ওসব আমি বিশ্বাসও করি না। কেউ আমাকে পূজা করবে এটা অসম্ভব!

সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে থাকা পূজারীদের অনেকের কানে গেল লিওর এই দৃঢ় বক্তব্য। একে অন্যের ভেতর কানাকানি করতে লাগলো তারা। একজন তো বলেই ফেললো-সাবধান, পছন্দের মানুষ! মায়ের ক্রোধ থেকে সাবধান।

আবার ক্ষণিকের জন্যে ভয়ের ছায়া পড়লো আয়শার মুখে। তারপর একটু হেসে ব্যাপারটাকে হাল্কা করার জন্যে বললো–ঠিক আছে, প্রিয়তম, তোমার ইচ্ছাই আমার ইচ্ছা। কেউ তোমার সামনে হাঁটু গেড়ে বসবে না, আমার ভাবী স্বামী হিসেবে তুমি বসো সিংহাসনে।

উপায়ান্তর না দেখে বসলোঁ লিও। পূজারী-পূজারিনীরা আবার সেই অদ্ভুত গানটা শুরু করলো। একসময় আচমকা থেমে গেল গান। আয়শা তার সিসট্রাম নেড়ে ইশারা করলো। পরপর তিনবার মাথা নুইয়ে সম্মান জানালো পূজারী পূজারিনীরা। তারপর ঘুরে দাঁড়িয়ে চলে গেল সারি বেঁধে। অবোস আর পাপাভ কেবল রইলো।

চমৎকার না গানটা? বললো আয়শা। স্বপ্নালু দৃষ্টি চোখে, গানের মায়ায় এখনও যেন আচ্ছন্ন ও। মিশরের বেহবিট-এ আইসিস আর ওসিরিসের বিবাহ উৎসবে গাওয়া হয়েছিলো এ গান। আমি উপস্থিত ছিলাম সে উৎসবে। চলো প্রিয়তমা—আচ্ছা, কি নামে ডাকবো তোমাকে? ক্যালিক্রেটিস না।

আমাকে লিও বলে ডেকো, আয়শা। আগে ক্যালিক্রেটিস ছিলাম না কি ছিলাম এখন কিছুই মনে নেই। এখন আমি লিও, এটাই আমার এখনকার পরিচয়।

বেশ, প্রিয়তম লিও। চলো তোমাদের এগিয়ে দিই মন্দিরের দুয়ার পর্যন্ত। আমি কিছুক্ষণ একা থাকতে চাই। আমাকে ভাবতে হবে। আর—আর কয়েকজন দেখা করতে আসবে, তাদের সাক্ষাৎ দিতে হবে।

.

১৮.

আয়শা এলো না কেন? ঘরে ফিরে প্রথম প্রশ্ন লিওর।

আমি কি করে জানবো? অরোসকে জিজ্ঞেস করে দেখতে পারো, দরজার বাইরেই আছে ও।

আমি ওকে ছাড়া থাকতে পারছি না, হোরেস। মনে হচ্ছে মনে হচ্ছে, অদৃশ্য কিছু যেন ওর দিকে টানছে আমাকে। যাই, অরোসকে জিজ্ঞেস করি, কেন এলো না আয়শা।

অরোস মৃদু হাসলো শুধু। বললো, হেস। এখনও তার ঘরে যাননি। তারমানে এখনও মন্দিরেই আছেন।

তাহলে চললাম ওকে খুঁজতে। অবোস,এসো; তুমিও, হোরেস।

আপনারা যেখানে খুশি যেতে পারেন, সবিনয়ে বললো পূজারী, সব দরজা খোলা আপনাদের জন্যে। কিন্তু আমার ওপর নির্দেশ আছে, আপনাদের দরজা ছেড়ে যেন না নড়ি।

চলো, হোরেস, বললো লিও। নাকি আমি একাই যাবো?

ইতস্তত করছি আমি। অবশেষে বললাম, যেতে পারি, কিন্তু পথ খুঁজে পাবে না তো।

দেখা যাক, পাই কিনা।

একটু আগে যে পথে গিয়েছিলাম সে পথেই আবার মন্দিরের দরজার কাছে পৌঁছুলাম। লোহার দরজা পেরিয়ে বৃত্তাকার কক্ষের কাঠের দরজার সামনে এলাম। বন্ধ দরজা। ঠেলা দিতেই নিঃশব্দে খুলে গেল। জীবন্ত আগুনের শুভগুলো নেই এখন। গাঢ় অন্ধকার প্রায় গোল কামরাটায়। অদ্ভুত এক অনুভূতি হলো আমার। কামরাটা যেন লোকে গিজ গিজ করছে। তাদের পোশাকের স্পর্শ পাচ্ছি গায়ে। ওদের নিঃশ্বাসও অনুভব করছি, কিন্তু তা উষ্ণ নয়, শীতল। মানুষগুলো চলে ফিরে বেড়াচ্ছে যেন। কেমন ভয় ভয় করতে লাগলো আমার। গায়ের লোম খাড়া হয়ে গেছে।

অবশেষে অনেক দূরে আলোর দেখা পাওয়া গেল। অকস্মাৎ জ্বলে উঠেছে দুটো অগ্নিস্তম্ভ প্রতিমা-বেদীর দুপাশে। কিন্তু খুব একটা উজ্জ্বল ভাবে নয়। আমরা ৩০৪

এখনও দরজার কাছে রয়েছি, এত দূরে আলো এসে পৌঁছাই না।

ওখানে সিংহাসনে বসে আছে আয়শা। ও আমাদেরকে দেখতে না পেলেও ওকে আমরা ঠিকই দেখতে পাচ্ছি। অগ্নিস্তম্ভের অস্পষ্ট নীল আলো খেলা করছে ওর অনিন্দ্য শরীরে। খাড়া বসে আছে ও, অদ্ভুত এক অহঙ্কার চেহারায়, দুচোখ থেকে ঠিকরে পড়ছে ক্ষমতার দ্যুতি।

আবছা ছায়ার মতো একটা মূর্তি হাঁটু গেড়ে বসলো তার সামনে। তারপর আরেকটা, আরও একটা, এবং আরও। হাঁটু গেড়ে বসে সবাই একসাথে মাথা নোয়ালো। হাতের সিট্রামটা উঁচু করে তাদের সম্মানের জবাব দিলো আয়শা। ওর ঠোঁট নড়তে দেখলাম, কিন্তু কোনো শব্দ পৌঁছুলো না আমাদের কানে। নিশ্চয়ই পরলোকের আত্মারা পূজা নিবেদন করতে এসেছে!

শুধু আমার নয়, লিওর মনেও সম্ভবত এই একই সম্ভাবনার কথা উঁকি দিয়েছে। কারণ যে মুহূর্তে আমি ওর হাত আঁকড়ে ধরতে গেলাম ঠিক সেই মুহূর্তে ও-ও আঁকড়ে ধরলো আমার হাত। দ্রুত অথচ নিঃশব্দ পায়ে বেরিয়ে এলাম আমরা মন্দির থেকে।

.

প্রায় ছুটতে ছুটতে এসে পৌঁছুলাম আমাদের ঘয়ের কাছে। অরোস এখনও দাঁড়িয়ে আছে দরজায়। স্বভাবসুলভ মেকি হাসিটা ধরা আছে মুখে। ওর পাশ কাটিয়ে ঘরে ঢুকলাম আমরা। একে অপরের দিকে তাকালাম।

কি ও? হাঁপাতে হাঁপাতে জিজ্ঞেস করলো লিও। দেবদুতী?

হ্যাঁ। বা ঐ ধরনের কিছু।

আর ওগুলো-ছায়ার মর্তো-কি করছিলো?

রূপান্তরের পর শুভেচ্ছা জানাচ্ছিল হয়তো। হয়তো ওগুলো ছায়া নয়, ছদ্মবেশী পুরোহিত, গোপন কোনো আচার পালন করছিলো!

কাঁধ ঝাঁকালো লিও, কোনো জবাব দিলো না।

.

অবেশেষে দরজা খুললো। অবোস ঢুকে বললো, হেসা তার ঘরে যেতে বলেছেন আমাদের।

একটু আগে যে দৃশ্য দেখেছি তা মনে হতেই গা শিরশির করে উঠলো, তবু গেলাম।

বসে আছে আয়শা। একটু যেন ক্লান্ত। পূজারিণী পাপাভ এইমাত্র খুলে নিয়েছে তার রাজকীয় আলখাল্লা। ভেতরের সাদা পোশাকটাই শুধু এখন ওর পরনে। ইশারায় লিওকে কাছে ডাকলো। এবার ওদেরকে একটু একা থাকতে দিতে হয়, ভেবে ঘুরে দাঁড়ালাম আমি।

কোথায় যাচ্ছো, হলি, আমাদের ফেলে? মৃদু হেসে জিজ্ঞেস করলো আয়শা। আবার মন্দিরে? অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালো ও। কেন, মায়ের প্রতিমার কাছে কোনো প্রশ্ন আছে? নাকি মা-কে জানাতে চাও জায়গাটা খুব ভালো লেগে গেছে?

আমি কোনো জবাব দিলাম না, সম্ভবত ও আশাও করেনি। কারণ না থেমেই ও বলে চললো, না, তুমি এখানেই থাকো। আমরা তিনজন সেই অতীতের মতো আজ একসাথে খাবো। অরোস, পাপা, তোমরা এখন যাও, দরকার হলে ডাকবো তোমাদের।

খুব বড় নয় আয়শার ঘর। ছাদ থেকে ঝোলানো প্রদীপের আলোয় দেখলাম, চমৎকার, দামী সব আসবাবপত্র সাজানো। পাথরের দেয়ালগুলোয় সুন্দর কারুকাজ করা পর্দা ঝুলছে। টেবিল চেয়ারগুলো রূপা দিয়ে বাঁধানো। এই ঘরে একজন নারী বাস করে তার একমাত্র প্রমাণ-বেশ কয়েকটা পাত্রে ফুল সাজানো।

টেবিলে খাবার দেয়াই ছিলো। সামান্য জিনিস; আমাদের জন্যে ডিম ভাজি, দই আর ঠাণ্ডা হরিণের মাংস; ওর জন্যে দুধ, ছোট্ট কয়েক টুকরো ময়দার পিঠে আর পাহাড়ী জাম। আয়শা বসে উল্টোদিকের দুটো চেয়ারে আমাদের বসতে ইশারা করলো।

আমি বসে পড়লাম। কিন্তু লিও বসার আগে গায়ের জমকালো আলখাল্লাটা খুলে ছুঁড়ে দিলো একদিকে, হাতের রুপালি দণ্ডটাও-একটু আগে অবোস জোর করে ওর হাতে গুঁজে দিয়েছিলো ওটা।

এসব পবিত্র জিনিসপত্রের ওপর খুব একটা শ্রদ্ধা নেই তোমার তাই না? হেসে জিজ্ঞেস করলো আয়শা।

একটুও না, জবাব দিলো লিও। মন্দিরে যা বলেছিলাম নিশ্চয়ই শুনেছিলে, আয়শা? আমি তোমার ধর্মের কিছুই বুঝি না, এপর্যন্ত যেটুকু দেখেছি তাতে ভক্তি জাগেনি আমার মনে। তারচেয়ে এসো একটা চুক্তি করি, আমরা কেউ কারও ধর্মবিশ্বাসে হস্তক্ষেপ করবে না। রাজি?

আমি ভাবছিলাম রাগে ফেটে পড়বে আয়শা। কিন্তু না, ও সামান্য মাথা ঝোকালো শুধু। নরম করে বললো, তোমার ইচ্ছাই আমার ইচ্ছা, লিও, তোমার ধর্মবিশ্বাস তো আমারও ধর্মবিশ্বাস।

মানে! আমার ধর্মবিশ্বাস তোমার ধর্মবিশ্বাস হবে কেমন করে?

পৃথিবীর সব মহান বিশ্বাস কি এক নয়? সামান্য যেটুকু পার্থক্য তা বহমান সময় আর জনগোষ্ঠীর ভিন্নতার কারণেই। আমি-আমরা বিশ্বাস করি সুমহান এক শুভশক্তি বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে নিয়ন্ত্রণ করছেন। এই শক্তিই ঈশ্বর। তোমার বিশ্বাস কি এর থেকে আলাদা?

না, আয়শা। কিন্তু তোমার? হেস বা আইসিস হলো তোমার দেবী। তার সঙ্গে দূর অতীতে তোমার কি চুক্তি হয়েছিলো তা কখনও বলোনি আমাদের। ভাগ্যক্রমে বা দুর্ভাগ্যক্রমে-যা-ই বলো, কাল রাতে জানলাম। কে এই দেবী হেস?

আমি তার নাম দিয়েছি প্রকৃতির আত্মা। পৃথিবীর যাবতীয় জ্ঞান ও রহস্য লুকিয়ে আছে তার ভেতর।

ভালো কথা। ভক্তরা কেউ অবাধ্য হলে উনি নিশ্চয়ই প্রতিশোধ নেন? যেমন নিয়েছেন আমার—দূর অতীতের আমার ওপর।

টেবিলে কনুই ঠেকিয়ে ঝুঁকে বসলো আয়শা। শান্ত, পূর্ণচোখে তাকালো লিওর দিকে। তোমার যে বিশ্বাস তাতে নিশ্চয়ই দুজন ঈশ্বর আছেন, একজন শুভের অন্যজন অশুভের, একজন ওসিরিস অন্যজন সেট?

মাথা ঝাঁকালো লিও। অনেকটা।

এবং অশুভের দেবতাই শক্তিশালী বেশি, তাই না?

কোনো কোনো ক্ষেত্রে।

তাহলে বলো, লিও, এখনও কি পৃথিবীর নশ্বর মানুষ তুচ্ছ জাগতিক মোহে অশুভের কাছে আত্মবিক্রি করে না?

হ্যাঁ, করে। সেরকম বদলোকের সংখ্যা কম নয় আজকের দুনিয়ায়।

এবং অতীতে যদি কোনো নারী অমন করে থাকে? রূপ, দীর্ঘজীবন, জ্ঞান এবং প্রেমের মোহে পাগল হয়ে–

নিজেকে বিক্রি করলো সেট নামের অপদেবতার কাছে? এইতো তুমি বলতে চাইছো, আয়শা? কম্পিত স্বরে বলতে বলতে উঠে দাঁড়ালো লিও। তুমি-অমন এক নারী?

ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালো আয়শা। যদি হই?

যদি হও–ভেঙে গেল লিওর গলা, ওহ!-সেক্ষেত্রে আমাদের বোধহয় আলাদা হওয়ার সময় এসেছে।

আহ! আর্তনাদ করে উঠলো আয়শা, আচমকা যেন ছুরি বিধেছে তার বুকে। তারপর কি আতেনের কাছে যাবে? উই, তা তুমি পারবে না। আমার আছে ক্ষমতা, আছে লোকবল। আমি-আমি-না না, আর হত্যা করবো না তোমাকে। জীবিত অবস্থায়ই আটকে রাখবো। লিও, লিও, আমার রূপের দিকে তাকাও– একটু ঝুঁকে মোহনীয় ভঙ্গিতে কিছুক্ষণ শরীর দোলালো সে। তারপর হঠাৎ সোজা হয়ে দাঁড়ালো। না, এভাবে তোমাকে প্রলুব্ধ করবো না, প্রিয়তম। তুমি যাও। আমার একাকীত্ব, আমার পাপের মধ্যে আমাকে রেখে তুমি যাও। এক্ষুণি যাও। আতেন তোমাকে আশ্রয় দেবে। দেখো, লিও, আমি আবার ঘোমটা টেনে দিচ্ছি, যাতে আমার রূপ তোমাকে প্রলুব্ধ করতে না পারে। সত্যিই ও আলখাল্লার কোনা দিয়ে আড়াল করে ফেললো মুখ। তারপর হঠাৎ জিজ্ঞেস করলোতুমি আর হলি

আবার মন্দিরে গিয়েছিলে না? মনে হলো তোমাদের দেখলাম দরজায়।

হ্যাঁ, তোমাকে খুঁজতে গিয়েছিলাম।

এবং গিয়ে যা খুঁজছিলে না তা-ও পেলে?

কি ওগুলো আয়শা? ছায়ার মতো, তোমার পায়ে মাথা ঠেকাচ্ছিলো?

আমি অনেক রূপে অনেক দেশ শাসন করেছি, লিও। হয়তো ওরা আমার অতীত পূজারীদের কয়েকজন, হয়তো ওরা তোমার নিছক উত্তপ্ত মস্তিষ্কের কল্পনা, আগুনের পর্দায় যেমন ছবি দেখেছিলে তেমন।

লিও ভিনসি, সত্যি কথাটা এবার শোনো, পৃথিবীর সবকিছুই মায়া, দৃষ্টিবিভ্রম। অতীত, ভবিষ্যৎ বলে কিছু নেই। আমি আয়শা এক কুহকিনী। আমি অসুন্দর যখন তুমি আমাকে অসুন্দর দেখ, আমি সুন্দর যখন তুমি আমাকে সুন্দর দেখ। কল্পনা করো সেই সিংহাসনে বসা রানীর কথা, যার পায়ে মাথা ঠেকাতে দেখেছো ছায়াময় শক্তিদের। সে আমি। আবার সেই কুৎসিত আতঙ্কজনক চেহারার কথা স্মরণ করো। সে-ও আমি। পাপ পুণ্য দুয়ে মিলিয়ে-ই আমি। এখন তুমি সিদ্ধান্ত নাও আমাকে ফেলে চলে যাবে, না আমাকে জড়িয়ে ধরে, ভালোবেসে আমার পাপের ভাগ তোমায় মাথায় তুলে নেবে?

কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো লিও। দু’তিনবার ঘরের এমাথা ওমাথা পায়চারি করলো। অবশেষে বললো, হ্যাঁ, আমি তোমাকে ভালোবেসেছি, পাপপুণ্যে মেশানো তোমাকে। তোমারিওপ ভালোটুকু যদি গ্রহণ করতে পারি, মন্দটুকুও পারবো—পারতে হবে। আমি জানি আমি নিরপরাধ। তবু যদি শাস্তি পেতে হয় তোমার জন্যে, সে শাস্তি আমি মাথা পেতে নেবো।

শুনলো আয়শা। মাথা থেকে আলখাল্লার প্রান্তটা কখন নেমে এলো খেয়ালই করলো না। নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইলো হতভম্বের মতো। তারপর হঠাৎ ভেঙে পড়লো কান্নায়। লিওর সামনে গিয়ে বসলো। আস্তে আস্তে মাথাটা নামিয়ে ঠেকালো মাটিতে, ওর পায়ের কাছে।

লিও তাড়াতাড়ি কুঁকে হাত ধরে তুললো আয়শাকে। ধীরে ধীরে হাঁটিয়ে নিয়ে গিয়ে বসিয়ে দিলো গদিমোড়া একটা আসনে। এখনও কাঁদছে আয়শা।

কি করেছে তা যদি জানতে! অবশেষে বললো ও। ওহ, লিও, তুমি–তুমিই একমাত্র বাধা আমার আর তোমার মিলনের মাঝে। কত কষ্ট করে, কত বিপদ পেরিয়ে, কত মোহ-লোভ জয় করে এখানে এসেছে আমাকে পাওয়ার জন্যে! এসে দেখলে এখানে আমার মাঝেই লুকিয়ে আছে তোমার সবচেয়ে ঘৃণার জিনিস। বুঝতে পারছো কি বলতে চাইছি?

সামান্য, পুরো নয়, আস্তে জবাব দিলো লিও!

তোমার চোখে তাহলে বুলি আঁটা বলতে হবে, অস্থির আয়শার কণ্ঠস্বর। আমার ভয়ঙ্কর কুৎসিত চেহারা দেখেও তুমি আমাকে গ্রহণ করতে চেয়েছে, আতেনের রূপ চোখের সামনে থাকতেও ভালোবাসার অমরত্বের অজুহাতে তুমি কুৎসিত আমাকেই নিলে এবং সেজন্যে আমি আমার রূপ, যৌবন, নারীত্ব ফিরে পেলাম। লিও, কাল তুমি যদি আমাকে গ্রহণ না করতে, ঐ ভয়ঙ্কর চেহারা নিয়ে অনন্তকাল আমাকে ধুকে যেতে হতো।

প্রতিদানে আমি কি দিলাম। আমার মনের কুশ্রী দিকটা উন্মোচন করলাম তোমার সামনে। তারপরও তুমি দমলে না, ভালো মন্দ মিলিয়ে আমি যা তাকেই তুমি গ্রহণ করলে। এতখানি মহত্ত্ব তোমার! এখন আমার কারণে যদি তোমার ওপর ভয়ানক অতিলৌকিক কোনো দুর্ভোগ নেমে আসে, হয়তো–

যদি আসে ভোগ করবো, বললো লিও। একদিন না একদিন শেষ হবে দুর্ভোগ। না হলেও ক্ষতি নেই, তোমাকে ছেড়ে চলে গেলেই বা কি সুখটা আমি পাবো? যাক, এখন কয়েকটা ব্যাপার পরিষ্কার করবে আমাদের সামনে? কাল রাতে চূড়ার ওপর তুমি বদলালে কি করে?

আগুনের মাঝ দিয়ে আমি তোমাকে ছেড়ে গিয়েছিলাম, লিও, আগুনের ভেতর দিয়েই আবার ফিরে এসেছি। অথবা–অথবা, পরিবর্তন বলে যা তোমরা দেখছো তা তোমাদের চোখের ভুল, আসলে আমি যা ছিলাম তা-ই আছি। ব্যস, এর চেয়ে বেশি জানতে চেয়ো না।

আরেকটা কথা, আয়শা, একটু আগে আমাদের বাগদান হলো, বিয়ে নয় কেন? কবে তুমি আমাকে বিয়ে করবে?

এখনও সময় হয়নি, বললো আয়শা। একটু কি কেঁপে গেল ওর গলা? একটু ধৈর্য ধরতে হবে তোমাকে, লিও, কয়েক মাস বা এক বছর। ততদিন আমরা বন্ধু বা প্রেমিক-প্রেমিকা হিসেবেই থাকবো।

কেন? একগুয়ের মতো বললো লিও। আমার বয়স তো কমছে না, আয়শা। তাছাড়া মানুষের মৃত্যু কখন কোন্ দিক থেকে হাজির হয় কেউ বলতে পারে? তোমাকে পাওয়ার তৃষ্ণা নিয়েই হয়তো ঝরে যাবে আমার জীবন।

না, না। অমন অলক্ষুণে কথা বোলা না। আবার ভয়ের ছাপ পড়লো আয়শার মুখে। কিছুক্ষণ পায়চারি করলো। তারপর ধীরে ধীরে মাথা নেড়ে বললো, ঠিকই বলেছো, সময়ের বাঁধন তো ছিড়তে পারোনি তুমি। ওহ! আমাকে জীবিত রেখে তুমি মারা যাবে ভাবতেই গা শিউরে ওঠে! আগামী বসন্তেই যখন বরফ গলতে শুরু করবে, আমরা লিবিয়ায় যাবে। প্রাণের অগ্নিধারায় স্নান করবে তুমি। তারপর আমাদের বিয়ে হবে।

ও জায়গা চিরতরে বন্ধ হয়ে গেছে আয়শা।

হতে পারে, তবে তোমার আমার জন্যে নয়। ভয় পেয়ো না, প্রিয়তম, ঐ পাহাড়ে যাওয়ার সব পথ বন্ধ হয়ে গেলেও আমার দৃষ্টি দিয়ে আমি পথ তৈরি করে নেবো। আপাতত অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই, বরফ গলতে শুরু করলেই আমরা রওনা হয়ে যাবো।

তার মানে এপ্রিল-আটমাস, রওনা হওয়ার আগেই এতদিন বসে থাকতে হবে! তারপর পাহাড় পেরিয়ে, সাগর পেরিয়ে, কোর-এর জলাভূমি পেরিয়ে যেতে হবে, তারও পরে খুঁজে বের করতে হবে পাহাড়টাকে। দুবছরের আগে কিছুতেই হবে না, আয়শা।

জবাবে আয়শা কেবল না, না আর না ছাড়া আর কিছু বললো না। অবশেষে, আমার মনে হলো, একটু বিরক্ত হয়েই ও আমাদের বিদায় করে দিলো।

নাহ! হলি, আমরা বিদায় নেয়ার আগে ও বললো, আমি বলছি, কয়েক ঘণ্টা বিশ্রাম নাও, শান্ত সুখে কয়েকটা ঘণ্টা কাটাও, দেখবে সব ঠিক হয়ে গেছে। কাল সকালেই দেখবে সব আর সুন্দর লাগছে। আমি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, কাল সকালেই আমরা সুখী হবো, হ্যাঁ, কাল সকালেই।

.

কেন ও এখনি আমাকে বিয়ে করল না? ঘরে পৌঁছার পর লিওর প্রথম প্রশ্ন।

কারণ ও ভয় পেয়েছে, জবাব দিলাম আমি।

.

১৯.

বেশ কয়েকটা সপ্তাহ কেটে গেছে, বিশেষ কিছু ঘটেনি। আয়শার প্রতিশ্রুতি মতো সুখ পেয়েছি কিনা বলতে পারবে না। সুখের সংজ্ঞা আমার জানা নেই। তবে এটুকু বলতে পারি কোনো কিছুর অভাব বোধ করিনি এই কদিন। মন্দিরের যেখানে খুশি যখন ইচ্ছা যাওয়ার স্বাধীনতা তো আছেই, সেই সাথে পেয়েছি, এখনও পাচ্ছি, পূজারী-পূজারিনীদের অপরিমেয় আন্তরিক সম্মান, তার ওপর আছে আয়শার সাহচর্য। তিন বেলাই আয়শার সাথে আহার করি আমরা।

আয়শা কেন এখনি আমাকে বিয়ে করলো না, আমার অনন্তজীবন পাওয়ার ব্যাপারটা তো বিয়ের পরেও হতে পারতো?—এ প্রশ্নের জবাব এখনও পায়নি লিও। আর আমার প্রশ্ন, এই সে হেস বা আয়শা নামের মেয়েলোকটার চেয়ে হতভাগিনী কেউ কি জন্ম নিয়েছে পৃথিবীতে?

আরও কিছু প্রশ্ন ভীড় করে আছে আমার মাথার ভেতর। আয়শার ক্ষমতা আসলে কতটুকু? ও-কি সত্যিই নারী না অশরীরী আত্মা? কি করে কোর-এর গুহা থেকে ও বা ওর আত্মা এখানে—এই মধ্য এশিয়ার পাহাড় চূড়ায় এলো? শুধুই কি ওর আত্মা এখানে এসেছে, না শরীরও এসেছে? যদি শরীরও এসে থাকে তাহলে হেস-এর পূজারিনী সেই বৃদ্ধার মৃতদেহ কোথায় গেল? অবোস বলেছে, ওরা সকারের ব্যবস্থা করতে গিয়ে দেখে সিংহাসনে বসে আছে আয়শার কুৎসিত রূপ। তাহলে? পুরনো পূজারিনীর দেহ গেল কোথায়? আরও একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন—আয়শা যদি এতই ক্ষমতাশালী হয়, ও কেন আমাদের বা তার হারানো ক্যালিক্রেটিসকে খুঁজতে গেল না? কেন আমরাই তার কাছে আসবো আশা করে বসে রইলো? আতেন যে মিসরীয় আমেনার্তাসের পুনর্জন্ম নেয়া রূপ তা কি ও জানতো না? যদি জানতো তাহলে কেন আতেনকে পাঠিয়েছিলো আমাদের অভ্যর্থনা জানাতে? কেন নিজে যায়নি বা নিজের বিশ্বস্ত কাউকে পাঠায়নি? ধরে নিলাম পাহাড়ের কারও কানের সমভূমিতে পা রাখা বারণ, সেক্ষেত্রে ওর গুপ্তচররা যখন দুর্গম পাহাড়ী এলাকায় আড়ি পেতে আমাদের কথা শুনে এসে ওকে জানায় তখনি কেন ও অন্য পথে আমাদের এখানে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করলো না?

নানা ভাবে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ভেবেছি, জবাব পাইনি প্রশ্নগুলোর। আয়শাকে জিজ্ঞেস করেছি। ও হয় এড়িয়ে গেছে নয়তো ঘোরানো প্যাচানো কথার তোড়ে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে প্রশ্নগুলো কখনও কখনও সরাসরি বলেছে, এসব প্রশ্নের জবাব আমার কাছে জানতে চেয়ো না।

.

লিওকে নিয়ে দুশ্চিন্তার অন্ত নেই আয়শার। মা যেমন সন্তানকে আগলে রাখতে চায় ঠিক তেমন লিওকে সবসময় আগলে রাখতে চায় ও। তবু মাঝে মাঝে লিও বেরিয়ে যায় বাইরে, জংলীদের দু’একজন সর্দার বা পূজারী সঙ্গে থাকে। পাহাড়ী হরিণ, ভেড়া বা ছাগল শিকার করে ফেরে। যতক্ষণ লিও মন্দির এলাকার বাইরে থাকে ততক্ষণ দুশ্চিন্তায় ছটফট করতে থাকে আয়শা।

একদিনের কথা আমার মনে আছে। সেদিনও লিও শিকারে গেছে। আমি যাইনি। বাগানে বসে আছি আয়শার সাথে। দেখছি ওকে। হাতের ওপর মুখ রেখে বসে আছে ও। বড় বড় চোখগুলো তাকিয়ে আছে শূন্য দৃষ্টিতে। গভীর চিন্তায় মগ্ন হয়ে গেলেই কেবল মানুষের দৃষ্টি এমন হতে পারে।

হঠাৎ চমকে উঠে দাঁড়ালো আয়শা। পাহাড়ের এক দিকে মাইল মাইল দূরে ইশারা করে বললো-দেখ!

তাকালাম। কিন্তু সাদা তুষারের স্তর ছাড়া আর কিছুই দেখতে পেলাম না।

কানা কোথাকার, দেখছো না আমার প্রভু বিপদে পড়েছে? চিৎকার করে উঠলো ও। ওহহো, ভুলেই গেছিলাম, তুমি সাধারণ মানুষ, আমার মতো দেখার ক্ষমতা তোমার নেই। নাও আমি দিচ্ছি তোমাকে। আবার দেখ, বলে আমার। কপালের পাশে হাত রাখলো ও। মনে হলো, অদ্ভুত এক অবশ করে দেয়া স্রোত যেন বয়ে যাচ্ছে আমার মাথার ভেতর দিয়ে। দ্রুত বিড়বিড় করে কয়েকটা কথা বললো আয়শা।

মুহূর্তে চোখ খুলে গেল আমার। দেখলাম পাহাড়ের ঢালে একটা তুষার চিতাকে জাপটে ধরে গড়াগড়ি করছে লিও। অন্য শিকারীরা চারদিক থেকে ঘিরে ধরেছে ওদের। বল্লম উঁচিয়ে সুযোগ খুঁজছে চিতাটাকে গেঁথে ফেলার। কিন্তু সুযোগ পেলো না ওরা, তার আগেই লিও ওর হান্টিং নাইফটা আমূল ঢুকিয়ে দিলো চিতার পেটে, তারপর উপর দিকে হ্যাচকা এক টান। সঙ্গে সঙ্গে স্থির হয়ে গেল চিতাটা। উঠে দাঁড়ালো লিও। গর্বিত হাসি মুখে। যেন কিছুই হয়নি।

দৃশ্যটা যেমন হঠাৎ এসেছিলো তেমন হঠাৎই মিলিয়ে গেল। আমার কাঁধে হাত রেখে দাঁড়ালো আয়শা। অতি সাধারণ ভয় পাওয়া রমণীর মতো হাঁপাতে হাঁপাতে বললো– যাক, বাবা, বিপদ কেটে গেছে, কিন্তু আবার আসতে কতক্ষণ?

এরপরই ওর যত রাগ গিয়ে পড়লো লিওর শিকারসঙ্গী জংলী সর্দারের ওপর। তক্ষুণি ক্ষত সারানোর মলম আর পালকি বেহারা পাঠিয়ে দিলো লিওকে নিয়ে আসার জন্যে। আর বলে দিলো, সর্দার আর তার চেলাদেরও যেন ধরে আনা হয়।

.

চারঘণ্টা পর ফিরলো লিও, পালকির পেছনে, খোড়াতে খোড়াতে। সঙ্গী শিকারী দের কষ্ট বাঁচাতে একটা পাহাড়ী ভেড়া আর চিতার চামড়াটা পালকিতে দিয়ে হেঁটে এসেছে নিজে। আয়শা তার শোবার ঘরের পাশে বড় হলঘরটায় অপেক্ষা করছিলো। লিও ঢুকতেই এগিয়ে গেল। হারানো ছেলেকে খুঁজে পেলে মা যেমন করে তেমন আকুল গলায় সমানে দোষ দিয়ে গেল, পাশাপাশি উদ্বেগ প্রকাশ করলো। লিও চুপ করে শুনলো। তারপর জিজ্ঞেস করলো-তুমি জানলে কি করে এত কথা? চিতার চামড়াটাই তো তুমি এখনও দেখনি।

আমি জানি, বললো আয়শা। আমি দেখেছি। হাঁটুর উপরেই সবচেয়ে মারাত্মক জখম হয়েছে। মলম পাঠিয়েছিলাম, লাগিয়েছে?

না। কিন্তু তুমি মন্দির ছেড়ে বেরোওনি, এসব জানলে কি করে? যাদু?

যেভাবেই দেখি; দেখেছি, হলিও দেখেছে।

তোমার এই যাদু দেখতে দেখতে ক্লান্ত হয়ে গেলাম। এক ঘণ্টার জন্যেও কি আমি একটু একা—তোমার খবরদারী ছাড়া থাকতে পারবো না? এই সাহসী মানুষগুলো

এই সময় অবোস ঢুকে ফিসফিস করে কিছু বললো আয়শার কানে।

তোমার এইসব সাহসী মানুষদের সাথে আমি আলাপ করবো, বলে মুখের ওপর ঘোমটা টেনে দিয়ে বেরিয়ে গেল আয়শা। পাহাড়ীদের সামনে ও ঘোমটা ছাড়া যায় না।

কোথায় গেল ও, হোরেস? জানতে চাইলো লিও। মন্দিরে কোনো ক্রিয়া কর্ম করতে?

জানি না। তবে এটুকু বলতে পারি, যদি হয় তো ঐ বেচারা সর্দারের শেষক্রিয়া হতে পারে।

তাই? বলেই ছুটলো লিও আয়শার পেছন পেছন।

এক বা দুমিনিট পর মনে হলো, আমিও গেলেই বুদ্ধিমানের কাজ করবো।

মন্দিরে পৌঁছে দেখলাম, কৌতূহলোদ্দীপক এক দৃশ্যের অবতারণা হয়েছে সেখানে। প্রতিমার সামনে বসে আছে আয়শা। তার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে আছে। পাঁচ জংলী শিকারী আর তাদের সর্দার ভয়ে কাঁপছে সব কজন। এখনও বর্শাগুলো রয়েছে তাদের হাতে। ওদের পেছনে খোলা তলোয়ার হাতে দাঁড়িয়ে আছে বারোজন মন্দির রক্ষী। পাশে পড়ে আছে মরা চিতাটার চামড়া। কম্পিত গলায় সর্দার ব্যাখ্যা করে বোঝাচ্ছে কি করে জন্তুটা একটা বড় পাথরের আড়াল থেকে লাফিয়ে এসে পড়েছিলো প্রভু লিওর ওপর, ওদের কিছুই করার ছিলো না।

উঁহুঁ, বললো আয়শা, আমি সব জানি, তোরা নিজেদের প্রাণ বাঁচানোর। জন্যে কাপুরুষের মতো আমার প্রভুকে ঠেলে দিয়েছিলি হিংস্র জন্তুটার সামনে। মন্দির রক্ষীদের দিকে তাকালো আয়শা, যাও, পাহাড়ে ছেড়ে দিয়ে এসো এদের। আর ঘোষণা করে দাও, যে ওদের আশ্রয় বা আহার দেবে সে মরবে।

কোনোরকম দয়া ভিক্ষা করলো না, করুণা প্রার্থনা করলো না, ধীরে ধীরে উঠে মাথা ঝোকালো সর্দার আর তার সঙ্গীরা। তারপর ঘুরে দাঁড়ালো চলে যাওয়ার জন্যে।

একটু দাঁড়াও। বাধা দিলো ওদের লিও। সর্দার, আমাকে একটু ধরো।

হাঁটুর নিচে বেশ ব্যথা করছে, সাহায্য ছাড়া হাঁটতে পারবো না। আমাকে ফেলে কি শিকার করবে তোমরা?

