একটু দাঁড়াও। বাধা দিলো ওদের লিও। সর্দার, আমাকে একটু ধরো।
হাঁটুর নিচে বেশ ব্যথা করছে, সাহায্য ছাড়া হাঁটতে পারবো না। আমাকে ফেলে কি শিকার করবে তোমরা?
কি করছো? চেঁচিয়ে উঠলো আয়শা। পাগল হয়েছো?
জানি না পাগল হয়েছি কিনা, তবে এটুকু জানি তুমি বড় পাজী মেয়েমানুষ, ন্যায়-অন্যায়ের কোনো বোধ নেই। এদের মতো সাহসী মানুষ আমি খুব কম দেখেছি। ঐ যে ও, এক জংলীর দিকে ইশারা করলো লিও, আমার নির্দেশে ও-ই প্রথমে এগিয়ে গিয়েছিলো চিতাটাকে মারার জন্যে। ও যখন পড়ে যায় তখন আমি এগিয়ে যাই। ওদের মতো সাহসী আর ভালো মানুষ হয় না, আর তুমি কিনা ওদের খামোকা হত্যা করার নির্দেশ দিচ্ছো! ওদের যদি মরতে হয় আমাকেও মরতে হবে। ওরা যা করার আমার নির্দেশেই করেছে।
বিস্ময়ের দৃষ্টিতে শিকারীরা তাকালো ওর দিকে। আর আয়শা, কয়েক মুহূর্ত চুপ করে কি যেন ভাবলো। তারপর বেশ চালাকের মতো বললো-সত্যি কথা বলতে কি, প্রিয়তম লিও, পুরো ঘটনাটাই আমি দেখেছি, যেটুকু দেখতে পাইনি, ওদের মুখে শুনেছি, এবং তারই ভিত্তিতে ওদের শাস্তি দিতে যাচ্ছিলাম। ঠিক আছে, তুমি যখন তা চাও না, ওদের মাফ করে দিচ্ছি। যা তোরা।
মাথা নুইয়ে বেরিয়ে গেল জংলী কজন। আয়শা উদ্বিগ্ন মুখে এগিয়ে গেল লিওর দিকে, কতখানি ব্যথা পেয়েছে না পেয়েছে এ সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করতে লাগলো। অরোসকে ডাকবে কিনা ক্ষতস্থান পরিষ্কার করার জন্যে জানতে চাইলো।
না, বললো লিও।
তাহলে আমিই পরিষ্কার করে দি, বললো আয়শা।
না। আমাকে নিয়ে দুর্ভাবনা না করলেও চলবে, আমাকে কি দুধের বাচ্চা পেয়েছো? শান্তভাবে কথাক’টা বললো, পর মুহূর্তে তীব্র রোষে ফেটে পড়লো লিও: ভেবেছো কি তুমি, হ্যাঁ, আমি যা পছন্দ করি না তোমার সেই যাদু দিয়ে আমার ওপর গোয়েন্দাগিরি চালাচ্ছো কেন? কেন ঐ নিরপরাধ ভালো মানুষগুলোকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করতে চাইছিলে? কেন আমি বাইরে বেরোলে আমার নিরাপত্তার ভার অন্যের ওপর দাও? তুমি কি ভাবো আমি নিজেকে রক্ষা করতে পারি না? বলো, জবাব দাও, আয়শা!
কিছুই জবাব দিলো না আয়শা। চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো শুধু। জলে থৈ থৈ করে উঠলো তার বিশাল দুচোখ। মুখ নিচু করতেই বৃষ্টির ফোঁটার মতো টপ টপ করে পড়লো মর্মরের মেঝেতে।
ভোজবাজির মতো একটা ব্যাপার ঘটলো এবার। লিও প্রায় ছুটে গিয়ে ধরলো আয়শাকে। করুণ কণ্ঠে ক্ষমা চাইতে লাগলো বার বার।
দুনিয়ার যে যা ইচ্ছে বলুক কিছু এসে যায় না, কিন্তু, লিও, তুমি যদি শক্ত কথা বলো আমি সইতে পারি না। ওহ, তুমি নিষ্ঠুর, তুমি নিষ্ঠুর। কেন আমি তোমাকে এমন আগলে রাখতে চাই, যদি বুঝতে প্রাণের আগুনের কাছে যাওয়ার আগেই যদি তুমি বিদায় নাও এ পৃথিবী থেকে, আমার অবস্থা কি হবে একবার ভাবো; কি করবো আমি তখন? বলো, লিও, একবার দুহাজার বছর অপেক্ষা করেছি, আবার বিশ বছর, এরপর কত বছর অপেক্ষা করবো?
