ভোর হতে আর বাকি নেই। ধূসর হতে শুরু করেছে আকাশ। এমন সময় সেই আশ্চর্য সঙ্গীত ভেসে এলো নিচ থেকে। নিশ্চয়ই নিচে যে পূজারীরা রয়েছে তারা গেয়ে উঠেছে। সে-সঙ্গীতের বর্ণনা দেয়ার সাধ্য আমার নেই। পৃথিবীর অনেক ধর্মের অনেক মন্দিরে অনেক ধরনের গান আমি শুনেছি, কিন্তু এমন অদ্ভুত সুর, লয় কখনও শুনিনি। ক্রমশ উঁচগ্রামে উঠছে সঙ্গীত। উঠতে উঠতে এক সময় উচ্চতম গ্রামে পৌঁছুলো, তারপর নামতে শুরু করলো আবার। কমতে কমতে অবশেষে মিলিয়ে গেল একসময়।
তারপর, পুবদিক থেকে একটা মাত্র আলোকরশ্মি লাফিয়ে উঠলো আকাশে।
ভোর হচ্ছে, শান্ত গলা শোনা গেল অরোসের।
আমাদের মাথা ছাড়িয়ে অনেক উঁচুতে উঠে গেল আলোকরশ্মি। ক্ষুরধার তরবারির মতো অগ্নিশিখা যেন। তারপর নেমে আসতে লাগলো। নামতে নামতে সামনের ছোট্ট পাথর খণ্ডটার ওপর পড়লো আলো।
ওহ! সেখানে দাঁড়িয়ে আছে স্বর্গীয় অবয়ব। একটা মাত্র বস্ত্রে আবৃত। চোখ দুটো বন্ধ, যেন ঘুমিয়ে আছে। নাকি মরে গেছে? প্রথম দর্শনে মুখটা মৃতের। মতোই লাগলো। সূর্যের প্রথম রশি খেলা করছে ওর শরীরে, পাতলা আবরণ ভেদ করে পৌঁছে যাচ্ছে ভেতরে। চোখ দুটো খুললো। অপার বিস্ময় তাতে, নবজাত শিশুর দৃষ্টিতে যেমন থাকে। প্রাণের প্রবাহ বইতে শুরু করেছে, মুখে, বুকে, শরীরে। কালো ঢেউ খেলানো কুন্তলদল উড়ছে বাতাসে। মণিখচিত সোনার সাপ ঝিকিয়ে উঠছে কোমরে।
একি মায়া, না সত্যি আয়শা? কোর-এর গুহায় ঘূর্ণায়মান প্রাণ-আগুনে ঢোকার আগে যে আয়শাকে দেখেছিলাম সে না অন্য কেউ? আর ভাবতে পারলাম আমি; সম্ভবত লিও-ও না। একটু পরে যখন কানের কাছে নিঝরের মতো মিষ্টি একটা কণ্ঠস্বর ফিসফিস করে উঠলো তখন সচেতন হয়ে দেখলাম, আমি লিও দুজনই মাটিতে পড়ে আছি। জড়িয়ে ধরে আছি একজন অন্যজনের গলা।
এখানে এসো, ক্যালিক্রেটিস, স্বর্গীয় সঙ্গীতের মত মিষ্টি কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম, আমার কাছে এসো।
অনেক কষ্টে উঠে দাঁড়ালো লিও। মাতালের মতো টলমলে পায়ে এগোলো আয়শার দিকে। তারপর আবার বসে পড়লো হাঁটু ভেঙে।
ওঠো, বললো আয়শা, তুমি কেন? আমিই তো হাঁটু গেড়ে বসবো তোমার সামনে। লিওকে ওঠানোর জন্যে হাত বাড়িয়ে দিলো ও।
এবারও উঠতে পারলো না লিও। ধীরে ধীরে একটু একটু করে ঝুঁকে এলো। আয়শা। ঠোঁট দুটো আলতো করে ছোঁয়ালো লিওর কপালে। তারপর ইশারায় ডাকলো আমাকে। আমি গেলাম, লিওর মতোই হাঁটু গেড়ে বসলাম।
না, বললো সে, তুমি ওঠো। চাইলে এমন কি না চাইলেও প্রেমিক বা পূজারী অনেক পাবো। কিন্তু হলি তোমার মতো বন্ধু কোথায় পাবো? তারপর ঝুঁকে আমার কপালেও আলতো করে ঠোঁট ছোঁয়ালো ও,কেবল ছোঁয়ালো, আর কিছু না।
স্বীকার করতে লজ্জা নেই, সেই মুহূর্তে অদ্ভুত এক আকুলতা বোধ করলাম মনে। ওকে জড়িয়ে ধরার ইচ্ছা হলো আমার। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ে গেল। আমি বৃদ্ধত্বের কথা, এধরনের আকুলতা প্রকাশ করার দিন পেরিয়ে এসেছি অনেক। আগে। তাছাড়া আয়শা আমাকে সত্যিকারের বন্ধু হিসেবে স্বীকার করেছে, এলোক ছাড়িয়ে অন্যলোকে গিয়েও সে বন্ধুত্ব অটুট থাকবে। এর বেশি আর কি চাইবার আছে আমার?
