ভয়ঙ্কর বেগে ছুটে চলেছি আমরা। খান র্যাসেন যখন মরণ-শ্বাপদ নিয়ে লিও আর আমাকে তাড়া করেছিলো তখনও সম্ভবত এত জোরে ঘোড়া ছোটাইনি। পেছনে তিন হাজার জংলীর উল্লসিত চিৎকার। খান র্যাসেনের তাড়া খেয়ে যে পথে এসেছিলাম এখন আমরা সে পথে যাচ্ছি না। সমভূমির ওপর দিয়ে কোনাকুনি একটা পথে ছুটছে আয়শা। ফলে অনেক কম সময়ে পৌঁছে গেলাম। কালুনের কাছাকাছি। দুপুরের সামান্য পরে দূরে দেখা গেল কালুন নগরী।
ছোট একটা জলার ধারে ঘোড়া থামালো আয়শা। তিন হাজার জংলী অশ্বারোহীও দাঁড়িয়ে পড়লো। এখানে ঘোড়াগুলোকে পানি খাইয়ে নেয়া হলো। যোদ্ধারাও সঙ্গের পুটুলি থেকে খাবার বের করে খেয়ে নিলো। আমিও সামান্য খেলাম। কিন্তু আয়শা কিছু মুখে তুললো না।
এখানেও কয়েকজন গুপ্তচর দেখা করলো অরোসের সঙ্গে। তাদের কাছে জানা গেল, খানিয়া আতেনের বড় বাহিনীটা নগর পরিখার সেতুগুলো পাহারা দিচ্ছে। আমাদের এই স্বল্পসংখ্যক যোদ্ধা নিয়ে ওদের আক্রমণ করাটা বোকামি হবে। এ সব কথায় কান দিলো না আয়শা। ঘোড়াগুলোর একটু বিশ্রাম হতেই আবার এগোনোর নির্দেশ দিলো সে।
আবার কয়েক ঘণ্টা একটানা ঘোড়া ছুটিয়ে চলা। ঘোড়ার খুরের সম্মিলিত আওয়াজ ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই। আয়শা কোনো কথা বলছে না, ওর সঙ্গী তিন সহস্র বুনো মানুষও নিপ। মাঝে মাঝে ঘাড় ফিরিয়ে তাকাচ্ছে পেছনে।
আমিও তাকালাম একবার। সে দৃশ্য ভোলার নয়। কালো মেঘে ছেয়ে গেছে পেছনের আকাশ। মেঘের প্রান্তগুলো আগুনের মতো লাল। মাথার ওপর দিয়ে স্বর্গীয় সেনাবাহিনীর মতো এগিয়ে চলেছে যেন আমাদের সাথে সাথে। এমন কালো মেঘ আমি জীবনে কখনও দেখিনি। মাত্র বিকেল এখন, কিন্তু মনে হচ্ছে সন্ধ্যা নেমে এসেছে প্রকৃতিতে। প্রায় অন্ধকার হয়ে গেছে পেছনের সমভূমি। মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে নিঃশব্দে। দেখে মনে হচ্ছে কোনো যোদ্ধা যেন মেঘের গায়ে তীব্র আঘাত হানছে হাতের খোলা তলোয়ার দিয়ে।
ক্রমশ এগিয়ে আসছে কালুন। একটু পরে দেখতে পেলাম ওদের দ্বিতীয় এবং বৃহত্তর বাহিনীটাকে। ভয় পাওয়ার মতোই দৃশ্য বটে। আকাশে পুঞ্জ পুঞ্জ মেঘের মতোই ঘন সন্নিবিষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সৈনিকরা, ঘোড়সওয়াররা। আমরা যেমন ওদের দেখেছি তেমনি ওরাও দেখেছে আমাদের।
