প্রায় পঞ্চাশ বছর আগের কথা সেটা। তারপর থেকে তারা এখানে আছে। বাইরের দুনিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ বলতে গেলে নেই। বছরে বা দুবছরে এক বা। দুজন পাঁচ মাসের পথ পাড়ি দিয়ে যায় লোকালয়ে। খবরাখবর, সামান্য খাবারদাবার, পোশাক পরিচ্ছদ নিয়ে ফিরে আসে। প্রথম দিকে দু’এক বছর পর পর বাইরে থেকে সগ্রহ করে আনা হতো সন্ন্যাসীদের। এখন লোকালয়ের বাইরে। এমন পোড়ো জায়গায় কেউ আর আসতে চায় না। ফলে ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে মঠবাসীর সংখ্যা।
তারপর? জিজ্ঞেস করলাম আমি।
তারপর আর কি? প্রধান পুরোহিত জবাব দিলো, অনেক জ্ঞান অর্জন করেছি আমরা। চিরবিদায়ের পর পুনর্জন্ম নিয়ে আবার যখন পৃথিবীতে আসবো তখন অনেক শান্তিপূর্ণ হবে আমাদের জীবন। জাগতিক সব মোহ, লোভ লালসাকে জয় করতে পেরেছি, এর চেয়ে বেশি আর কি চাই?
দিনের বিরাট একটা অংশ প্রার্থনা করে কাটায় আর লোকালয়ের বাইরে নারীসঙ্গ বিবর্জিত অবস্থায় আছে; এছাড়া গৃহী মানুষের সঙ্গে কোনো পার্থক্য নেই » এই সন্ন্যাসীদের। পাহাড়ের পাদদেশে উর্বর ভূখণ্ডে চাষ করে এরা, পশুপালন করে; গৃহকর্ম করে। তারপর এক সময় থুথুরে বুড়ো হয়ে মরে যায়। একটা ব্যাপার দেখলাম, সন্ন্যাসীর ব্রত গ্রহণ করে আর কিছু না হোক অন্তত দীর্ঘ জীবন লাভ করেছে এরা।
.
আমরা মঠে পৌঁছানোর পরপরই প্রচণ্ড ঠাণ্ডা আর তুষার ঝড় নিয়ে শুরু হয়ে গেল শীত। সামনের বিশাল মরুভূমিতে পুরু তুষারের স্তর জমে গেল। শিগগিরই বুঝে ফেললাম, বেশ কয়েক মাস এখানে থাকতে হবে। শীতকাল শেষ হওয়ার আগে যে এখান থেকে নড়তে পারবো না তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
অত্যন্ত সংকোচের সাথে খুবিলগান অর্থাৎ মঠ-প্রধান কোউ-এনকে বললাম, আমরা যদি কয়েকটা দিন থাকি তাহলে কি আপনাদের খুব অসুবিধা হবে? ভাঙাচোরা কোনো ঘরে থাকতে দেবেন আমাদের, খাবার দাবার লাগবে না। পাহাড়ের ওপর একটা হ্রদ আছে বলেছিলেন, ওখান থেকে মাছ ধরে নেবো, তাছাড়া হরিণ-টরিণ-ও শিকার করে নিতে পারবো…
আমাকে শেষ করতে দিলো না কোউ-এন। বাধা দিয়ে বললো, হয়েছে থাক, আর বলতে হবে না। যতদিন ইচ্ছা তোমরা থাকবে এখানে। ভাঙা ঘরে থাকারও কোনো দরকার নেই, যেখানে আছে সেখানেই থাকবে। আর আমাদের যদি খাবার জোটে তোমাদেরও জুটবে। আর যা-ই হোক, ক্ষুধার্ত পথিককে দয়া না দেখানোর মতো পাপ আমরা করতে পারবো না।
শিগগিরই আমরা বুঝে ফেললাম বৃদ্ধের উদ্দেশ্য। আমাদের বুদ্ধের পথের পথিক করে নিতে চায়। ওর বা ওর সঙ্গীদের মতো সংসারত্যাগী লামা বানিয়ে ফেলতে চায়।
আপাতত তাতে কোনো অসুবিধা নেই আমাদের। সুতরাং আমরা পথিক হলাম। আগেও অনেক মঠে থেকেছি, বুদ্ধের শিক্ষা সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করেছি, এবার আরেকটু ভালো করে শিখবো, তারপর সময় হলে আমাদের পথে রওনা হয়ে যাবো।
সন্ন্যাসীদের সাথে তত্ত্ব আলোচনা আর গৃহকর্ম করে দিন কেটে যেতে লাগলো। মাঝে মাঝে আমাদের ধর্ম নিয়ে আলোচনা করি ওদের সঙ্গে, বিশ্ব নামক মঠের গল্প শোনাই। এই সন্ন্যাসীরা রুশ, চীনা আর কিছু আধা বর্বর উপজাতি ছাড়া দুনিয়ার আর কোনো জাতির কথা জানে না। আমরা যখন গল্প করি তখন হাঁ করে শোনে নতুন নতুন দেশের নতুন নতুন মানুষের কথা।
