খুব বড় নয় আয়শার ঘর। ছাদ থেকে ঝোলানো প্রদীপের আলোয় দেখলাম, চমৎকার, দামী সব আসবাবপত্র সাজানো। পাথরের দেয়ালগুলোয় সুন্দর কারুকাজ করা পর্দা ঝুলছে। টেবিল চেয়ারগুলো রূপা দিয়ে বাঁধানো। এই ঘরে একজন নারী বাস করে তার একমাত্র প্রমাণ-বেশ কয়েকটা পাত্রে ফুল সাজানো।
টেবিলে খাবার দেয়াই ছিলো। সামান্য জিনিস; আমাদের জন্যে ডিম ভাজি, দই আর ঠাণ্ডা হরিণের মাংস; ওর জন্যে দুধ, ছোট্ট কয়েক টুকরো ময়দার পিঠে আর পাহাড়ী জাম। আয়শা বসে উল্টোদিকের দুটো চেয়ারে আমাদের বসতে ইশারা করলো।
আমি বসে পড়লাম। কিন্তু লিও বসার আগে গায়ের জমকালো আলখাল্লাটা খুলে ছুঁড়ে দিলো একদিকে, হাতের রুপালি দণ্ডটাও-একটু আগে অবোস জোর করে ওর হাতে গুঁজে দিয়েছিলো ওটা।
এসব পবিত্র জিনিসপত্রের ওপর খুব একটা শ্রদ্ধা নেই তোমার তাই না? হেসে জিজ্ঞেস করলো আয়শা।
একটুও না, জবাব দিলো লিও। মন্দিরে যা বলেছিলাম নিশ্চয়ই শুনেছিলে, আয়শা? আমি তোমার ধর্মের কিছুই বুঝি না, এপর্যন্ত যেটুকু দেখেছি তাতে ভক্তি জাগেনি আমার মনে। তারচেয়ে এসো একটা চুক্তি করি, আমরা কেউ কারও ধর্মবিশ্বাসে হস্তক্ষেপ করবে না। রাজি?
আমি ভাবছিলাম রাগে ফেটে পড়বে আয়শা। কিন্তু না, ও সামান্য মাথা ঝোকালো শুধু। নরম করে বললো, তোমার ইচ্ছাই আমার ইচ্ছা, লিও, তোমার ধর্মবিশ্বাস তো আমারও ধর্মবিশ্বাস।
মানে! আমার ধর্মবিশ্বাস তোমার ধর্মবিশ্বাস হবে কেমন করে?
পৃথিবীর সব মহান বিশ্বাস কি এক নয়? সামান্য যেটুকু পার্থক্য তা বহমান সময় আর জনগোষ্ঠীর ভিন্নতার কারণেই। আমি-আমরা বিশ্বাস করি সুমহান এক শুভশক্তি বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে নিয়ন্ত্রণ করছেন। এই শক্তিই ঈশ্বর। তোমার বিশ্বাস কি এর থেকে আলাদা?
না, আয়শা। কিন্তু তোমার? হেস বা আইসিস হলো তোমার দেবী। তার সঙ্গে দূর অতীতে তোমার কি চুক্তি হয়েছিলো তা কখনও বলোনি আমাদের। ভাগ্যক্রমে বা দুর্ভাগ্যক্রমে-যা-ই বলো, কাল রাতে জানলাম। কে এই দেবী হেস?
আমি তার নাম দিয়েছি প্রকৃতির আত্মা। পৃথিবীর যাবতীয় জ্ঞান ও রহস্য লুকিয়ে আছে তার ভেতর।
ভালো কথা। ভক্তরা কেউ অবাধ্য হলে উনি নিশ্চয়ই প্রতিশোধ নেন? যেমন নিয়েছেন আমার—দূর অতীতের আমার ওপর।
টেবিলে কনুই ঠেকিয়ে ঝুঁকে বসলো আয়শা। শান্ত, পূর্ণচোখে তাকালো লিওর দিকে। তোমার যে বিশ্বাস তাতে নিশ্চয়ই দুজন ঈশ্বর আছেন, একজন শুভের অন্যজন অশুভের, একজন ওসিরিস অন্যজন সেট?
মাথা ঝাঁকালো লিও। অনেকটা।
এবং অশুভের দেবতাই শক্তিশালী বেশি, তাই না?
কোনো কোনো ক্ষেত্রে।
তাহলে বলো, লিও, এখনও কি পৃথিবীর নশ্বর মানুষ তুচ্ছ জাগতিক মোহে অশুভের কাছে আত্মবিক্রি করে না?