কি করছো? চেঁচিয়ে উঠলো আয়শা। পাগল হয়েছো?

জানি না পাগল হয়েছি কিনা, তবে এটুকু জানি তুমি বড় পাজী মেয়েমানুষ, ন্যায়-অন্যায়ের কোনো বোধ নেই। এদের মতো সাহসী মানুষ আমি খুব কম দেখেছি। ঐ যে ও, এক জংলীর দিকে ইশারা করলো লিও, আমার নির্দেশে ও-ই প্রথমে এগিয়ে গিয়েছিলো চিতাটাকে মারার জন্যে। ও যখন পড়ে যায় তখন আমি এগিয়ে যাই। ওদের মতো সাহসী আর ভালো মানুষ হয় না, আর তুমি কিনা ওদের খামোকা হত্যা করার নির্দেশ দিচ্ছো! ওদের যদি মরতে হয় আমাকেও মরতে হবে। ওরা যা করার আমার নির্দেশেই করেছে।

বিস্ময়ের দৃষ্টিতে শিকারীরা তাকালো ওর দিকে। আর আয়শা, কয়েক মুহূর্ত চুপ করে কি যেন ভাবলো। তারপর বেশ চালাকের মতো বললো-সত্যি কথা বলতে কি, প্রিয়তম লিও, পুরো ঘটনাটাই আমি দেখেছি, যেটুকু দেখতে পাইনি, ওদের মুখে শুনেছি, এবং তারই ভিত্তিতে ওদের শাস্তি দিতে যাচ্ছিলাম। ঠিক আছে, তুমি যখন তা চাও না, ওদের মাফ করে দিচ্ছি। যা তোরা।

মাথা নুইয়ে বেরিয়ে গেল জংলী কজন। আয়শা উদ্বিগ্ন মুখে এগিয়ে গেল লিওর দিকে, কতখানি ব্যথা পেয়েছে না পেয়েছে এ সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করতে লাগলো। অরোসকে ডাকবে কিনা ক্ষতস্থান পরিষ্কার করার জন্যে জানতে চাইলো।

না, বললো লিও।

তাহলে আমিই পরিষ্কার করে দি, বললো আয়শা।

না। আমাকে নিয়ে দুর্ভাবনা না করলেও চলবে, আমাকে কি দুধের বাচ্চা পেয়েছো? শান্তভাবে কথাক’টা বললো, পর মুহূর্তে তীব্র রোষে ফেটে পড়লো লিও: ভেবেছো কি তুমি, হ্যাঁ, আমি যা পছন্দ করি না তোমার সেই যাদু দিয়ে আমার ওপর গোয়েন্দাগিরি চালাচ্ছো কেন? কেন ঐ নিরপরাধ ভালো মানুষগুলোকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করতে চাইছিলে? কেন আমি বাইরে বেরোলে আমার নিরাপত্তার ভার অন্যের ওপর দাও? তুমি কি ভাবো আমি নিজেকে রক্ষা করতে পারি না? বলো, জবাব দাও, আয়শা!

কিছুই জবাব দিলো না আয়শা। চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো শুধু। জলে থৈ থৈ করে উঠলো তার বিশাল দুচোখ। মুখ নিচু করতেই বৃষ্টির ফোঁটার মতো টপ টপ করে পড়লো মর্মরের মেঝেতে।

ভোজবাজির মতো একটা ব্যাপার ঘটলো এবার। লিও প্রায় ছুটে গিয়ে ধরলো আয়শাকে। করুণ কণ্ঠে ক্ষমা চাইতে লাগলো বার বার।

দুনিয়ার যে যা ইচ্ছে বলুক কিছু এসে যায় না, কিন্তু, লিও, তুমি যদি শক্ত কথা বলো আমি সইতে পারি না। ওহ, তুমি নিষ্ঠুর, তুমি নিষ্ঠুর। কেন আমি তোমাকে এমন আগলে রাখতে চাই, যদি বুঝতে প্রাণের আগুনের কাছে যাওয়ার আগেই যদি তুমি বিদায় নাও এ পৃথিবী থেকে, আমার অবস্থা কি হবে একবার ভাবো; কি করবো আমি তখন? বলো, লিও, একবার দুহাজার বছর অপেক্ষা করেছি, আবার বিশ বছর, এরপর কত বছর অপেক্ষা করবো?

যতদিন আমি তোমার মতো অনন্ত জীবন না পাচ্ছি ততদিন তো সে ভয় থাকবেই, বললো লিও, সুতরাং ও নিয়ে দুশ্চিন্তা না করাই কি ভালো নয়? দুশ্চিন্তা কোরো না, বললেই কি নিশ্চিন্তে থাকা যায়? বলে দ্রুত পায়ে চলে গেল আয়শা।

.

২০.

সারা দুনিয়ার ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখছে আয়শা। প্রতি সন্ধ্যায় খেতে বসে ও আলোচনা করে আমাদের অপার সম্ভাবনাময় ভবিষ্যতের কথা। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বর্তমান বিশ্ব, তার রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক পরিস্থিতি সম্পর্কে আমার কাছে জানতে চায়। আমি বলি। তারপরও পরিকল্পনা করে, কিভাবে বিভিন্ন দেশের ওপর শাসন প্রতিষ্ঠা করবে। ব্যপারটা ওর অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে। প্রতিটা দিন ঐ এক কথা। আমি ওকে কয়েকটা খসড়া মানচিত্র এঁকে দিয়েছি, যতটা সম্ভব ওতে চিহ্নিত করেছি পৃথিবীর দেশ ও মহাদেশগুলো। ওগুলোও নেড়ে চেড়ে দেখে ও। এখন যেখানে আছে সেখান থেকে কি করে ওসব দূরের দেশে পৌঁছুবে তার জল্পনা কল্পনা করে। এবং সব জল্পনার শেষে ঘোষণা করে। এসব সে করবে তার প্রভু লিওর জন্যে। লিওকে ও পৃথিবীর একচ্ছত্র অধিপতি বানাবে।

একদিন আমি জিজ্ঞেস করলাম, আচ্ছা, পৃথিবীর সব রাজা, রাষ্ট্রনায়কদের কিভাবে তুমি রাজি করাবে ক্ষমতা তোমার হাতে ছেড়ে দিতে? বললেই তো আর তারা তাদের মুকুটগুলো তোমার মাথায় পরিয়ে দেবে না।

ওহ! কি স্বল্প বুদ্ধি তোমার, হলি! মৃদু হেসে বললো আয়শা। জনগণ যখন স্বেচ্ছায় আমাদের বরণ করবে তখন রাজা বা রাষ্ট্রনায়করা বাধা দেবে কি করে? আমরা যখন ওদের মাঝে যাবো আমাদের জ্যোতির্ময় সৌন্দর্য আর অনন্ত পরমায়, নিয়ে এবং ওদের সব জাগতিক চাহিদা পূরণ করবো ওরা চিৎকার করে উঠবে না এসো আমাদের শাসন করো বলে?

হয়তো। সন্দেহের সুর আমার গলায়। কোথায় তুমি প্রথম আবির্ভূত হবে?

আমার আঁকা পূর্ব গোলার্ধের একটা মানচিত্র টেনে নিলো ও। পিকিং-এর উপর আঙুল রেখে বললো, প্রথমে এখানে কয়েক শতাব্দী বসবাস করবো আমরা-ধরো তিন বা পা বা সাত শতাব্দী। আশা করি এর ভেতর ওখানকার মানুষদের আমার মনের তো করে গড়ে নিতে পারবো। এই চীনাদের পছন্দ করেছি কেন জানো? তুমি বলেছো, ওরা সংখ্যায় অগুণতি, ওরা সাহসী, সহনশীল, বুদ্ধিমান। যদিও এখন সঠিক শিক্ষার অভাব আর কুশাসনের কারণে ক্ষমতাহীন, তবু আমার বিশ্বাস ওদের দিয়ে পূরণ হবে আমার উদ্দেশ্য। ওদেরকে জ্ঞান দেব, নতুন ধর্মবিশ্বাস দেবো। আর আমার হলি ওদের ভেতর থেকে বাছাই করা সব মানুষ নিয়ে গড়ে তুলবে অপরাজেয় এক সেনাবাহিনী। সেই সেনাবাহিনীর সহায়তায় সারা দুনিয়ার ওপর শাসন প্রতিষ্ঠিত করবো আমরা। আমার প্রভু লিও হবে পৃথিবীর সম্রাট।

.

আর একদিন সন্ধ্যার পর এই একই বিষয়ে আলাপ করছি আমরা। আলাপ ঠিক না, আয়শা বলে যাচ্ছে আমি আর লিও শুনছি। বলতে বলতে তন্ময় হয়ে গেছে আয়শা। ভবিষ্যতের কল্পনায় উজ্জ্বল দুচোখ। এই সময় অরোস ঢুকলো ঘরে। মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে সম্মান জানালো।

কি চাই, পূজারী? প্রশ্ন করলো আয়শা।

মহামহিমাময়ী হেসা, গুপ্তচররা ফিরে এসেছে।

তো আমি কি করবো? নিরাসক্ত ভঙ্গিতে বললো ও। কেন পাঠিয়েছিলে ওদের?

আপনি নির্দেশ দিয়েছিলেন তাই।

এতক্ষণে যেন সচেতন হলো আয়শা। বেশ, কি খবর এনেছে ওরা?

দুঃসংবাদ, হেস। কালুনের লোকেরা মরীয়া হয়ে উঠেছে। ওখানে এখন যে খরা চলছে তার জন্যে ওরা ওদের দেশের ওপর দিয়ে আসা বিদেশীদের দায়ী করছে। খানিয়া আতেনও প্রতিশোধ নেয়ার জন্যে পাগল হয়ে উঠেছে। দিন রাত পরিশ্রম করছে। এর ভেতরেই নাকি দুটো বিরাট বাহিনী প্রস্তুত করে ফেলেছে। একটা চল্লিশ হাজারের অন্যটা বিশ হাজারের। খানিয়া তার চাচা শামান সিমব্রির অধিনায়কত্বে বিশ হাজারি বাহিনীটা পাঠাবে পবিত্র মন্দির জয়ের উদ্দেশ্যে। কোনো কারণে যদি ঐ বাহিনী পরাজিত হয়, ও নিজে আসবে বড় বাহিনীটা নিয়ে।

খবর বটে যাহোক, তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বললো আয়শা। ও কি পাগল হয়ে গেছে। আমার বিরুদ্ধে লড়বে! হলি, আমি জানি আমাকে মনে মনে পাগল। ভাবো তোমরা, এবার দেখবে আসলে কে পাগল, আর আমি কি মিথ্যে বড়াই করি না, যা বলি তাই করি?

হঠাৎ কেমন যেন আনমনা হয়ে গেল আয়শা। চোখ দুটো দেখে মনে হয় এখানকার কিছু নয়, বহু দূরের কিছু দেখছে-সম্মোহিত হয়ে দেখছে।

মিনিট পাঁচেক একটানা একদিকে অমন তাকিয়ে রইলো ও। অখণ্ড নিস্তব্ধতা কামরায়। আমরা তাকিয়ে আছি ওর দিকে।

ঠিকই বলেছে তোমার গুপ্তচররা, অরোস, হঠাৎ বলে উঠলো আয়শা। এখন যত তাড়াতাড়ি আমি তৎপর হবো তত কম মরবে আমার মানুষ। প্রভু লিও, যুদ্ধ দেখবে? না, তোমার কোনো বিপদ ঘটুক তা আমি চাই না। তুমি এখানে মন্দিরের নিরাপদ আশ্রয়ে থাকবে। আমি যাবো আতেনের মোকাবেলার জন্যে।

তুমি যেখানে যাবে আমিও সেখানে যাবো, সাফ সাফ জানিয়ে দিলো লিও। না, না, আমার মিনতি শোনো, তুমি এখানেই থাকবে।

আবার সেই আগলে রাখার প্রবণতা। লাল হয়ে উঠলো লিওর মুখ, লজ্জায় না রাগে জানি না। কাটা কাটা গলায় বললো, আমি যা বলেছি তার নড়চড় হবে না।

তুমি যেখানে যাবে আমিও সেখানে যাবো।

হতাশ চোখে লিওর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো আয়শা। তারপর ফিরলো অরোসের দিকে।

যাও, পূজারী! সব কজন সর্দারকে জানিয়ে দাও হেস-এর নির্দেশ। আগামী চাঁদের শুরু যে রাতে সে রাতে ওরা যেন জড়ো হয়। না, সবাই না, বিশ হাজার হলেই চলবে। বাকিরা মন্দির পাহারা দেবে। বলে দেবে, বাছাই করে সেরা লোকগুলোকে যেন নেয়। আর পনেরো দিনের মতো খাবার যেন নিয়ে আসে সঙ্গে করে।

কুর্নিশ করে বিদায় নিলো পূজারী-প্রধান।

২১-২৪. দুদিন পর

২১.

দুদিন পর।

যুদ্ধের শুভফল কামনা করে বিশেষ এক পূজা অনুষ্ঠান হলো মন্দিরে। আমরা তাতে যোগ দিলাম না। তবে রাতে যথারীতি এক সাথে খেতে বসলাম। আয়শার মেজাজ মর্জির কোনো থই পেলাম না এ সময়। এই হাসি, পরমুহূর্তে খেপে উঠছে। বুঝতে পারছি কোনো কারণে বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে ওর মন।

জানো, বললো ও, আজ পাহাড়ের ঐ গর্দভগুলো কি করেছে? ওদের সর্দারদের পাঠিয়েছে হেসাকে জিজ্ঞেস করতে, কিভাবে যুদ্ধ হবে; শত্রুদের কাকে কাকে মারতে হবে, কাকে কাকে হবে না বা সম্মান দেখাতে হবে, ইত্যাদি ইত্যাদি। আমি-আমি কোনো জবাব দিতে পারলাম না। শেষমেশ কথার ফুলঝুরি ছুটিয়ে বুঝিয়ে দিলাম, যা ইচ্ছা করতে পারে ওরা। যুদ্ধ কি হবে ভালোই জানি। আমি নিজে পরিচালনা করবো। কিন্তু ভবিষ্যৎ-ওহ! যদি জানতে পারতাম! এই একটা ব্যাপারে আমার কোনো ক্ষমতা নেই। ভবিষ্যতের কথা ভাবলেই মনে হয়, কালো দেয়াল যেন আমার সামনে।

এরপর ঘাড় গুঁজে অনেকক্ষণ চুপ করে রইলো আয়শা। অবশেষে মুখ তুলে তাকালো লিওর দিকে।

আমার অনুরোধ রাখবে না তুমি? কয়েকটা দিন চুপচাপ থাকবে ন এখানে? না হয় কয়েকটা দিন শিকার করে এলে?, আমিও না হয় থাকবো তোমার সঙ্গে। হলি আর অবোসই পারবে যুদ্ধ পরিচালনা করতে।

না না না! সরোষে বললো লিও। আমার ধারণা আমাকে যুদ্ধে পাঠিয়ে ও নিরাপদ আশ্রয়ে রইবে-আয়শার এই প্রস্তাবে বিশেষভাবে খেপে গেছে লিও। কিছুতেই অমন কাজ আমার দ্বারা হবে না। যদি এখানে রেখে যাও ঠিকই আমি পথ খুঁজে নিয়ে যুদ্ধে যোগ দেবো।

বেশ, তুমিই তাহলে নেতৃত্ব দেবে যুদ্ধের।…না, না, তুমি না, প্রিয়তম, আমি–আমিই পরিচালনা করবো যুদ্ধ।

এরপর হঠাৎ করেই বাচ্চা মেয়ের মতো উজ্জ্বল হয়ে উঠলো আয়শা। কারণে অকারণে হাসতে লাগলো খিল খিল করে। সুদূর অতীতের অনেক গল্প শোনালো। সে যুগের দু’একটা কৌতুকও শোনালো। অবশেষে ব্যক্তিগত প্রসঙ্গে এলো সে। কিভাবে সত্যের সন্ধান করেছে, জ্ঞানের অন্বেষণে ঘুরে বেড়িয়েছে দেশে দেশে; সে যুগে প্রচলিত ধর্মবিশ্বাসগুলো বিশ্লেষণ করেছে এবং প্রত্যাখ্যান করেছে; তারপর নিজের মতো করে একটা ধর্মবিশ্বাস গড়ে তুলে তা প্রচার করেছে। জেরুজালেমে ওই ধর্মমত প্রচার করার সময় লোকেরা ওর গায়ে পাথর ছুঁড়ে মেরেছিলো। তখন ও নিজের দেশ আরবে ফিরে যায়। সেখানেও প্রত্যাখ্যাত হয়। অবশেষে চলে আসে মিশরে। মিশরের ফারাও-এর রাসভায় তখনকার সেরা এক যাদুকরের সাথে সাক্ষাৎ হয়। তার সব কৌশল ও শিখে নেয়, এবং শিগগিরই বেচারাকে ওর তাঁবেদার বানিয়ে ফেলে।

এরপর মিশর থেকে কোর-এ চলে এলো আয়শার গল্প। এবং এই সময় অবোসও হাজির হলো কামরায়। কুর্নিশ করে দাঁড়ালো।

উহ, তোমার জন্যে একটা ঘণ্টাও কি শান্তিতে কাটাতে পারবো না? বিরক্তকণ্ঠে বললো আয়শা। কি চাই?

ও হেস, খানিয়া আতেনের কাছ থেকে একটা লিপি এসেছে।

খুলে পড়ো, আদেশ করলো আয়শা, তারপর আপন মনেই বলতে লাগলো, আর কি লিখবে? অনুতাপ হয়েছে মনে, ক্ষমা চাই, আর কি?

অরোস, পড়তে শুরু করলো-শৈল চূড়ার মন্দিরের হেসা, যিনি পৃথিবীতে আয়শা নামে পরিচিত এবং পৃথিবীর ওপরে যখন সুযোগ পান খসে পড়া তারা-র মতো ঘুরে বেড়ান—

.

