মানে তুমি আমার রাজ্য দিয়ে দিচ্ছো ওকে, হেস, প্রীতি উপহার হিসেবে? অনেকক্ষণ পর কথা বললো আতেন। কিন্তু এত সহজে তো তা সম্ভব নয়, আগে ওটা জয় করতে হবে তোমাকে।
নিঃশব্দে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইলো আয়শা আতেনের দিকে। অবশেষে বললো, অন্য সময় হলে এই অশিষ্ট কথার জন্যে ভয়ানক শাস্তি পেতে হতো তোমাকে। কিন্তু এবারও ক্ষমা করে দিলাম। আমিও প্রতিদ্বন্দীর চরম লজ্জার সময় দুঃখ বোধ করি। যখন আমার চেয়ে সুন্দর ছিলে তখন তুমিই ওকে দিতে চেয়েছিলে তোমার রাজ্য। কিন্তু এখন কে বেশি সুন্দর? সবাই দেখ, বলো কে বেশি সুন্দর? হাসি মুখে আতেনের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো সে।
খানিয়া রূপসী সন্দেহ নেই। পৃথিবীতে এত রূপ খুব কম নারীরই আছে। তবু আয়শার স্বর্গীয় সৌন্দর্যের পাশে কি স্নান লাগছে ওকে!
আমি নিছক নারী, বললো আতেন। কিন্তু তুমি পিশাচী না দেবী তুমিই ভালো জানো, ভয়ঙ্কর ক্রোধে ফেঁপাচ্ছে ও। স্বীকার করছি তোমার আগুনের মতো রূপের কাছে আমি প্রদীপের মতোই নিস্প্রভ, আমার মরণশীল রক্ত-মাংসের সঙ্গে তোমার অশুভ গৌরবের তুলনা চলে না। পারলে সাধারণ হয়ে এসো, নারী হয়ে এসো, দেখি আমি আমার হারানো প্রেম ফিরে পেতে পারি কিনা। একটা কথা মনে রেখো, মানুষের সঙ্গেই মানুষের মিলন সম্ভব, পশু বা দেবী, বা পিশাচীর সঙ্গে নয়।
অস্থিরতার ছাপ পড়তে দেখলাম আয়শার মুখে। লাল ঠোঁট দুটোতে একটু যেন ধূসর ছোপ লাগলো, চোখ দুটো যেন চঞ্চল। পরমুহূর্তে চঞ্চলতা, শঙ্কা, অস্থিরতা দূর হয়ে গেল। রুপালি ঘণ্টার মৃদু টুং-টাং-এর মতো বেজে উঠল ওর কণ্ঠস্বর: কেন প্রলাপ বকছো, আতেন? জানো না গ্রীষ্মের ক্ষণজীবী ঝড় যতই চেষ্টা করুক, পর্বতশৃঙ্গকে টলাতে পারে না, নিজেই নিঃশেষ হয়ে যায়। এখন শোনো, খুব শিগগিরই আমি তোমার রাজধালীতে যাবো। তুমি ঠিক করো, শান্তিতে যাবো না যুদ্ধ করে যাবো।
চলো, অতিথিরা, আমরা এবার বিদায় নিই।
আতেনকে পেরিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে আয়শা, লিওর হাতটা এখনও ওর হাতে। এই সময় নড়ে উঠতে দেখলাম খানিয়াকে। পরমুহূর্তে তার হাতে ঝিক করে . উঠলো একটা ছুরি। পাগলের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে ছুরিটা সে গেঁথে দিলো আয়শার। পিঠে। স্পষ্ট দেখলাম ছুরির ফলা আমূল ঢুকে গেল ওর শরীরে। কিন্তু এ কি! আর্তনাদ তো দূরের কথা ভুরুটাও সামান্য কুঁচকালো না আয়শার। যেমন। যাচ্ছিলো তেমনি হেঁটে যেতে লাগলো।
