বুঝেছি, ও মহামহিমাময়ী রানী, আন্তরিক গলায় জবাব দিলো সিমব্রি।
ও, আর একটা কথা। আতেনকে বলবে, আমি ওকে ক্ষমা করেছি। ওর বিরুদ্ধে যা-ই করে থাকি না কেন, ওর মহত্ত্ব আমি অস্বীকার করবো কি করে?
বলবো, দেবী।
তাহলে যাও তুমি!
আয়শার মুখ থেকে কথাটা বেরোনো মাত্র মেঝে থেকে শূন্যে উঠে গেল সিমব্রি। বাতাসে কিছু একটা আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করলো দুহাত বাড়িয়ে। খাওয়ার টেবিলটার সাথে ধাক্কা খেলো একটা। তারপর হুড়মুড় করে পড়ে গেল মাটিতে। নিষ্পন্দ পড়ে রইলো ওর শরীর। আমার দিকে ফিরলো আয়শা।
তুমি ক্লান্ত, হলি। যাও বিশ্রাম নাও গে। কাল রাতে আমরা পাহাড়ের পথে রওনা হবো।
.
নিঃশব্দে পাশের কামরায় ঢুকে পড়লাম আমি। সিমব্রির শোয়ার ঘর এটা। খাটে পরিপাটি বিছানা পাতা। যেমন নিঃশব্দে ঢুকেছিলাম তেমনি নিঃশব্দে শুয়ে পড়লাম। কিন্তু ঘুম এলো না। কালুন নগরী এখনও জ্বলছে। আগুনের আভা জানালা গলে এসে পড়েছে পাশের কামরায়। সেই অস্পষ্ট আলোয় দেখলাম, আয়শা বসে বসে দেখছে মৃত দয়িতের মুখ। নিপ নিষ্পন্দ। হাতের ওপর ভর দিয়ে আছে মাথা। কাঁদছে না ও। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলছে না। কেবল দেখছে, ঘুমন্ত শিশুর দিকে মা যেমন চেয়ে থাকে তেমন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা পেরিয়ে গেল ওর দেখা শেষ হলো না।
ওর মুখে এখন কোনো আবরণ নেই। পরিষ্কার দেখতে পেলাম, সব অহঙ্কার, ক্রোধ দূর হয়ে গেছে সে মুখ থেকে। অদ্ভুত কোমল, মায়াময় হয়ে উঠেছে। মনে হলো, কোথায় যেন দেখেছি এ মুখ। কিন্তু স্মরণংকরতে পারলাম না। অনেকক্ষণ ভাবলাম, অবশেষে মনে পড়লো। মন্দিরের উপবৃত্তাকার কক্ষে মায়ের যে প্রতিমা দেখেছিলাম হুবহু সেই মুখ। হ্যাঁ, একেবারে সেই অভিব্যক্তি, প্রেম আর শক্তি মিলে মিশে একাকার হয়ে গেছে। এ
অবশেষে আয়শা উঠে আমার কামরায় এলো।
আমি শেষ হয়ে গেছি ভেবে আমার জন্যে দুঃখ হচ্ছে তোমার, তাই না, হলি? মৃদু কণ্ঠে ও বললো।
হ্যাঁ, আয়শা, দুঃখ হচ্ছে; তোমার জন্যে, আমার জন্যে।
দুঃখ পাওয়ার কিছু নেই, হলি। আমার মানবীয় অংশ ওকে পৃথিবীতে ধরে রাখতে পারেনি বটে, কিন্তু আত্মা? আমার আত্মা ঠিকই মিলবে ওর আত্মার সাথে। সময় হলে তুমিও চলে আসবে। মৃত্যুই তো প্রেমের শক্তি; মৃত্যুই তো প্রেমের গন্ত ব্য। সেজন্যেই তো আমি জল মুছে ফেলেছি চোখ থেকে। দুঃখ কিসের? আমি যাবো, শিগগিরই যাবো ওর কাছে।
কিন্তু একি করছি আমি, ছি! ভুলে বসে আছি তোমার বিশ্রাম দরকার। হয়েছে, আর কথা নয়, এবার তুমি ঘুমাও, বন্ধু, আমি আদেশ করছি তোমাকে, ঘুমাও।
আমি ঘুমিয়ে গেলাম।
.