বাহ! চমৎকার সম্বোধন, বলে উঠলো আয়শা, কিন্তু, আতেন, খসে পড়া তারা আবার উঠবে, পাতাল ফুঁড়ে উঠলেও উঠবে। পড়ো, অরোস।

.

শুভেচ্ছা, ও আয়শা। আপনি প্রাচীন, অনেক জ্ঞান সঞ্চয় করেছেন বিগত শতাব্দীগুলোয়। সেই সঙ্গে এমন ক্ষমতাও অর্জন করেছেন যার বলে মানুষকে মোহাবিষ্ট করে তাদের চোখে আপনি সুন্দর বলে প্রতীয়মান হন। তবে একটা জ্ঞানের বা ক্ষমতার অভাব রয়েছে আপনার। তা হচ্ছে এখনও যা ঘটেনি তা দেখার বা জানার ক্ষমতা। শুনুন, ও আয়শা, আমি এবং আমার মহাজ্ঞানী পিতৃব্য আসন্ন যুদ্ধের ফলাফল কি হবে জানার আশায় সব স্বর্গীয় পুস্তকাদি ঘেঁটে দেখেছি।

লেখা আছে: আমার জন্যে মৃত্যু, তাতে আমার কোনো দুঃখ নেই, বরং বলতে পারেন সানন্দচিত্তে আমি বরণ করবো এই নিয়তি। আপনার জন্যে নির্ধারিত আছে আপনার নিজের হাতে তৈরি একটি বর্শা। আর কালুনের ভাগ্যে রক্তপাত আর ধ্বংস যার জননী আপনি।

আতেন,

কালুনের খানিয়া।

.

নিঃশব্দে শুনলো আয়শা। এক বিন্দু কাঁপলো না ওর ঠোঁট বা বিবর্ণ হলো না মুখ। গর্বিত ভাবে অরোসকে বললো-আতেনের দূতকে জানিয়ে দাও, আমি বার্তা পেয়েছি, জবাব দেবো কালুনের রাজপ্রাসাদে গিয়ে। এবার যাও, পূজারী, আর বিরক্ত কোরো না আমাকে।

.

পরদিন দুপরে আমরা রওনা হলাম। পাহাড়ী ঢাল বেয়ে নেমে চলেছি উপজাতীয় সেনাবাহিনী নিয়ে। হিংস্র, বুনো চেহারার মানুষ সব। অগ্রবর্তী সৈনিকরা সামনে, তারপর অশ্বারোহী বাহিনী; তাদের ডানে, বামে এবং পেছনে পদাতিকরা। বিভিন্ন দলে ভাগ হয়ে এগিয়ে চলেছে। প্রতিটা দলের নেতৃত্ব দিচ্ছে একেকজন গোত্রপতি অর্থাৎ সর্দার।

অত্যন্ত বেগবান এবং সুদর্শন একটি সাদা মাদী ঘোড়ার পিঠে চেপে চলেছে আয়শা। ঘোড়সওয়ার বাহিনীর মাঝামাঝি জায়গায় রয়েছে ও। ওর পাশে লিও আর আমি। লিও খান র‍্যাসেনের কালো ঘোড়ায় আর আমি অমনই আরেকটা ঘোড়ার পিঠে বসে আছি। আমাদেরকে ঘিরে থেকে এগোচ্ছে সশস্ত্র পূজারী আর বাছাই করা যোদ্ধাদের একটা দল।

সবার মন বেশ প্রফুল্প। শেষ শরতের না শীত না গরম আবহাওয়া। উজ্জ্বল সূর্যালোকে হাসছে প্রকৃতি। যত ভয় বা শঙ্কা-ই থাক এমন পরিবেশে আপনিই মন ভালো হয়ে ওঠে। তার ওপর হাজার হাজার সশস্ত্র সঙ্গীর সাহচর্য আর আসন্ন যুদ্ধের কল্পনায় উত্তেজিত হয়ে আছে স্নায়ু। আমার চেয়ে লিও আরও বেশি উৎফুল্ল। বহুদিন ওকে এত প্রাণোচ্ছল দেখিনি। আয়শাও উৎফুল্ল।

ওহ! কতদিন! বললো আয়শা। কতদিন পর পাহাড়ের ঐ কন্দর ছেড়ে বেরোলাম! মুক্ত পৃথিবীর মাঝে এসে কি যে আনন্দ আজ লাগছে! দূরের ঐ চূড়ায় দেখ, তুষার জমে আছে, কি সুন্দর! নিচে পাহাড়ী ঢলের দিকে তাকাও, তার ওপাশে সবুজ মাঠ! সূর্য! বাতাস! আহ কি মিষ্টি!

বিশ্বাস করো, লিও, বিশ শতাব্দীরও বেশি হয়ে গেছে, শেষবার আমি ঘোড়ায় চড়েছি, কিন্তু দেখ, এখনও ভুলিনি ঘোড়ায় চড়ার কায়দা কৌশল। তবে যা-ই বলো, আরবী ঘোড়ার তুলনায় এগুলো কিছু না। ওহ! আমার মনে আছে, বেদুঈনদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে বাবার পাশে পাশে ঘোড়া ছুটিয়ে গিয়েছিলাম। আমার বাবা মহান এক মানুষ ছিলেন, অন্য একদিন বলবো তার কথা।

ঐ দেখ সেই গিরিখাত। ওর ওপাশে থাকতো সেই বিড়াল উপাসক। পুরোহিত, আরেকটু হলেই তোমরা যার লোকদের হাতে মরতে বসেছিলে। একেক সময় আমার আশ্চর্য লাগে, এই বিড়াল পূজার ব্যাপারটা এখানে চালু হলো কি করে! সম্ভবত আলেকজাণ্ডারের সেনাপতি প্রথম রাসেনের সঙ্গে মিসর থেকে এসেছিলো ঐ প্রথা। অবশ্য র‍্যাসেনকে পুরোপুরি দোষ দেয়া যায় না। ও বিড়াল উপাসক ছিলো না, ওর সঙ্গে যে সব ধর্মগুরু এসেছিলো তাদের কেউ গোপনে বিড়াল পূজা করতো। এক সময় সুযোগ বুঝে ব্যাটা জংলীদের ভেতর চালু করে দেয় তার আসল বিশ্বাস। সেরকমই মনে পড়ছে আমার। এই মন্দিরের প্রথম হেসা ছিলাম আমি তা জানো? র‍্যাসেনের সঙ্গে এসেছিলাম।

বিস্মিত চোখে আয়শার দিকে তাকালাম আমি আর লিও।

কি বিশ্বাস হলো না তো? বললো ও। তুমি, হলি, তোমার মতো সন্দেহবাতিকগ্রস্ত মানুষ আমি দেখিনি। ভাবছো আলেকজান্ডারের সময় আমি এখানে এলাম কি করে, আর যদি এসেই থাকি তাহলে আবার কোর-এ গেলাম কি করে? শোনো, সেটা আমার এ জীবনের কথা নয়, আগের জন্মের কথা। মেসিডোনিয়ার আলেকজাণ্ডার আর আমি একই গ্রীষ্মে জন্ম নিয়েছিলাম। ওকে ভালোভাবে চিনতাম, যুদ্ধবিগ্রহের ব্যাপারে আমি ছিলাম ওর প্রধান মন্ত্রণাদাতা। পরে আমাদের ভেতর ঝগড়া হয়। র‍্যাসেনকে নিয়ে চলে আসি আমি। সেদিন থেকেই আলেকজাণ্ডার নামক নক্ষত্রের উজ্জ্বলতা মলিন হতে শুরু করে।

আগের জীবনে কি কি ঘটেছে, কি কি করেছে স্পষ্ট মনে আছে তোমার? আমি জিজ্ঞেস করলাম।

না। টুকরো টুকরো কিছু স্মৃতি কেবল আছে। গোপন সাধনা—তোমরা যাকে বলো যাদু-তার মাধ্যমে পরে মনে করেছি, তা-ও সম্পূর্ণ পারিনি। যেমন ধরো, হলি, আমার মনে পড়ে তোমার কথা। নোংরা কাপড়চোপড় পরা কুৎসিত এক দার্শনিককে আমি দেখেছিলাম। আলেকজাণ্ডারের সঙ্গে গোলমাল বাধিয়েছিল লোকটা। আলেকজাণ্ডার তাকে হত্যা করেছিলো অথবা ডুবিয়ে মেরেছিলো—ঠিক মনে নেই।

নিশ্চয়ই ডায়োজেনেস নামে ডাকা হতো না আমাকে?

না, ডায়োজেনেস আরও বিখ্যাত লোক ছিলো। কিন্তু ও কি! সামনের ওরা আক্রান্ত হয়েছে মনে হচ্ছে!

আয়শার কথা শেষ হতে না হতেই দূর থেকে ভেসে এলো চিৎকার, কোলাহলের শব্দ। এবং সঙ্গে সঙ্গে দেখতে পেলাম দীর্ঘ এক অশ্বারোহীর সারি ছত্রভঙ্গ হয়ে পিছিয়ে যাচ্ছে। একটু পরেই অগ্রবর্তী বাহিনীর কয়েকজন সৈনিক এক বন্দীকে নিয়ে হাজির হলো আমাদের কাছে। তারা জানালো, নিছক একটু খোঁচা দেয়ার জন্যে এগিয়ে এসেছিলো আতেনের বাহিনীটা। ঝড়ের বেগে এসে পড়ে ওদের ওপর, তারপরই পিছিয়ে গেছে আবার। এই অদ্ভুত আক্রমণের কারণটা বোধগম্য হলো না আমাদের। তবে একটু পরেই আটক লোকটাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে জানা গেল, পবিত্র পাহাড়ের ওপর যুদ্ধ করার কোনো ইচ্ছা নেই খানিয়ার। আমরা যতক্ষণ না নদীর ওপারে পৌঁছুচ্ছি ততক্ষণ ঠায় অপেক্ষা করার নির্দেশ দিয়েছে সে চাচা সিমব্রিকে। আমরা যাতে অবশ্যই নদী অতিক্রম করি সেজন্যে একটু উস্কানি দিলো সিমব্রি এই আক্রমণের মাধ্যমে।

সুতরাং সেদিন কোনো যুদ্ধ হলো না।

সারা বিকেল আমরা পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে চললাম! সূর্যাস্তের সামান্য আগে পৌঁছুলাম এক প্রশস্ত ঢালু জায়গায়। ঢালটা শেষ হয়েছে পাহাড়ে ওঠার দিন যেখানে আমরা নরকঙ্কাল ছড়িয়ে থাকতে দেখেছিলাম, যেখানে সাক্ষাৎ হয়েছিলো রহস্যময়ী পথ-প্রদর্শকের সঙ্গে সেই উপত্যকার প্রান্তে। এখানে রাতের মতো ছাউনি ফেলা হলো।

অশ্বারোহী আর পদাতিকদের এখানে রেখে। আয়শার সঙ্গে আমরা বাঁয়ে মোড় নিয়ে এগিয়ে গেলাম কয়েকটা ছোট ছোট চূড়ার দিকে। সেগুলোর ওপাশে একটা সুড়ঙ্গ মতো। মশাল জ্বেলে আমরা এগিয়ে চললাম অন্ধকার সুড়ঙ্গের ভেতর দিয়ে। অবশেষে পৌঁছুলাম ওপাশে। এখানেই রাত কাটাবো আমরা। সুড়ঙ্গের মুখে প্রহরী থাকবে, নিরাপদে ঘুমাতে কোনো অসুবিধা হবে না।

আয়শার জন্যে একটা তাবু খাটানো হলো। একটাই মাত্র তাবু ছিলো সঙ্গে, সুতরাং আমি আর লিও শখানেক গজ দূরে কয়েকটা পাথরের আড়ালে আশ্রয় নিলাম। কয়েকজন প্রহরী রইলো আমাদের সঙ্গে। এ অবস্থা দেখে ভীষণ রেগে গেল আয়শা। খাদ্য এবং সাজসরঞ্জামের দায়িত্ব যে সর্দারের ওপর তাকে ডেকে বকাঝকা করলো। বোকার মতো মুখ করে শুনলো বেচারা। তবু জিনিসটা কি তা-ই জানে না, তো ব্যবস্থা করবে কি?

অরোসকেও ধমকালো আয়শা। বিনীতভাবে পূজারীপ্রধান জবাব দিলো, সে ভেবেছিলো আমরা যুদ্ধের কঠোর কষ্ট সম্পর্কে ওয়াকেবহাল এবং অভ্যস্ত। শেষ পর্যন্ত নিজের ওপরই রাগ দেখাতে লাগলো আয়শা। বার বার বলতে লাগলো কেন আমি খেয়াল করলাম না খুঁটিনাটি বিষয়গুলো? শেষে যোগ করলো, তাহলে তোমরা তাঁবুতে ঘুমাও, আমি বাইরে থাকি। এখানকার ঠাণ্ডায় আমি অভ্যস্ত।

লিও হেসে উড়িয়ে দিলো ওর কথা। এরপর খোলা আকাশের নিচে বসে খেয়ে নিলাম আমরা-আমি আর লিও আশেপাশে প্রহরীরা থাকায় আয়শা ঘোমটাই খুললো না। ফলে আমাদের সুখেতে পারলো না। পরে তাঁবুতে ঢুকে খেয়েছিলো কিনা জানি না।

খাওয়ার পর আমরা আর দেরি না করে শুতে চলে গেলাম। আয়শাও ঢুকলো। ওর তাঁবুতে। প্রহরীরা ছাড়াও সুড়ঙ্গের ওপাশে রয়েছে পুরো বাহিনী। সুতরাং শোয়ার প্রায় সাথে সাথে নিশ্চিন্ত মনে ঘুমিয়ে পড়লাম দুজন।

.

দূর থেকে ভেসে আসা চিৎকারে ঘুম ভেঙে গেল আমার। মনে হলো কোনো প্রহরী কারও পরিচয় জিজ্ঞেস করলো। এক মুহূর্ত পরে শুনতে পেলাম আমাদের প্রহরীরে দলনেতার জবাব। কি একটা প্রশ্নও করলো সে। উল্টোদিক থেকে আরেকটা। জবাব ভেসে এলো। কয়েক সেকেণ্ডের নীরবতা। তারপর একজন পূজারী কুর্নিশ করে এসে দাঁড়ালো আমার সামনে। মশাল তার হাতে। লোকটার চেহারা চেনা চেনা মনে হলো।

আমি– একটা নাম বললো সে, এখন আর নামটা মনে নেই আমার। পূজারী প্রধান অরোস আমাকে পাঠিয়েছেন। উনি বললেন, হেসা এক্ষুণি আপনাদের দুজনের সাথে আলাপ করতে চান।

ইতিমধ্যে হাই তুলতে তুলতে উঠে বসেছে লিও। ব্যাপার কি, জিজ্ঞেস করলো। আমি বললাম।

সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করলেই পারতো, বললো ও। যাক, ডেকেছে যখন যেতে হবে। চলো, হোরেস।

আবার কুর্নিশ করলো পূজারী। আপনাদের অস্ত্র আর রক্ষীদেরও নিয়ে যেতে বলেছেন হেসা।

কি! বিস্ময় প্রকাশ করলো লিও। নিজেদের সেনাবাহিনীর মাঝখানে থেকে একশো গজ যাবো তাতে আবার রক্ষী লাগবে!

হেসা তার তাবু ছেড়ে বেরিয়ে গেছেন, ব্যাখ্যা করলো নোকটা। গিরিখাতের মুখে আছেন এখন। কোন দিক দিয়ে বাহিনী নিয়ে গেলে সুবিধা হবে, পর্যবেক্ষণ করছেন।

তুমি কি করে জানলে এত কথা? আমি জিজ্ঞেস করলাম।

অবোস বলেছেন। হেসা ওখানে একা আছেন তাই রক্ষীদের নিয়ে যেতে বলেছেন।

পাগল নাকি ও? বললো লিও। এই মাঝাত্তিরে অমন জায়গায় গেছে, তাও আবার একা! হ্যাঁ, ওর পক্ষেই সম্ভব এমন অর কাজ।

আমারও মনে হলো, এমন অসম্ভব কাজ ওর পক্ষেই সম্ভব। তবু ইতস্তত করতে লাগলাম। অবশেষে আধা ইচ্ছায় আধা অনিচ্ছায় রওনা হলাম দূতের পেছন পেছন। আমাদের তলোয়ার, বর্শা নিয়ে নিলাম। রক্ষীদেরও ডেকে নিলাম। মোট বারো জন। একটা কথা ভেবে নিশ্চিন্ত বোধ করলাম, এর ভেতর কোনো কৌশল থাকলে রক্ষীদের নিয়ে যেতে বলা হতো না।

পথে দুজায়গায় প্রহরীরা থামালো আমাদের। সংকেত শব্দ বলতেই ছেড়ে দিলো। আমাদের যারা চিনতে পারলে তাদের মুখে বিস্ময়ের ছাপ পড়তে দেখলাম। ওরা কি কিছু সন্দেহ করছে? বুঝতে পারলাম না।

গিরিখাতের ধার দিয়ে নেমে চললাম আমরা। বেশ ঢালু পথ। তাল রাখতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। কিন্তু আমাদের পথ-প্রদর্শক পূজারী অনায়াসে নেমে চলেছে, যেন নিজের বাড়ির বাঁধানো সিঁড়ি বেয়ে নামছে।

রাত দুপুরে এমন অদ্ভুত জায়গায়! সন্দেহের সুর লিওর গলায়। রক্ষীদের দলনেতাও কিছু একটা বিড়বিড় করলো। আমি বোঝার চেষ্টা করছি ও কি বললো, এই সময় গিরিখাতের নিচে অস্পষ্ট সাদা একটা অবয়ব দেখতে পেলাম। আয়শার মুখ ঢাকা মূর্তিই মনে হলো।

হেস! হেস! বলে উঠলো রক্ষী দলনেতা। স্বস্তির ভাব তার কণ্ঠস্বরে।

দেখ ওকে, বললো লিও, এই ভয়ঙ্কর জায়গায় কেমন ঘুরে বেড়াচ্ছে, যেন হাইড পার্কে বেড়াতে এসেছে। বলেই ছুটে গেল ও আয়শার দিকে।

ঘুরে আমার দিকে তাকালো মূর্তি। পেছন পেছন যাওয়ার ইশারা করে হাঁটতে শুরু করলো।

কঙ্কাল ছাওয়া উপত্যকায় পৌঁছলাম। না থেমে এগিয়ে চললো আয়শা। কিছুদূর গিয়ে নিচু একটা চূড়ার কাছে থামলো। সেখানেও চারপাশে ছড়িয়ে আছে অসংখ্য কঙ্কাল। আমাদের পথপ্রদর্শক পুরোহিত দাঁড়িয়ে পড়লো রক্ষীদের নিয়ে–হেসার নির্দেশ ছাড়া তার কাছাকাছি যাওয়া বারণ। আমি এগিয়ে গেলাম। লিও সাত আট গজ সামনে। ওকে বলতে শুনলাম- এই রাতে এমন জায়গায় কি জন্যে এসেছে, আয়শা? বিপদ ঘটতে কতক্ষণ?

