পাগল নাকি ও? বললো লিও। এই মাঝাত্তিরে অমন জায়গায় গেছে, তাও আবার একা! হ্যাঁ, ওর পক্ষেই সম্ভব এমন অর কাজ।
আমারও মনে হলো, এমন অসম্ভব কাজ ওর পক্ষেই সম্ভব। তবু ইতস্তত করতে লাগলাম। অবশেষে আধা ইচ্ছায় আধা অনিচ্ছায় রওনা হলাম দূতের পেছন পেছন। আমাদের তলোয়ার, বর্শা নিয়ে নিলাম। রক্ষীদেরও ডেকে নিলাম। মোট বারো জন। একটা কথা ভেবে নিশ্চিন্ত বোধ করলাম, এর ভেতর কোনো কৌশল থাকলে রক্ষীদের নিয়ে যেতে বলা হতো না।
পথে দুজায়গায় প্রহরীরা থামালো আমাদের। সংকেত শব্দ বলতেই ছেড়ে দিলো। আমাদের যারা চিনতে পারলে তাদের মুখে বিস্ময়ের ছাপ পড়তে দেখলাম। ওরা কি কিছু সন্দেহ করছে? বুঝতে পারলাম না।
গিরিখাতের ধার দিয়ে নেমে চললাম আমরা। বেশ ঢালু পথ। তাল রাখতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। কিন্তু আমাদের পথ-প্রদর্শক পূজারী অনায়াসে নেমে চলেছে, যেন নিজের বাড়ির বাঁধানো সিঁড়ি বেয়ে নামছে।
রাত দুপুরে এমন অদ্ভুত জায়গায়! সন্দেহের সুর লিওর গলায়। রক্ষীদের দলনেতাও কিছু একটা বিড়বিড় করলো। আমি বোঝার চেষ্টা করছি ও কি বললো, এই সময় গিরিখাতের নিচে অস্পষ্ট সাদা একটা অবয়ব দেখতে পেলাম। আয়শার মুখ ঢাকা মূর্তিই মনে হলো।
হেস! হেস! বলে উঠলো রক্ষী দলনেতা। স্বস্তির ভাব তার কণ্ঠস্বরে।
দেখ ওকে, বললো লিও, এই ভয়ঙ্কর জায়গায় কেমন ঘুরে বেড়াচ্ছে, যেন হাইড পার্কে বেড়াতে এসেছে। বলেই ছুটে গেল ও আয়শার দিকে।
ঘুরে আমার দিকে তাকালো মূর্তি। পেছন পেছন যাওয়ার ইশারা করে হাঁটতে শুরু করলো।
কঙ্কাল ছাওয়া উপত্যকায় পৌঁছলাম। না থেমে এগিয়ে চললো আয়শা। কিছুদূর গিয়ে নিচু একটা চূড়ার কাছে থামলো। সেখানেও চারপাশে ছড়িয়ে আছে অসংখ্য কঙ্কাল। আমাদের পথপ্রদর্শক পুরোহিত দাঁড়িয়ে পড়লো রক্ষীদের নিয়ে–হেসার নির্দেশ ছাড়া তার কাছাকাছি যাওয়া বারণ। আমি এগিয়ে গেলাম। লিও সাত আট গজ সামনে। ওকে বলতে শুনলাম- এই রাতে এমন জায়গায় কি জন্যে এসেছে, আয়শা? বিপদ ঘটতে কতক্ষণ?
