শুনলো আয়শা। মাথা থেকে আলখাল্লার প্রান্তটা কখন নেমে এলো খেয়ালই করলো না। নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইলো হতভম্বের মতো। তারপর হঠাৎ ভেঙে পড়লো কান্নায়। লিওর সামনে গিয়ে বসলো। আস্তে আস্তে মাথাটা নামিয়ে ঠেকালো মাটিতে, ওর পায়ের কাছে।
লিও তাড়াতাড়ি কুঁকে হাত ধরে তুললো আয়শাকে। ধীরে ধীরে হাঁটিয়ে নিয়ে গিয়ে বসিয়ে দিলো গদিমোড়া একটা আসনে। এখনও কাঁদছে আয়শা।
কি করেছে তা যদি জানতে! অবশেষে বললো ও। ওহ, লিও, তুমি–তুমিই একমাত্র বাধা আমার আর তোমার মিলনের মাঝে। কত কষ্ট করে, কত বিপদ পেরিয়ে, কত মোহ-লোভ জয় করে এখানে এসেছে আমাকে পাওয়ার জন্যে! এসে দেখলে এখানে আমার মাঝেই লুকিয়ে আছে তোমার সবচেয়ে ঘৃণার জিনিস। বুঝতে পারছো কি বলতে চাইছি?
সামান্য, পুরো নয়, আস্তে জবাব দিলো লিও!
তোমার চোখে তাহলে বুলি আঁটা বলতে হবে, অস্থির আয়শার কণ্ঠস্বর। আমার ভয়ঙ্কর কুৎসিত চেহারা দেখেও তুমি আমাকে গ্রহণ করতে চেয়েছে, আতেনের রূপ চোখের সামনে থাকতেও ভালোবাসার অমরত্বের অজুহাতে তুমি কুৎসিত আমাকেই নিলে এবং সেজন্যে আমি আমার রূপ, যৌবন, নারীত্ব ফিরে পেলাম। লিও, কাল তুমি যদি আমাকে গ্রহণ না করতে, ঐ ভয়ঙ্কর চেহারা নিয়ে অনন্তকাল আমাকে ধুকে যেতে হতো।
প্রতিদানে আমি কি দিলাম। আমার মনের কুশ্রী দিকটা উন্মোচন করলাম তোমার সামনে। তারপরও তুমি দমলে না, ভালো মন্দ মিলিয়ে আমি যা তাকেই তুমি গ্রহণ করলে। এতখানি মহত্ত্ব তোমার! এখন আমার কারণে যদি তোমার ওপর ভয়ানক অতিলৌকিক কোনো দুর্ভোগ নেমে আসে, হয়তো–
যদি আসে ভোগ করবো, বললো লিও। একদিন না একদিন শেষ হবে দুর্ভোগ। না হলেও ক্ষতি নেই, তোমাকে ছেড়ে চলে গেলেই বা কি সুখটা আমি পাবো? যাক, এখন কয়েকটা ব্যাপার পরিষ্কার করবে আমাদের সামনে? কাল রাতে চূড়ার ওপর তুমি বদলালে কি করে?
আগুনের মাঝ দিয়ে আমি তোমাকে ছেড়ে গিয়েছিলাম, লিও, আগুনের ভেতর দিয়েই আবার ফিরে এসেছি। অথবা–অথবা, পরিবর্তন বলে যা তোমরা দেখছো তা তোমাদের চোখের ভুল, আসলে আমি যা ছিলাম তা-ই আছি। ব্যস, এর চেয়ে বেশি জানতে চেয়ো না।
আরেকটা কথা, আয়শা, একটু আগে আমাদের বাগদান হলো, বিয়ে নয় কেন? কবে তুমি আমাকে বিয়ে করবে?
