আমরা ঝড়ের ভেতর দিয়ে আসিনি, জবাব দিলো আয়শা। এসেছি ঝড়ের ডানায় চেপে। এখন বলল, তোমাকে ধরে আনছি পর কি কি ঘটেছে?
হাত পা বেঁধে এখানে নিয়ে এলো। তারপর তোমার কাছে চিঠি লিখতে বললো। তাতে লিখতে হবে তুমি ফিরে যাও না হলে আমি মারা পড়বে। আমি রাজি হলাম না। তখন–মেঝেতে পড়ে থাকা মৃত আতেনের দিকে তাকালো ও।
তখন? আয়শার প্রশ্ন।
তখন শুরু হলো সেই ভয়ঙ্কর ঝড়। মনে হচ্ছিলো, আর কিছুক্ষণ চললে পাগল হয়ে যাবো। এই পাথরের প্রাসাদ পর্যন্ত থর থর করে কাঁপছিলো। বাতাসের শোঁ-শোঁ গর্জন যদি শুনতে! বিদ্যুতের চমক যদি দেখতে।
তোমাকে বাঁচানোর জন্যে আমিই পাঠিয়েছিলাম ওদের।
স্থির চোখে এক মুহূর্ত তাকিয়ে রইলো লিও আয়শার দিকে। কিছু যেন বোঝার চেষ্টা করলো। তারপর বলে চললো-আতেনও তাই বলছিলো, আমি বিশ্বাস করিনি। আমার মনে হচ্ছিলো মহাপ্রলয় আসন্ন। ওই জানালার সামনে গিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো আতেন। তারপর আবার এসে দাঁড়ালো আমার সামনে। একটা ছুরি তুলে নিলো আমাকে হত্যা করার জন্যে।
আমি জানি, যেখানেই যাই না কেন, তুমি আসবে পেছন পেছন। সুতরাং নির্ভয়ে বললাম, হ্যাঁ, বিধিয়ে দাও আমার বুকে। বলেই চোখ বুজে অপেক্ষা করতে লাগলাম আঘাতের। বেশ কিছুক্ষণ পেরিয়ে গেল, আঘাত এলো না। তার বদলে কপালে অনুভব করলাম ওর ঠোঁটের ছোঁয়া।
না, এ আমি করবো না, ওকে বলতে শুনলাম। বিদায় প্রিয়তম। তোমার নিয়তি তুমিই নির্ধারণ কোরো, আমারটা আমি করছি।
চোখ মেলে দেখলাম, একটা গ্লাস হাতে দাঁড়িয়ে আছে আতেন। ওই যে, ওর পাশে পড়ে আছে। গ্লাসের তরল পদার্থটুকু গলায় ঢেলে দিতেই ও লুটিয়ে পড়লো। তারপর ওই বুড়ো তুলে নিলো ছুরিটা। বিধিয়ে দিতে যাবে আমার বুকে এই সময় তোমরা ঢুকলে।
বলতে বলতে হাঁপিয়ে গেছে লিও। হঠাৎ টলে উঠলো ওর পা। পড়ে যেতে যেতেও সামলে নিলো কোনো রকমে। তাড়াতাড়ি বসে পড়লো চেয়ারটায়।
তুমি অসুস্থ! উদ্বিগ্ন গলায় বললো আয়শা। অরোস, সেই ওষুধটা! তাড়াতাড়ি!
কুর্নিশ করে আলখাল্লার পকেট থেকে একটা ছোট্ট শিশি বের করলো পূজারী। লিওর হাতে দিয়ে বললো, খেয়ে নিন, প্রভু। এক্ষুণি আপনার হারানো শক্তি ফিরে পাবেন।
সত্যিই তাই। ওষুধটা খাওয়ার কয়েক মিনিটের ভেতর সম্পূর্ণ স্বাভাবিক হয়ে গেল লিও। মুখের ফ্যাকাসে ভাব কেটে গেল। চোখের উজ্জ্বলতা ফিরে এলো। দেহের শক্তিও সম্ভবত স্বাভাবিক হয়ে এলো, কারণ দেখলাম, একটু পরেই চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো ও।
টেবিলের ওপর রান্না করা মাংস ছিলো। সেটা দেখিয়ে লিও প্রশ্ন করলো, এখন খেতে পারি, আয়শা? খিদেয় মরে যাওয়ার অবস্থা আমার।
নিশ্চয়ই, বললো আয়শা। খাও। হলি, তোমারও নিশ্চয়ই খিদে পেয়েছে? খেয়ে নাও।
আমি আর লিও ঝাঁপিয়ে পড়লাম খাবারটুকুর ওপর। হ্যাঁ, আক্ষরিক অর্থেই ঝাঁপিয়ে পড়লাম, ঘরে একটা মৃতদেহ থাকা সত্ত্বেও। অবোস খেলো না। আয়শাও কোনো খাবার স্পর্শ করলো না। বৃদ্ধ যাদুকর সিমব্রি দাঁড়িয়েই রইলো পাথরের মূর্তির মতো, ক্ষমতাহীন।
.