ব্যর্থ হয়েছে বোঝার সঙ্গে সঙ্গে আবার চেষ্টা চালালো আতেন। দুহাত বাড়িয়ে ছুটে গেল আয়শাকে ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলে দেয়ার জন্যে। আশ্চর্য! আয়শাকে ও স্পর্শই করতে পারলো না। আয়শার শরীরের সামান্য দূরে থাকতে অদৃশ্য কিছুর প্রভাবে সরে গেল ওর হাত। বাতাসে ধাক্কা মারলো আতেন এবং তাল হারালো। হোচট খাওয়ার ভঙ্গিতে এগিয়ে গেল এক পা, তারপর আরও এক পা। আতেনের একটা পা এখন মাটিতে অন্য পা শূন্যে। এখনই উল্টে পড়বে। কিন্তু না, বিদ্যুৎগতিতে হাত বাড়িয়েছে আয়শা। আতেনের এক হাত ধরে অবলীলায় তুলে আনলো ওপরে।
বোকা মেয়েমানুষ! করুণা মেশানো স্বরে বললো আয়শা। পাগল নাকি, আত্মহত্যা করতে যাচ্ছিলে! আবার যখন আসবে পৃথিবীতে, সাপ হয়ে না বিড়াল হয়ে ঠিক আছে কোনো? বাকি জীবনটা ভোগ করে নাও।
এই বিদ্রূপ সইতে পারলো না আতেন। ফুঁপিয়ে উঠে বললো, তুমি মানুষ নও, কি করে তোমার সাথে আমি লড়বো? ঈশ্বরের হাতে ছেড়ে দিলাম তোমার শাস্তির ভার। মুখ গুঁজে বসে কাঁদতে লাগলো ও।
লিও সহ্য করতে পারলো না বেচারির কষ্ট। এগিয়ে গিয়ে দুহাতে ধরে তুললো ওকে। দু’একটা সান্ত্বনাবাক্য শোনালো। কয়েক সেকেণ্ড ওর হাতে মাথা রেখে দাঁড়িয়ে রইলো আতেন। তারপর ছাড়িয়ে নিলো নিজেকে। শামান সিমব্রি এসে ধরলো ভাইঝির হাত।
এখনও দেখছি তোমার সৌজন্যবোধ আগের মতোই টনটনে, প্রভু লিও, আয়শা বললো। কিন্তু উচিত হয়নি কাজটা, ওর কাপড়ের ভেতর আরও ছুরি লুকানো থাকতে পারে। যাক, চলো, অনেক বেলা হলো, এবার নিশ্চয়ই বিশ্রাম দরকার তোমাদের।
.
১৭.
নিচে নেমে এলাম আমরা। আয়শা বিদায় নিলো আপাতত। বলে গেল, অরোস তোমাদের সাথে থাকবে, সময় হলেই আবার আমার কাছে নিয়ে যাবে। ততক্ষণ আরাম করোগে যাও।
অবোস সুন্দর একটা বাড়িতে নিয়ে গেল আমাদের। সামনে আরও সুন্দর একটা বাগান। মাটি থেকে এত উঁচুতেও তরতাজা সবুজ গাছে রঙ-বেরঙের ফুল ফুটে আছে।
ওহ! ভয়ানক ক্লান্ত লাগছে। আমি এখন ঘুমাবো, লিও বললো।
বিনীত ভঙ্গিতে একটা কামরায় নিয়ে গেল আমাদের পূজারী-প্রধান। ধবধবে চাদর পাতা বিছানা সে ঘরে। প্রায় লাফিয়ে বিছানায় উঠলাম আমরা। শুতে না শুতেই ঘুমিয়ে গেলাম।
ঘুম ভাঙলো বিকেলে। উঠে স্নান করে খাওয়া-দাওয়া সেরে গিয়ে বসলাম বাগানে। আমাদের বিশেষ করে লিওর বর্তমান, ভবিষ্যত নিয়ে টুকটাক আলাপ করলাম কিছুক্ষণ। হঠাৎ দেখি অরোস আসছে। লিওর সামনে এসে কুর্নিশের ভঙ্গিতে মাথা নুইয়ে সে বললো, মন্দিরে আপনাদের উপস্থিতি আশা করছেন হেসা।
উঠে ঘরে এলাম আমরা। কয়েকজন পূজারী অপেক্ষা করছিলো। প্রথমেই আমাদের চুল দাড়ি ঘেঁটে দিলো ওরা। লিও বাধা দেয়ার চেষ্টা করলো একবার, ওরা শুনলো না। এরপর সোনার কারুকাজ করা পাদুকা পরিয়ে দিলো পায়ে। গায়ে পরিয়ে দিলো অত্যন্ত জমকালো পোশাক। আমারটার চেয়ে লিওরটা বেশি সুন্দর, সাদার ওপর সোনালি আর লাল-এ কাজ করা। সবশেষে লিওর হাতে একটা রুপোর দণ্ড ধরিয়ে দেয়া হলো আর আমাকে সাধারণ একটা ছড়ি।