ওসিরিসের দণ্ড! লিওর কানে কানে বললাম। এখন থেকে বোধইয় ওসিরিসের অভিনয় করতে হবে তোমাকে।
দেখ, বলে দিচ্ছি, কোনো উদ্ভট দেবতার অভিনয় আমি করতে পারবো না, সোজাসাপ্টা জবাব লিওর। যা হয় হবে, আমি যা বিশ্বাস করি না তা করবো না।
আমি বোঝানোর চেষ্টা করলাম ওকে, ব্যাপারটা অত গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়, কিছুক্ষণ চোখ কান বুজে থাকলেই চুকে যাবে, না হলে আয়শা হয়তো অসন্তুষ্ট হবে, তখন কি ঘটবে কেউ বলতে পারে? ধর্মসংক্রান্ত ব্যাপারে লিওর কোনো গোড়ামি নেই, ভণ্ডামিও নেই। তবু কিছুতেই ও রাজি হলো না যা বিশ্বাস করে না তার অভিনয় করতে। অবশেষে অরোসের কাছে জিজ্ঞেস করলো ও, কি হবে মন্দিরে? একটু রুক্ষ ওর কণ্ঠস্বর।
থতমত খেয়ে প্রথমে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো অরোস। তারপর বললো, বাগদান।
এবার শান্ত হলো লিও। প্রশ্ন করলো, খানিয়া আতেন থাকবে?
না। যুদ্ধ এবং প্রতিশোধের প্রতিজ্ঞা নিয়ে উনি কালুনে ফিরে গেছেন।
রওনা হলাম আমরা। উঠান, সড়ক, সিঁড়ি, বারান্দা পেরিয়ে অবশেষে পৌঁছলাম মন্দিরের সেই উপবৃত্তাকার কক্ষে। শুধু আয়শা নয়, পূজারী পূজারিনীরাও উপস্থিত সেখানে। সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে সবাই। এক সারিতে পূজারীরা, অন্য সারিতে পূজারিনী। আমাদের দেখেই সমবেত কণ্ঠে গান গেয়ে উঠলো তারা। আনন্দের গান। দুই সারির মাঝ দিয়ে এগিয়ে চললাম আমরা। সামনে অরোস, পেছনে পাশাপাশি আমি আর লিও। সারির শেষে দাঁড়িয়ে পড়লো। অরোস। আমরা এগিয়ে গিয়ে দাঁড়ালাম আয়শার মুখোমুখি।
সিংহাসনের পাশে দাঁড়িয়ে আছে আয়শা। লিওর গায়ে যেমন তেমনি জমকালো সুন্দর একটা আলখাল্লা ওরও পরনে। হাতে মণিখচিত সোনার সিস্ট্রাম। আমরা দাঁড়িয়ে পড়তেই সিস্ট্রামটা উঁচু করলো আয়শা। থেমে গেল সমবেত সঙ্গীত।
হের পছন্দের মানুষকে দেখ? জলতরঙ্গের মতো বেজে উঠলো আয়শার কণ্ঠস্বর।
সমবেত পূজারী-পূজারিনীরা সমস্বরে চিৎকার করে উঠলো, হেসার পছন্দের মানুষ, স্বাগতম!
ফাঁকা মন্দিরের দেয়ালে দেয়ালে প্রতিধ্বনি তুলে গমগম করতে লাগলো আওয়াজটা। আমাকে তার পাশে দাঁড়ানোর ইশারা করে লিওর হাত ধরলো আয়শা। কয়েক পা এগিয়ে গেল সাদা পোশাক পরা পূজারী-পূজারিনীদের দিকে। তারপর ওভাবেই লিওর হাত ধরে থেকে বলতে লাগলোহেস-এর পূজারী ও পূজারিনীরা, শোনো। এই প্রথমবারের মতো আমি আমার রূপে তোমাদের সামনে এসেছি। কেন জানো? এই লোকটাকে দেখছো, তোমরা জানো ও বিদেশী, ঘুরতে ঘুরতে ও আমাদের মন্দিরে এসে পড়েছে। কিন্তু না, ও আগন্তুক নয়। অনেক অনেক শতাব্দী আগে ও ছিলো আমার প্রভু, এখন আবার আমার প্রেমের প্রত্যাশায় এসেছে। তাই না, ক্যালিক্রেটিস?
