ভালোই ফন্দি এঁটেছিলো আতেন, দাঁতে দাঁত চেপে বললো আয়শা। কিন্তু, হলি, আমার প্রভু কি আঘাত পেয়েছে?
খুব একটা না। জ্ঞান হারানোর আগ মুহূর্তে দেখেছিলাম, ওই দুজনের সঙ্গে লড়ছে। মুখ থেকে বোধহয় একটু রক্তও পড়তে দেখেছিলাম। আর কিছু মনে নেই।
প্রতি বিন্দুর জন্যে একশোটা করে জীবন নেব। আমি শপথ করে বলছি, হলি।
ইতিমধ্যে শিবির ভেঙে কঙ্কাল উপত্যকায় জড়ো হতে শুরু করেছে উপজাতীয় সেনাবাহিনী। পাঁচ হাজার সৈনিকের অশ্বারোহী বাহিনীও এসে গেছে। সবগুলো দলের সর্দারকে ডেকে পাঠালো আয়শা। ভাষণ দিলো ও ওদের উদ্দেশ্যে।
হেস-এর ভৃত্যরা, শুরু করলো আয়শা, তোমাদের প্রভু, আমার অতিথি এবং হবু স্বামী লিওকে কৌশলে বন্দী করে নিয়ে গেছে খানিয়া আতেন ও তার লোকজন। যতদূর অনুমান করতে পারছি, ওঁকে জিম্মি হিসেবে আটক রাখবে। আমার ধারণা খুব বেশি দূর যেতে পারেনি ওরা আমাদের প্রভুকে নিয়ে। সুতরাং এই মুহূর্তে রওনা হতে হবে আমাদের। ঝড়ের বেগে নদী পেরিয়ে আমরা আক্রমণ করবো খানিয়ার বাহিনীকে। আজ রাতে আমি কালুনে ঘুমাতে চাই। কি বলো, অরোস, দ্বিতীয় এবং আরও বড় একটা কাহিনী থাকবে নগর প্রাচীর রক্ষা করার জন্যে? থাকুক, প্রয়োজন হলে ঐ কাহিনীও আমি ধ্বংস করে দেবো, মিশিয়ে দেবো বাতাসের সঙ্গে। না, অবাক হওয়ার কিছু নেই। ধরে নাও ওর মারা গেছে।
ঘোড়সওয়াররা, আমার পেছন পেছন এসো। পদাতিকরা, তোমরা এগিয়ে যাবে আমাদের দুপাশ দিয়ে। যে পিছু হটবে বা এগোতে ভয় পাবে তার জন্যে অপেক্ষা করছে মৃত্যু। আর অকার সম্পদ ও সম্মান, যারা সাহসের সঙ্গে এগিয়ে যাবে তাদের জন্যে। হ্যাঁ, আমি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, কালুনের উর্বরা জমি তোমাদের হবে। এবার যাও, প্রত্যেকে যার যার দল প্রস্তুত করে নাও। এক্ষুণি রওনা হবো আমরা।
উৎফুল্ল কণ্ঠে সমস্বরে চিৎকার করে উঠলো সর্দাররা। হিংস্র জাতি ওরা, পুরুষানুক্রমে যুদ্ধপ্রিয়, তার ওপর হেসার প্রতিশ্রুতি সম্পদ ও সম্মান প্রদানের। উফুল্ল হওয়ারই কথা।
প্রায় এক ঘণ্টা ঢাল বেয়ে নামার পর জলাভূমির কাছে পৌঁছুলো সেনাবাহিনী। সামনে কোনো প্রতিবন্ধক দেয়া গেল না, যদিও সবাই মনে মনে আশা করছিলো, ছোট বা বড় যা-ই হোক না কেন, বানিয়ার কোনো বাহিনী থাকবে এখানে। নেই দেখে আমাদের সেনাপতিরা হতাশ হলো না খুশি হলো বুঝতে পারলাম না।
কিছুক্ষণ পর নদী তীরে পৌঁছুলাম আমরা। এবার দেখা গেল খানিয়ার সৈনিকদের। ওপারে দীর্ঘ সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে। নদীর মাঝখানেও দেখলাম, কয়েকশো কালুন সেনা। বল্লম উঁচিয়ে অপেক্ষা করছে। কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে রইলো আমাদের সৈনিকরা। তারপর প্রচণ্ড বুনো উল্লাসে চিৎকার করে ঝাঁপিয়ে