অন্ধকার এগিয়ে আসছে, হলি, ভোরের উজ্জ্বলতা ঢেকে দেয়ার মতো গাঢ় অন্ধকার। এবার আমি যাবো। যখন তোমার মৃত্যু সময় উপস্থিত হবে—তার আগে নয় কিন্তু আমাকে ডেকো, আমি আসবো তোমার কাছে।
ভেবো না আয়শা হেরে গেছে, ভেবো না আয়শা নিঃশেষ হয়ে গেছে; আয়শা নামক বইয়ের একটা মাত্র পৃষ্ঠা তুমি পড়েছে।
একটু ভাবলো সে। তারপর আবার বললো, বন্ধু, এই সিট্রামটা নাও। এটা দেখে আমাকে স্মরণ কোরো। কিন্তু সাবধান, একেবারে শেষ মুহূর্তে, আমাকে ডাকার জন্যে ছাড়া কখনও এটা ব্যবহার করবে না। হাত বাড়িয়ে আমি নিলাম রত্নখচিত দণ্ডটা। সোনার ঘণ্টার মৃদু টুং-টাং শব্দ হলো। ওর কপালে চুমু দাও, আবার বললো ও। তারপর পিছিয়ে গিয়ে চুপ করে দাঁড়াবে, সব শেষ না হওয়া পর্যন্ত নড়বে না।
আজও অন্ধকার ধীরে ধীরে গাঢ় হয়ে আসছে। আগুনের পর্দা ক্রমে ম্লান হয়ে যাচ্ছে। এক সময় নিকষ কালো হয়ে গেল চারদিক। অদ্ভুত গম্ভীর এক সঙ্গীত উঠে আসতে লাগলো নিচে থেকে লুরের পাখায় ভর করে যেন উঠে এলো দুই ডানাওয়ালা আগুনটা। জড়িয়ে ধরলো আয়শাকে।
হঠাৎ নাই হয়ে গেল আগুন। ভোরের প্রথম রশ্মি ছুটে এলো পাথরখণ্ডটার ওপর।
শূন্য পড়ে আছে ওটা। লিওর মৃতদেহ নেই, আয়শাও নেই।
.
অবোস এবং আর সব পূজারীরা খুব ভালো ব্যবহার করলো আমার সঙ্গে। আয়শা যেমন বলে গিয়েছিলো তার একটুও অন্যথা হলো না।
গ্রীষ্মের আগ পর্যন্ত মন্দিরেই কাটালাম। তারপর বরফ গলতে শুরু করলো। এবারও আয়শার নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করলো ওরা। আমার প্রয়োজন না থাকলেও প্রায় জোর করে আমার হাতে ধরিয়ে দিলো মূল্যবান রত্নভর্তি একটা থলে। কালুনের সমভূমি পেরিয়ে নগরে পৌঁছুলাম। রাত কাটালাম প্রাসাদের বাইরে তাবু খাঁটিয়ে। আতেনের প্রাসাদে ঢোকার প্রবৃত্তি হলো না। জায়গাটা কেমন যেন ভূকুটি করে তাকিয়ে আছে আমার দিকে।
পরদিন নৌকায় করে রওনা হলাম আমরা। অবশেষে তোরণ গৃহে পৌঁছুলাম। আরেকটা রাত কাটাতে হলে এখানে, যদিও ঘুমাতে পারলাম না।
পরদিন সক্কালে সেই খরস্রোতা পাহাড়ী নদীর তীরে পৌঁছুলাম। আশ্চর্য হয়ে দেখলাম, পুল জাতীয় একটা কিছু তৈরি করা হয়েছে ওটার ওপর। ওপাশে পাহাড়ের গায়ে মই উঠে গেছে গিরিখাতের উপর পর্যন্ত। এসব করা হয়েছে কেবল আমার জন্যে।
মইয়ের গোড়ায় দাঁড়িয়ে অরোসের দিকে তাকালাম। যেদিন প্রথম দেখা হয়েছিলো সেদিন যেমন মৃদু একটু হেসেছিলো তেমনি হাসলো আজও বিদায় নেয়ার আগ মুহূর্তে।
অনেক অদ্ভুত জিনিস দেখলাম, কি বলবো বুঝতে না পেরে বললাম।
খুবই অদ্ভুত, জবাব দিলো অরোস।
অন্তত, বন্ধু অবোস, ব্ৰিত ভাবে আমি বললাম, আমার কাছে লেগেছে। তোমার হয়তো লাগেনি, তোমার রাজকীয় গুণের কারণে।
আমার রাজকীয় অভিব্যক্তি ধার করা। একদিন খসে যাবে এ মুখোশ।
তুমি বলতে চাও মহান হেসা মারা যাননি?
