আবেশ জড়ানো গলায় আয়শা বললো, এমনি করে, লিও ভিসি, ওহ! এমনি করে আমি দ্বিতীয়বারের মতো তোমার কাছে সমর্পণ করলাম আমাকে। সেদিন কোর-এর গুহায় যে প্রতিজ্ঞা তোমার কাছে করেছিলাম আজ এই কালুনের প্রাসাদেও তাই করছি। জেনে রাখো, ফলাফল যা-ই হোক-শুভ বা অশুভ, আমরা কখনও আলাদা হবে না। কিছুতেই ছিন্ন হতো আমাদের বন্ধন। তুমি বেঁচে থাকলে আমি বেঁচে থাকবো তোমার পাশে, তুমি মৃত্যু নদীর ওপারে গেলে আমিও যাবো। যেতেই হবে। যেখানে তুমি যাবে সেখানেই আমি যাবো, যখন তুমি ঘুমাবে আমিও ঘুমাবো তোমার সঙ্গে; জীবন মৃত্যুর স্বপ্নের ভেতর আমার কণ্ঠস্বরই তুমি শুনবে।
থামলো আয়শা। মুখ তুলে তাকালো ওপর দিকে। চোখে মুগ্ধ দৃষ্টি।
আয়শার মুখ থেকে লিওর মুখের ওপর স্থির হলো আমার চোখ। বৃদ্ধ শামান যেমন দাঁড়িয়ে আছে তেমনি মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে লিও। প্রাণে কোনো লক্ষণ নেই তার শরীরে। মুখটা ফ্যাকাসে মৃতের মতো। কিন্তু সে মুখেও লেগে। আছে শান্ত মৃদু একটুখানি হাসি।
নূপুরের মৃদু নিক্কনের মতো বেজে উঠলো আয়শার গলা। কি মিষ্টি! শ্বাস আটকে গেল আমার গলার কাছে। আয়শা গান গাইছে।
পৃধিবী ছিলো না, ছিলো না,
শুধু ছিলো নৈঃশব্দের গর্ভে ঘুমিয়ে
মানুষের প্রাণ।
তবু আমি ছিলাম আর তুমি—
যেমন শুরু করেছিলো তেমন হঠাৎ থেমে গেল আয়শা। তারপর আমি দেখলামনা অনুভব করলাম, ওর মুখের আতঙ্ক। সঙ্গে সঙ্গে লিওর দিকে তাকালাম।
টলছে লিও। ও যেন মাটিতে নয় উর্মিমুখর নদীতে নৌকায় দাঁড়িয়ে আছে। দুলতে দুলতে অন্ধের মতো দুহাত বাড়িয়ে ধরার চেষ্টা করলো আয়শাকে। তারপর আচমকা চিৎ হয়ে পড়ে গেল আতেনের বুকের ওপর। তখনও ওর মুখে লেগে আছে সেই শান্ত হাসি।
ওহ! কি তী, তীব্র এক চিৎকার বেরোলো আয়শার গলা চিরে, আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারবো না। আমার মনে হলো যুদ্ধে নিহত সব মৃত সৈনিক বুঝি জেগে উঠবে সে শব্দে। একটা মাত্র চিৎকার—তারপর আবার সব চুপ।
.
ছুটে গেলাম আমি লিওর কাছে। আয়শার প্রেমের আগুন ওকে হত্যা করেছে। আমার লিও মৃত পড়ে আছে মৃত আতেনের বুকের ওপর।
.
২৪.
