আমাদের খেলা বোধহয় শেষ হলো। সন্দেহ নেই আমরা হারবো, অন্তত আমার তাই মনে হচ্ছে।
পপলার বন থেকে বেরিয়ে আসা ঘোড়সওয়ারদের দিকে তাকালো একবার আয়শা। সামনের বাহিনীটার দিকে তাকালো একবার। তারপর এক টানে মুখের আবরণ ছিঁড়ে ফেলে উঁচু করে ধরলো। ওর কপালে জ্বলে উঠলো সেই অদ্ভুত রহস্যময় নীল আলো। উপস্থিত অর্ধলক্ষ মানুষের ভেতর একমাত্র আমি এর আগে দেখেছি এ আলো।
ইতিমধ্যে মাথার ওপর মেঘ আরও ঘন হয়েছে, এবং এখনও হচ্ছে। মুহুর্মুহু বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। এখন আর নিঃশব্দে নয়, শব্দে। পেছনের পাহাড় চূড়া থেকে আচমকা বেরিয়ে এলো কয়েক দমক অগ্নিশিখা। তিমি যেমন নিঃশ্বাস ছাড়ে তেমনি ফোয়ারার মতো উঠে গেল তা অনেক অনেক উপরে। লাল আভা ধরলো মেঘের কালো গা।
ঘোড়ার লাগাম ফেলে দিয়ে দুহাত আকাশে ছুঁড়ে দিলো আয়শা। হেঁড়া সাদা মুখাবরণটা নাড়তে লাগলো, স্বর্গের উদ্দেশ্যে সংকেত দিচ্ছে যেন।
সেই মুহূর্তে আকাশের কালো চোয়ালটা যেন হাঁ হয়ে গেল। তীব্র, উজ্জ্বল আগুনের শিখা ছুটলো কালুনের দিকে। বিদ্যুচ্চমক ম্লান হয়ে যায় সে উজ্জ্বলতার কাছে। পরক্ষণে শো শো শব্দে ধেয়ে এলো বাতাস। আমাদের সামান্য উপর দিয়ে ছুটে গেল কালুন নগরীর দিকে। কি ভয়ঙ্কর বেগ সে বাতাসের! প্রবল ঝড়ও হার মানে তার কাছে। সামনে যা পেলোইট, কাঠ, পাথর, মানুষ, ঘোড়া সব, উড়িয়ে নিয়ে গেল। বসন্তের আগমনে শীতের তুষার যেমন গলে মাটির সঙ্গে মিশে যায় তেমনি দেখতে না দেখতে নাই হয়ে গেল আতেনের বিশাল বাহিনী।
আমি দেখলাম, প্রবল বাতাসে প্রথমে বেঁকে গেল পপলার গাছগুলো, তারপর উপড়ে এলো মাটি থেকে এবং একটু পরে তীব্র বাতাসে উড়তে উড়তে অদৃশ্য হয়ে গেল সব। কালুনের উঁচু নগর প্রাচীর বালির বাঁধের মত ধসে পড়লো। ইট, পাথরের দালানকোঠাগুলোয় দেখা দিলো আগুনের লেলিহান শিখা। এক বাড়ি থেকে অন্য বাড়িতে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে আগুন। অল্প-সময়ের ভেতর পুরো নগরীটা জ্বলন্ত চুল্লি হয়ে উঠলো। বিশাল পাখির মতো ডানা ঝাঁপটাতে ঝাঁপটাতে, অন্ধকার নেমে এলো। আমাদের পেরিয়ে এগিয়ে গেল সামনে। তারপরই দেখলাম কালো ডানাগুলো লাল গনগনে হয়ে উঠেছে। আগুনের বান ডাকিয়ে উড়ে গেল কালুনের ওপর দিয়ে।
তারপর সব শান্ত। চারদিকে কালো শান্ত অন্ধকার, নৈঃশব্দ, ধ্বংস আর মৃত্যু। ধীরে ধীরে মেঘ কেটে গেল। গোধূলির ম্লান আলোয় দেখলাম সামনে শূন্য পড়ে আছে কালুনে ঢোকার সেতু। আতেনের বিশাল বাহিনীর চিহ্নও নেই। কোথাও। অন্যদিকে নিহত তো দূরের কথা, আমাদের জংলী বাহিনীর একটা লোকও আহত হয়নি। তবে বিস্ময়ের পাথর হয়ে গেছে তারা। আতঙ্কে মুখ দিয়ে কথা সরছে না, কারও। আয়শা যখন এগোনোর নির্দেশ দিলো তখনও দাঁড়িয়ে রইলো সবাই। অরোসের কাছ থেকে দ্বিতীয় নির্দেশ পাওয়ার পর সংবিৎ ফিরলো ওদের। ক্লান্ত ভঙ্গিতে এগোতে লাগলো আমাদের পেছন পেছন।
