এরপর মিশর থেকে কোর-এ চলে এলো আয়শার গল্প। এবং এই সময় অবোসও হাজির হলো কামরায়। কুর্নিশ করে দাঁড়ালো।
উহ, তোমার জন্যে একটা ঘণ্টাও কি শান্তিতে কাটাতে পারবো না? বিরক্তকণ্ঠে বললো আয়শা। কি চাই?
ও হেস, খানিয়া আতেনের কাছ থেকে একটা লিপি এসেছে।
খুলে পড়ো, আদেশ করলো আয়শা, তারপর আপন মনেই বলতে লাগলো, আর কি লিখবে? অনুতাপ হয়েছে মনে, ক্ষমা চাই, আর কি?
অরোস, পড়তে শুরু করলো-শৈল চূড়ার মন্দিরের হেসা, যিনি পৃথিবীতে আয়শা নামে পরিচিত এবং পৃথিবীর ওপরে যখন সুযোগ পান খসে পড়া তারা-র মতো ঘুরে বেড়ান—
.
বাহ! চমৎকার সম্বোধন, বলে উঠলো আয়শা, কিন্তু, আতেন, খসে পড়া তারা আবার উঠবে, পাতাল ফুঁড়ে উঠলেও উঠবে। পড়ো, অরোস।
.
শুভেচ্ছা, ও আয়শা। আপনি প্রাচীন, অনেক জ্ঞান সঞ্চয় করেছেন বিগত শতাব্দীগুলোয়। সেই সঙ্গে এমন ক্ষমতাও অর্জন করেছেন যার বলে মানুষকে মোহাবিষ্ট করে তাদের চোখে আপনি সুন্দর বলে প্রতীয়মান হন। তবে একটা জ্ঞানের বা ক্ষমতার অভাব রয়েছে আপনার। তা হচ্ছে এখনও যা ঘটেনি তা দেখার বা জানার ক্ষমতা। শুনুন, ও আয়শা, আমি এবং আমার মহাজ্ঞানী পিতৃব্য আসন্ন যুদ্ধের ফলাফল কি হবে জানার আশায় সব স্বর্গীয় পুস্তকাদি ঘেঁটে দেখেছি।
লেখা আছে: আমার জন্যে মৃত্যু, তাতে আমার কোনো দুঃখ নেই, বরং বলতে পারেন সানন্দচিত্তে আমি বরণ করবো এই নিয়তি। আপনার জন্যে নির্ধারিত আছে আপনার নিজের হাতে তৈরি একটি বর্শা। আর কালুনের ভাগ্যে রক্তপাত আর ধ্বংস যার জননী আপনি।
আতেন,
কালুনের খানিয়া।
.
নিঃশব্দে শুনলো আয়শা। এক বিন্দু কাঁপলো না ওর ঠোঁট বা বিবর্ণ হলো না মুখ। গর্বিত ভাবে অরোসকে বললো-আতেনের দূতকে জানিয়ে দাও, আমি বার্তা পেয়েছি, জবাব দেবো কালুনের রাজপ্রাসাদে গিয়ে। এবার যাও, পূজারী, আর বিরক্ত কোরো না আমাকে।
.
