উপায়ান্তর না দেখে বসলোঁ লিও। পূজারী-পূজারিনীরা আবার সেই অদ্ভুত গানটা শুরু করলো। একসময় আচমকা থেমে গেল গান। আয়শা তার সিসট্রাম নেড়ে ইশারা করলো। পরপর তিনবার মাথা নুইয়ে সম্মান জানালো পূজারী পূজারিনীরা। তারপর ঘুরে দাঁড়িয়ে চলে গেল সারি বেঁধে। অবোস আর পাপাভ কেবল রইলো।
চমৎকার না গানটা? বললো আয়শা। স্বপ্নালু দৃষ্টি চোখে, গানের মায়ায় এখনও যেন আচ্ছন্ন ও। মিশরের বেহবিট-এ আইসিস আর ওসিরিসের বিবাহ উৎসবে গাওয়া হয়েছিলো এ গান। আমি উপস্থিত ছিলাম সে উৎসবে। চলো প্রিয়তমা—আচ্ছা, কি নামে ডাকবো তোমাকে? ক্যালিক্রেটিস না।
আমাকে লিও বলে ডেকো, আয়শা। আগে ক্যালিক্রেটিস ছিলাম না কি ছিলাম এখন কিছুই মনে নেই। এখন আমি লিও, এটাই আমার এখনকার পরিচয়।
বেশ, প্রিয়তম লিও। চলো তোমাদের এগিয়ে দিই মন্দিরের দুয়ার পর্যন্ত। আমি কিছুক্ষণ একা থাকতে চাই। আমাকে ভাবতে হবে। আর—আর কয়েকজন দেখা করতে আসবে, তাদের সাক্ষাৎ দিতে হবে।
.
১৮.
আয়শা এলো না কেন? ঘরে ফিরে প্রথম প্রশ্ন লিওর।
আমি কি করে জানবো? অরোসকে জিজ্ঞেস করে দেখতে পারো, দরজার বাইরেই আছে ও।
আমি ওকে ছাড়া থাকতে পারছি না, হোরেস। মনে হচ্ছে মনে হচ্ছে, অদৃশ্য কিছু যেন ওর দিকে টানছে আমাকে। যাই, অরোসকে জিজ্ঞেস করি, কেন এলো না আয়শা।
অরোস মৃদু হাসলো শুধু। বললো, হেস। এখনও তার ঘরে যাননি। তারমানে এখনও মন্দিরেই আছেন।
তাহলে চললাম ওকে খুঁজতে। অবোস,এসো; তুমিও, হোরেস।
আপনারা যেখানে খুশি যেতে পারেন, সবিনয়ে বললো পূজারী, সব দরজা খোলা আপনাদের জন্যে। কিন্তু আমার ওপর নির্দেশ আছে, আপনাদের দরজা ছেড়ে যেন না নড়ি।
চলো, হোরেস, বললো লিও। নাকি আমি একাই যাবো?
ইতস্তত করছি আমি। অবশেষে বললাম, যেতে পারি, কিন্তু পথ খুঁজে পাবে না তো।
দেখা যাক, পাই কিনা।
একটু আগে যে পথে গিয়েছিলাম সে পথেই আবার মন্দিরের দরজার কাছে পৌঁছুলাম। লোহার দরজা পেরিয়ে বৃত্তাকার কক্ষের কাঠের দরজার সামনে এলাম। বন্ধ দরজা। ঠেলা দিতেই নিঃশব্দে খুলে গেল। জীবন্ত আগুনের শুভগুলো নেই এখন। গাঢ় অন্ধকার প্রায় গোল কামরাটায়। অদ্ভুত এক অনুভূতি হলো আমার। কামরাটা যেন লোকে গিজ গিজ করছে। তাদের পোশাকের স্পর্শ পাচ্ছি গায়ে। ওদের নিঃশ্বাসও অনুভব করছি, কিন্তু তা উষ্ণ নয়, শীতল। মানুষগুলো চলে ফিরে বেড়াচ্ছে যেন। কেমন ভয় ভয় করতে লাগলো আমার। গায়ের লোম খাড়া হয়ে গেছে।
অবশেষে অনেক দূরে আলোর দেখা পাওয়া গেল। অকস্মাৎ জ্বলে উঠেছে দুটো অগ্নিস্তম্ভ প্রতিমা-বেদীর দুপাশে। কিন্তু খুব একটা উজ্জ্বল ভাবে নয়। আমরা ৩০৪