একটু পরে কথা বললো আয়শা। চরম হতাশা ওর গলায়। মনে হচ্ছে আমার প্রভু ক্ষণিকের জন্যে আমায় ছেড়ে গেছে। আমাকেও যেতে হবে প্রভুর পেছন পেছন।
এর পর কি কি ঘটেছে আমি সঠিক বলতে পারবো না। পৃথিবীতে আমার একমাত্র বন্ধু, সন্তান, আপনজনকে হারিয়েছি। আমার আর বেঁচে থাকার কি অর্থ? কে কি করলো না করলো তা জেনেই বা আমার কি দরকার? অস্পষ্টভাবে যা মনে আছে তাহলো, আয়শা আর অরোস মিলে ওর প্রাণ ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করলো। কিন্তু পারলো না। মহামহিমাময়ী, শক্তিমতি আয়শার ক্ষমতা এখানে ব্যর্থ।
অবশেষে যখন একটু স্বাভাবিক অবস্থায় এলাম, শুনলাম আয়শা বলছে, অভিশপ্ত মেয়ে মানুষটার লাশ নিয়ে যাও এখান থেকে? কয়েকজন পূজারী ওর নির্দেশ পালন করলো।
একটা দীর্ঘ আসনের ওপর শুইয়ে রাখা হয়েছে লিওকে। অদ্ভুত শান্ত, পরিতৃপ্ত চেহারা। আয়শা বসে আছে ওর পাশে। একটু যেন দুশ্চিন্তার ছাপ চেহারায়। ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালো ও।
আমি একজনকে এক জায়গায় পাঠাতে চাই। সাধারণ কাজ নয়, আঁধার রাজ্যের খোঁজ খবর নিতে হবে। অরোসের দিকে তাকালো আয়শা।
এই প্রথমবারের মত আমি পূজারী-প্রধানের মুখ থেকে মৃদু হাসিটা মুছে যেতে দেখলাম। ফ্যাকাসে হয়ে গেল তার চেহারা, কেঁপে উঠলো শরীর।
তুমি ভয় পেয়েছে, বলে চললো আয়শা। না, অবোস, যে যেতে ভয় পাবে তাকে পাঠাবো না। তুমি যাবে, হলি, আমার—এবং ওর পক্ষ থেকে?
হ্যাঁ, আমি জবাব দিলাম। এ ছাড়া আর কি চাইবার আছে আমার? খালি দেখো, ব্যাপারটা যেন তাড়াতাড়ি ঘটে আর বেশি কষ্ট না পাই।…
এক মুহূর্ত ভাবলো আয়শা। না। এখনও তোমার সময় হয়নি। কিছু কাজ এখনও বাকি রয়ে গেছে, সেগুলো করতে হবে তোমাকে।
এরপর ও বৃদ্ধ শামানের দিকে তাকালো। এখনও লোকটা অনড় দাঁড়িয়ে আছে মূর্তির মতো।
এই শোনো! ডাকলো আয়শা।
মুহূর্তে সিমব্রির দেহে প্রাণ এলো যেন। শুনছি, দেবী। বলতে বলতে নেহায়েত নিরুপায় হয়ে করছে এমন ভঙ্গিতে কুর্নিশ করলো বুড়ো।
দেখেছো, সিমব্রি? হাত নেড়ে জিজ্ঞেস করলো আয়শা।
দেখেছি। আতেন আর আমি যা ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলাম ঠিক তা-ই ঘটেছে। কালুনের এক ভাবী খানকে শুয়ে থাকতে দেখছি, বলেছিলাম কি না? খুশিতে চক চক করে উঠলো বুড়োর চোখ।
বুড়োর খুশিটুকু গ্রাহ্য করলো না আয়শা। তোমার ভাইঝির এই করুণ মৃত্যুর জন্যে আন্তরিকভাবে দুঃখিত, সিমব্রি। আর আনন্দিত এই ভেবে, তোমার মতো অন্ধ বাদুড়েরও দেখার ক্ষমতা আছে। যাক, সিমব্রি, আমি তোমাকে আরও উঁচু সম্মানে সম্মানিত করবো। তুমি আমার দূত হয়ে যাবে। মৃত্যুর অন্ধকার পথ ধরে চলে যাবে, আমার প্রভুকে খুঁজে বের করবে—জানি না কোথায় কি ভাবে আজ রাত কাটাবে আমার প্রিয়তম। ওকে বলবে, আয়শা শিগগিরই আসছে ওর সাথে মিলিত হওয়ার জন্যে। বলবে, এটাই আমাদের নিয়তি। আলোকিত পৃথিবীতে আমাদের মিলন নির্ধারিত ছিলো না, তাই আঁধারের রাজ্যে আমরা এক হবো। এ ই ভালো, মরণশীলতার রাত পেরিয়ে এখন অমরত্বের অনন্ত দিন ওর সামনে। এই ভালো। মৃত্যুর সিংহ দরজায় আমার জন্যে অপেক্ষা করতে বলবে ওকে। বুঝেছো?