এসব আমাদের শিখে রাখা উচিত, ঘোষণা করলো ওরা। কে জানে আগামী জন্মে হয়তো এসব দেশের কোনো একটার বাসিন্দা হিসেবে জন্ম হবে আমাদের।
দিন চলে যাচ্ছে। মোটামুটি সুখেই আছি। কিন্তু মনে শান্তি নেই। যার খোঁজে বেরিয়েছি কবে পাবো তাকে? বুদ্ধি দিয়ে বুঝতে পারছি, আপাতত কিছু করার নেই, শীত শেষ না হলে এখান থেকে রওনা হতে পারবো না, তবু মনের অস্থিরতা কমে না।
এর মাঝে একদিন আশ্চর্য এক জিনিস আবিষ্কার করে উৎফুল্ল হয়ে উঠলাম আমি। মঠের ধসে পড়া অংশে গিয়েছিলাম। কোনো কাজে নয়, এমনি জায়গাটা দেখতে। একটা কামরায় ঢুকেই চোখ কপালে উঠে গেল। রাশি রাশি হাতে লেখা বই-এ ঠাসা ঘরটা। এক পলক দেখেই বুঝলাম নিহত সন্ন্যাসীদের সময়কার জিনিস। কোউ-এন-এর কাছে জানতে চাইলাম, বইগুলো আমরা উল্টে পাল্টে দেখতে পারি কিনা। সানন্দে অনুমতি দিলো বৃদ্ধ।
অদ্ভুত এক সংগ্রহ ওটা। এক কথায় অমূল্য। নানা ভাষায় নানা বিষয়ে লেখা এমন সব বই ওখানে আছে যার খোঁজ আজকের দুনিয়ার কেউ এখনও পায়নি। বেশির ভাগই বুদ্ধ-দর্শন সম্পর্কে। যে জিনিসটা আমাকে সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ করলো তা হলো বহু খণ্ডে বিভক্ত একটা দিনলিপি। যুগ যুগ ধরে মঠের খুবিলগানরা রচনা করেছে। প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বর্ণনা লিপিবদ্ধ করা হয়েছে ওগুলোয়। পড়তে শুরু করলাম একটা একটা করে। অল্প কিছু দিনের ভেতর কয়েকটা খণ্ড শেষ করে ফেললাম। শেষখণ্ডগুলোর একটার পাতা ওল্টাতে গিয়ে কৌতূহলোদ্দীপক এক কাহিনী জানতে পারলাম। প্রায় আড়াইশো বছর আগে—অর্থাৎ প্রাচীন মঠটা ধ্বংস হওয়ার কিছু আগে লেখা কাহিনীটা। তার যতটুকু মনে আছে তুলে দিচ্ছি পাঠকদের জন্যে
এবছর গ্রীষ্মে, ভয়ানক এক ধূলিঝড়ের পর আমাদের মঠের এক ভাই (অর্থাৎ সন্ন্যাসী, নামটা দেয়া ছিলো, এখন আর মনে নেই আমার) মরণাপন্ন এক লোককে মরুভূমিতে পড়ে থাকতে দেখে। মরুভূমির ওপারে যে বিশাল পাহাড়ী এলাকা সেখানকার মানুষ সে। এতদিন এ দেশ সম্পর্কে নানা গুজব শুনে এসেছি, এই প্রথম ওখানকার একজনের দেখা পাওয়া গেল। আরও দুজন লোক ছিলো ওর সঙ্গে। খাবার এবং পানির অভাবে মারা গেছে দুজনই। ভীষণ হিংস্র দেখতে লোকটা, মেজাজের দিক থেকেও একরোখা। কি করে এই দুর্গম মরুভূমিতে এলো সে সম্পর্কে কিছু বলতে চাইলো না। আমরা অনেক অনুরোধ উপরোধ করেছিলাম, কিন্তু একটা কথাও বের করতে পারিনি তার মুখ থেকে। শুধু এটুকু, বলেছিলো, প্রাচীন কালে বাইরের দুনিয়ার সাথে যোগাযোগ ছিন্ন হয়ে যাওয়ার আগে তার দেশের লোকেরা যে রাস্তা ব্যবহার করতো, সেই পথ ধরে সে এসেছে। শেষ পর্যন্ত আমরা জানতে পারলাম, মারাত্মক কোনো অপরাধ করেছিলো বলে ওকে আর ওর দুই সঙ্গীকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছিলো, তাই দেশ থেকে পালিয়ে যাচ্ছিলো তারা। ওর কাছ থেকে আরও জানতে পেরেছি, ঐ পাহাড় শ্রেণীর ওপাশে চমৎকার এক দেশ আছে। অত্যন্ত উর্বর সেখানকার মাটি। তবে প্রায়ই ভূমিকম্প হয় ওখানে। অনাবৃষ্টিও সেদেশের এক প্রধান সমস্যা। এদুটো বিপর্যয় সৃষ্টিকারী ব্যাপার না থাকলে বলা যেতো সুখে দিন কাটায় ওখানকার মানুষ।