এখনও দরজার কাছে রয়েছি, এত দূরে আলো এসে পৌঁছাই না।
ওখানে সিংহাসনে বসে আছে আয়শা। ও আমাদেরকে দেখতে না পেলেও ওকে আমরা ঠিকই দেখতে পাচ্ছি। অগ্নিস্তম্ভের অস্পষ্ট নীল আলো খেলা করছে ওর অনিন্দ্য শরীরে। খাড়া বসে আছে ও, অদ্ভুত এক অহঙ্কার চেহারায়, দুচোখ থেকে ঠিকরে পড়ছে ক্ষমতার দ্যুতি।
আবছা ছায়ার মতো একটা মূর্তি হাঁটু গেড়ে বসলো তার সামনে। তারপর আরেকটা, আরও একটা, এবং আরও। হাঁটু গেড়ে বসে সবাই একসাথে মাথা নোয়ালো। হাতের সিট্রামটা উঁচু করে তাদের সম্মানের জবাব দিলো আয়শা। ওর ঠোঁট নড়তে দেখলাম, কিন্তু কোনো শব্দ পৌঁছুলো না আমাদের কানে। নিশ্চয়ই পরলোকের আত্মারা পূজা নিবেদন করতে এসেছে!
শুধু আমার নয়, লিওর মনেও সম্ভবত এই একই সম্ভাবনার কথা উঁকি দিয়েছে। কারণ যে মুহূর্তে আমি ওর হাত আঁকড়ে ধরতে গেলাম ঠিক সেই মুহূর্তে ও-ও আঁকড়ে ধরলো আমার হাত। দ্রুত অথচ নিঃশব্দ পায়ে বেরিয়ে এলাম আমরা মন্দির থেকে।
.
প্রায় ছুটতে ছুটতে এসে পৌঁছুলাম আমাদের ঘয়ের কাছে। অরোস এখনও দাঁড়িয়ে আছে দরজায়। স্বভাবসুলভ মেকি হাসিটা ধরা আছে মুখে। ওর পাশ কাটিয়ে ঘরে ঢুকলাম আমরা। একে অপরের দিকে তাকালাম।
কি ও? হাঁপাতে হাঁপাতে জিজ্ঞেস করলো লিও। দেবদুতী?
হ্যাঁ। বা ঐ ধরনের কিছু।
আর ওগুলো-ছায়ার মর্তো-কি করছিলো?
রূপান্তরের পর শুভেচ্ছা জানাচ্ছিল হয়তো। হয়তো ওগুলো ছায়া নয়, ছদ্মবেশী পুরোহিত, গোপন কোনো আচার পালন করছিলো!
কাঁধ ঝাঁকালো লিও, কোনো জবাব দিলো না।
.
অবেশেষে দরজা খুললো। অবোস ঢুকে বললো, হেসা তার ঘরে যেতে বলেছেন আমাদের।
একটু আগে যে দৃশ্য দেখেছি তা মনে হতেই গা শিরশির করে উঠলো, তবু গেলাম।
বসে আছে আয়শা। একটু যেন ক্লান্ত। পূজারিণী পাপাভ এইমাত্র খুলে নিয়েছে তার রাজকীয় আলখাল্লা। ভেতরের সাদা পোশাকটাই শুধু এখন ওর পরনে। ইশারায় লিওকে কাছে ডাকলো। এবার ওদেরকে একটু একা থাকতে দিতে হয়, ভেবে ঘুরে দাঁড়ালাম আমি।
কোথায় যাচ্ছো, হলি, আমাদের ফেলে? মৃদু হেসে জিজ্ঞেস করলো আয়শা। আবার মন্দিরে? অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালো ও। কেন, মায়ের প্রতিমার কাছে কোনো প্রশ্ন আছে? নাকি মা-কে জানাতে চাও জায়গাটা খুব ভালো লেগে গেছে?
আমি কোনো জবাব দিলাম না, সম্ভবত ও আশাও করেনি। কারণ না থেমেই ও বলে চললো, না, তুমি এখানেই থাকো। আমরা তিনজন সেই অতীতের মতো আজ একসাথে খাবো। অরোস, পাপা, তোমরা এখন যাও, দরকার হলে ডাকবো তোমাদের।