তাচ্ছিল্যের সাথে মুকুটটা ছুঁড়ে ফেলে দিলো আয়শা। এবং কি আশ্চর্য, মৃত আতেনের বুকের ওপর গিয়ে সেটা পড়লো। সোজা হয়ে রইলো সেখানেই।
আমার এসব উপহারে তুমি খুশি হওনি, প্রভু? জিজ্ঞেস করলো আয়শা।
বিমর্ষ ভঙ্গিতে ওর দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়লো লিও।
আর কি তাহলে তুমি চাও? বলো, আমি দেবো তোমাকে।
সত্যিই দেবে?
হ্যাঁ। শপথ করে বলছি। এই যে এখানে যারা আছে সবাই সাক্ষী। তুমি শুধু চাও।
আমি লক্ষ করলাম, সূক্ষ্ম একটা হাসি যেন ফুটে উঠেই মিলিয়ে গেল মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকা শামানের ঠোঁটে।
আমি এমন কিছু চাইবো, না যা দেয়া তোমার অসাধ্য, বললো লিও। আয়শা, আমি তোমাকে চাই। এখন চাই। হ্যাঁ, এখনই, আজ রাতেই। কবে কোন রহস্যময় আগুনে স্নান করবে, ততদিন অপেক্ষা করতে পারবো না!
শোনামাত্র কুঁকড়ে গেল যেন আয়শা। একটু পিছিয়ে এলো লিওর কাছ থেকে। দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরলো নিচের ঠোঁট। তারপর ধীরে ধীরে বললো, সেই বোকা দার্শনিকের মতো অবস্থা হয়েছে আমার, হাঁটতে হাটতে নক্ষত্রের দিকে তাকিয়ে দেশ বিদেশের ভাগ্য গণনা করছিলো, নিজের ভাগ্যের কথা আর খেয়াল ছিলো না। শেষ পর্যন্ত দুষ্ট ছেলেদের খুঁড়ে রাখা গর্তে পড়ে হাত-পা ভেঙে মরলো। আমি ভাবতে পারিনি পৃথিবীর সব ঐশ্চর্য, সব সম্মান, ক্ষমতা পায়ে ঠেলে তুমি নিছক এক নারীর প্রেম চাইতে পা্রো।
ওহ! লিও, আমি ভেবেছিলাম আরও ভালো, আরও মহান কিছু চাইবে। ভেবেছিলাম, হয়তো বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের ওপর ক্ষমতা চাইবে, নয়তো আমার সম্পর্কে যে সব কথা এখনও জানতে পারোনি সেগুলো জানতে চাইবে। কিন্তু এ তুমি কি চাইলে?
হ্যাঁ, আয়শা, নিছক এক নারীর প্রেমই আমি চাই। আমি ঈশ্বর নই, শয়তানও নই। আমি নিছক এক মানুষ-পুরুষ। যে নারীকে ভালোবাসি তাকেই আমি চাই। ক্ষমতার সব পোশাক খুলে ফেলে দাও, আয়শা। উচ্চকাঙক্ষা, মহত্ত্ব ভুলে নারী হয়ে–আমার স্ত্রী হয়ে এসো।
কোনো জবাব দিলো না আয়শা। লিওর দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়লো একটু।
এই তোমার শপথ, আয়শা? পাঁচ মিনিটও হয়নি, এখনি ভঙ্গ করতে চাইছো?
আগের মতোই চুপ করে রইলো আয়শা।
সত্যিই বলছি, আয়শা, বলে চললো লিও, আমি আর সইতে পারছি না, অপেক্ষার জ্বালা। কোনো কথাই আর আমি শুনতে চাই না। আমি আর অপেক্ষা করতে পারবো না। যা ঘটে ঘটুক, যা আসে আসুক, আমি হাসি মুখে বরণ করবো। অন্তত কিছুক্ষণের জন্যে হলেও তো আমরা সুখ পাবো। বলতে বলতে লিও গিয়ে জড়িয়ে ধরলো আয়শাকে, চুমু খেতে চেষ্টা করলো। কিন্তু শরীর মুচড়ে বেরিয়ে এলো আয়শা ওর আলিঙ্গন থেকে।
হ্যাঁ, লিও, সুখ পাবো, কিন্তু কতক্ষণ?