এখনও সময় হয়নি, বললো আয়শা। একটু কি কেঁপে গেল ওর গলা? একটু ধৈর্য ধরতে হবে তোমাকে, লিও, কয়েক মাস বা এক বছর। ততদিন আমরা বন্ধু বা প্রেমিক-প্রেমিকা হিসেবেই থাকবো।
কেন? একগুয়ের মতো বললো লিও। আমার বয়স তো কমছে না, আয়শা। তাছাড়া মানুষের মৃত্যু কখন কোন্ দিক থেকে হাজির হয় কেউ বলতে পারে? তোমাকে পাওয়ার তৃষ্ণা নিয়েই হয়তো ঝরে যাবে আমার জীবন।
না, না। অমন অলক্ষুণে কথা বোলা না। আবার ভয়ের ছাপ পড়লো আয়শার মুখে। কিছুক্ষণ পায়চারি করলো। তারপর ধীরে ধীরে মাথা নেড়ে বললো, ঠিকই বলেছো, সময়ের বাঁধন তো ছিড়তে পারোনি তুমি। ওহ! আমাকে জীবিত রেখে তুমি মারা যাবে ভাবতেই গা শিউরে ওঠে! আগামী বসন্তেই যখন বরফ গলতে শুরু করবে, আমরা লিবিয়ায় যাবে। প্রাণের অগ্নিধারায় স্নান করবে তুমি। তারপর আমাদের বিয়ে হবে।
ও জায়গা চিরতরে বন্ধ হয়ে গেছে আয়শা।
হতে পারে, তবে তোমার আমার জন্যে নয়। ভয় পেয়ো না, প্রিয়তম, ঐ পাহাড়ে যাওয়ার সব পথ বন্ধ হয়ে গেলেও আমার দৃষ্টি দিয়ে আমি পথ তৈরি করে নেবো। আপাতত অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই, বরফ গলতে শুরু করলেই আমরা রওনা হয়ে যাবো।
তার মানে এপ্রিল-আটমাস, রওনা হওয়ার আগেই এতদিন বসে থাকতে হবে! তারপর পাহাড় পেরিয়ে, সাগর পেরিয়ে, কোর-এর জলাভূমি পেরিয়ে যেতে হবে, তারও পরে খুঁজে বের করতে হবে পাহাড়টাকে। দুবছরের আগে কিছুতেই হবে না, আয়শা।
জবাবে আয়শা কেবল না, না আর না ছাড়া আর কিছু বললো না। অবশেষে, আমার মনে হলো, একটু বিরক্ত হয়েই ও আমাদের বিদায় করে দিলো।
নাহ! হলি, আমরা বিদায় নেয়ার আগে ও বললো, আমি বলছি, কয়েক ঘণ্টা বিশ্রাম নাও, শান্ত সুখে কয়েকটা ঘণ্টা কাটাও, দেখবে সব ঠিক হয়ে গেছে। কাল সকালেই দেখবে সব আর সুন্দর লাগছে। আমি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, কাল সকালেই আমরা সুখী হবো, হ্যাঁ, কাল সকালেই।
.
কেন ও এখনি আমাকে বিয়ে করল না? ঘরে পৌঁছার পর লিওর প্রথম প্রশ্ন।
কারণ ও ভয় পেয়েছে, জবাব দিলাম আমি।
.
১৯.
বেশ কয়েকটা সপ্তাহ কেটে গেছে, বিশেষ কিছু ঘটেনি। আয়শার প্রতিশ্রুতি মতো সুখ পেয়েছি কিনা বলতে পারবে না। সুখের সংজ্ঞা আমার জানা নেই। তবে এটুকু বলতে পারি কোনো কিছুর অভাব বোধ করিনি এই কদিন। মন্দিরের যেখানে খুশি যখন ইচ্ছা যাওয়ার স্বাধীনতা তো আছেই, সেই সাথে পেয়েছি, এখনও পাচ্ছি, পূজারী-পূজারিনীদের অপরিমেয় আন্তরিক সম্মান, তার ওপর আছে আয়শার সাহচর্য। তিন বেলাই আয়শার সাথে আহার করি আমরা।
আয়শা কেন এখনি আমাকে বিয়ে করলো না, আমার অনন্তজীবন পাওয়ার ব্যাপারটা তো বিয়ের পরেও হতে পারতো?—এ প্রশ্নের জবাব এখনও পায়নি লিও। আর আমার প্রশ্ন, এই সে হেস বা আয়শা নামের মেয়েলোকটার চেয়ে হতভাগিনী কেউ কি জন্ম নিয়েছে পৃথিবীতে?
আরও কিছু প্রশ্ন ভীড় করে আছে আমার মাথার ভেতর। আয়শার ক্ষমতা আসলে কতটুকু? ও-কি সত্যিই নারী না অশরীরী আত্মা? কি করে কোর-এর গুহা থেকে ও বা ওর আত্মা এখানে—এই মধ্য এশিয়ার পাহাড় চূড়ায় এলো? শুধুই কি ওর আত্মা এখানে এসেছে, না শরীরও এসেছে? যদি শরীরও এসে থাকে তাহলে হেস-এর পূজারিনী সেই বৃদ্ধার মৃতদেহ কোথায় গেল? অবোস বলেছে, ওরা সকারের ব্যবস্থা করতে গিয়ে দেখে সিংহাসনে বসে আছে আয়শার কুৎসিত রূপ। তাহলে? পুরনো পূজারিনীর দেহ গেল কোথায়? আরও একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন—আয়শা যদি এতই ক্ষমতাশালী হয়, ও কেন আমাদের বা তার হারানো ক্যালিক্রেটিসকে খুঁজতে গেল না? কেন আমরাই তার কাছে আসবো আশা করে বসে রইলো? আতেন যে মিসরীয় আমেনার্তাসের পুনর্জন্ম নেয়া রূপ তা কি ও জানতো না? যদি জানতো তাহলে কেন আতেনকে পাঠিয়েছিলো আমাদের অভ্যর্থনা জানাতে? কেন নিজে যায়নি বা নিজের বিশ্বস্ত কাউকে পাঠায়নি? ধরে নিলাম পাহাড়ের কারও কানের সমভূমিতে পা রাখা বারণ, সেক্ষেত্রে ওর গুপ্তচররা যখন দুর্গম পাহাড়ী এলাকায় আড়ি পেতে আমাদের কথা শুনে এসে ওকে জানায় তখনি কেন ও অন্য পথে আমাদের এখানে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করলো না?