আগের জীবনে কি কি ঘটেছে, কি কি করেছে স্পষ্ট মনে আছে তোমার? আমি জিজ্ঞেস করলাম।
না। টুকরো টুকরো কিছু স্মৃতি কেবল আছে। গোপন সাধনা—তোমরা যাকে বলো যাদু-তার মাধ্যমে পরে মনে করেছি, তা-ও সম্পূর্ণ পারিনি। যেমন ধরো, হলি, আমার মনে পড়ে তোমার কথা। নোংরা কাপড়চোপড় পরা কুৎসিত এক দার্শনিককে আমি দেখেছিলাম। আলেকজাণ্ডারের সঙ্গে গোলমাল বাধিয়েছিল লোকটা। আলেকজাণ্ডার তাকে হত্যা করেছিলো অথবা ডুবিয়ে মেরেছিলো—ঠিক মনে নেই।
নিশ্চয়ই ডায়োজেনেস নামে ডাকা হতো না আমাকে?
না, ডায়োজেনেস আরও বিখ্যাত লোক ছিলো। কিন্তু ও কি! সামনের ওরা আক্রান্ত হয়েছে মনে হচ্ছে!
আয়শার কথা শেষ হতে না হতেই দূর থেকে ভেসে এলো চিৎকার, কোলাহলের শব্দ। এবং সঙ্গে সঙ্গে দেখতে পেলাম দীর্ঘ এক অশ্বারোহীর সারি ছত্রভঙ্গ হয়ে পিছিয়ে যাচ্ছে। একটু পরেই অগ্রবর্তী বাহিনীর কয়েকজন সৈনিক এক বন্দীকে নিয়ে হাজির হলো আমাদের কাছে। তারা জানালো, নিছক একটু খোঁচা দেয়ার জন্যে এগিয়ে এসেছিলো আতেনের বাহিনীটা। ঝড়ের বেগে এসে পড়ে ওদের ওপর, তারপরই পিছিয়ে গেছে আবার। এই অদ্ভুত আক্রমণের কারণটা বোধগম্য হলো না আমাদের। তবে একটু পরেই আটক লোকটাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে জানা গেল, পবিত্র পাহাড়ের ওপর যুদ্ধ করার কোনো ইচ্ছা নেই খানিয়ার। আমরা যতক্ষণ না নদীর ওপারে পৌঁছুচ্ছি ততক্ষণ ঠায় অপেক্ষা করার নির্দেশ দিয়েছে সে চাচা সিমব্রিকে। আমরা যাতে অবশ্যই নদী অতিক্রম করি সেজন্যে একটু উস্কানি দিলো সিমব্রি এই আক্রমণের মাধ্যমে।
সুতরাং সেদিন কোনো যুদ্ধ হলো না।
সারা বিকেল আমরা পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে চললাম! সূর্যাস্তের সামান্য আগে পৌঁছুলাম এক প্রশস্ত ঢালু জায়গায়। ঢালটা শেষ হয়েছে পাহাড়ে ওঠার দিন যেখানে আমরা নরকঙ্কাল ছড়িয়ে থাকতে দেখেছিলাম, যেখানে সাক্ষাৎ হয়েছিলো রহস্যময়ী পথ-প্রদর্শকের সঙ্গে সেই উপত্যকার প্রান্তে। এখানে রাতের মতো ছাউনি ফেলা হলো।
অশ্বারোহী আর পদাতিকদের এখানে রেখে। আয়শার সঙ্গে আমরা বাঁয়ে মোড় নিয়ে এগিয়ে গেলাম কয়েকটা ছোট ছোট চূড়ার দিকে। সেগুলোর ওপাশে একটা সুড়ঙ্গ মতো। মশাল জ্বেলে আমরা এগিয়ে চললাম অন্ধকার সুড়ঙ্গের ভেতর দিয়ে। অবশেষে পৌঁছুলাম ওপাশে। এখানেই রাত কাটাবো আমরা। সুড়ঙ্গের মুখে প্রহরী থাকবে, নিরাপদে ঘুমাতে কোনো অসুবিধা হবে না।
আয়শার জন্যে একটা তাবু খাটানো হলো। একটাই মাত্র তাবু ছিলো সঙ্গে, সুতরাং আমি আর লিও শখানেক গজ দূরে কয়েকটা পাথরের আড়ালে আশ্রয় নিলাম। কয়েকজন প্রহরী রইলো আমাদের সঙ্গে। এ অবস্থা দেখে ভীষণ রেগে গেল আয়শা। খাদ্য এবং সাজসরঞ্জামের দায়িত্ব যে সর্দারের ওপর তাকে ডেকে বকাঝকা করলো। বোকার মতো মুখ করে শুনলো বেচারা। তবু জিনিসটা কি তা-ই জানে না, তো ব্যবস্থা করবে কি?