জবাব দিলো না আয়শা। হাত দুপাশে ছড়িয়ে দিয়ে আবার নামিয়ে আনলো। বিস্মিত হয়ে আমি ভাবছি, এটা কোনো সংকেত কিনা? হলে কিসের? এমন সময় অদ্ভুত এক আওয়াজ উঠলো চারপাশ থেকে। অনেক লোক যেন হুটোপুটি করছে।

ভুরু কুঁচকে তাকাতেই দেখলাম, ছড়িয়ে থাকা কঙ্কালগুলো উঠে দাঁড়িয়েছে। প্রত্যেকের হাতে বল্লম। চারপাশ থেকে ঘিরে ফেলে এগিয়ে আসছে আমাদের দিকে।

ভূত বিশ্বাস করি না আমি। জানি আয়শার কোনো কৌশল এটা, তা ছাড়া এমন হতে পারে না। তবু এতগুলো কঙ্কালকে আচমকা দাঁড়িয়ে পড়তে দেখে সত্যি ভূত দেখার মতোই চমকে উঠলাম। শিরশির একটা অনুভূতি হলো শরীর জুড়ে।

এ আবার কোন্ ধরনের পৈশাচিকতা? ভয় আর রাগ মেশানো স্বরে চেঁচিয়ে উঠলো লিও।

এবারও কোনো জবাব দিলো না সাদা আলখাল্লা পরা মৃর্তি। পেছনে শব্দ শুনে ঘাড় ফিরিয়ে তাকালাম। আমাদের রক্ষীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে কাল। বাহিনী।:কঙ্কালগুলোকে দাঁড়িয়ে পড়তে দেখেই ভয়ে আধমরা হয়ে গিয়েছিলো জংলীগুলো। বাধা দেয়ার কথা বোধ হয় মনেও পড়েনি বেচারাদের। এক এক করে সব কজনকে বল্পমে গেঁথে ফেললো শত্র: লিওর দিকে বল্লম উঁচিয়ে গেল এক কঙ্কাল। ঘোমটা টানা মৃর্তি হাত উঁচু করলো।

উঁহুঁ, ওকে বন্দী করো! আমার নির্দেশ, ওর যেন কোনো ক্ষতি না হয়।

কণ্ঠস্বরটা আমার চেনা। কালুনের খানিয়া আতেনের।

ষড়যন্ত্র! চিৎকার করতে চাইলাম আমি; পারলাম না। তার আগেই জ্ঞান হারালাম মাথায় শক্ত, ভারি কিছুর আঘাতে।

.

২২.

যখন জ্ঞান ফিরলো তখন দিন হয়ে গেছে। মাথায় অসহ্য যন্ত্রণা। অরোসের শান্ত মুখটা ঝুঁকে আছে আমার ওপর। আমাকে চোখ মেলতে দেখেই খানিকটা তরল পদার্থ ঢেলে দিলো আমার গলায়। সাথে সাথে আশ্চর্য প্রতিক্রিয়া হলো আমার ভেতরে। মনের ওপর জমে থাকা ঘষা কাচের মতো একটা পর্দা যেন গলে যেতে লাগলো। যন্ত্রণা দূর হয়ে গেল কয়েক সেকেন্দ্রে ভেতর। তারপর দেখলাম আয়শাকে। অরোসের পাশে দাঁড়িয়ে আছে।

কি সর্বনেশে কাণ্ড! তুমি বেঁচে আছে, আমার প্রভু লিও কোথায়? চিৎকার করলো ও। বলো কোথায় লুকিয়ে রেখেছো আমার প্রভুকে? বলো—না হলে মরবে!

হিমবাহের তুষারে যখন ডুবে মরতে বসেছিলাম তখন জ্ঞান হারানোর আগে এই দৃশ্যটাই দেখেছিলাম, এই কথাগুলোই জিজ্ঞেস করেছিলো আয়শা।

আতেন নিয়ে গেছে ওকে।

তোমাকে জীবিত রেখে ওকে নিয়ে গেছে আতেন!

আমার ওপর রাগ দেখিও না। আমার কোনো দোষ নেই।

এরপর আমি সংক্ষেপে বর্ণনা করলাম রাতের ঘটনা।

নিঃশব্দে শুনলো আয়শা। ধীর পায়ে এগিয়ে গেল নিহত রক্ষীদের দিকে। গম্ভীর মুখে দেখলো কিছুক্ষণ।

আচ্ছা! তাই তো ভেবে পাচ্ছিলাম না, ওরা মরলো কিভাবে? অবশেষে সে বললো। তারপর এগিয়ে গেল আরেকটু-যে জায়গা থেকে লিওকে বন্দী করা হয়েছিলো সেখানে। ভাঙা একটা তলোয়ার পড়ে আছে। জিনিসটা খান রাসেনের। র‍্যাসেন মারা যাওয়ার পর ওটা লিওর সম্পত্তিতে পরিণত হয়। তলোয়ারটার পাশে দুটো মৃতদেহ। কালো আঁটো পোশাক তাদের পরনে। মাথা এবং মুখ খড়িমাটি দিয়ে সাদা করা। হাত, পা এবং বুকেও খড়িমাটির দাগ দিয়ে কঙ্কালের চেহারা দেয়া হয়েছে।

ভালোই ফন্দি এঁটেছিলো আতেন, দাঁতে দাঁত চেপে বললো আয়শা। কিন্তু, হলি, আমার প্রভু কি আঘাত পেয়েছে?

খুব একটা না। জ্ঞান হারানোর আগ মুহূর্তে দেখেছিলাম, ওই দুজনের সঙ্গে লড়ছে। মুখ থেকে বোধহয় একটু রক্তও পড়তে দেখেছিলাম। আর কিছু মনে নেই।

প্রতি বিন্দুর জন্যে একশোটা করে জীবন নেব। আমি শপথ করে বলছি, হলি।

ইতিমধ্যে শিবির ভেঙে কঙ্কাল উপত্যকায় জড়ো হতে শুরু করেছে উপজাতীয় সেনাবাহিনী। পাঁচ হাজার সৈনিকের অশ্বারোহী বাহিনীও এসে গেছে। সবগুলো দলের সর্দারকে ডেকে পাঠালো আয়শা। ভাষণ দিলো ও ওদের উদ্দেশ্যে।

হেস-এর ভৃত্যরা, শুরু করলো আয়শা, তোমাদের প্রভু, আমার অতিথি এবং হবু স্বামী লিওকে কৌশলে বন্দী করে নিয়ে গেছে খানিয়া আতেন ও তার লোকজন। যতদূর অনুমান করতে পারছি, ওঁকে জিম্মি হিসেবে আটক রাখবে। আমার ধারণা খুব বেশি দূর যেতে পারেনি ওরা আমাদের প্রভুকে নিয়ে। সুতরাং এই মুহূর্তে রওনা হতে হবে আমাদের। ঝড়ের বেগে নদী পেরিয়ে আমরা আক্রমণ করবো খানিয়ার বাহিনীকে। আজ রাতে আমি কালুনে ঘুমাতে চাই। কি বলো, অরোস, দ্বিতীয় এবং আরও বড় একটা কাহিনী থাকবে নগর প্রাচীর রক্ষা করার জন্যে? থাকুক, প্রয়োজন হলে ঐ কাহিনীও আমি ধ্বংস করে দেবো, মিশিয়ে দেবো বাতাসের সঙ্গে। না, অবাক হওয়ার কিছু নেই। ধরে নাও ওর মারা গেছে।

ঘোড়সওয়াররা, আমার পেছন পেছন এসো। পদাতিকরা, তোমরা এগিয়ে যাবে আমাদের দুপাশ দিয়ে। যে পিছু হটবে বা এগোতে ভয় পাবে তার জন্যে অপেক্ষা করছে মৃত্যু। আর অকার সম্পদ ও সম্মান, যারা সাহসের সঙ্গে এগিয়ে যাবে তাদের জন্যে। হ্যাঁ, আমি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, কালুনের উর্বরা জমি তোমাদের হবে। এবার যাও, প্রত্যেকে যার যার দল প্রস্তুত করে নাও। এক্ষুণি রওনা হবো আমরা।

উৎফুল্ল কণ্ঠে সমস্বরে চিৎকার করে উঠলো সর্দাররা। হিংস্র জাতি ওরা, পুরুষানুক্রমে যুদ্ধপ্রিয়, তার ওপর হেসার প্রতিশ্রুতি সম্পদ ও সম্মান প্রদানের। উফুল্ল হওয়ারই কথা।

প্রায় এক ঘণ্টা ঢাল বেয়ে নামার পর জলাভূমির কাছে পৌঁছুলো সেনাবাহিনী। সামনে কোনো প্রতিবন্ধক দেয়া গেল না, যদিও সবাই মনে মনে আশা করছিলো, ছোট বা বড় যা-ই হোক না কেন, বানিয়ার কোনো বাহিনী থাকবে এখানে। নেই দেখে আমাদের সেনাপতিরা হতাশ হলো না খুশি হলো বুঝতে পারলাম না।

কিছুক্ষণ পর নদী তীরে পৌঁছুলাম আমরা। এবার দেখা গেল খানিয়ার সৈনিকদের। ওপারে দীর্ঘ সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে। নদীর মাঝখানেও দেখলাম, কয়েকশো কালুন সেনা। বল্লম উঁচিয়ে অপেক্ষা করছে। কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে রইলো আমাদের সৈনিকরা। তারপর প্রচণ্ড বুনো উল্লাসে চিৎকার করে ঝাঁপিয়ে পড়লো নদীতে। অশ্বারোহীরা নড়লো না। অপেক্ষা করতে লাগলো পদাতিকদের কি অবস্থা হয় দেখার জন্যে। কয়েক মিনিট মাত্র লাগলো নদীর মাঝের শত্রুদের ছত্রভঙ্গ করে দিতে। প্রাণ ভয়ে হাচড়ে পাচড়ে পাড়ে উঠতে লাগলো তারা। ধাওয়া করে গেল আমাদের সৈনিকরা। এই সময় অরোস এসে জানালো, এক গুপ্তচর এই মাত্র খবর নিয়ে এসেছে, সে লিওকে হাত পা বাঁধা অবস্থায় একটা দুই চাকাওয়ালা ঘোড়ায় টানা গাড়িতে দেখেছে। আতেন, সিমব্রি আর এক রক্ষীও ছিলো সঙ্গে। পূর্ণ বেগে কালুনের দিকে ছুটে চলেছে তারা।

ইতিমধ্যে আমাদের কিছু সৈনিক নদীর অপর পাড়ে উঠতে পেরেছে। শত্রু সেনারা ধেয়ে এলো ওদের দিকে। কয়েক মিনিট লড়ে পিছিয়ে আসতে বাধ্য হলো আমাদের সৈনিকরা। পর পর তিনবার এমন পিছিয়ে আসতে হলো ওদের। ক্ষয় ক্ষতিও কম হলো না। অধীর হয়ে উঠলো আয়শা।

ওদের নেতা দরকার, বললো ও, আমি নেতৃত্ব দেবো। এসো আমার সাথে, হলি, বলেই ঘোড়া ছুটিয়ে দিলো আয়শা। ঘোড়সওয়ার বাহিনীর মূল অংশটা অনুসরণ করলো ওকে। মহা উল্লাসে চিৎকার করতে করতে ঝাঁপিয়ে পড়লো নদীতে। শত সহস্র তীর বল্লম ছুটে আসতে লাগলো শত্রুর দিক থেকে। ডানে বাঁয়ে আমাদের অনেক ঘোড়া এবং আরোহীকে লুটিয়ে পড়তে দেখলাম। কিন্তু আমার বা এক কি দুগজ সামনে সাদা আলখাল্লা মোড়া আয়শার গা স্পর্শ করলো না একটাও। পাঁচ মিনিটের মাথায় নদীর অপর পাড় দখল করে নিলাম আমরা। এবার শুরু হলো আসল লড়াই।

একটু পিছিয়ে গিয়েছিলো কালুনের বাহিনী। আমরা পাড় দখল করা মাত্র হামলা চালালো আবার। আমাদের মতো ওরাও মাঝখানে অশ্বারোহী আর দুপাশে পদাতিক বাহিনী মোতায়েন করেছে। আমাদের পদাতিকরা মুখোমুখি হলো ওদের পদাতিকদের, আর ঘোড়সওয়াররা ওদের ঘোড়সওয়ারদের। দুপক্ষই সমানে বর্ষণ করছে তীর আর বল্লম। হতাহতও হচ্ছে সমানে সমানে। কিছুক্ষণ পর খেয়াল করলাম, খুব ধীরে হলেও আমরা এগোচ্ছি। আগেই বলেছি তীর বল্লম আমাদের দিকে আসছে কিন্তু অদৃশ্য কোনো শক্তির প্রভাবে যেন আমাদের গায়ে লেগে আশপাশ দিয়ে চলে যাচ্ছে। সামনে, পেছনে, দুপাশে লড়ছে আমাদের সৈনিক, ঘোড়সওয়াররা। জখম হচ্ছে, মরছে; কিন্তু ভূক্ষেপ নেই কারও।

অবশেষে শক্ত বাহিনীর ব্যুহ ভেদ করে বেরিয়ে এলাম আমরা। প্রায় আধ মাইল মতো ছুটে গিয়ে থামলাম কিছুক্ষণের জন্যে। পাঁচ, দশ বা বিশ, পঞ্চাশ জনের ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে হাজির হতে লাগলো আমাদের ঘোড়সওয়াররা। সামান্য সময়ের ভেতর হাজার তিনেক লোক জড় হয়ে গেল। শেষ দলটা উপস্থিত হওয়ার পর মিনিট পাঁচেক অপেক্ষা করলো আয়শা। আর কেউ এলো না দেখে হাত উঁচু করে এগোনোর নির্দেশ দিলো। কালুন নগরীর পথে ছুটে চললো জংলীবাহিনী। পুরোভাগে আয়শা। তার সামান্য পেছনে পাশাপাশি আমি আর অবোস।

ভয়ঙ্কর বেগে ছুটে চলেছি আমরা। খান র‍্যাসেন যখন মরণ-শ্বাপদ নিয়ে লিও আর আমাকে তাড়া করেছিলো তখনও সম্ভবত এত জোরে ঘোড়া ছোটাইনি। পেছনে তিন হাজার জংলীর উল্লসিত চিৎকার। খান র‍্যাসেনের তাড়া খেয়ে যে পথে এসেছিলাম এখন আমরা সে পথে যাচ্ছি না। সমভূমির ওপর দিয়ে কোনাকুনি একটা পথে ছুটছে আয়শা। ফলে অনেক কম সময়ে পৌঁছে গেলাম। কালুনের কাছাকাছি। দুপুরের সামান্য পরে দূরে দেখা গেল কালুন নগরী।

ছোট একটা জলার ধারে ঘোড়া থামালো আয়শা। তিন হাজার জংলী অশ্বারোহীও দাঁড়িয়ে পড়লো। এখানে ঘোড়াগুলোকে পানি খাইয়ে নেয়া হলো। যোদ্ধারাও সঙ্গের পুটুলি থেকে খাবার বের করে খেয়ে নিলো। আমিও সামান্য খেলাম। কিন্তু আয়শা কিছু মুখে তুললো না।

এখানেও কয়েকজন গুপ্তচর দেখা করলো অরোসের সঙ্গে। তাদের কাছে জানা গেল, খানিয়া আতেনের বড় বাহিনীটা নগর পরিখার সেতুগুলো পাহারা দিচ্ছে। আমাদের এই স্বল্পসংখ্যক যোদ্ধা নিয়ে ওদের আক্রমণ করাটা বোকামি হবে। এ সব কথায় কান দিলো না আয়শা। ঘোড়াগুলোর একটু বিশ্রাম হতেই আবার এগোনোর নির্দেশ দিলো সে।

আবার কয়েক ঘণ্টা একটানা ঘোড়া ছুটিয়ে চলা। ঘোড়ার খুরের সম্মিলিত আওয়াজ ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই। আয়শা কোনো কথা বলছে না, ওর সঙ্গী তিন সহস্র বুনো মানুষও নিপ। মাঝে মাঝে ঘাড় ফিরিয়ে তাকাচ্ছে পেছনে।

আমিও তাকালাম একবার। সে দৃশ্য ভোলার নয়। কালো মেঘে ছেয়ে গেছে পেছনের আকাশ। মেঘের প্রান্তগুলো আগুনের মতো লাল। মাথার ওপর দিয়ে স্বর্গীয় সেনাবাহিনীর মতো এগিয়ে চলেছে যেন আমাদের সাথে সাথে। এমন কালো মেঘ আমি জীবনে কখনও দেখিনি। মাত্র বিকেল এখন, কিন্তু মনে হচ্ছে সন্ধ্যা নেমে এসেছে প্রকৃতিতে। প্রায় অন্ধকার হয়ে গেছে পেছনের সমভূমি। মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে নিঃশব্দে। দেখে মনে হচ্ছে কোনো যোদ্ধা যেন মেঘের গায়ে তীব্র আঘাত হানছে হাতের খোলা তলোয়ার দিয়ে।

ক্রমশ এগিয়ে আসছে কালুন। একটু পরে দেখতে পেলাম ওদের দ্বিতীয় এবং বৃহত্তর বাহিনীটাকে। ভয় পাওয়ার মতোই দৃশ্য বটে। আকাশে পুঞ্জ পুঞ্জ মেঘের মতোই ঘন সন্নিবিষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সৈনিকরা, ঘোড়সওয়াররা। আমরা যেমন ওদের দেখেছি তেমনি ওরাও দেখেছে আমাদের।

একটু পরেই দেখলাম একজন দূত এগিয়ে আসছে ঘোড়ায় চেপে। আয়শা হাত উঁচিয়ে সংকেত দিতেই থেমে গেলাম আমরা। আরও এগিয়ে এলো দূত। চিনতে পারলাম লোকটাকে। সাবেক খানের এক পারিষদ। লাগাম টেনে দৃঢ় কণ্ঠে সে বলতে লাগলো-শুনুন, হেস, খানিয়া আতেনের কথা। আপনার প্রিয়তম, বিদেশী প্রভু এখন বন্দী তার প্রাসাদে। এখোনোর চেষ্টা করলেই আপনাকে এবং আপনার ছোট্ট দলটাকে আমরা ধ্বংস করে দেবো। দেখতেই পাচ্ছেন কি বিশাল বাহিনী তৈরি রয়েছে এখানে। তবু যদি কোনো অলৌকিক উপায়ে আপনি জয়ী হন, কালুনের প্রাসাদে পৌঁছুনোর আগেই মারা যাবে আপনার প্রিয়তম। তার চেয়ে আপনি আপনার পাহাড়ে ফিরে যান, খানিয়া প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন আপনাকে এবং আপনার লোকদের অক্ষত অবস্থায় ফিরে যাওয়ার সুযোগ দেবেন তিনি। এখন বলুন, আপনার যদি কিছু বলার থাকে।

ফিসফিস করে অরোসকে কিছু বললো আয়শা। অবোস উঁচু গলায় শুনিয়ে দিলো কথাগুলো–কিছু বলার নেই। প্রাণের মায়া থাকলে পালাও এক্ষুণি, মৃত্যু তোমার পেছনেই।

হতাশ মুখে ঘোড়া ছুটিয়ে দিলো দূত। কিন্তু আয়শা তক্ষুণি রওনা হওয়ার নির্দেশ দিলো না আমাদের। গভীর চিন্তায় ডুবে গেছে ও।

একটু পরেই আমার দিকে তাকালো আয়শা। পাতলা মুখাবরণের ভেতর দিয়ে দেখতে পাচ্ছি ওর মুখ। সাদা, ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে। চোখ দুটো সিংহীর চোখ রাতের বেলা যেমন জ্বলে তেমন জ্বলছে। দাঁতে দাঁত চেপে হিসহিসে স্বরে সে বললো–নরকের মুখ দেখার জন্যে তৈরি হও, হলি! ভেবেছিলাম সম্ভব হলে ওদের মাফ করে দেবো। পারলাম না। আমার সব গোপন শক্তি প্রয়োগ করে হলেও আমি লিওকে জীবিত দেখতে চাই। ওরা ওকে খুন করতে চাইছে!