আমি বলতে চাই, হেসা কখনও মরেন। হয়তো রূপ বদলান, ব্যস। উনি চলে গেছেন, কালই হয়তো ফিরে আসবেন। আমি তাঁর আসার অপেক্ষায় আছি।
আমিও ওর ফিরে আসার আশায় থাকবো, বলে উঠতে শুরু করলাম মই বেয়ে।
.
বিশজন সশস্ত্র পূজারী আমাকে পাহারা দিয়ে, পথ দেখিয়ে নিয়ে চললো। কোনো দুর্ঘটনা ছাড়াই পাহাড় পেরোলাম। মরুভূমির ভেতর দিয়ে এগিয়ে চললাম। অবশেষে সেই মঠের দেখা পেলাম, যেখানে বিশাল বুদ্ধ বসে আছেন মরুভূমির দিকে তাকিয়ে। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। তাঁবু ফেললাম আমরা।
পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখলাম, পূজারীরা চলে গেছে। আমার ছোট্ট পুটুলিটা নিয়ে হাঁটতে শুরু করলাম একা। সারাদিন পর পৌঁছুলাম মঠে। দরজার সামনে ছিন্ন বসন পরে বসে আছে প্রাগৈতিহাসিক এক মূর্তি। আমাদের পুরনো বন্ধু কোউ-এন। শিং-এর চশমাটা নাকের ওপর ঠিক করতে করতে আমার দিকে তাকালো বৃদ্ধ।
তোমার জন্যেই অপেক্ষা করছিলাম, বিশ্বমঠের ভাই। খুব খিদে পেয়েছে যে আবার এই বাজে জায়গায় ফিরে এসেছো?
খুউব, কোউ-এন-বিশ্রামের খিদে।
এ জন্মের বাকি দিনগুলোতে পাবে। কিন্তু আমার আরেক ভাই কোথায়?
মরে গেছে। ।
এবং কোথাও আবার জন্ম নিয়েছে। পরে ওর সঙ্গে দেখা হবে আমাদের। চলো খেয়ে নেয়া যাক, তারপর শুনবো তোমার গল্প।
এক সাথে খেলাম আমরা। মঠ থেকে রওনা হওয়ার পর যা ঘটেছে সব বললাম কোউ-এনকে। মনোযোগ দিয়ে লো বৃদ্ধ, কিন্তু বিন্দুমাত্র অবাক হলো না। আমি শেষ করতেই সে শুরু করলো পুনর্জন্মের মতবাদ দিয়ে একে ব্যাখ্যা করতে। শুনতে শুনতে ক্লান্ত হয়ে গেলাম আমি। শেষে ঝিমুতে শুরু করলাম।
আর কিছু না হোক, হাই তুলতে তুলতে আমি বললাম, অন্তত কিছু জ্ঞান বা অভিজ্ঞতা যা-ই বলেন, সঞ্চয় তো হলো।
হ্যাঁ, বিশ্ব মঠের ভাই, নিঃসন্দেহে জ্ঞান হয়েছে। তবে একটু ধীরে, এই আর কি। আমি যদি বলি, তোমার এই দেবী, রমণী, সে, হেস, আয়শা, খসে পড়া নক্ষত্র যে নামেই ডাকো–
(এখানেই শেষ মিস্টার হলির পাণ্ডুলিপি। কাম্বারল্যাণ্ডের বাড়িতে আগুনে ফেলে দেয়ায় পরের পৃষ্ঠাগুলো খুঁড়ে গিয়েছিলো।)
***