জবাব দিলো না আয়শা। হাত দুপাশে ছড়িয়ে দিয়ে আবার নামিয়ে আনলো। বিস্মিত হয়ে আমি ভাবছি, এটা কোনো সংকেত কিনা? হলে কিসের? এমন সময় অদ্ভুত এক আওয়াজ উঠলো চারপাশ থেকে। অনেক লোক যেন হুটোপুটি করছে।
ভুরু কুঁচকে তাকাতেই দেখলাম, ছড়িয়ে থাকা কঙ্কালগুলো উঠে দাঁড়িয়েছে। প্রত্যেকের হাতে বল্লম। চারপাশ থেকে ঘিরে ফেলে এগিয়ে আসছে আমাদের দিকে।
ভূত বিশ্বাস করি না আমি। জানি আয়শার কোনো কৌশল এটা, তা ছাড়া এমন হতে পারে না। তবু এতগুলো কঙ্কালকে আচমকা দাঁড়িয়ে পড়তে দেখে সত্যি ভূত দেখার মতোই চমকে উঠলাম। শিরশির একটা অনুভূতি হলো শরীর জুড়ে।
এ আবার কোন্ ধরনের পৈশাচিকতা? ভয় আর রাগ মেশানো স্বরে চেঁচিয়ে উঠলো লিও।
এবারও কোনো জবাব দিলো না সাদা আলখাল্লা পরা মৃর্তি। পেছনে শব্দ শুনে ঘাড় ফিরিয়ে তাকালাম। আমাদের রক্ষীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে কাল। বাহিনী।:কঙ্কালগুলোকে দাঁড়িয়ে পড়তে দেখেই ভয়ে আধমরা হয়ে গিয়েছিলো জংলীগুলো। বাধা দেয়ার কথা বোধ হয় মনেও পড়েনি বেচারাদের। এক এক করে সব কজনকে বল্পমে গেঁথে ফেললো শত্র: লিওর দিকে বল্লম উঁচিয়ে গেল এক কঙ্কাল। ঘোমটা টানা মৃর্তি হাত উঁচু করলো।
উঁহুঁ, ওকে বন্দী করো! আমার নির্দেশ, ওর যেন কোনো ক্ষতি না হয়।
কণ্ঠস্বরটা আমার চেনা। কালুনের খানিয়া আতেনের।
ষড়যন্ত্র! চিৎকার করতে চাইলাম আমি; পারলাম না। তার আগেই জ্ঞান হারালাম মাথায় শক্ত, ভারি কিছুর আঘাতে।
.
২২.
যখন জ্ঞান ফিরলো তখন দিন হয়ে গেছে। মাথায় অসহ্য যন্ত্রণা। অরোসের শান্ত মুখটা ঝুঁকে আছে আমার ওপর। আমাকে চোখ মেলতে দেখেই খানিকটা তরল পদার্থ ঢেলে দিলো আমার গলায়। সাথে সাথে আশ্চর্য প্রতিক্রিয়া হলো আমার ভেতরে। মনের ওপর জমে থাকা ঘষা কাচের মতো একটা পর্দা যেন গলে যেতে লাগলো। যন্ত্রণা দূর হয়ে গেল কয়েক সেকেন্দ্রে ভেতর। তারপর দেখলাম আয়শাকে। অরোসের পাশে দাঁড়িয়ে আছে।
কি সর্বনেশে কাণ্ড! তুমি বেঁচে আছে, আমার প্রভু লিও কোথায়? চিৎকার করলো ও। বলো কোথায় লুকিয়ে রেখেছো আমার প্রভুকে? বলো—না হলে মরবে!
হিমবাহের তুষারে যখন ডুবে মরতে বসেছিলাম তখন জ্ঞান হারানোর আগে এই দৃশ্যটাই দেখেছিলাম, এই কথাগুলোই জিজ্ঞেস করেছিলো আয়শা।
আতেন নিয়ে গেছে ওকে।
তোমাকে জীবিত রেখে ওকে নিয়ে গেছে আতেন!
আমার ওপর রাগ দেখিও না। আমার কোনো দোষ নেই।
এরপর আমি সংক্ষেপে বর্ণনা করলাম রাতের ঘটনা।
নিঃশব্দে শুনলো আয়শা। ধীর পায়ে এগিয়ে গেল নিহত রক্ষীদের দিকে। গম্ভীর মুখে দেখলো কিছুক্ষণ।
আচ্ছা! তাই তো ভেবে পাচ্ছিলাম না, ওরা মরলো কিভাবে? অবশেষে সে বললো। তারপর এগিয়ে গেল আরেকটু-যে জায়গা থেকে লিওকে বন্দী করা হয়েছিলো সেখানে। ভাঙা একটা তলোয়ার পড়ে আছে। জিনিসটা খান রাসেনের। র্যাসেন মারা যাওয়ার পর ওটা লিওর সম্পত্তিতে পরিণত হয়। তলোয়ারটার পাশে দুটো মৃতদেহ। কালো আঁটো পোশাক তাদের পরনে। মাথা এবং মুখ খড়িমাটি দিয়ে সাদা করা। হাত, পা এবং বুকেও খড়িমাটির দাগ দিয়ে কঙ্কালের চেহারা দেয়া হয়েছে।