কতক্ষণ? এক জীবন, এক বছর, বা এক মাস, এক দিন হতে পারে-কি এসে গেল তাতে? তুমি যতক্ষণ আমার বিশ্বস্ত আছো ততক্ষণ কোনো কিছুই আমি ভয় করি না।
সত্যি বলছো? ঝুঁকি নেবে তুমি? তুমি যা বলছে তা যদি করি, কি ঘটবে আমি জানি না। সত্যিই বলছি আমি জানি না। তুমি মারাও যেতে পারো।
কি হবে তাতে? আমরা আলাদা হয়ে যাবো?
না, না, লিও, তা কখনও সম্ভব নয়। আমরা কখনও আলাদা হবে না, হতে পারি না, এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। আমাকে প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে। এ জীবনে না হোক অন্য জীবনে, অন্য বলয়ে গিয়ে হলেও আমরা মিলিত হবো।
তাহলে কেন আমি এ যাতনা সইবো আয়শা? আমি আর কিছুই চাই না, তুমি তোমার শপথ রক্ষা করো।
অদ্ভুত এক পরিবর্তন লক্ষ করলাম এ সময় আয়শার ভেতর। সব দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ঝেড়ে ফেলে দিলো সে।
দেখ! বর্শার শত আঘাতে ছিন্ন, ধুলো বালি লাগা ময়লা আলখাল্লাটা দেখিয়ে আয়শা বললো, দেখ, প্রিয়তম, কি পোশাকে আমি এসেছি তোমাকে বিয়ে করতে। এ কি মানায়? তোমা্র আমার বিয়ে এই পোশাকে, এই অবস্থায়?
আমি আমার পছন্দের নারীকে চাই তার পোশাক নয়, আয়শার চোখে চোখ রেখে বললো লিও।
বেশ, তাহলে বলো কিভাবে বিয়ে হবে?…হ্যাঁ, পেয়েছি। হলি ছাড়া আর কে আমাদের দুজনার হাত এক করে দেবে? আজীবন আমাকে পথ দেখিয়েছে এখন তোমার হাতে সমর্পণ করবে আমাকে, আমার হাতে তোমাকে।
এসো, হলি, তোমার কাজটুকু শেষ করো, এই কুমারীকে এই পুরুষের হাতে তুলে দাও।
স্বপ্নচ্ছন্নের মতো আমি ওর নির্দেশ পালন করলাম। আয়শার বাড়িয়ে দেয়া হাত তুলে নিলাম, লিওরটাও। ধীরে ধীরে দুটো হাত এক করে দিলাম! সত্যি কথা বলতে কি, সেই মাহেন্দ্র মুহূর্তে মনে হলো, আমার শিরা উপশিরা দিয়ে যেন আগুনের এক স্রাত হয়ে গেল। অদ্ভুত এক দৃশ্য ভেসে উঠলো চোখের সামনে, কে জানে কোথা থেকে যেন ভেসে এলো অদ্ভুত এক সঙ্গীতের সুর, মস্তিষ্কে ওজনশূন্য অপার্থিব এক অনুভূতি।
আমি ওদের হাত দুটো এক করে দিলাম, জানি না কি রে। ওদের আশীর্বাদ করলাম, কি বলে তা-ও জানি না। টলতে টলতে পিছিয়ে গিয়ে দাঁড়ালাম দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে। তারপর ঘটলো সেই ঘটনা!
স্বামী! গভীর আবেগে ঘাঢ় স্বরে আয়শা বললো। দুবাহু বাড়িয়ে জড়িয়ে ধরলো প্রেমিকের গলা। একহাতে কাছে টেনে নিলো তার মাথা। লিওর সোনালী চুল মিশে গেল আয়শার কালো কেশগুছের সাথে। ধীরে ধীরে এক হয়ে গেল দুজোড়া ঠোঁট।
কয়েক সেকেণ্ড অমন অবস্থায় রইলো ওরা। আয়শার কপাল থেকে সেই অদ্ভুত নীলচে আলো বেরিয়ে ছড়িয়ে পড়লো লিওর কপালে। আগুনের আভার মতো জ্বল জ্বল করে উঠলো ওর নিটোল গোলাপি শরীর। সাদা আলখাল্লা ভেদ করে দৃশ্যমান হয়ে উঠলো।