ঘুম যখন ভাঙলো তখন যাত্রার সময় হয়ে গেছে। আমার বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে আছে আয়শা।
সব তৈরি, বললো ও। ওঠো, চলো।
রওনা হলাম আমরা। এক সহস্র অশ্বারোহী চলেছে আমাদের সাথে। বাকিরা থেকে যাচ্ছে কালুনে, দখল বজায় রাখার জন্যে। একেবারে সামনে লিওর মৃতদেহ, শুভ্রবসন পূজারীরা বয়ে নিয়ে চলেছে। তার পেছনে অবগুণ্ঠিত আয়শা, ওর সেই অপূর্ব মাদী ঘোড়ার পিঠে, পাশে আমি।
কি অদ্ভুত বৈপরীত্ব আমাদের আসা আর যাওয়ার ভেতর।
কি উল্লাসে বজ্র, বিদ্যুৎ আর ঝঞ্জাকে সাথী করে এসেছিলাম, আর যাচ্ছি কেমন ধীরে, নিঃশব্দে; আমার, আয়শার প্রাণের শব বহন করে।
সারা রাত চললাম আমরা। তারপর সারাদিন। আবার রাত হলো। অবশেষে পৌঁছুলাম অগ্নিগর্ভা পবিত্র পাহাড়ে। মন্দিরের উপবৃত্তাকার কক্ষে মায়ের প্রতিমার সামনে নামিয়ে রাখা হলো লিওর শববাহী খাট।
সিংহাসনে বসলো হেসা। পূজারী, পূজারিনীদের উদ্দেশে বললো-আমি খুব ক্লান্ত। একটু বিশ্রাম দরকার। সেজন্যে শিগগির হয়তো কিছু দিনের জন্যে তোমাদের ছেড়ে যাবো। এক বছর বা হাজার বছর–ঠিক বলতে পারি না। যদি তেমন কিছু ঘটে পাপাভকে তোমরা বরণ করে নেবে আমার জায়গায়। আমি যতদিন না ফিরি অরোসকে স্বামী এবং পরামর্শদাতা হিসেবে গ্রহণ করে ও আমার কাজ চালাবে।
হেস-এর দেবালয়ের পূজারী ও পূজারিনীগণ! নতুন একটা রাজ্য আমি তোমাদের দিয়ে যাচ্ছি। নম্র, ভদ্রভাবে ওদের শাসন করবে। এখন থেকে অগ্নি পর্বতের হেসা কালুনের খানিয়া হিসেবেও গণ্য হবে।
পূজারী ও পূজারিনীরা! আমাদের এই পবিত্র পর্বত এবং মন্দিরের পবিত্রতা তোমরা রক্ষা করবে। একটা কথা মনে রাখবে, দেবী হেসা যদি আজকের পৃথিবীকে শাসন না-ও করেন, প্রকৃতি করছেন। দেবী আইসিসের নাম যদি আজ স্বর্গের দেব সভায় ধ্বনিত না-ও হয় স্বর্গ এখনও তার মানব সন্তানদের বুকে করে পরিচর্যা করছেন।
হাত নেড়ে সবাইকে চলে যাওয়ার ইশারা করলো ও। তারপর হঠাৎ মনে পড়ে গেছে এমন ভঙ্গিতে যোগ করলো, আর একটা কথা এই লোকটা আমার প্রিয় বন্ধু এবং অতিথি। একেও তোমাদের একজন করে নেবে। আমি আশা করি, ওর বিশেষ যত্ন নেবে তোমরা। তারপর যখন গ্রীষ্মের সূচনায় বরফ গলতে শুরু করবে, ওকে তোমরা নিরাপদে দূরের ঐ পাহাড়শ্রেণী পার করে দিয়ে আসবে। এবার যাও তোমরা। ভোরের দিকে এগিয়ে চলেছে রাত। স্তম্ভের চূড়ায় উঠে এলাম আমরা, মাত্র চারজন—আয়শা, আমি, অরোস আর পাপাভ। বাহকরা লিওর মৃতদেহ পাশের পাথরখণ্ডটার ওপর রেখে চলে গেছে। আগুনের পর্দা জ্বলে উঠলো আমাদের সামনে। লিওর পাশে হাঁটু গেড়ে বসলো আয়শা। শান্ত হাসি মাখা মুখটার দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ তারপর উঠে দাঁড়ালো।