হ্যাঁ, জবাব দিলো লিও।
হেস-এর পূজারী ও পূজারিনীরা, তোমরা জানো, আমি যে পদ অধিকার করে আছি সে-পদের অধিকারী ইচ্ছে করলে একজন স্বামী বেছে নিতে পারে। এরকমই রীতি, তাই না?
হ্যাঁ, ও হেস, ওরা জবাব দিলো।
কয়েক মুহূর্ত চুপ করে রইলো আয়শা। তারপর অপূর্ব মিষ্টি এক ভঙ্গিতে লিওর দিকে ফিরে মাথা ঝোঁকালো পর পর তিনবার। তারপর হাঁটু গেড়ে বসলো। মুখ উঁচু করে বিশাল দু’চোখ মেলে লিওর চোখে চোখে তাকালো। মৃদু মিষ্টি স্বরে বললো: বলো তুমি সমবেত সবার সামনে, এবং যাদেরকে দেখতে পাচ্ছো না তাদের সামনে, আবার তুমি আমাকে বাগদত্তা বধূ হিসেবে গ্রহণ। করছো।
হ্যাঁ, দেবী, গাঢ়, একটু কম্পিত স্বরে বললো লিও, এখন এবং চিরদিনের জন্যে।
নিঃশব্দে দেখছে সবাই। ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালো আয়শা। সিসট্রামটা পড়ে গেল ওর হাত থেকে। টুং-টাং আওয়াজ উঠলো ঘণ্টাগুলো থেকে। দুহাত বাড়িয়ে দিলো ও লিওর দিকে।
লিও-ও ঝুঁকে এলো ওর দিকে। দুজনের ঠোঁট এক হয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ আমি খেয়াল করলাম, রক্তশূন্য ফ্যাকাসে হয়ে গেছে লিওর মুখ। অদ্ভুত এক আভা বিচ্ছুরিত হচ্ছে আয়শার কপাল থেকে, সেই আভায় সোনার মতো দেখাচ্ছে লিওর উজ্জ্বল চুল। আমি দেখলাম, বাতাস লাগা পাতার মতো কেঁপে উঠলো বিশালদেহী লিও, পড়ে যাবে এক্ষুণি।
আয়শাও খেয়াল করলো ব্যাপারটা। ঠোঁট দুটো এক হয়ে যাওয়ার আগ মুহূর্তে লিওকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো ও। মুখে নেমে এসেছে ভয়ের কালো ছায়া। অবশ্য ক্ষণিকের জন্যে। তারপরেই লিওর আলিঙ্গন থেকে বেরিয়ে এসে হাত বাড়িয়ে ধরলো ওকে। ধরে রইলো যতক্ষণ না কাপুনি দূর হলো লিওর।
অবোস সিসট্রামটা আবার ধরিয়ে দিলো আয়শার হাতে। ওটা উঁচু করে সে বললো–
প্রিয়তম, তোমার নির্ধারিত আসন গ্রহণ করো। চিরদিন ঐ আসনে আমার পাশে, বসবে তুমি। ও হেস-এর প্রিয়তম প্রভু, বসো তোমার সিংহাসনে, গ্রহণ করো তোমার পূজারীদের পূজা।
না, বললো লিও, কেউ আমার সামনে হাঁটু গেড়ে বসবে না। এই প্রথম এবং শেষবারের মতো বলে দিচ্ছি, তোমাদের অদ্ভুত সব দেবতা অপদেবতা সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই আমার, ওসব আমি বিশ্বাসও করি না। কেউ আমাকে পূজা করবে এটা অসম্ভব!
সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে থাকা পূজারীদের অনেকের কানে গেল লিওর এই দৃঢ় বক্তব্য। একে অন্যের ভেতর কানাকানি করতে লাগলো তারা। একজন তো বলেই ফেললো-সাবধান, পছন্দের মানুষ! মায়ের ক্রোধ থেকে সাবধান।
আবার ক্ষণিকের জন্যে ভয়ের ছায়া পড়লো আয়শার মুখে। তারপর একটু হেসে ব্যাপারটাকে হাল্কা করার জন্যে বললো–ঠিক আছে, প্রিয়তম, তোমার ইচ্ছাই আমার ইচ্ছা। কেউ তোমার সামনে হাঁটু গেড়ে বসবে না, আমার ভাবী স্বামী হিসেবে তুমি বসো সিংহাসনে।