হ্যাঁ, করে। সেরকম বদলোকের সংখ্যা কম নয় আজকের দুনিয়ায়।
এবং অতীতে যদি কোনো নারী অমন করে থাকে? রূপ, দীর্ঘজীবন, জ্ঞান এবং প্রেমের মোহে পাগল হয়ে–
নিজেকে বিক্রি করলো সেট নামের অপদেবতার কাছে? এইতো তুমি বলতে চাইছো, আয়শা? কম্পিত স্বরে বলতে বলতে উঠে দাঁড়ালো লিও। তুমি-অমন এক নারী?
ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালো আয়শা। যদি হই?
যদি হও–ভেঙে গেল লিওর গলা, ওহ!-সেক্ষেত্রে আমাদের বোধহয় আলাদা হওয়ার সময় এসেছে।
আহ! আর্তনাদ করে উঠলো আয়শা, আচমকা যেন ছুরি বিধেছে তার বুকে। তারপর কি আতেনের কাছে যাবে? উই, তা তুমি পারবে না। আমার আছে ক্ষমতা, আছে লোকবল। আমি-আমি-না না, আর হত্যা করবো না তোমাকে। জীবিত অবস্থায়ই আটকে রাখবো। লিও, লিও, আমার রূপের দিকে তাকাও– একটু ঝুঁকে মোহনীয় ভঙ্গিতে কিছুক্ষণ শরীর দোলালো সে। তারপর হঠাৎ সোজা হয়ে দাঁড়ালো। না, এভাবে তোমাকে প্রলুব্ধ করবো না, প্রিয়তম। তুমি যাও। আমার একাকীত্ব, আমার পাপের মধ্যে আমাকে রেখে তুমি যাও। এক্ষুণি যাও। আতেন তোমাকে আশ্রয় দেবে। দেখো, লিও, আমি আবার ঘোমটা টেনে দিচ্ছি, যাতে আমার রূপ তোমাকে প্রলুব্ধ করতে না পারে। সত্যিই ও আলখাল্লার কোনা দিয়ে আড়াল করে ফেললো মুখ। তারপর হঠাৎ জিজ্ঞেস করলোতুমি আর হলি
আবার মন্দিরে গিয়েছিলে না? মনে হলো তোমাদের দেখলাম দরজায়।
হ্যাঁ, তোমাকে খুঁজতে গিয়েছিলাম।
এবং গিয়ে যা খুঁজছিলে না তা-ও পেলে?
কি ওগুলো আয়শা? ছায়ার মতো, তোমার পায়ে মাথা ঠেকাচ্ছিলো?
আমি অনেক রূপে অনেক দেশ শাসন করেছি, লিও। হয়তো ওরা আমার অতীত পূজারীদের কয়েকজন, হয়তো ওরা তোমার নিছক উত্তপ্ত মস্তিষ্কের কল্পনা, আগুনের পর্দায় যেমন ছবি দেখেছিলে তেমন।
লিও ভিনসি, সত্যি কথাটা এবার শোনো, পৃথিবীর সবকিছুই মায়া, দৃষ্টিবিভ্রম। অতীত, ভবিষ্যৎ বলে কিছু নেই। আমি আয়শা এক কুহকিনী। আমি অসুন্দর যখন তুমি আমাকে অসুন্দর দেখ, আমি সুন্দর যখন তুমি আমাকে সুন্দর দেখ। কল্পনা করো সেই সিংহাসনে বসা রানীর কথা, যার পায়ে মাথা ঠেকাতে দেখেছো ছায়াময় শক্তিদের। সে আমি। আবার সেই কুৎসিত আতঙ্কজনক চেহারার কথা স্মরণ করো। সে-ও আমি। পাপ পুণ্য দুয়ে মিলিয়ে-ই আমি। এখন তুমি সিদ্ধান্ত নাও আমাকে ফেলে চলে যাবে, না আমাকে জড়িয়ে ধরে, ভালোবেসে আমার পাপের ভাগ তোমায় মাথায় তুলে নেবে?
কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো লিও। দু’তিনবার ঘরের এমাথা ওমাথা পায়চারি করলো। অবশেষে বললো, হ্যাঁ, আমি তোমাকে ভালোবেসেছি, পাপপুণ্যে মেশানো তোমাকে। তোমারিওপ ভালোটুকু যদি গ্রহণ করতে পারি, মন্দটুকুও পারবো—পারতে হবে। আমি জানি আমি নিরপরাধ। তবু যদি শাস্তি পেতে হয় তোমার জন্যে, সে শাস্তি আমি মাথা পেতে নেবো।