অরোসকেও ধমকালো আয়শা। বিনীতভাবে পূজারীপ্রধান জবাব দিলো, সে ভেবেছিলো আমরা যুদ্ধের কঠোর কষ্ট সম্পর্কে ওয়াকেবহাল এবং অভ্যস্ত। শেষ পর্যন্ত নিজের ওপরই রাগ দেখাতে লাগলো আয়শা। বার বার বলতে লাগলো কেন আমি খেয়াল করলাম না খুঁটিনাটি বিষয়গুলো? শেষে যোগ করলো, তাহলে তোমরা তাঁবুতে ঘুমাও, আমি বাইরে থাকি। এখানকার ঠাণ্ডায় আমি অভ্যস্ত।
লিও হেসে উড়িয়ে দিলো ওর কথা। এরপর খোলা আকাশের নিচে বসে খেয়ে নিলাম আমরা-আমি আর লিও আশেপাশে প্রহরীরা থাকায় আয়শা ঘোমটাই খুললো না। ফলে আমাদের সুখেতে পারলো না। পরে তাঁবুতে ঢুকে খেয়েছিলো কিনা জানি না।
খাওয়ার পর আমরা আর দেরি না করে শুতে চলে গেলাম। আয়শাও ঢুকলো। ওর তাঁবুতে। প্রহরীরা ছাড়াও সুড়ঙ্গের ওপাশে রয়েছে পুরো বাহিনী। সুতরাং শোয়ার প্রায় সাথে সাথে নিশ্চিন্ত মনে ঘুমিয়ে পড়লাম দুজন।
.
দূর থেকে ভেসে আসা চিৎকারে ঘুম ভেঙে গেল আমার। মনে হলো কোনো প্রহরী কারও পরিচয় জিজ্ঞেস করলো। এক মুহূর্ত পরে শুনতে পেলাম আমাদের প্রহরীরে দলনেতার জবাব। কি একটা প্রশ্নও করলো সে। উল্টোদিক থেকে আরেকটা। জবাব ভেসে এলো। কয়েক সেকেণ্ডের নীরবতা। তারপর একজন পূজারী কুর্নিশ করে এসে দাঁড়ালো আমার সামনে। মশাল তার হাতে। লোকটার চেহারা চেনা চেনা মনে হলো।
আমি– একটা নাম বললো সে, এখন আর নামটা মনে নেই আমার। পূজারী প্রধান অরোস আমাকে পাঠিয়েছেন। উনি বললেন, হেসা এক্ষুণি আপনাদের দুজনের সাথে আলাপ করতে চান।
ইতিমধ্যে হাই তুলতে তুলতে উঠে বসেছে লিও। ব্যাপার কি, জিজ্ঞেস করলো। আমি বললাম।
সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করলেই পারতো, বললো ও। যাক, ডেকেছে যখন যেতে হবে। চলো, হোরেস।
আবার কুর্নিশ করলো পূজারী। আপনাদের অস্ত্র আর রক্ষীদেরও নিয়ে যেতে বলেছেন হেসা।
কি! বিস্ময় প্রকাশ করলো লিও। নিজেদের সেনাবাহিনীর মাঝখানে থেকে একশো গজ যাবো তাতে আবার রক্ষী লাগবে!
হেসা তার তাবু ছেড়ে বেরিয়ে গেছেন, ব্যাখ্যা করলো নোকটা। গিরিখাতের মুখে আছেন এখন। কোন দিক দিয়ে বাহিনী নিয়ে গেলে সুবিধা হবে, পর্যবেক্ষণ করছেন।
তুমি কি করে জানলে এত কথা? আমি জিজ্ঞেস করলাম।
অবোস বলেছেন। হেসা ওখানে একা আছেন তাই রক্ষীদের নিয়ে যেতে বলেছেন।