নানা ভাবে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ভেবেছি, জবাব পাইনি প্রশ্নগুলোর। আয়শাকে জিজ্ঞেস করেছি। ও হয় এড়িয়ে গেছে নয়তো ঘোরানো প্যাচানো কথার তোড়ে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে প্রশ্নগুলো কখনও কখনও সরাসরি বলেছে, এসব প্রশ্নের জবাব আমার কাছে জানতে চেয়ো না।
.
লিওকে নিয়ে দুশ্চিন্তার অন্ত নেই আয়শার। মা যেমন সন্তানকে আগলে রাখতে চায় ঠিক তেমন লিওকে সবসময় আগলে রাখতে চায় ও। তবু মাঝে মাঝে লিও বেরিয়ে যায় বাইরে, জংলীদের দু’একজন সর্দার বা পূজারী সঙ্গে থাকে। পাহাড়ী হরিণ, ভেড়া বা ছাগল শিকার করে ফেরে। যতক্ষণ লিও মন্দির এলাকার বাইরে থাকে ততক্ষণ দুশ্চিন্তায় ছটফট করতে থাকে আয়শা।
একদিনের কথা আমার মনে আছে। সেদিনও লিও শিকারে গেছে। আমি যাইনি। বাগানে বসে আছি আয়শার সাথে। দেখছি ওকে। হাতের ওপর মুখ রেখে বসে আছে ও। বড় বড় চোখগুলো তাকিয়ে আছে শূন্য দৃষ্টিতে। গভীর চিন্তায় মগ্ন হয়ে গেলেই কেবল মানুষের দৃষ্টি এমন হতে পারে।
হঠাৎ চমকে উঠে দাঁড়ালো আয়শা। পাহাড়ের এক দিকে মাইল মাইল দূরে ইশারা করে বললো-দেখ!
তাকালাম। কিন্তু সাদা তুষারের স্তর ছাড়া আর কিছুই দেখতে পেলাম না।
কানা কোথাকার, দেখছো না আমার প্রভু বিপদে পড়েছে? চিৎকার করে উঠলো ও। ওহহো, ভুলেই গেছিলাম, তুমি সাধারণ মানুষ, আমার মতো দেখার ক্ষমতা তোমার নেই। নাও আমি দিচ্ছি তোমাকে। আবার দেখ, বলে আমার। কপালের পাশে হাত রাখলো ও। মনে হলো, অদ্ভুত এক অবশ করে দেয়া স্রোত যেন বয়ে যাচ্ছে আমার মাথার ভেতর দিয়ে। দ্রুত বিড়বিড় করে কয়েকটা কথা বললো আয়শা।
মুহূর্তে চোখ খুলে গেল আমার। দেখলাম পাহাড়ের ঢালে একটা তুষার চিতাকে জাপটে ধরে গড়াগড়ি করছে লিও। অন্য শিকারীরা চারদিক থেকে ঘিরে ধরেছে ওদের। বল্লম উঁচিয়ে সুযোগ খুঁজছে চিতাটাকে গেঁথে ফেলার। কিন্তু সুযোগ পেলো না ওরা, তার আগেই লিও ওর হান্টিং নাইফটা আমূল ঢুকিয়ে দিলো চিতার পেটে, তারপর উপর দিকে হ্যাচকা এক টান। সঙ্গে সঙ্গে স্থির হয়ে গেল চিতাটা। উঠে দাঁড়ালো লিও। গর্বিত হাসি মুখে। যেন কিছুই হয়নি।
দৃশ্যটা যেমন হঠাৎ এসেছিলো তেমন হঠাৎই মিলিয়ে গেল। আমার কাঁধে হাত রেখে দাঁড়ালো আয়শা। অতি সাধারণ ভয় পাওয়া রমণীর মতো হাঁপাতে হাঁপাতে বললো– যাক, বাবা, বিপদ কেটে গেছে, কিন্তু আবার আসতে কতক্ষণ?
এরপরই ওর যত রাগ গিয়ে পড়লো লিওর শিকারসঙ্গী জংলী সর্দারের ওপর। তক্ষুণি ক্ষত সারানোর মলম আর পালকি বেহারা পাঠিয়ে দিলো লিওকে নিয়ে আসার জন্যে। আর বলে দিলো, সর্দার আর তার চেলাদেরও যেন ধরে আনা হয়।
.
