আর আমি যেমন ছিলাম তেমনই আছি-কুৎসিত, কদাকার। বয়স ষাটের ওপর হয়ে গেছে, কিন্তু শক্তি সামর্থ্য এক বিন্দু কমেনি, বরং মাঝে মাঝে মনে হয় একটু যেন বেড়েছে। শরীর আগের মতো এখনও পেটা লোহার মতো। আশ্চর্য হওয়ার মতো ব্যাপার হলো, গত ষোলো বছরে দুর্ঘটনার কবলে পড়েছি বেশ কয়েকবার কিন্তু অসুস্থ হইনি একবারওনা আমি, না লিও। কঠোর পরিশ্রম আমাদের শরীরকে সত্যি সত্যিই যেন লোহায় রূপান্তরিত করেছে। নাকি আমরা অন্তত প্রাণের সৌরভ বুক ভরে টেনে নিয়েছিলাম তাই এমন হয়েছে?
রাত শেষ হতেই রাতের ভয়গুলো কেটে গেছে। অনাহারে মরার দুশ্চিন্তাও আর নেই। কাল দুপুরের পর কিছু খাইনি, প্রায় সারারাত হেঁটেছি, তবু খুব একটা ক্ষুধা বা ক্লান্তি বোধ করছি না। ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালাম আমরা। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালাম চারপাশে। সামনে এক ফালি উর্বর জমি, তার ওপাশ থেকেই শুরু হয়েছে বিস্তৃত মরুভূমি। গাছহীন, জলহীন, বালুময়। শীতের প্রথম তুষার ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে এখানে সেখানে। তার ওপাশে প্রায় আশি কি একশো মাইল দূরে মাথা তুলেছে একসারি পাহাড়। অসংখ্য বরফ ছাওয়া সাদা চূড়া অস্পষ্টভাবে দেখতে পাচ্ছি এখান থেকে।
সূর্যের প্রথম রশ্মি যখন সেগুলোর ওপর পড়লো, আমার মনে হলো, বিশেষ কিছু একটা যেন ধরা পড়েছে লিওর দৃষ্টিতে। ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে আছে সে পেছন দিকে।
দেখ, হোরেস, ঐ যে ওখানে, বিবর্ণ বিরাট কিছু একটার দিকে ইশারা করলো লিও। যে জিনিসটা দেখাতে চাচ্ছি ইতিমধ্যে সেটার ওপরেও আলো পড়েছে। আমাদের যে পাশে মরুভূমি তার উল্টোপাশে প্রকাণ্ড এক পাহাড়। এখান থেকে অন্তত দশ মাইল দূরে ওটার চূড়া। পাহাড়টা ঢালু হতে হতে যেখানে এসে মরুভূমির সঙ্গে মিশেছে সেখানে দাঁড়িয়ে আছি আমরা।
এখন পাহাড়টার চূড়া কেবল আলোকিত। কিন্তু সূর্য যত ওপরে উঠতে লাগলো ততই বন্যার তোড়ের মতো আলো নেমে আসতে লাগলো পাহাড়ের গা বেয়ে। অবশেষে আমাদের শ তিনেক ফুট ওপরে ছোট এক অধিত্যকায় পৌঁছুলো। সূর্য-রশ্মি। সেখানে, অধিত্যকার কিনারে বসে আছে বিরাট এক মূর্তি। আমাদের—মানে মরুভূমির দিকে প্রসারিত তার দৃষ্টি। বিপুলায়তন বুদ্ধ। মূর্তির পেছনে হলুদ পাথরে তৈরি অর্ধচন্দ্রাকৃতির মঠ।
শেষ পর্যন্ত! চিৎকার করে উঠলো লিও, ওহ, ঈশ্বর! পেয়েছি শেষ পর্যন্ত! দুহাতে মুখ ঢাকলো ও। ফোপাতে ফোঁপাতে হাঁটু গেড়ে বসে ধীরে ধীরে উপুড় হয়ে মুখ গুঁজে দিলো তুষারে।