একটু পরেই দেখলাম একজন দূত এগিয়ে আসছে ঘোড়ায় চেপে। আয়শা হাত উঁচিয়ে সংকেত দিতেই থেমে গেলাম আমরা। আরও এগিয়ে এলো দূত। চিনতে পারলাম লোকটাকে। সাবেক খানের এক পারিষদ। লাগাম টেনে দৃঢ় কণ্ঠে সে বলতে লাগলো-শুনুন, হেস, খানিয়া আতেনের কথা। আপনার প্রিয়তম, বিদেশী প্রভু এখন বন্দী তার প্রাসাদে। এখোনোর চেষ্টা করলেই আপনাকে এবং আপনার ছোট্ট দলটাকে আমরা ধ্বংস করে দেবো। দেখতেই পাচ্ছেন কি বিশাল বাহিনী তৈরি রয়েছে এখানে। তবু যদি কোনো অলৌকিক উপায়ে আপনি জয়ী হন, কালুনের প্রাসাদে পৌঁছুনোর আগেই মারা যাবে আপনার প্রিয়তম। তার চেয়ে আপনি আপনার পাহাড়ে ফিরে যান, খানিয়া প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন আপনাকে এবং আপনার লোকদের অক্ষত অবস্থায় ফিরে যাওয়ার সুযোগ দেবেন তিনি। এখন বলুন, আপনার যদি কিছু বলার থাকে।
ফিসফিস করে অরোসকে কিছু বললো আয়শা। অবোস উঁচু গলায় শুনিয়ে দিলো কথাগুলো–কিছু বলার নেই। প্রাণের মায়া থাকলে পালাও এক্ষুণি, মৃত্যু তোমার পেছনেই।
হতাশ মুখে ঘোড়া ছুটিয়ে দিলো দূত। কিন্তু আয়শা তক্ষুণি রওনা হওয়ার নির্দেশ দিলো না আমাদের। গভীর চিন্তায় ডুবে গেছে ও।
একটু পরেই আমার দিকে তাকালো আয়শা। পাতলা মুখাবরণের ভেতর দিয়ে দেখতে পাচ্ছি ওর মুখ। সাদা, ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে। চোখ দুটো সিংহীর চোখ রাতের বেলা যেমন জ্বলে তেমন জ্বলছে। দাঁতে দাঁত চেপে হিসহিসে স্বরে সে বললো–নরকের মুখ দেখার জন্যে তৈরি হও, হলি! ভেবেছিলাম সম্ভব হলে ওদের মাফ করে দেবো। পারলাম না। আমার সব গোপন শক্তি প্রয়োগ করে হলেও আমি লিওকে জীবিত দেখতে চাই। ওরা ওকে খুন করতে চাইছে!
তারপর ও পেছন ফিরে চিৎকার করে উঠলো, ভয় পেয়ো না সর্দাররা। তোমরা সংখ্যায় কম, কিন্তু তোমাদের সঙ্গে আছে লক্ষ লক্ষ সৈনিকের শক্তি। হেসাকে অনুসরণ করো, যা-ই ঘটুক না কেন, ভয় পেয়ো না বা হতাশ হয়ো না। তোমাদের সৈনিকদের জানিয়ে দাও একথা। বলো, ভয়ের কিছু নেই, হেসার বর্মের আড়ালে তোমরা সেতু পেরিয়ে কালুন নগরীতে প্রবেশ করবে।
সর্দাররা যার যার যোদ্ধাদের কাছে গিয়ে জানিয়ে দিলো আয়শার নির্দেশ।
আমরা আপনার পেছন পেছন নদী পেরিয়েছি, হেস, চেঁচিয়ে জবাব দিলো বুনো লোকগুলো, এতদূর এসেছি বিনা বাধায়। আপনি এগিয়ে চলুন, আমরা আছি আপনার পেছনে।
নির্দেশ দিলো আয়শা। বর্শার ফলার মতো চেহারায় দাঁড়িয়ে গেল ঘোড় সওয়াররা। আয়শা রইলো ফলার একেবারে মাথায়। অরোস আর আমি একটু পেছনে আগের মতোই পাশাপাশি।
তীক্ষ স্বরে একবার শিঙ্গা বেজে উঠলো কোথাও। পর মুহূর্তে কাছের এক পপলার বন থেকে সার বেঁধে বেরিয়ে এলো কালুনের বিরাট এক অশ্বারোহী বাহিনী। দ্রুত বেগে আমাদের চারদিক থেকে ঘিরে ফেলার চেষ্টা করছে তারা। এদিকে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা বাহিনীটাও এগোতে শুরু করেছে। প্রথমে ঘোড়সওয়াররা তারপর পদাতিকরা।