লিওর হাত ধরে ছাদের নিচে ফিরে এলো আয়শা।
নাহ শীত লাগছে, বললো সে। পাপাভ, আমার আলখাল্লাটা দাও তো।
কারুকাজ করা লাল পোশাকটা যত্ন করে পরিয়ে দিলো ওকে পূজারিনী। রাজকীয় ভঙ্গিতে ওটা ঝুলে রইলো ওর কাঁধ থেকে, অভিষেকের পোশাক যেন।
ও প্রিয়তম, প্রিয়তম, লিওর দিকে তাকিয়ে বলে চললো সে, ক্ষমতাবানরা একবার খেচা খেলে সহজে ভুলতে পারে না। জানি না কদিন তুমি আমি এক সাথে থাকতে পারবো এপৃথিবীতে, হয়তো সামান্যক্ষণ। সুতরাং সময়টুকু হেলায় নষ্ট করবো কেন? চলো আনন্দের পেয়ালায় চুমুক দিয়ে একে গৌরবময় করে রাখি। এ জায়গা আমার কাছে অসহ্য লাগছে। এখানে যত কষ্ট, যত যাতনা সহ্য করেছি, পৃথিবীতে কোনো নারী তা কখনও করেনি। আর এক মুহূর্ত এখানে। থাকতে ইচ্ছে হচ্ছে না আমার। তারপর আচমকা শামান সিমব্রির দিকে ফিরে বললো, বলো তো, যাদুকর, আমার এখন কি মনে হচ্ছে?
বুকের ওপর দুহাত ভাঁজ করে এতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলো বৃদ্ধ শামান। জবাব দিলো, সুন্দরী, তোমার যা নেই আমার তা আছে, ভবিষ্যৎ দেখবার ক্ষমতা। আমি একটা মৃতদেহ দেখতে পাচ্ছি। পড়ে আছে- আর একটা কথা বলেছো কি, সেটা তোমার মৃতদেহ হবে! গর্জে উঠলো আয়শা। আগুন ঝরছে যেন ওর। চোখ থেকে। গর্দভ, আমাকে মনে করিয়ে দিও না আমি আমার হারানো শক্তি ফিরে পেয়েছি। ইচ্ছে করলেই এখন আমি যাদের ঘৃণা করি সেই সব পুরনো শত্রুদের ধ্বংস করে দিতে পারি।
ভয় পেয়ে পিছিয়ে গেল বুড়ো যাদুকর। পিছাতে পিছাতে দেয়ালে গিয়ে ঠেকলো তার পিঠ।
ম–মহামহিমাময়ী! এখনও আমি-আমি আপনাকে আগের মতোই ভক্তি করি, তো-তো করে বললো বৃদ্ধ। আমি-আমি শুধু বলতে চাইছিলাম, কালুনের এক ভাবী খামকে এখানে শুয়ে থাকতে দেখছি।
নিঃসন্দেহে কালুনের অনেক খানই এখানে শুয়ে থাকবে, সেটা আবার বলার মতো ব্যাপার হলো? যাক, ভয় পেয়ো না, শামান, তোমাকে কিছু বলবো না। আমার রাগ পড়ে গেছে। চলো আমরা যাই।
সূর্য এখন পুরোপুরি বেরিয়ে এসেছে দিগন্তের আড়াল থেকে। আলোর বন্যায় প্লবিত পাহাড়ের পাদদেশ, দূরে কালুনের সমভূমি। মুগ্ধ চোখে দেখলো আয়শা। লিওর দিকে তাকিয়ে বললো, পৃথিবীটা খুব সুন্দর। আমি এ-সব তোমাকে দিয়ে দিলাম।