চারঘণ্টা পর ফিরলো লিও, পালকির পেছনে, খোড়াতে খোড়াতে। সঙ্গী শিকারী দের কষ্ট বাঁচাতে একটা পাহাড়ী ভেড়া আর চিতার চামড়াটা পালকিতে দিয়ে হেঁটে এসেছে নিজে। আয়শা তার শোবার ঘরের পাশে বড় হলঘরটায় অপেক্ষা করছিলো। লিও ঢুকতেই এগিয়ে গেল। হারানো ছেলেকে খুঁজে পেলে মা যেমন করে তেমন আকুল গলায় সমানে দোষ দিয়ে গেল, পাশাপাশি উদ্বেগ প্রকাশ করলো। লিও চুপ করে শুনলো। তারপর জিজ্ঞেস করলো-তুমি জানলে কি করে এত কথা? চিতার চামড়াটাই তো তুমি এখনও দেখনি।
আমি জানি, বললো আয়শা। আমি দেখেছি। হাঁটুর উপরেই সবচেয়ে মারাত্মক জখম হয়েছে। মলম পাঠিয়েছিলাম, লাগিয়েছে?
না। কিন্তু তুমি মন্দির ছেড়ে বেরোওনি, এসব জানলে কি করে? যাদু?
যেভাবেই দেখি; দেখেছি, হলিও দেখেছে।
তোমার এই যাদু দেখতে দেখতে ক্লান্ত হয়ে গেলাম। এক ঘণ্টার জন্যেও কি আমি একটু একা—তোমার খবরদারী ছাড়া থাকতে পারবো না? এই সাহসী মানুষগুলো
এই সময় অবোস ঢুকে ফিসফিস করে কিছু বললো আয়শার কানে।
তোমার এইসব সাহসী মানুষদের সাথে আমি আলাপ করবো, বলে মুখের ওপর ঘোমটা টেনে দিয়ে বেরিয়ে গেল আয়শা। পাহাড়ীদের সামনে ও ঘোমটা ছাড়া যায় না।
কোথায় গেল ও, হোরেস? জানতে চাইলো লিও। মন্দিরে কোনো ক্রিয়া কর্ম করতে?
জানি না। তবে এটুকু বলতে পারি, যদি হয় তো ঐ বেচারা সর্দারের শেষক্রিয়া হতে পারে।
তাই? বলেই ছুটলো লিও আয়শার পেছন পেছন।
এক বা দুমিনিট পর মনে হলো, আমিও গেলেই বুদ্ধিমানের কাজ করবো।
মন্দিরে পৌঁছে দেখলাম, কৌতূহলোদ্দীপক এক দৃশ্যের অবতারণা হয়েছে সেখানে। প্রতিমার সামনে বসে আছে আয়শা। তার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে আছে। পাঁচ জংলী শিকারী আর তাদের সর্দার ভয়ে কাঁপছে সব কজন। এখনও বর্শাগুলো রয়েছে তাদের হাতে। ওদের পেছনে খোলা তলোয়ার হাতে দাঁড়িয়ে আছে বারোজন মন্দির রক্ষী। পাশে পড়ে আছে মরা চিতাটার চামড়া। কম্পিত গলায় সর্দার ব্যাখ্যা করে বোঝাচ্ছে কি করে জন্তুটা একটা বড় পাথরের আড়াল থেকে লাফিয়ে এসে পড়েছিলো প্রভু লিওর ওপর, ওদের কিছুই করার ছিলো না।
উঁহুঁ, বললো আয়শা, আমি সব জানি, তোরা নিজেদের প্রাণ বাঁচানোর। জন্যে কাপুরুষের মতো আমার প্রভুকে ঠেলে দিয়েছিলি হিংস্র জন্তুটার সামনে। মন্দির রক্ষীদের দিকে তাকালো আয়শা, যাও, পাহাড়ে ছেড়ে দিয়ে এসো এদের। আর ঘোষণা করে দাও, যে ওদের আশ্রয় বা আহার দেবে সে মরবে।
কোনোরকম দয়া ভিক্ষা করলো না, করুণা প্রার্থনা করলো না, ধীরে ধীরে উঠে মাথা ঝোকালো সর্দার আর তার সঙ্গীরা। তারপর ঘুরে দাঁড়ালো চলে যাওয়ার জন্যে।