.
আর একদিন সন্ধ্যার পর এই একই বিষয়ে আলাপ করছি আমরা। আলাপ ঠিক না, আয়শা বলে যাচ্ছে আমি আর লিও শুনছি। বলতে বলতে তন্ময় হয়ে গেছে আয়শা। ভবিষ্যতের কল্পনায় উজ্জ্বল দুচোখ। এই সময় অরোস ঢুকলো ঘরে। মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে সম্মান জানালো।
কি চাই, পূজারী? প্রশ্ন করলো আয়শা।
মহামহিমাময়ী হেসা, গুপ্তচররা ফিরে এসেছে।
তো আমি কি করবো? নিরাসক্ত ভঙ্গিতে বললো ও। কেন পাঠিয়েছিলে ওদের?
আপনি নির্দেশ দিয়েছিলেন তাই।
এতক্ষণে যেন সচেতন হলো আয়শা। বেশ, কি খবর এনেছে ওরা?
দুঃসংবাদ, হেস। কালুনের লোকেরা মরীয়া হয়ে উঠেছে। ওখানে এখন যে খরা চলছে তার জন্যে ওরা ওদের দেশের ওপর দিয়ে আসা বিদেশীদের দায়ী করছে। খানিয়া আতেনও প্রতিশোধ নেয়ার জন্যে পাগল হয়ে উঠেছে। দিন রাত পরিশ্রম করছে। এর ভেতরেই নাকি দুটো বিরাট বাহিনী প্রস্তুত করে ফেলেছে। একটা চল্লিশ হাজারের অন্যটা বিশ হাজারের। খানিয়া তার চাচা শামান সিমব্রির অধিনায়কত্বে বিশ হাজারি বাহিনীটা পাঠাবে পবিত্র মন্দির জয়ের উদ্দেশ্যে। কোনো কারণে যদি ঐ বাহিনী পরাজিত হয়, ও নিজে আসবে বড় বাহিনীটা নিয়ে।
খবর বটে যাহোক, তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বললো আয়শা। ও কি পাগল হয়ে গেছে। আমার বিরুদ্ধে লড়বে! হলি, আমি জানি আমাকে মনে মনে পাগল। ভাবো তোমরা, এবার দেখবে আসলে কে পাগল, আর আমি কি মিথ্যে বড়াই করি না, যা বলি তাই করি?
হঠাৎ কেমন যেন আনমনা হয়ে গেল আয়শা। চোখ দুটো দেখে মনে হয় এখানকার কিছু নয়, বহু দূরের কিছু দেখছে-সম্মোহিত হয়ে দেখছে।
মিনিট পাঁচেক একটানা একদিকে অমন তাকিয়ে রইলো ও। অখণ্ড নিস্তব্ধতা কামরায়। আমরা তাকিয়ে আছি ওর দিকে।
ঠিকই বলেছে তোমার গুপ্তচররা, অরোস, হঠাৎ বলে উঠলো আয়শা। এখন যত তাড়াতাড়ি আমি তৎপর হবো তত কম মরবে আমার মানুষ। প্রভু লিও, যুদ্ধ দেখবে? না, তোমার কোনো বিপদ ঘটুক তা আমি চাই না। তুমি এখানে মন্দিরের নিরাপদ আশ্রয়ে থাকবে। আমি যাবো আতেনের মোকাবেলার জন্যে।
তুমি যেখানে যাবে আমিও সেখানে যাবো, সাফ সাফ জানিয়ে দিলো লিও। না, না, আমার মিনতি শোনো, তুমি এখানেই থাকবে।
আবার সেই আগলে রাখার প্রবণতা। লাল হয়ে উঠলো লিওর মুখ, লজ্জায় না রাগে জানি না। কাটা কাটা গলায় বললো, আমি যা বলেছি তার নড়চড় হবে না।
তুমি যেখানে যাবে আমিও সেখানে যাবো।
হতাশ চোখে লিওর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো আয়শা। তারপর ফিরলো অরোসের দিকে।
যাও, পূজারী! সব কজন সর্দারকে জানিয়ে দাও হেস-এর নির্দেশ। আগামী চাঁদের শুরু যে রাতে সে রাতে ওরা যেন জড়ো হয়। না, সবাই না, বিশ হাজার হলেই চলবে। বাকিরা মন্দির পাহারা দেবে। বলে দেবে, বাছাই করে সেরা লোকগুলোকে যেন নেয়। আর পনেরো দিনের মতো খাবার যেন নিয়ে আসে সঙ্গে করে।
কুর্নিশ করে বিদায় নিলো পূজারী-প্রধান।
২১-২৪. দুদিন পর
২১.