তারপর ও পেছন ফিরে চিৎকার করে উঠলো, ভয় পেয়ো না সর্দাররা। তোমরা সংখ্যায় কম, কিন্তু তোমাদের সঙ্গে আছে লক্ষ লক্ষ সৈনিকের শক্তি। হেসাকে অনুসরণ করো, যা-ই ঘটুক না কেন, ভয় পেয়ো না বা হতাশ হয়ো না। তোমাদের সৈনিকদের জানিয়ে দাও একথা। বলো, ভয়ের কিছু নেই, হেসার বর্মের আড়ালে তোমরা সেতু পেরিয়ে কালুন নগরীতে প্রবেশ করবে।

সর্দাররা যার যার যোদ্ধাদের কাছে গিয়ে জানিয়ে দিলো আয়শার নির্দেশ।

আমরা আপনার পেছন পেছন নদী পেরিয়েছি, হেস, চেঁচিয়ে জবাব দিলো বুনো লোকগুলো, এতদূর এসেছি বিনা বাধায়। আপনি এগিয়ে চলুন, আমরা আছি আপনার পেছনে।

নির্দেশ দিলো আয়শা। বর্শার ফলার মতো চেহারায় দাঁড়িয়ে গেল ঘোড় সওয়াররা। আয়শা রইলো ফলার একেবারে মাথায়। অরোস আর আমি একটু পেছনে আগের মতোই পাশাপাশি।

তীক্ষ স্বরে একবার শিঙ্গা বেজে উঠলো কোথাও। পর মুহূর্তে কাছের এক পপলার বন থেকে সার বেঁধে বেরিয়ে এলো কালুনের বিরাট এক অশ্বারোহী বাহিনী। দ্রুত বেগে আমাদের চারদিক থেকে ঘিরে ফেলার চেষ্টা করছে তারা। এদিকে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা বাহিনীটাও এগোতে শুরু করেছে। প্রথমে ঘোড়সওয়াররা তারপর পদাতিকরা।

আমাদের খেলা বোধহয় শেষ হলো। সন্দেহ নেই আমরা হারবো, অন্তত আমার তাই মনে হচ্ছে।

পপলার বন থেকে বেরিয়ে আসা ঘোড়সওয়ারদের দিকে তাকালো একবার আয়শা। সামনের বাহিনীটার দিকে তাকালো একবার। তারপর এক টানে মুখের আবরণ ছিঁড়ে ফেলে উঁচু করে ধরলো। ওর কপালে জ্বলে উঠলো সেই অদ্ভুত রহস্যময় নীল আলো। উপস্থিত অর্ধলক্ষ মানুষের ভেতর একমাত্র আমি এর আগে দেখেছি এ আলো।

ইতিমধ্যে মাথার ওপর মেঘ আরও ঘন হয়েছে, এবং এখনও হচ্ছে। মুহুর্মুহু বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। এখন আর নিঃশব্দে নয়, শব্দে। পেছনের পাহাড় চূড়া থেকে আচমকা বেরিয়ে এলো কয়েক দমক অগ্নিশিখা। তিমি যেমন নিঃশ্বাস ছাড়ে তেমনি ফোয়ারার মতো উঠে গেল তা অনেক অনেক উপরে। লাল আভা ধরলো মেঘের কালো গা।

ঘোড়ার লাগাম ফেলে দিয়ে দুহাত আকাশে ছুঁড়ে দিলো আয়শা। হেঁড়া সাদা মুখাবরণটা নাড়তে লাগলো, স্বর্গের উদ্দেশ্যে সংকেত দিচ্ছে যেন।

সেই মুহূর্তে আকাশের কালো চোয়ালটা যেন হাঁ হয়ে গেল। তীব্র, উজ্জ্বল আগুনের শিখা ছুটলো কালুনের দিকে। বিদ্যুচ্চমক ম্লান হয়ে যায় সে উজ্জ্বলতার কাছে। পরক্ষণে শো শো শব্দে ধেয়ে এলো বাতাস। আমাদের সামান্য উপর দিয়ে ছুটে গেল কালুন নগরীর দিকে। কি ভয়ঙ্কর বেগ সে বাতাসের! প্রবল ঝড়ও হার মানে তার কাছে। সামনে যা পেলোইট, কাঠ, পাথর, মানুষ, ঘোড়া সব, উড়িয়ে নিয়ে গেল। বসন্তের আগমনে শীতের তুষার যেমন গলে মাটির সঙ্গে মিশে যায় তেমনি দেখতে না দেখতে নাই হয়ে গেল আতেনের বিশাল বাহিনী।

আমি দেখলাম, প্রবল বাতাসে প্রথমে বেঁকে গেল পপলার গাছগুলো, তারপর উপড়ে এলো মাটি থেকে এবং একটু পরে তীব্র বাতাসে উড়তে উড়তে অদৃশ্য হয়ে গেল সব। কালুনের উঁচু নগর প্রাচীর বালির বাঁধের মত ধসে পড়লো। ইট, পাথরের দালানকোঠাগুলোয় দেখা দিলো আগুনের লেলিহান শিখা। এক বাড়ি থেকে অন্য বাড়িতে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে আগুন। অল্প-সময়ের ভেতর পুরো নগরীটা জ্বলন্ত চুল্লি হয়ে উঠলো। বিশাল পাখির মতো ডানা ঝাঁপটাতে ঝাঁপটাতে, অন্ধকার নেমে এলো। আমাদের পেরিয়ে এগিয়ে গেল সামনে। তারপরই দেখলাম কালো ডানাগুলো লাল গনগনে হয়ে উঠেছে। আগুনের বান ডাকিয়ে উড়ে গেল কালুনের ওপর দিয়ে।

তারপর সব শান্ত। চারদিকে কালো শান্ত অন্ধকার, নৈঃশব্দ, ধ্বংস আর মৃত্যু। ধীরে ধীরে মেঘ কেটে গেল। গোধূলির ম্লান আলোয় দেখলাম সামনে শূন্য পড়ে আছে কালুনে ঢোকার সেতু। আতেনের বিশাল বাহিনীর চিহ্নও নেই। কোথাও। অন্যদিকে নিহত তো দূরের কথা, আমাদের জংলী বাহিনীর একটা লোকও আহত হয়নি। তবে বিস্ময়ের পাথর হয়ে গেছে তারা। আতঙ্কে মুখ দিয়ে কথা সরছে না, কারও। আয়শা যখন এগোনোর নির্দেশ দিলো তখনও দাঁড়িয়ে রইলো সবাই। অরোসের কাছ থেকে দ্বিতীয় নির্দেশ পাওয়ার পর সংবিৎ ফিরলো ওদের। ক্লান্ত ভঙ্গিতে এগোতে লাগলো আমাদের পেছন পেছন।

সেতুর ওপর উঠলো আয়শা। ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে তাকালো তার সৈনিকদের দিকে। যেন বলতে চাইলো, স্বাগতম আমার সন্তানেরা। সে এক দেখার মতো দৃশ্য। ঘোড়ার পিঠে ঋজু হয়ে আছে সে। মাথায় তারার মুকুট। জংলীরা প্রথম এবং শেষ বারের মতো দেখলো তার চেহারা।

দেবী! কাঁপা কাঁপা গলায় চিৎকার করে উঠলো তারা।

ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে চলতে শুরু করলো আয়শা। জ্বলন্ত কালুনের রাজপথ ধরে এগিয়ে চললো রাজ প্রাসাদের দিকে।

পুরোপুরি রাত নেমে আসার আগেই আমরা পৌঁছে গেলাম প্রাসাদে। প্রহরীশূন্য অবস্থায় পড়ে আছে ফটক। শূন্য উঠান পেরিয়ে ঘোড়া থেকে নামলো আয়শা। প্রাসাদে ঢুকলো। পেছনে আমি আর অরোস। একের পর এক খোলা দরজা পেরিয়ে এগিয়ে চলেছি আমরা। কোথাও কোনো সাড়াশব্দ নেই। সবগুলো। ঘর ফাঁকা। সবাই পালিয়েছে নয়তো মারা গেছে।

অবশেষে একটা সিঁড়ির কাছে এলাম। উঠতে শুরু করলো আয়শা। প্রাসাদের চূড়ায় যেখানে শামান সিমব্রির ঘর সেখানে গিয়ে শেষ হয়েছে সিঁড়ি। দেখামাত্র চিনতে পারলাম ঘরটা। আতেন এখানেই হত্যা করার হুমকি দিয়েছিলো। আমাদের। দরজাটা বন্ধ। কি আশ্চর্য! আয়শা সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই আপনা থেকে খুলে গেল ওটা।

আয়শার পেছন পেছন আমরা ঢুকলাম। প্রদীপের মৃদু আলোয় আলোকিত ঘরটা। ঘরের মাঝখানে একটু চেয়ারে বসে আছে লিও। হাত পা বাঁধা চেয়ারের হাতল আর পায়ার সাথে। মুখটা ফ্যাকাসে। কম্পিত হাতে একটা ছোরা ধরে আছে বৃদ্ধ শামান ওর বুকের ওপর। বিধিয়ে দিতে উদ্যত। মাটিতে পড়ে আছে খানিয়া আতেন। চোখ দুটো হাঁ করে খোলা, তাকিয়ে আছে ছাদের দিকে। মারা গেছে কালুনের খানিয়া আতেন, কিন্তু এতটুকু মলিন হয়নি তার রাজকীয় চেহারা।

মুহূর্তের ভেতর এতগুলো ব্যাপার লক্ষ করলাম আমরা। আয়শা তার হাতটা সামান্য নাড়লো। সিমব্রির হাত থেকে খসে পড়ে গেল ছুরি। আর বৃদ্ধ শামান ঘুরে দাঁড়িয়েই ভূত দেখার মতো চমকে উঠে স্থির হয়ে গেল।

ঝুঁকে ছুরিটা তুললো আয়শা। দ্রুত হাতে বাঁধন কেটে দিলো লিওর হাত পায়ের। তারপর ক্লান্ত ভঙ্গিতে বসে পড়লো একটা চেয়ারে। লিও উঠে শূন্য দৃষ্টিতে একবার তাকালো চারপাশে। তারপর বললো-একেবারে ঠিক সময়ে এসেছো, আয়শা! আর এক সেকেণ্ড দেরি করলেই খুনী কুকুরটা। শামানের দিকে ইশারা করলো ও, যাক সময়মতো এসেছিলে। কিন্তু, কি করে এলে তোমরা ঐ প্রচণ্ড ঝড়ের ভেতর দিয়ে? ওহ, হোরেস, তুমি এখনও বেঁচে আছে!

আমরা ঝড়ের ভেতর দিয়ে আসিনি, জবাব দিলো আয়শা। এসেছি ঝড়ের ডানায় চেপে। এখন বলল, তোমাকে ধরে আনছি পর কি কি ঘটেছে?

হাত পা বেঁধে এখানে নিয়ে এলো। তারপর তোমার কাছে চিঠি লিখতে বললো। তাতে লিখতে হবে তুমি ফিরে যাও না হলে আমি মারা পড়বে। আমি রাজি হলাম না। তখন–মেঝেতে পড়ে থাকা মৃত আতেনের দিকে তাকালো ও।

তখন? আয়শার প্রশ্ন।

তখন শুরু হলো সেই ভয়ঙ্কর ঝড়। মনে হচ্ছিলো, আর কিছুক্ষণ চললে পাগল হয়ে যাবো। এই পাথরের প্রাসাদ পর্যন্ত থর থর করে কাঁপছিলো। বাতাসের শোঁ-শোঁ গর্জন যদি শুনতে! বিদ্যুতের চমক যদি দেখতে।

তোমাকে বাঁচানোর জন্যে আমিই পাঠিয়েছিলাম ওদের।

স্থির চোখে এক মুহূর্ত তাকিয়ে রইলো লিও আয়শার দিকে। কিছু যেন বোঝার চেষ্টা করলো। তারপর বলে চললো-আতেনও তাই বলছিলো, আমি বিশ্বাস করিনি। আমার মনে হচ্ছিলো মহাপ্রলয় আসন্ন। ওই জানালার সামনে গিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো আতেন। তারপর আবার এসে দাঁড়ালো আমার সামনে। একটা ছুরি তুলে নিলো আমাকে হত্যা করার জন্যে।

আমি জানি, যেখানেই যাই না কেন, তুমি আসবে পেছন পেছন। সুতরাং নির্ভয়ে বললাম, হ্যাঁ, বিধিয়ে দাও আমার বুকে। বলেই চোখ বুজে অপেক্ষা করতে লাগলাম আঘাতের। বেশ কিছুক্ষণ পেরিয়ে গেল, আঘাত এলো না। তার বদলে কপালে অনুভব করলাম ওর ঠোঁটের ছোঁয়া।

না, এ আমি করবো না, ওকে বলতে শুনলাম। বিদায় প্রিয়তম। তোমার নিয়তি তুমিই নির্ধারণ কোরো, আমারটা আমি করছি।

চোখ মেলে দেখলাম, একটা গ্লাস হাতে দাঁড়িয়ে আছে আতেন। ওই যে, ওর পাশে পড়ে আছে। গ্লাসের তরল পদার্থটুকু গলায় ঢেলে দিতেই ও লুটিয়ে পড়লো। তারপর ওই বুড়ো তুলে নিলো ছুরিটা। বিধিয়ে দিতে যাবে আমার বুকে এই সময় তোমরা ঢুকলে।

বলতে বলতে হাঁপিয়ে গেছে লিও। হঠাৎ টলে উঠলো ওর পা। পড়ে যেতে যেতেও সামলে নিলো কোনো রকমে। তাড়াতাড়ি বসে পড়লো চেয়ারটায়।

তুমি অসুস্থ! উদ্বিগ্ন গলায় বললো আয়শা। অরোস, সেই ওষুধটা! তাড়াতাড়ি!

কুর্নিশ করে আলখাল্লার পকেট থেকে একটা ছোট্ট শিশি বের করলো পূজারী। লিওর হাতে দিয়ে বললো, খেয়ে নিন, প্রভু। এক্ষুণি আপনার হারানো শক্তি ফিরে পাবেন।

সত্যিই তাই। ওষুধটা খাওয়ার কয়েক মিনিটের ভেতর সম্পূর্ণ স্বাভাবিক হয়ে গেল লিও। মুখের ফ্যাকাসে ভাব কেটে গেল। চোখের উজ্জ্বলতা ফিরে এলো। দেহের শক্তিও সম্ভবত স্বাভাবিক হয়ে এলো, কারণ দেখলাম, একটু পরেই চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো ও।

টেবিলের ওপর রান্না করা মাংস ছিলো। সেটা দেখিয়ে লিও প্রশ্ন করলো, এখন খেতে পারি, আয়শা? খিদেয় মরে যাওয়ার অবস্থা আমার।

নিশ্চয়ই, বললো আয়শা। খাও। হলি, তোমারও নিশ্চয়ই খিদে পেয়েছে? খেয়ে নাও।

আমি আর লিও ঝাঁপিয়ে পড়লাম খাবারটুকুর ওপর। হ্যাঁ, আক্ষরিক অর্থেই ঝাঁপিয়ে পড়লাম, ঘরে একটা মৃতদেহ থাকা সত্ত্বেও। অবোস খেলো না। আয়শাও কোনো খাবার স্পর্শ করলো না। বৃদ্ধ যাদুকর সিমব্রি দাঁড়িয়েই রইলো পাথরের মূর্তির মতো, ক্ষমতাহীন।

.

২৩.

