ক্ষুধার্ত সাহায্যপ্রার্থীকে বিমুখ করা-ও আপনাদের নিয়ম বিরুদ্ধ? বলে এ প্রসঙ্গে বুদ্ধের বহুল প্রচলিত একটি বাণী আওড়ালাম।
চমকৃত হলো বৃদ্ধ লামা। বুঝতে পারছি পেটে বিদ্যা আছে তোমাদের। এমন মানুষদের আশ্রয় দিতে রাজি হবে না আমরা। ভেতরে এসো, বিশ্ব মঠের ভাইরা। দাঁড়াও, দাঁড়াও, তোমাদের সঙ্গে ওটা কি?, ইয়াক! ও-ও মনে হয় আমাদের দয়া চায়, বলতে বলতে ঘুরে দাঁড়িয়ে দরজার পাশে ঝোলানো একটা ঘণ্টা বাজালো সে।
কয়েক সেকেণ্ডের ভেতর আরেকজন লোক এসে দাঁড়ালো। প্রথম জনের চেয়েও বেশি এর বয়েস, অন্তত চেহারা তাই বলছে। মুখের চামড়ায় শত শত ভাঁজ। আমাদের দেখে হাঁ হয়ে গেল তার মুখ।
ভাই, প্রথম বৃদ্ধ বললো, অতবড় হাঁ করে থেকো না, অশুভ আত্মারা তোমার পেটে ঢুকে পড়বে ওখান দিয়ে। এই ইয়াকটাকে নিয়ে যাও। অন্য জন্ত গুলোর সাথে বেঁধে রাখো, আর খাবার দিও।
ইয়াকের পিঠ থেকে আমাদের মালপত্র খুলে নিলাম। দ্বিতীয় বৃদ্ধ, যার পদবী পশু-পতি, ওকে নিয়ে চলে গেল।
বৃদ্ধ সন্ন্যাসী, যার নাম কোউ-এন, পথ দেখিয়ে একটা ঘরে নিয়ে গেল আমাদের। একই সাথে বসা এবং রান্নার কাজে ব্যবহার হয় ঘরটা। মঠের অন্য সন্ন্যাসীদের দেখলাম এখানে। সব মিলে বারোজন। আগুনের সামনে গোল হয়ে বসে আছে। একজন সকালের খাবার রান্না করছে, অন্যরা আগুন পোহাচ্ছে। সব কজনই বৃদ্ধ। সবচেয়ে তরুণ যে জন তারও বয়েস পঁয়ষট্টির কম নয়। গম্ভীর ভঙ্গিতে সবার সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিলো কোউ-এন: যে মঠে সবারই খিদে পায় সেই বিশ্ব-মঠের লামা এরা।
আমাদের দিকে তাকালো ওরা। শীর্ণ হাতগুলো ঘষলো তালুতে তালু। লাগিয়ে। মাথা নুইয়ে সম্মান জানালো। অবশেষে কথা বললো একজন: আপনাদের আগমনে অত্যন্ত আনন্দিত আমরা।
শুধু কথায় নয়, কাজেও ওরা সে প্রমাণ দিলো। হাত মুখ ধধায়ার জন্যে পানি গরম করলো একজন। দুজন উঠে চলে গেল আমাদের জন্যে একটা কামরা। সাজিয়ে গুছিয়ে ফেলতে। অন্যেরা আমাদের গা থেকে খুলে নিলো দীর্ঘ ব্যবহারে নোংরা হয়ে যাওয়া পোশাকগুলো। পা থেকে বুটগুলোও খুলে নেয়া হলো। তার বদলে চটি দিলো পরবার জন্যে। তারপর নিয়ে গেল অতিথি কুঠুরিতে। আগুন জ্বেলে দেয়া হলো ঘরের মাঝখানে। বিস্ময়ের ওপর বিস্ময়! এরপর পরিষ্কার কাপড় এনে দেয়া হলো আমাদের পরার জন্যে। তার ভেতর লিনেনও আছে। সব প্রাচীন কালের, দেখলেই বোঝা যায় খুব উঁচু মানের জিনিস, যদিও পুরনো হয়ে গেছে।