যতদিন আমি তোমার মতো অনন্ত জীবন না পাচ্ছি ততদিন তো সে ভয় থাকবেই, বললো লিও, সুতরাং ও নিয়ে দুশ্চিন্তা না করাই কি ভালো নয়? দুশ্চিন্তা কোরো না, বললেই কি নিশ্চিন্তে থাকা যায়? বলে দ্রুত পায়ে চলে গেল আয়শা।
.
২০.
সারা দুনিয়ার ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখছে আয়শা। প্রতি সন্ধ্যায় খেতে বসে ও আলোচনা করে আমাদের অপার সম্ভাবনাময় ভবিষ্যতের কথা। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বর্তমান বিশ্ব, তার রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক পরিস্থিতি সম্পর্কে আমার কাছে জানতে চায়। আমি বলি। তারপরও পরিকল্পনা করে, কিভাবে বিভিন্ন দেশের ওপর শাসন প্রতিষ্ঠা করবে। ব্যপারটা ওর অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে। প্রতিটা দিন ঐ এক কথা। আমি ওকে কয়েকটা খসড়া মানচিত্র এঁকে দিয়েছি, যতটা সম্ভব ওতে চিহ্নিত করেছি পৃথিবীর দেশ ও মহাদেশগুলো। ওগুলোও নেড়ে চেড়ে দেখে ও। এখন যেখানে আছে সেখান থেকে কি করে ওসব দূরের দেশে পৌঁছুবে তার জল্পনা কল্পনা করে। এবং সব জল্পনার শেষে ঘোষণা করে। এসব সে করবে তার প্রভু লিওর জন্যে। লিওকে ও পৃথিবীর একচ্ছত্র অধিপতি বানাবে।
একদিন আমি জিজ্ঞেস করলাম, আচ্ছা, পৃথিবীর সব রাজা, রাষ্ট্রনায়কদের কিভাবে তুমি রাজি করাবে ক্ষমতা তোমার হাতে ছেড়ে দিতে? বললেই তো আর তারা তাদের মুকুটগুলো তোমার মাথায় পরিয়ে দেবে না।
ওহ! কি স্বল্প বুদ্ধি তোমার, হলি! মৃদু হেসে বললো আয়শা। জনগণ যখন স্বেচ্ছায় আমাদের বরণ করবে তখন রাজা বা রাষ্ট্রনায়করা বাধা দেবে কি করে? আমরা যখন ওদের মাঝে যাবো আমাদের জ্যোতির্ময় সৌন্দর্য আর অনন্ত পরমায়, নিয়ে এবং ওদের সব জাগতিক চাহিদা পূরণ করবো ওরা চিৎকার করে উঠবে না এসো আমাদের শাসন করো বলে?
হয়তো। সন্দেহের সুর আমার গলায়। কোথায় তুমি প্রথম আবির্ভূত হবে?
আমার আঁকা পূর্ব গোলার্ধের একটা মানচিত্র টেনে নিলো ও। পিকিং-এর উপর আঙুল রেখে বললো, প্রথমে এখানে কয়েক শতাব্দী বসবাস করবো আমরা-ধরো তিন বা পা বা সাত শতাব্দী। আশা করি এর ভেতর ওখানকার মানুষদের আমার মনের তো করে গড়ে নিতে পারবো। এই চীনাদের পছন্দ করেছি কেন জানো? তুমি বলেছো, ওরা সংখ্যায় অগুণতি, ওরা সাহসী, সহনশীল, বুদ্ধিমান। যদিও এখন সঠিক শিক্ষার অভাব আর কুশাসনের কারণে ক্ষমতাহীন, তবু আমার বিশ্বাস ওদের দিয়ে পূরণ হবে আমার উদ্দেশ্য। ওদেরকে জ্ঞান দেব, নতুন ধর্মবিশ্বাস দেবো। আর আমার হলি ওদের ভেতর থেকে বাছাই করা সব মানুষ নিয়ে গড়ে তুলবে অপরাজেয় এক সেনাবাহিনী। সেই সেনাবাহিনীর সহায়তায় সারা দুনিয়ার ওপর শাসন প্রতিষ্ঠিত করবো আমরা। আমার প্রভু লিও হবে পৃথিবীর সম্রাট।