খাওয়া শেষ করে লিও বললো, তোমাদের সঙ্গে থাকতে পারলে বেশ হতো। অদ্ভুত ঘটনাগুলো স্বচক্ষে দেখতে পেতাম।

দেখার মতো কিছু ঘটেনি তো দেখবে কি? বললো আয়শা। নদী পেরোনোর সময় সামান্য যুদ্ধ করতে হয়েছিলো ব্যস, আর কিছু না। আগুন, পৃথিবী, বাতাস আমার হয়ে করে দিয়েছে বাকিটুকু। আমি ওদের ঘুম থেকে ডেকে তুলেছিলাম। আমার নির্দেশে ওরা ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো তোমাকে বাঁচানোর জন্যে। একজনের জন্যে অনেক জীবন গেছে, শান্ত গম্ভীর গলায় বললো লিও।

আঁ…কয়েক হাজার হাজার না হয়ে যদি ওরা সংখ্যায় লক্ষ লক্ষ হতে তবু একজনকেও আমি রেহাই দিতাম না। এর সব দায় ওর, মৃত আতেনের দিকে ইশারা করলো আয়শা। আমি ভেবেছিলাম যতটুকু না করলেই নয় ততটুকু ক্ষতি করবো। কিন্তু ও যখন বাধ্য করলো…

তবু, প্রিয়তমা, তোমার হাত রক্তে রাঙানো ভাবতে কেমন জানি লাগছে আমার।

কেমন লাগার কিছু নেই, প্রিয়তম। এতদিন তোমার রক্তের দাগ লেগে ছিলো এ হাতে, আজ ওদের রক্তে তা ধুয়ে নিলাম। যাক, রাতের দুঃস্বপ্ন আমরা যেমন ভুলে যাই, দুঃখময় অতীতও তেমন ভুলে যাওয়াই ভালো। এখন বলো কি দিয়ে তোমাকে সম্মানিত করবো?।

আতেনের মুকুটটা পড়ে আছে মেঝেতে তার চুলের ওপর। সেটা তুলে নিলো আয়শা। লিওর সামনে এসে দুহাতে উঁচু করে ধরলো। আস্তে আস্তে হাত নামিয়ে এনে মুকুটটা লিওর কপালে ঠেকালো আয়শা। শান্ত উদাত্ত স্বরে বললো, জাগতিক, অতি তুচ্ছ এই প্রতীক-এর সাহায্যে আমি তোমাকে পৃথিবীর রাজ আসনে অভিষিক্ত করছি, প্রিয়তমা। এ বিশ্বে যা কিছু আছে, সব এখন থেকে তোমার শাসনাধীন। এমন কি আমিও!

আবার ও মুকুটটা উঁচু করে ধরলো। ধীরে ধীরে নামিয়ে এনে ঠেকালো লিওর কপালে। তারপর আবার সেই সঙ্গীতের মতো সুরেলা কণ্ঠস্বর: আমি শপথ করে বলছি, প্রিয়তম, অশেষ দিনের প্রসাদ তুমি পাবে। যতদিন পৃথিবী থাকবে ততদিন তুমি থাকবে, এবং প্রভু হিসেবেই থাকবে।

আবার উঁচু হলো মুকুট। নেমে এসে স্পর্শ করলো লিওর কপাল।

এই স্বর্ণ-প্রতীকের মাধ্যমে আমি তোমাকে দিচ্ছি জ্ঞান, প্রকৃত জ্ঞান, যে। জ্ঞান তোমার সামনে খুলে দেবে প্রকৃতির সব গোপন দুয়ার। বিজয়ীর মতো সে পথে হেঁটে যাবে তুমি আমার পাশে পাশে। তারপর এক সময় শেষ দরজাটা অতিক্রম করবো আমরা। জীবন মৃত্যুর ভেদ আর তখন থাকবে না আমাদের কাছে।

তাচ্ছিল্যের সাথে মুকুটটা ছুঁড়ে ফেলে দিলো আয়শা। এবং কি আশ্চর্য, মৃত আতেনের বুকের ওপর গিয়ে সেটা পড়লো। সোজা হয়ে রইলো সেখানেই।

আমার এসব উপহারে তুমি খুশি হওনি, প্রভু? জিজ্ঞেস করলো আয়শা।

বিমর্ষ ভঙ্গিতে ওর দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়লো লিও।

আর কি তাহলে তুমি চাও? বলো, আমি দেবো তোমাকে।

সত্যিই দেবে?

হ্যাঁ। শপথ করে বলছি। এই যে এখানে যারা আছে সবাই সাক্ষী। তুমি শুধু চাও।

আমি লক্ষ করলাম, সূক্ষ্ম একটা হাসি যেন ফুটে উঠেই মিলিয়ে গেল মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকা শামানের ঠোঁটে।

আমি এমন কিছু চাইবো, না যা দেয়া তোমার অসাধ্য, বললো লিও। আয়শা, আমি তোমাকে চাই। এখন চাই। হ্যাঁ, এখনই, আজ রাতেই। কবে কোন রহস্যময় আগুনে স্নান করবে, ততদিন অপেক্ষা করতে পারবো না!

শোনামাত্র কুঁকড়ে গেল যেন আয়শা। একটু পিছিয়ে এলো লিওর কাছ থেকে। দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরলো নিচের ঠোঁট। তারপর ধীরে ধীরে বললো, সেই বোকা দার্শনিকের মতো অবস্থা হয়েছে আমার, হাঁটতে হাটতে নক্ষত্রের দিকে তাকিয়ে দেশ বিদেশের ভাগ্য গণনা করছিলো, নিজের ভাগ্যের কথা আর খেয়াল ছিলো না। শেষ পর্যন্ত দুষ্ট ছেলেদের খুঁড়ে রাখা গর্তে পড়ে হাত-পা ভেঙে মরলো। আমি ভাবতে পারিনি পৃথিবীর সব ঐশ্চর্য, সব সম্মান, ক্ষমতা পায়ে ঠেলে তুমি নিছক এক নারীর প্রেম চাইতে পা্রো।

ওহ! লিও, আমি ভেবেছিলাম আরও ভালো, আরও মহান কিছু চাইবে। ভেবেছিলাম, হয়তো বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের ওপর ক্ষমতা চাইবে, নয়তো আমার সম্পর্কে যে সব কথা এখনও জানতে পারোনি সেগুলো জানতে চাইবে। কিন্তু এ তুমি কি চাইলে?

হ্যাঁ, আয়শা, নিছক এক নারীর প্রেমই আমি চাই। আমি ঈশ্বর নই, শয়তানও নই। আমি নিছক এক মানুষ-পুরুষ। যে নারীকে ভালোবাসি তাকেই আমি চাই। ক্ষমতার সব পোশাক খুলে ফেলে দাও, আয়শা। উচ্চকাঙক্ষা, মহত্ত্ব ভুলে নারী হয়ে–আমার স্ত্রী হয়ে এসো।

কোনো জবাব দিলো না আয়শা। লিওর দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়লো একটু।

এই তোমার শপথ, আয়শা? পাঁচ মিনিটও হয়নি, এখনি ভঙ্গ করতে চাইছো?

আগের মতোই চুপ করে রইলো আয়শা।

সত্যিই বলছি, আয়শা, বলে চললো লিও, আমি আর সইতে পারছি না, অপেক্ষার জ্বালা। কোনো কথাই আর আমি শুনতে চাই না। আমি আর অপেক্ষা করতে পারবো না। যা ঘটে ঘটুক, যা আসে আসুক, আমি হাসি মুখে বরণ করবো। অন্তত কিছুক্ষণের জন্যে হলেও তো আমরা সুখ পাবো। বলতে বলতে লিও গিয়ে জড়িয়ে ধরলো আয়শাকে, চুমু খেতে চেষ্টা করলো। কিন্তু শরীর মুচড়ে বেরিয়ে এলো আয়শা ওর আলিঙ্গন থেকে।

হ্যাঁ, লিও, সুখ পাবো, কিন্তু কতক্ষণ?

কতক্ষণ? এক জীবন, এক বছর, বা এক মাস, এক দিন হতে পারে-কি এসে গেল তাতে? তুমি যতক্ষণ আমার বিশ্বস্ত আছো ততক্ষণ কোনো কিছুই আমি ভয় করি না।

সত্যি বলছো? ঝুঁকি নেবে তুমি? তুমি যা বলছে তা যদি করি, কি ঘটবে আমি জানি না। সত্যিই বলছি আমি জানি না। তুমি মারাও যেতে পারো।

কি হবে তাতে? আমরা আলাদা হয়ে যাবো?

না, না, লিও, তা কখনও সম্ভব নয়। আমরা কখনও আলাদা হবে না, হতে পারি না, এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। আমাকে প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে। এ জীবনে না হোক অন্য জীবনে, অন্য বলয়ে গিয়ে হলেও আমরা মিলিত হবো।

তাহলে কেন আমি এ যাতনা সইবো আয়শা? আমি আর কিছুই চাই না, তুমি তোমার শপথ রক্ষা করো।

অদ্ভুত এক পরিবর্তন লক্ষ করলাম এ সময় আয়শার ভেতর। সব দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ঝেড়ে ফেলে দিলো সে।

দেখ! বর্শার শত আঘাতে ছিন্ন, ধুলো বালি লাগা ময়লা আলখাল্লাটা দেখিয়ে আয়শা বললো, দেখ, প্রিয়তম, কি পোশাকে আমি এসেছি তোমাকে বিয়ে করতে। এ কি মানায়? তোমা্র আমার বিয়ে এই পোশাকে, এই অবস্থায়?

আমি আমার পছন্দের নারীকে চাই তার পোশাক নয়, আয়শার চোখে চোখ রেখে বললো লিও।

বেশ, তাহলে বলো কিভাবে বিয়ে হবে?…হ্যাঁ, পেয়েছি। হলি ছাড়া আর কে আমাদের দুজনার হাত এক করে দেবে? আজীবন আমাকে পথ দেখিয়েছে এখন তোমার হাতে সমর্পণ করবে আমাকে, আমার হাতে তোমাকে।

এসো, হলি, তোমার কাজটুকু শেষ করো, এই কুমারীকে এই পুরুষের হাতে তুলে দাও।

স্বপ্নচ্ছন্নের মতো আমি ওর নির্দেশ পালন করলাম। আয়শার বাড়িয়ে দেয়া হাত তুলে নিলাম, লিওরটাও। ধীরে ধীরে দুটো হাত এক করে দিলাম! সত্যি কথা বলতে কি, সেই মাহেন্দ্র মুহূর্তে মনে হলো, আমার শিরা উপশিরা দিয়ে যেন আগুনের এক স্রাত হয়ে গেল। অদ্ভুত এক দৃশ্য ভেসে উঠলো চোখের সামনে, কে জানে কোথা থেকে যেন ভেসে এলো অদ্ভুত এক সঙ্গীতের সুর, মস্তিষ্কে ওজনশূন্য অপার্থিব এক অনুভূতি।

আমি ওদের হাত দুটো এক করে দিলাম, জানি না কি রে। ওদের আশীর্বাদ করলাম, কি বলে তা-ও জানি না। টলতে টলতে পিছিয়ে গিয়ে দাঁড়ালাম দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে। তারপর ঘটলো সেই ঘটনা!

স্বামী! গভীর আবেগে ঘাঢ় স্বরে আয়শা বললো। দুবাহু বাড়িয়ে জড়িয়ে ধরলো প্রেমিকের গলা। একহাতে কাছে টেনে নিলো তার মাথা। লিওর সোনালী চুল মিশে গেল আয়শার কালো কেশগুছের সাথে। ধীরে ধীরে এক হয়ে গেল দুজোড়া ঠোঁট।

কয়েক সেকেণ্ড অমন অবস্থায় রইলো ওরা। আয়শার কপাল থেকে সেই অদ্ভুত নীলচে আলো বেরিয়ে ছড়িয়ে পড়লো লিওর কপালে। আগুনের আভার মতো জ্বল জ্বল করে উঠলো ওর নিটোল গোলাপি শরীর। সাদা আলখাল্লা ভেদ করে দৃশ্যমান হয়ে উঠলো।

আবেশ জড়ানো গলায় আয়শা বললো, এমনি করে, লিও ভিসি, ওহ! এমনি করে আমি দ্বিতীয়বারের মতো তোমার কাছে সমর্পণ করলাম আমাকে। সেদিন কোর-এর গুহায় যে প্রতিজ্ঞা তোমার কাছে করেছিলাম আজ এই কালুনের প্রাসাদেও তাই করছি। জেনে রাখো, ফলাফল যা-ই হোক-শুভ বা অশুভ, আমরা কখনও আলাদা হবে না। কিছুতেই ছিন্ন হতো আমাদের বন্ধন। তুমি বেঁচে থাকলে আমি বেঁচে থাকবো তোমার পাশে, তুমি মৃত্যু নদীর ওপারে গেলে আমিও যাবো। যেতেই হবে। যেখানে তুমি যাবে সেখানেই আমি যাবো, যখন তুমি ঘুমাবে আমিও ঘুমাবো তোমার সঙ্গে; জীবন মৃত্যুর স্বপ্নের ভেতর আমার কণ্ঠস্বরই তুমি শুনবে।

থামলো আয়শা। মুখ তুলে তাকালো ওপর দিকে। চোখে মুগ্ধ দৃষ্টি।

আয়শার মুখ থেকে লিওর মুখের ওপর স্থির হলো আমার চোখ। বৃদ্ধ শামান যেমন দাঁড়িয়ে আছে তেমনি মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে লিও। প্রাণে কোনো লক্ষণ নেই তার শরীরে। মুখটা ফ্যাকাসে মৃতের মতো। কিন্তু সে মুখেও লেগে। আছে শান্ত মৃদু একটুখানি হাসি।

নূপুরের মৃদু নিক্কনের মতো বেজে উঠলো আয়শার গলা। কি মিষ্টি! শ্বাস আটকে গেল আমার গলার কাছে। আয়শা গান গাইছে।

পৃধিবী ছিলো না, ছিলো না,
শুধু ছিলো নৈঃশব্দের গর্ভে ঘুমিয়ে
মানুষের প্রাণ।
তবু আমি ছিলাম আর তুমি—

যেমন শুরু করেছিলো তেমন হঠাৎ থেমে গেল আয়শা। তারপর আমি দেখলামনা অনুভব করলাম, ওর মুখের আতঙ্ক। সঙ্গে সঙ্গে লিওর দিকে তাকালাম।

টলছে লিও। ও যেন মাটিতে নয় উর্মিমুখর নদীতে নৌকায় দাঁড়িয়ে আছে। দুলতে দুলতে অন্ধের মতো দুহাত বাড়িয়ে ধরার চেষ্টা করলো আয়শাকে। তারপর আচমকা চিৎ হয়ে পড়ে গেল আতেনের বুকের ওপর। তখনও ওর মুখে লেগে আছে সেই শান্ত হাসি।

ওহ! কি তী, তীব্র এক চিৎকার বেরোলো আয়শার গলা চিরে, আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারবো না। আমার মনে হলো যুদ্ধে নিহত সব মৃত সৈনিক বুঝি জেগে উঠবে সে শব্দে। একটা মাত্র চিৎকার—তারপর আবার সব চুপ।

.

ছুটে গেলাম আমি লিওর কাছে। আয়শার প্রেমের আগুন ওকে হত্যা করেছে। আমার লিও মৃত পড়ে আছে মৃত আতেনের বুকের ওপর।

.

২৪.

একটু পরে কথা বললো আয়শা। চরম হতাশা ওর গলায়। মনে হচ্ছে আমার প্রভু ক্ষণিকের জন্যে আমায় ছেড়ে গেছে। আমাকেও যেতে হবে প্রভুর পেছন পেছন।

এর পর কি কি ঘটেছে আমি সঠিক বলতে পারবো না। পৃথিবীতে আমার একমাত্র বন্ধু, সন্তান, আপনজনকে হারিয়েছি। আমার আর বেঁচে থাকার কি অর্থ? কে কি করলো না করলো তা জেনেই বা আমার কি দরকার? অস্পষ্টভাবে যা মনে আছে তাহলো, আয়শা আর অরোস মিলে ওর প্রাণ ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করলো। কিন্তু পারলো না। মহামহিমাময়ী, শক্তিমতি আয়শার ক্ষমতা এখানে ব্যর্থ।

অবশেষে যখন একটু স্বাভাবিক অবস্থায় এলাম, শুনলাম আয়শা বলছে, অভিশপ্ত মেয়ে মানুষটার লাশ নিয়ে যাও এখান থেকে? কয়েকজন পূজারী ওর নির্দেশ পালন করলো।

একটা দীর্ঘ আসনের ওপর শুইয়ে রাখা হয়েছে লিওকে। অদ্ভুত শান্ত, পরিতৃপ্ত চেহারা। আয়শা বসে আছে ওর পাশে। একটু যেন দুশ্চিন্তার ছাপ চেহারায়। ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালো ও।

আমি একজনকে এক জায়গায় পাঠাতে চাই। সাধারণ কাজ নয়, আঁধার রাজ্যের খোঁজ খবর নিতে হবে। অরোসের দিকে তাকালো আয়শা।

এই প্রথমবারের মত আমি পূজারী-প্রধানের মুখ থেকে মৃদু হাসিটা মুছে যেতে দেখলাম। ফ্যাকাসে হয়ে গেল তার চেহারা, কেঁপে উঠলো শরীর।

তুমি ভয় পেয়েছে, বলে চললো আয়শা। না, অবোস, যে যেতে ভয় পাবে তাকে পাঠাবো না। তুমি যাবে, হলি, আমার—এবং ওর পক্ষ থেকে?