কিছুক্ষণ ওভাবে ওকে পড়ে থাকতে দিলাম। নিজের হৃদয় দিয়ে আমি বুঝতে পারছি কি ঝড় চলছে ওর হৃদয়ে। ইয়াকটার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। হতভাগ্য জন্তুটা আমাদের আনন্দের কণামাত্র ভাগও নিতে পারছে না। ক্ষুধার্ত চোখে চারদিকে তাকাচ্ছে কেবল। চামড়ার কম্বল আর পোশাকগুলো ভাজ করে তুলে দিলাম তার পিঠে। তারপর ফিরে এলাম লিওর কাছে। একটা হাত রাখলাম ওর কাধে।
ওঠো, লিও, মঠটা যদি জনশূন্য না হয় ওখানে আমরা খাবার এবং আশ্রয় পাবো। চলো, শিগগিরই ঝড় উঠবে মনে হচ্ছে।
নিঃশব্দে উঠে দাঁড়ালো ও। দাড়ি এবং কাপড় থেকে তুষার ঝেড়ে ফেলে আমার সঙ্গে হাত লাগালো ঠেলে ইয়াকটাকে দাঁড় করাবার জন্যে। আশ্চর্য এক প্রশান্তিময় আনন্দ-দ্যুতি ছড়িয়ে পড়ছে ওর মুখ থেকে।
তুষার ছাওয়া ঢাল বেয়ে উঠতে শুরু করলাম আমরা।
মালভূমির কিনারে পৌঁছে গেলাম এক সময়। সামনে দেখতে পাচ্ছি হলদে পাথরে গড়া মঠটা। কিন্তু ওতে মানুষজন আছে বলে তো মনে হচ্ছে না! তুষারের ওপর একটা পায়ের ছাপও নজরে পড়ছে না। জায়গাটা পোড়ো নাকি? কথাটা মনে হতেই দমে গেল বুক। চারপাশ ভালো করে দেখে মঠের ওপর দিকে দৃষ্টি ফেললাম। সঙ্গে সঙ্গে লাফিয়ে উঠলো হৃদয়। সরু একটা ধোঁয়ার রেখা, বেরুচ্ছে চিমনি দিয়ে।
মঠের কেন্দ্রস্থলে বড়ো একটা দালান। নিঃসন্দেহে মন্দির ওটা। কিন্তু ওদিকে গেলাম না আমরা। সামনে খুব কাছেই দেখতে পাচ্ছি একটা দরজা। এর প্রায় ওপরেই ধোঁয়া উঠতে দেখেছি। এগিয়ে গিয়ে ধাক্কা দিলাম দরজায়। সেই সঙ্গে চিৎকার।
দরজা খুলুন! দরজা খুলুন! আমরা পথিক, আপনাদের দয়া ভিক্ষা করছি।
প্রথমে কিছুক্ষণ কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না। তারপর হাল্কা একটা পদশব্দ! থেমে গেল। কাঁচ-কুচ আওয়াজ তুলে খুললো দরজা। জীর্ণ হলুদ কাপড়ে মোড়া থুথুরে এক বুড়ো দাঁড়িয়ে আছে দরজায়।
কে! কে? জিজ্ঞেস করলো বৃদ্ধ, শিং-এর চশমার ভেতর দিয়ে পিটপিট করে তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে। কে তোমরা আমাদের শান্তি ভঙ্গ করতে এসেছো!?
পথিক, বৃদ্ধের ভাষাতে-ই জবাব দিলাম আমি। নিরীহ, শান্তিপ্রিয় পথিক, অনাহারে মৃত প্রায়, আপনাদের দয়া চাই।
শিং-এর চশমার ভেতর দিয়ে তীক্ষ্ণ্ণ চোখে তাকালো বৃদ্ধ আমাদের মুখের দিকে। তারপর পোশাকের দিকে। তার মতো আমাদের পরনেও জীর্ণ লামাদের পোশাক।
তোমরা লামা? সন্দেহের সুর বৃদ্ধের গলায়। কোন মঠের?
লামা অবশ্যই, জবাব দিলাম আমি। মঠের নাম পৃথিবী, যেখানে হায়, সবারই খিদে পায়।
জবাব শুনে মনে হলো বেশ খুশি হয়েছে বৃদ্ধ। মুখ টিপে একটু হেসে মাথা নাড়লো।
অপরিচিত লোকদের মঠে ঢুকতে দেয়া আমাদের নিয়ম বিরুদ্ধ। আমাদের ধর্মাবলম্বী হলেও না হয় একটা কথা ছিলো। তা যে তোমরা নও তা তোমাদের চেহারা দেখেই বুঝতে পারছি।