পরদিন দুপরে আমরা রওনা হলাম। পাহাড়ী ঢাল বেয়ে নেমে চলেছি উপজাতীয় সেনাবাহিনী নিয়ে। হিংস্র, বুনো চেহারার মানুষ সব। অগ্রবর্তী সৈনিকরা সামনে, তারপর অশ্বারোহী বাহিনী; তাদের ডানে, বামে এবং পেছনে পদাতিকরা। বিভিন্ন দলে ভাগ হয়ে এগিয়ে চলেছে। প্রতিটা দলের নেতৃত্ব দিচ্ছে একেকজন গোত্রপতি অর্থাৎ সর্দার।
অত্যন্ত বেগবান এবং সুদর্শন একটি সাদা মাদী ঘোড়ার পিঠে চেপে চলেছে আয়শা। ঘোড়সওয়ার বাহিনীর মাঝামাঝি জায়গায় রয়েছে ও। ওর পাশে লিও আর আমি। লিও খান র্যাসেনের কালো ঘোড়ায় আর আমি অমনই আরেকটা ঘোড়ার পিঠে বসে আছি। আমাদেরকে ঘিরে থেকে এগোচ্ছে সশস্ত্র পূজারী আর বাছাই করা যোদ্ধাদের একটা দল।
সবার মন বেশ প্রফুল্প। শেষ শরতের না শীত না গরম আবহাওয়া। উজ্জ্বল সূর্যালোকে হাসছে প্রকৃতি। যত ভয় বা শঙ্কা-ই থাক এমন পরিবেশে আপনিই মন ভালো হয়ে ওঠে। তার ওপর হাজার হাজার সশস্ত্র সঙ্গীর সাহচর্য আর আসন্ন যুদ্ধের কল্পনায় উত্তেজিত হয়ে আছে স্নায়ু। আমার চেয়ে লিও আরও বেশি উৎফুল্ল। বহুদিন ওকে এত প্রাণোচ্ছল দেখিনি। আয়শাও উৎফুল্ল।
ওহ! কতদিন! বললো আয়শা। কতদিন পর পাহাড়ের ঐ কন্দর ছেড়ে বেরোলাম! মুক্ত পৃথিবীর মাঝে এসে কি যে আনন্দ আজ লাগছে! দূরের ঐ চূড়ায় দেখ, তুষার জমে আছে, কি সুন্দর! নিচে পাহাড়ী ঢলের দিকে তাকাও, তার ওপাশে সবুজ মাঠ! সূর্য! বাতাস! আহ কি মিষ্টি!
বিশ্বাস করো, লিও, বিশ শতাব্দীরও বেশি হয়ে গেছে, শেষবার আমি ঘোড়ায় চড়েছি, কিন্তু দেখ, এখনও ভুলিনি ঘোড়ায় চড়ার কায়দা কৌশল। তবে যা-ই বলো, আরবী ঘোড়ার তুলনায় এগুলো কিছু না। ওহ! আমার মনে আছে, বেদুঈনদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে বাবার পাশে পাশে ঘোড়া ছুটিয়ে গিয়েছিলাম। আমার বাবা মহান এক মানুষ ছিলেন, অন্য একদিন বলবো তার কথা।
ঐ দেখ সেই গিরিখাত। ওর ওপাশে থাকতো সেই বিড়াল উপাসক। পুরোহিত, আরেকটু হলেই তোমরা যার লোকদের হাতে মরতে বসেছিলে। একেক সময় আমার আশ্চর্য লাগে, এই বিড়াল পূজার ব্যাপারটা এখানে চালু হলো কি করে! সম্ভবত আলেকজাণ্ডারের সেনাপতি প্রথম রাসেনের সঙ্গে মিসর থেকে এসেছিলো ঐ প্রথা। অবশ্য র্যাসেনকে পুরোপুরি দোষ দেয়া যায় না। ও বিড়াল উপাসক ছিলো না, ওর সঙ্গে যে সব ধর্মগুরু এসেছিলো তাদের কেউ গোপনে বিড়াল পূজা করতো। এক সময় সুযোগ বুঝে ব্যাটা জংলীদের ভেতর চালু করে দেয় তার আসল বিশ্বাস। সেরকমই মনে পড়ছে আমার। এই মন্দিরের প্রথম হেসা ছিলাম আমি তা জানো? র্যাসেনের সঙ্গে এসেছিলাম।
বিস্মিত চোখে আয়শার দিকে তাকালাম আমি আর লিও।
কি বিশ্বাস হলো না তো? বললো ও। তুমি, হলি, তোমার মতো সন্দেহবাতিকগ্রস্ত মানুষ আমি দেখিনি। ভাবছো আলেকজান্ডারের সময় আমি এখানে এলাম কি করে, আর যদি এসেই থাকি তাহলে আবার কোর-এ গেলাম কি করে? শোনো, সেটা আমার এ জীবনের কথা নয়, আগের জন্মের কথা। মেসিডোনিয়ার আলেকজাণ্ডার আর আমি একই গ্রীষ্মে জন্ম নিয়েছিলাম। ওকে ভালোভাবে চিনতাম, যুদ্ধবিগ্রহের ব্যাপারে আমি ছিলাম ওর প্রধান মন্ত্রণাদাতা। পরে আমাদের ভেতর ঝগড়া হয়। র্যাসেনকে নিয়ে চলে আসি আমি। সেদিন থেকেই আলেকজাণ্ডার নামক নক্ষত্রের উজ্জ্বলতা মলিন হতে শুরু করে।