আমাদের রেখে চলে গেল সন্ন্যাসীরা। আমরা হাত মুখ ধুয়ে নিলাম-ভালো করে ধুয়ে নিলাম—প্রায় গোসল বলা যেতে পারে। তারপর লামাদের দেয়া পরিষ্কার পোশাক পরলাম। লিওর কাপড়টা একটু ছোট হয়েছে। এ ঘরেও দরজার কাছে ঝুলছে একটা ঘণ্টা। বাজাতেই এক লামা হাজির। আমাদের নিয়ে এলো রান্নাঘরে। সেখানে তখন খাবার পরিবেশন করা হচ্ছে। এক ধরনের পরিজ আর সদ্য দোয়ানো দুধ-পশু-পতি দুইয়ে এনেছে। এছাড়া আমাদের সম্মানে বিশেষ ব্যবস্থা করা হয়েছে শুকমো মাছ আর মাখন দেয়া চায়ের। খেতে গিয়ে মনে হলো এমন সুস্বাদু খাবার জীবনে খাইনি। প্রচুর খেলাম। আমাদের গোগ্রাসে খাওয়া দেখে চোখ বড় বড় হয়ে গেল সন্ন্যাসীদের।
বিশ্ব-মঠের সন্ন্যাসীরা দেখছি সত্যিই ক্ষুধার্ত! শেষ পর্যন্ত একজন বলেই ফেললো; লোকটার পদবী খাদ্য-পতি। এভাবে খেতে থাকলে আমাদের শীতের সঞ্চয় শেষ হতে দুদিনও লাগবে না!
সুতরাং শেষ করলাম আমরা। তারপর বুদ্ধের বাণী থেকে দীর্ঘ এক স্তোত্র আওড়ালাম।
অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলো বৃদ্ধ সন্ন্যাসীরা। বিদেশীদের মুখে বুদ্ধের বাণী যেন তাদের কল্পনারও অতীত।
অতিথি-কুঠুরিতে ফিরে একটানা চব্বিশ ঘণ্টা ঘুমালাম। যখন উঠলাম তখন একেবারে ঝরঝরে তাজা আমাদের শরীর।
.
পরের ছটা মাস এই পাহাড়ী মঠে কাটলো। কয়েক দিনের ভেতরেই সহৃদয় বৃদ্ধ সন্ন্যাসীদের বিশ্বাসভাজন হয়ে উঠলাম। আরও কদিন পর ওরা ওদের ইতিহাস শোনালো আমাদের।
সুপ্রাচীন কাল থেকে মঠটা আছে এখানে। আগে বেশ কয়েকশো সন্ন্যাসী থাকতো। দুই শতাব্দী বা তার কিছু আগে হিংস্র এক উপজাতি হামলা চালিয়ে সন্ন্যাসীদের হত্যা করে দখল করে নেয় মঠটা। সামনে মরুভূমির ওপাশে যে বিশাল পাহাড়ী এলাকা সেখানে বাস করে সেই উপজাতি। আগুনের উপাসনা করে তারা। সন্ন্যাসীদের প্রায় সবাই নিহত হয় সে হামলায়। যে দুচারজন ভাগ্যক্রমে বেঁচে গিয়েছিলো তারা কোনো মতে পালিয়ে গিয়ে লোকালয়ে পৌঁছে দেয়। খবরটা। তারপর পাঁচ পুরুষেরও বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও মঠটা পুনর্দখলের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
এই মঠের খুবিলগান (প্রধান পুরোহিত) আমাদের বন্ধু কোউ-এন-এর যখন যৌবন কাল তখন প্রথম উদ্যোগ নেয়া হলো। দুশো বছর আগে যে সন্ন্যাসীরা নিহত হয়েছিলো তাদের মধ্যেও এক কোউ-এন ছিলো। আমাদের কোউ-এন-এর ধারণা সে সেই কোউ-এন-এরই পুনর্জন্ম নেয়া রূপ। তার মতে বর্তমান জীবনে তার প্রধান দায়িত্ব ছিলো মঠে ফিরে আসা। সে দায়িত্ব সে পালন করেছে। মঠটা যদি পুনর্দখল করতে পারে তাহলে তার পক্ষে নির্বাণ লাভ কষ্টসাধ্য কিছু হবে না এই ধারণা থেকে আমাদের এই কোউ-এন এক দল উদ্যোগী মানুষ নিয়ে রওনা হয়। অনেক কষ্ট আর ক্ষতি স্বীকার করে জায়গাটা পুনর্দখল করে তারা। প্রয়োজনীয় সংস্কার করে মঠটার।