হ্যাঁ, আমি জবাব দিলাম। এ ছাড়া আর কি চাইবার আছে আমার? খালি দেখো, ব্যাপারটা যেন তাড়াতাড়ি ঘটে আর বেশি কষ্ট না পাই।…

এক মুহূর্ত ভাবলো আয়শা। না। এখনও তোমার সময় হয়নি। কিছু কাজ এখনও বাকি রয়ে গেছে, সেগুলো করতে হবে তোমাকে।

এরপর ও বৃদ্ধ শামানের দিকে তাকালো। এখনও লোকটা অনড় দাঁড়িয়ে আছে মূর্তির মতো।

এই শোনো! ডাকলো আয়শা।

মুহূর্তে সিমব্রির দেহে প্রাণ এলো যেন। শুনছি, দেবী। বলতে বলতে নেহায়েত নিরুপায় হয়ে করছে এমন ভঙ্গিতে কুর্নিশ করলো বুড়ো।

দেখেছো, সিমব্রি? হাত নেড়ে জিজ্ঞেস করলো আয়শা।

দেখেছি। আতেন আর আমি যা ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলাম ঠিক তা-ই ঘটেছে। কালুনের এক ভাবী খানকে শুয়ে থাকতে দেখছি, বলেছিলাম কি না? খুশিতে চক চক করে উঠলো বুড়োর চোখ।

বুড়োর খুশিটুকু গ্রাহ্য করলো না আয়শা। তোমার ভাইঝির এই করুণ মৃত্যুর জন্যে আন্তরিকভাবে দুঃখিত, সিমব্রি। আর আনন্দিত এই ভেবে, তোমার মতো অন্ধ বাদুড়েরও দেখার ক্ষমতা আছে। যাক, সিমব্রি, আমি তোমাকে আরও উঁচু সম্মানে সম্মানিত করবো। তুমি আমার দূত হয়ে যাবে। মৃত্যুর অন্ধকার পথ ধরে চলে যাবে, আমার প্রভুকে খুঁজে বের করবে—জানি না কোথায় কি ভাবে আজ রাত কাটাবে আমার প্রিয়তম। ওকে বলবে, আয়শা শিগগিরই আসছে ওর সাথে মিলিত হওয়ার জন্যে। বলবে, এটাই আমাদের নিয়তি। আলোকিত পৃথিবীতে আমাদের মিলন নির্ধারিত ছিলো না, তাই আঁধারের রাজ্যে আমরা এক হবো। এ ই ভালো, মরণশীলতার রাত পেরিয়ে এখন অমরত্বের অনন্ত দিন ওর সামনে। এই ভালো। মৃত্যুর সিংহ দরজায় আমার জন্যে অপেক্ষা করতে বলবে ওকে। বুঝেছো?

বুঝেছি, ও মহামহিমাময়ী রানী, আন্তরিক গলায় জবাব দিলো সিমব্রি।

ও, আর একটা কথা। আতেনকে বলবে, আমি ওকে ক্ষমা করেছি। ওর বিরুদ্ধে যা-ই করে থাকি না কেন, ওর মহত্ত্ব আমি অস্বীকার করবো কি করে?

বলবো, দেবী।

তাহলে যাও তুমি!

আয়শার মুখ থেকে কথাটা বেরোনো মাত্র মেঝে থেকে শূন্যে উঠে গেল সিমব্রি। বাতাসে কিছু একটা আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করলো দুহাত বাড়িয়ে। খাওয়ার টেবিলটার সাথে ধাক্কা খেলো একটা। তারপর হুড়মুড় করে পড়ে গেল মাটিতে। নিষ্পন্দ পড়ে রইলো ওর শরীর। আমার দিকে ফিরলো আয়শা।

তুমি ক্লান্ত, হলি। যাও বিশ্রাম নাও গে। কাল রাতে আমরা পাহাড়ের পথে রওনা হবো।

.

নিঃশব্দে পাশের কামরায় ঢুকে পড়লাম আমি। সিমব্রির শোয়ার ঘর এটা। খাটে পরিপাটি বিছানা পাতা। যেমন নিঃশব্দে ঢুকেছিলাম তেমনি নিঃশব্দে শুয়ে পড়লাম। কিন্তু ঘুম এলো না। কালুন নগরী এখনও জ্বলছে। আগুনের আভা জানালা গলে এসে পড়েছে পাশের কামরায়। সেই অস্পষ্ট আলোয় দেখলাম, আয়শা বসে বসে দেখছে মৃত দয়িতের মুখ। নিপ নিষ্পন্দ। হাতের ওপর ভর দিয়ে আছে মাথা। কাঁদছে না ও। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলছে না। কেবল দেখছে, ঘুমন্ত শিশুর দিকে মা যেমন চেয়ে থাকে তেমন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা পেরিয়ে গেল ওর দেখা শেষ হলো না।

ওর মুখে এখন কোনো আবরণ নেই। পরিষ্কার দেখতে পেলাম, সব অহঙ্কার, ক্রোধ দূর হয়ে গেছে সে মুখ থেকে। অদ্ভুত কোমল, মায়াময় হয়ে উঠেছে। মনে হলো, কোথায় যেন দেখেছি এ মুখ। কিন্তু স্মরণংকরতে পারলাম না। অনেকক্ষণ ভাবলাম, অবশেষে মনে পড়লো। মন্দিরের উপবৃত্তাকার কক্ষে মায়ের যে প্রতিমা দেখেছিলাম হুবহু সেই মুখ। হ্যাঁ, একেবারে সেই অভিব্যক্তি, প্রেম আর শক্তি মিলে মিশে একাকার হয়ে গেছে। এ

অবশেষে আয়শা উঠে আমার কামরায় এলো।

আমি শেষ হয়ে গেছি ভেবে আমার জন্যে দুঃখ হচ্ছে তোমার, তাই না, হলি? মৃদু কণ্ঠে ও বললো।

হ্যাঁ, আয়শা, দুঃখ হচ্ছে; তোমার জন্যে, আমার জন্যে।

দুঃখ পাওয়ার কিছু নেই, হলি। আমার মানবীয় অংশ ওকে পৃথিবীতে ধরে রাখতে পারেনি বটে, কিন্তু আত্মা? আমার আত্মা ঠিকই মিলবে ওর আত্মার সাথে। সময় হলে তুমিও চলে আসবে। মৃত্যুই তো প্রেমের শক্তি; মৃত্যুই তো প্রেমের গন্ত ব্য। সেজন্যেই তো আমি জল মুছে ফেলেছি চোখ থেকে। দুঃখ কিসের? আমি যাবো, শিগগিরই যাবো ওর কাছে।

কিন্তু একি করছি আমি, ছি! ভুলে বসে আছি তোমার বিশ্রাম দরকার। হয়েছে, আর কথা নয়, এবার তুমি ঘুমাও, বন্ধু, আমি আদেশ করছি তোমাকে, ঘুমাও।

আমি ঘুমিয়ে গেলাম।

.

ঘুম যখন ভাঙলো তখন যাত্রার সময় হয়ে গেছে। আমার বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে আছে আয়শা।

সব তৈরি, বললো ও। ওঠো, চলো।

রওনা হলাম আমরা। এক সহস্র অশ্বারোহী চলেছে আমাদের সাথে। বাকিরা থেকে যাচ্ছে কালুনে, দখল বজায় রাখার জন্যে। একেবারে সামনে লিওর মৃতদেহ, শুভ্রবসন পূজারীরা বয়ে নিয়ে চলেছে। তার পেছনে অবগুণ্ঠিত আয়শা, ওর সেই অপূর্ব মাদী ঘোড়ার পিঠে, পাশে আমি।

কি অদ্ভুত বৈপরীত্ব আমাদের আসা আর যাওয়ার ভেতর।

কি উল্লাসে বজ্র, বিদ্যুৎ আর ঝঞ্জাকে সাথী করে এসেছিলাম, আর যাচ্ছি কেমন ধীরে, নিঃশব্দে; আমার, আয়শার প্রাণের শব বহন করে।

সারা রাত চললাম আমরা। তারপর সারাদিন। আবার রাত হলো। অবশেষে পৌঁছুলাম অগ্নিগর্ভা পবিত্র পাহাড়ে। মন্দিরের উপবৃত্তাকার কক্ষে মায়ের প্রতিমার সামনে নামিয়ে রাখা হলো লিওর শববাহী খাট।

সিংহাসনে বসলো হেসা। পূজারী, পূজারিনীদের উদ্দেশে বললো-আমি খুব ক্লান্ত। একটু বিশ্রাম দরকার। সেজন্যে শিগগির হয়তো কিছু দিনের জন্যে তোমাদের ছেড়ে যাবো। এক বছর বা হাজার বছর–ঠিক বলতে পারি না। যদি তেমন কিছু ঘটে পাপাভকে তোমরা বরণ করে নেবে আমার জায়গায়। আমি যতদিন না ফিরি অরোসকে স্বামী এবং পরামর্শদাতা হিসেবে গ্রহণ করে ও আমার কাজ চালাবে।

হেস-এর দেবালয়ের পূজারী ও পূজারিনীগণ! নতুন একটা রাজ্য আমি তোমাদের দিয়ে যাচ্ছি। নম্র, ভদ্রভাবে ওদের শাসন করবে। এখন থেকে অগ্নি পর্বতের হেসা কালুনের খানিয়া হিসেবেও গণ্য হবে।

পূজারী ও পূজারিনীরা! আমাদের এই পবিত্র পর্বত এবং মন্দিরের পবিত্রতা তোমরা রক্ষা করবে। একটা কথা মনে রাখবে, দেবী হেসা যদি আজকের পৃথিবীকে শাসন না-ও করেন, প্রকৃতি করছেন। দেবী আইসিসের নাম যদি আজ স্বর্গের দেব সভায় ধ্বনিত না-ও হয় স্বর্গ এখনও তার মানব সন্তানদের বুকে করে পরিচর্যা করছেন।

হাত নেড়ে সবাইকে চলে যাওয়ার ইশারা করলো ও। তারপর হঠাৎ মনে পড়ে গেছে এমন ভঙ্গিতে যোগ করলো, আর একটা কথা এই লোকটা আমার প্রিয় বন্ধু এবং অতিথি। একেও তোমাদের একজন করে নেবে। আমি আশা করি, ওর বিশেষ যত্ন নেবে তোমরা। তারপর যখন গ্রীষ্মের সূচনায় বরফ গলতে শুরু করবে, ওকে তোমরা নিরাপদে দূরের ঐ পাহাড়শ্রেণী পার করে দিয়ে আসবে। এবার যাও তোমরা। ভোরের দিকে এগিয়ে চলেছে রাত। স্তম্ভের চূড়ায় উঠে এলাম আমরা, মাত্র চারজন—আয়শা, আমি, অরোস আর পাপাভ। বাহকরা লিওর মৃতদেহ পাশের পাথরখণ্ডটার ওপর রেখে চলে গেছে। আগুনের পর্দা জ্বলে উঠলো আমাদের সামনে। লিওর পাশে হাঁটু গেড়ে বসলো আয়শা। শান্ত হাসি মাখা মুখটার দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ তারপর উঠে দাঁড়ালো।

অন্ধকার এগিয়ে আসছে, হলি, ভোরের উজ্জ্বলতা ঢেকে দেয়ার মতো গাঢ় অন্ধকার। এবার আমি যাবো। যখন তোমার মৃত্যু সময় উপস্থিত হবে—তার আগে নয় কিন্তু আমাকে ডেকো, আমি আসবো তোমার কাছে।

ভেবো না আয়শা হেরে গেছে, ভেবো না আয়শা নিঃশেষ হয়ে গেছে; আয়শা নামক বইয়ের একটা মাত্র পৃষ্ঠা তুমি পড়েছে।

একটু ভাবলো সে। তারপর আবার বললো, বন্ধু, এই সিট্রামটা নাও। এটা দেখে আমাকে স্মরণ কোরো। কিন্তু সাবধান, একেবারে শেষ মুহূর্তে, আমাকে ডাকার জন্যে ছাড়া কখনও এটা ব্যবহার করবে না। হাত বাড়িয়ে আমি নিলাম রত্নখচিত দণ্ডটা। সোনার ঘণ্টার মৃদু টুং-টাং শব্দ হলো। ওর কপালে চুমু দাও, আবার বললো ও। তারপর পিছিয়ে গিয়ে চুপ করে দাঁড়াবে, সব শেষ না হওয়া পর্যন্ত নড়বে না।

আজও অন্ধকার ধীরে ধীরে গাঢ় হয়ে আসছে। আগুনের পর্দা ক্রমে ম্লান হয়ে যাচ্ছে। এক সময় নিকষ কালো হয়ে গেল চারদিক। অদ্ভুত গম্ভীর এক সঙ্গীত উঠে আসতে লাগলো নিচে থেকে লুরের পাখায় ভর করে যেন উঠে এলো দুই ডানাওয়ালা আগুনটা। জড়িয়ে ধরলো আয়শাকে।

হঠাৎ নাই হয়ে গেল আগুন। ভোরের প্রথম রশ্মি ছুটে এলো পাথরখণ্ডটার ওপর।

শূন্য পড়ে আছে ওটা। লিওর মৃতদেহ নেই, আয়শাও নেই।

.

অবোস এবং আর সব পূজারীরা খুব ভালো ব্যবহার করলো আমার সঙ্গে। আয়শা যেমন বলে গিয়েছিলো তার একটুও অন্যথা হলো না।

গ্রীষ্মের আগ পর্যন্ত মন্দিরেই কাটালাম। তারপর বরফ গলতে শুরু করলো। এবারও আয়শার নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করলো ওরা। আমার প্রয়োজন না থাকলেও প্রায় জোর করে আমার হাতে ধরিয়ে দিলো মূল্যবান রত্নভর্তি একটা থলে। কালুনের সমভূমি পেরিয়ে নগরে পৌঁছুলাম। রাত কাটালাম প্রাসাদের বাইরে তাবু খাঁটিয়ে। আতেনের প্রাসাদে ঢোকার প্রবৃত্তি হলো না। জায়গাটা কেমন যেন ভূকুটি করে তাকিয়ে আছে আমার দিকে।

পরদিন নৌকায় করে রওনা হলাম আমরা। অবশেষে তোরণ গৃহে পৌঁছুলাম। আরেকটা রাত কাটাতে হলে এখানে, যদিও ঘুমাতে পারলাম না।

পরদিন সক্কালে সেই খরস্রোতা পাহাড়ী নদীর তীরে পৌঁছুলাম। আশ্চর্য হয়ে দেখলাম, পুল জাতীয় একটা কিছু তৈরি করা হয়েছে ওটার ওপর। ওপাশে পাহাড়ের গায়ে মই উঠে গেছে গিরিখাতের উপর পর্যন্ত। এসব করা হয়েছে কেবল আমার জন্যে।

মইয়ের গোড়ায় দাঁড়িয়ে অরোসের দিকে তাকালাম। যেদিন প্রথম দেখা হয়েছিলো সেদিন যেমন মৃদু একটু হেসেছিলো তেমনি হাসলো আজও বিদায় নেয়ার আগ মুহূর্তে।

অনেক অদ্ভুত জিনিস দেখলাম, কি বলবো বুঝতে না পেরে বললাম।

খুবই অদ্ভুত, জবাব দিলো অরোস।

অন্তত, বন্ধু অবোস, ব্ৰিত ভাবে আমি বললাম, আমার কাছে লেগেছে। তোমার হয়তো লাগেনি, তোমার রাজকীয় গুণের কারণে।

আমার রাজকীয় অভিব্যক্তি ধার করা। একদিন খসে যাবে এ মুখোশ।

তুমি বলতে চাও মহান হেসা মারা যাননি?

আমি বলতে চাই, হেসা কখনও মরেন। হয়তো রূপ বদলান, ব্যস। উনি চলে গেছেন, কালই হয়তো ফিরে আসবেন। আমি তাঁর আসার অপেক্ষায় আছি।

আমিও ওর ফিরে আসার আশায় থাকবো, বলে উঠতে শুরু করলাম মই বেয়ে।

.

বিশজন সশস্ত্র পূজারী আমাকে পাহারা দিয়ে, পথ দেখিয়ে নিয়ে চললো। কোনো দুর্ঘটনা ছাড়াই পাহাড় পেরোলাম। মরুভূমির ভেতর দিয়ে এগিয়ে চললাম। অবশেষে সেই মঠের দেখা পেলাম, যেখানে বিশাল বুদ্ধ বসে আছেন মরুভূমির দিকে তাকিয়ে। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। তাঁবু ফেললাম আমরা।

পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখলাম, পূজারীরা চলে গেছে। আমার ছোট্ট পুটুলিটা নিয়ে হাঁটতে শুরু করলাম একা। সারাদিন পর পৌঁছুলাম মঠে। দরজার সামনে ছিন্ন বসন পরে বসে আছে প্রাগৈতিহাসিক এক মূর্তি। আমাদের পুরনো বন্ধু কোউ-এন। শিং-এর চশমাটা নাকের ওপর ঠিক করতে করতে আমার দিকে তাকালো বৃদ্ধ।

তোমার জন্যেই অপেক্ষা করছিলাম, বিশ্বমঠের ভাই। খুব খিদে পেয়েছে যে আবার এই বাজে জায়গায় ফিরে এসেছো?

খুউব, কোউ-এন-বিশ্রামের খিদে।

এ জন্মের বাকি দিনগুলোতে পাবে। কিন্তু আমার আরেক ভাই কোথায়?

মরে গেছে। ।

এবং কোথাও আবার জন্ম নিয়েছে। পরে ওর সঙ্গে দেখা হবে আমাদের। চলো খেয়ে নেয়া যাক, তারপর শুনবো তোমার গল্প।

এক সাথে খেলাম আমরা। মঠ থেকে রওনা হওয়ার পর যা ঘটেছে সব বললাম কোউ-এনকে। মনোযোগ দিয়ে লো বৃদ্ধ, কিন্তু বিন্দুমাত্র অবাক হলো না। আমি শেষ করতেই সে শুরু করলো পুনর্জন্মের মতবাদ দিয়ে একে ব্যাখ্যা করতে। শুনতে শুনতে ক্লান্ত হয়ে গেলাম আমি। শেষে ঝিমুতে শুরু করলাম।

আর কিছু না হোক, হাই তুলতে তুলতে আমি বললাম, অন্তত কিছু জ্ঞান বা অভিজ্ঞতা যা-ই বলেন, সঞ্চয় তো হলো।

হ্যাঁ, বিশ্ব মঠের ভাই, নিঃসন্দেহে জ্ঞান হয়েছে। তবে একটু ধীরে, এই আর কি। আমি যদি বলি, তোমার এই দেবী, রমণী, সে, হেস, আয়শা, খসে পড়া নক্ষত্র যে নামেই ডাকো–

(এখানেই শেষ মিস্টার হলির পাণ্ডুলিপি। কাম্বারল্যাণ্ডের বাড়িতে আগুনে ফেলে দেয়ায় পরের পৃষ্ঠাগুলো খুঁড়ে গিয়েছিলো।)

***

Exit mobile version