পড়লো নদীতে। অশ্বারোহীরা নড়লো না। অপেক্ষা করতে লাগলো পদাতিকদের কি অবস্থা হয় দেখার জন্যে। কয়েক মিনিট মাত্র লাগলো নদীর মাঝের শত্রুদের ছত্রভঙ্গ করে দিতে। প্রাণ ভয়ে হাচড়ে পাচড়ে পাড়ে উঠতে লাগলো তারা। ধাওয়া করে গেল আমাদের সৈনিকরা। এই সময় অরোস এসে জানালো, এক গুপ্তচর এই মাত্র খবর নিয়ে এসেছে, সে লিওকে হাত পা বাঁধা অবস্থায় একটা দুই চাকাওয়ালা ঘোড়ায় টানা গাড়িতে দেখেছে। আতেন, সিমব্রি আর এক রক্ষীও ছিলো সঙ্গে। পূর্ণ বেগে কালুনের দিকে ছুটে চলেছে তারা।
ইতিমধ্যে আমাদের কিছু সৈনিক নদীর অপর পাড়ে উঠতে পেরেছে। শত্রু সেনারা ধেয়ে এলো ওদের দিকে। কয়েক মিনিট লড়ে পিছিয়ে আসতে বাধ্য হলো আমাদের সৈনিকরা। পর পর তিনবার এমন পিছিয়ে আসতে হলো ওদের। ক্ষয় ক্ষতিও কম হলো না। অধীর হয়ে উঠলো আয়শা।
ওদের নেতা দরকার, বললো ও, আমি নেতৃত্ব দেবো। এসো আমার সাথে, হলি, বলেই ঘোড়া ছুটিয়ে দিলো আয়শা। ঘোড়সওয়ার বাহিনীর মূল অংশটা অনুসরণ করলো ওকে। মহা উল্লাসে চিৎকার করতে করতে ঝাঁপিয়ে পড়লো নদীতে। শত সহস্র তীর বল্লম ছুটে আসতে লাগলো শত্রুর দিক থেকে। ডানে বাঁয়ে আমাদের অনেক ঘোড়া এবং আরোহীকে লুটিয়ে পড়তে দেখলাম। কিন্তু আমার বা এক কি দুগজ সামনে সাদা আলখাল্লা মোড়া আয়শার গা স্পর্শ করলো না একটাও। পাঁচ মিনিটের মাথায় নদীর অপর পাড় দখল করে নিলাম আমরা। এবার শুরু হলো আসল লড়াই।
একটু পিছিয়ে গিয়েছিলো কালুনের বাহিনী। আমরা পাড় দখল করা মাত্র হামলা চালালো আবার। আমাদের মতো ওরাও মাঝখানে অশ্বারোহী আর দুপাশে পদাতিক বাহিনী মোতায়েন করেছে। আমাদের পদাতিকরা মুখোমুখি হলো ওদের পদাতিকদের, আর ঘোড়সওয়াররা ওদের ঘোড়সওয়ারদের। দুপক্ষই সমানে বর্ষণ করছে তীর আর বল্লম। হতাহতও হচ্ছে সমানে সমানে। কিছুক্ষণ পর খেয়াল করলাম, খুব ধীরে হলেও আমরা এগোচ্ছি। আগেই বলেছি তীর বল্লম আমাদের দিকে আসছে কিন্তু অদৃশ্য কোনো শক্তির প্রভাবে যেন আমাদের গায়ে লেগে আশপাশ দিয়ে চলে যাচ্ছে। সামনে, পেছনে, দুপাশে লড়ছে আমাদের সৈনিক, ঘোড়সওয়াররা। জখম হচ্ছে, মরছে; কিন্তু ভূক্ষেপ নেই কারও।
অবশেষে শক্ত বাহিনীর ব্যুহ ভেদ করে বেরিয়ে এলাম আমরা। প্রায় আধ মাইল মতো ছুটে গিয়ে থামলাম কিছুক্ষণের জন্যে। পাঁচ, দশ বা বিশ, পঞ্চাশ জনের ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে হাজির হতে লাগলো আমাদের ঘোড়সওয়াররা। সামান্য সময়ের ভেতর হাজার তিনেক লোক জড় হয়ে গেল। শেষ দলটা উপস্থিত হওয়ার পর মিনিট পাঁচেক অপেক্ষা করলো আয়শা। আর কেউ এলো না দেখে হাত উঁচু করে এগোনোর নির্দেশ দিলো। কালুন নগরীর পথে ছুটে চললো জংলীবাহিনী। পুরোভাগে আয়শা। তার সামান্য পেছনে পাশাপাশি আমি আর অবোস।