২৩.
খাওয়া শেষ করে লিও বললো, তোমাদের সঙ্গে থাকতে পারলে বেশ হতো। অদ্ভুত ঘটনাগুলো স্বচক্ষে দেখতে পেতাম।
দেখার মতো কিছু ঘটেনি তো দেখবে কি? বললো আয়শা। নদী পেরোনোর সময় সামান্য যুদ্ধ করতে হয়েছিলো ব্যস, আর কিছু না। আগুন, পৃথিবী, বাতাস আমার হয়ে করে দিয়েছে বাকিটুকু। আমি ওদের ঘুম থেকে ডেকে তুলেছিলাম। আমার নির্দেশে ওরা ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো তোমাকে বাঁচানোর জন্যে। একজনের জন্যে অনেক জীবন গেছে, শান্ত গম্ভীর গলায় বললো লিও।
আঁ…কয়েক হাজার হাজার না হয়ে যদি ওরা সংখ্যায় লক্ষ লক্ষ হতে তবু একজনকেও আমি রেহাই দিতাম না। এর সব দায় ওর, মৃত আতেনের দিকে ইশারা করলো আয়শা। আমি ভেবেছিলাম যতটুকু না করলেই নয় ততটুকু ক্ষতি করবো। কিন্তু ও যখন বাধ্য করলো…
তবু, প্রিয়তমা, তোমার হাত রক্তে রাঙানো ভাবতে কেমন জানি লাগছে আমার।
কেমন লাগার কিছু নেই, প্রিয়তম। এতদিন তোমার রক্তের দাগ লেগে ছিলো এ হাতে, আজ ওদের রক্তে তা ধুয়ে নিলাম। যাক, রাতের দুঃস্বপ্ন আমরা যেমন ভুলে যাই, দুঃখময় অতীতও তেমন ভুলে যাওয়াই ভালো। এখন বলো কি দিয়ে তোমাকে সম্মানিত করবো?।
আতেনের মুকুটটা পড়ে আছে মেঝেতে তার চুলের ওপর। সেটা তুলে নিলো আয়শা। লিওর সামনে এসে দুহাতে উঁচু করে ধরলো। আস্তে আস্তে হাত নামিয়ে এনে মুকুটটা লিওর কপালে ঠেকালো আয়শা। শান্ত উদাত্ত স্বরে বললো, জাগতিক, অতি তুচ্ছ এই প্রতীক-এর সাহায্যে আমি তোমাকে পৃথিবীর রাজ আসনে অভিষিক্ত করছি, প্রিয়তমা। এ বিশ্বে যা কিছু আছে, সব এখন থেকে তোমার শাসনাধীন। এমন কি আমিও!
আবার ও মুকুটটা উঁচু করে ধরলো। ধীরে ধীরে নামিয়ে এনে ঠেকালো লিওর কপালে। তারপর আবার সেই সঙ্গীতের মতো সুরেলা কণ্ঠস্বর: আমি শপথ করে বলছি, প্রিয়তম, অশেষ দিনের প্রসাদ তুমি পাবে। যতদিন পৃথিবী থাকবে ততদিন তুমি থাকবে, এবং প্রভু হিসেবেই থাকবে।
আবার উঁচু হলো মুকুট। নেমে এসে স্পর্শ করলো লিওর কপাল।
এই স্বর্ণ-প্রতীকের মাধ্যমে আমি তোমাকে দিচ্ছি জ্ঞান, প্রকৃত জ্ঞান, যে। জ্ঞান তোমার সামনে খুলে দেবে প্রকৃতির সব গোপন দুয়ার। বিজয়ীর মতো সে পথে হেঁটে যাবে তুমি আমার পাশে পাশে। তারপর এক সময় শেষ দরজাটা অতিক্রম করবো আমরা। জীবন মৃত্যুর ভেদ আর তখন থাকবে না আমাদের কাছে।