দুদিন পর।
যুদ্ধের শুভফল কামনা করে বিশেষ এক পূজা অনুষ্ঠান হলো মন্দিরে। আমরা তাতে যোগ দিলাম না। তবে রাতে যথারীতি এক সাথে খেতে বসলাম। আয়শার মেজাজ মর্জির কোনো থই পেলাম না এ সময়। এই হাসি, পরমুহূর্তে খেপে উঠছে। বুঝতে পারছি কোনো কারণে বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে ওর মন।
জানো, বললো ও, আজ পাহাড়ের ঐ গর্দভগুলো কি করেছে? ওদের সর্দারদের পাঠিয়েছে হেসাকে জিজ্ঞেস করতে, কিভাবে যুদ্ধ হবে; শত্রুদের কাকে কাকে মারতে হবে, কাকে কাকে হবে না বা সম্মান দেখাতে হবে, ইত্যাদি ইত্যাদি। আমি-আমি কোনো জবাব দিতে পারলাম না। শেষমেশ কথার ফুলঝুরি ছুটিয়ে বুঝিয়ে দিলাম, যা ইচ্ছা করতে পারে ওরা। যুদ্ধ কি হবে ভালোই জানি। আমি নিজে পরিচালনা করবো। কিন্তু ভবিষ্যৎ-ওহ! যদি জানতে পারতাম! এই একটা ব্যাপারে আমার কোনো ক্ষমতা নেই। ভবিষ্যতের কথা ভাবলেই মনে হয়, কালো দেয়াল যেন আমার সামনে।
এরপর ঘাড় গুঁজে অনেকক্ষণ চুপ করে রইলো আয়শা। অবশেষে মুখ তুলে তাকালো লিওর দিকে।
আমার অনুরোধ রাখবে না তুমি? কয়েকটা দিন চুপচাপ থাকবে ন এখানে? না হয় কয়েকটা দিন শিকার করে এলে?, আমিও না হয় থাকবো তোমার সঙ্গে। হলি আর অবোসই পারবে যুদ্ধ পরিচালনা করতে।
না না না! সরোষে বললো লিও। আমার ধারণা আমাকে যুদ্ধে পাঠিয়ে ও নিরাপদ আশ্রয়ে রইবে-আয়শার এই প্রস্তাবে বিশেষভাবে খেপে গেছে লিও। কিছুতেই অমন কাজ আমার দ্বারা হবে না। যদি এখানে রেখে যাও ঠিকই আমি পথ খুঁজে নিয়ে যুদ্ধে যোগ দেবো।
বেশ, তুমিই তাহলে নেতৃত্ব দেবে যুদ্ধের।…না, না, তুমি না, প্রিয়তম, আমি–আমিই পরিচালনা করবো যুদ্ধ।
এরপর হঠাৎ করেই বাচ্চা মেয়ের মতো উজ্জ্বল হয়ে উঠলো আয়শা। কারণে অকারণে হাসতে লাগলো খিল খিল করে। সুদূর অতীতের অনেক গল্প শোনালো। সে যুগের দু’একটা কৌতুকও শোনালো। অবশেষে ব্যক্তিগত প্রসঙ্গে এলো সে। কিভাবে সত্যের সন্ধান করেছে, জ্ঞানের অন্বেষণে ঘুরে বেড়িয়েছে দেশে দেশে; সে যুগে প্রচলিত ধর্মবিশ্বাসগুলো বিশ্লেষণ করেছে এবং প্রত্যাখ্যান করেছে; তারপর নিজের মতো করে একটা ধর্মবিশ্বাস গড়ে তুলে তা প্রচার করেছে। জেরুজালেমে ওই ধর্মমত প্রচার করার সময় লোকেরা ওর গায়ে পাথর ছুঁড়ে মেরেছিলো। তখন ও নিজের দেশ আরবে ফিরে যায়। সেখানেও প্রত্যাখ্যাত হয়। অবশেষে চলে আসে মিশরে। মিশরের ফারাও-এর রাসভায় তখনকার সেরা এক যাদুকরের সাথে সাক্ষাৎ হয়। তার সব কৌশল ও শিখে নেয়, এবং শিগগিরই বেচারাকে ওর তাঁবেদার বানিয়ে ফেলে।