সেতুর ওপর উঠলো আয়শা। ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে তাকালো তার সৈনিকদের দিকে। যেন বলতে চাইলো, স্বাগতম আমার সন্তানেরা। সে এক দেখার মতো দৃশ্য। ঘোড়ার পিঠে ঋজু হয়ে আছে সে। মাথায় তারার মুকুট। জংলীরা প্রথম এবং শেষ বারের মতো দেখলো তার চেহারা।
দেবী! কাঁপা কাঁপা গলায় চিৎকার করে উঠলো তারা।
ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে চলতে শুরু করলো আয়শা। জ্বলন্ত কালুনের রাজপথ ধরে এগিয়ে চললো রাজ প্রাসাদের দিকে।
পুরোপুরি রাত নেমে আসার আগেই আমরা পৌঁছে গেলাম প্রাসাদে। প্রহরীশূন্য অবস্থায় পড়ে আছে ফটক। শূন্য উঠান পেরিয়ে ঘোড়া থেকে নামলো আয়শা। প্রাসাদে ঢুকলো। পেছনে আমি আর অরোস। একের পর এক খোলা দরজা পেরিয়ে এগিয়ে চলেছি আমরা। কোথাও কোনো সাড়াশব্দ নেই। সবগুলো। ঘর ফাঁকা। সবাই পালিয়েছে নয়তো মারা গেছে।
অবশেষে একটা সিঁড়ির কাছে এলাম। উঠতে শুরু করলো আয়শা। প্রাসাদের চূড়ায় যেখানে শামান সিমব্রির ঘর সেখানে গিয়ে শেষ হয়েছে সিঁড়ি। দেখামাত্র চিনতে পারলাম ঘরটা। আতেন এখানেই হত্যা করার হুমকি দিয়েছিলো। আমাদের। দরজাটা বন্ধ। কি আশ্চর্য! আয়শা সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই আপনা থেকে খুলে গেল ওটা।
আয়শার পেছন পেছন আমরা ঢুকলাম। প্রদীপের মৃদু আলোয় আলোকিত ঘরটা। ঘরের মাঝখানে একটু চেয়ারে বসে আছে লিও। হাত পা বাঁধা চেয়ারের হাতল আর পায়ার সাথে। মুখটা ফ্যাকাসে। কম্পিত হাতে একটা ছোরা ধরে আছে বৃদ্ধ শামান ওর বুকের ওপর। বিধিয়ে দিতে উদ্যত। মাটিতে পড়ে আছে খানিয়া আতেন। চোখ দুটো হাঁ করে খোলা, তাকিয়ে আছে ছাদের দিকে। মারা গেছে কালুনের খানিয়া আতেন, কিন্তু এতটুকু মলিন হয়নি তার রাজকীয় চেহারা।
মুহূর্তের ভেতর এতগুলো ব্যাপার লক্ষ করলাম আমরা। আয়শা তার হাতটা সামান্য নাড়লো। সিমব্রির হাত থেকে খসে পড়ে গেল ছুরি। আর বৃদ্ধ শামান ঘুরে দাঁড়িয়েই ভূত দেখার মতো চমকে উঠে স্থির হয়ে গেল।
ঝুঁকে ছুরিটা তুললো আয়শা। দ্রুত হাতে বাঁধন কেটে দিলো লিওর হাত পায়ের। তারপর ক্লান্ত ভঙ্গিতে বসে পড়লো একটা চেয়ারে। লিও উঠে শূন্য দৃষ্টিতে একবার তাকালো চারপাশে। তারপর বললো-একেবারে ঠিক সময়ে এসেছো, আয়শা! আর এক সেকেণ্ড দেরি করলেই খুনী কুকুরটা। শামানের দিকে ইশারা করলো ও, যাক সময়মতো এসেছিলে। কিন্তু, কি করে এলে তোমরা ঐ প্রচণ্ড ঝড়ের ভেতর দিয়ে? ওহ, হোরেস, তুমি এখনও বেঁচে আছে!