না, আয়শা কি ছিলো স্মরণ করে, কি হতে পারে কল্পনা ও আশা করে, এখনকার আয়শাকে আমি গ্রহণ করছি।
এগিয়ে গিয়ে ভয়ঙ্কর মূর্তিটার সামনে দাঁড়ালো লিও। ঝুঁকে চুমু খেলো তার কপালে।
হ্যাঁ, ও চুমু খেলো সহস্র কুঞ্চনে সংকুচিত জিনিসটাকে। মূর্তিমান আতঙ্কটাকে। আমার মনে হয় সভ্যতার শুরু থেকে মানুষ যত ভয়ঙ্কর দুঃসাহসিক কাজ করেছে তার একটা হিসেবে গণ্য হতে পারে লিওর এ কাজটা।
বেশ, লিও ভিনসি, বললো আতেন, অদ্ভুদ শান্ত, শীতল তার গলা, তোমার বুদ্ধি বিবেচনা দিয়ে তুমি বেছে নিয়েছে। আমার কিছু বলবার নেই। তোমাকে হারানোর বেদনা আমি বয়ে বেড়াবো সারাজীবন। তোমার—তোমার বধূকে গ্রহণ করো, আমি যাই।
এবারও কিছু বললো না আয়শা। একই রকম স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো কিছুক্ষণ। তারপর তার হাড়সর্বস্ব হাঁটু মাটিতে ঠেকিয়ে বসলো। উচ্চকণ্ঠে প্রার্থনা করতে লাগল—ও সর্বশক্তিমান ইচ্ছার প্রতিনিধি, তুমি শেষ বিচারের ক্ষুরধার তরবারি, প্রকৃতি নামের অলঙ্ঘনীয় আইন; মিসরীয়রা তোমাকে অভিষিক্ত করেছিলো আইসিস নামে; তুমি মায়ের বুকে সন্তান দাও, মৃতকে দাও জীবন, প্রাণবানকে করো মৃত; তুমি সুজলা সুফলা করেছো ধরিত্রীকে; তোমার মৃদু হাসি বসন্ত, অট্টহাসি সাগরের ঝঞা, ঘুম শীতের রাত্রি; হতভাগিনী সন্তানের সবিনয় প্রার্থনা শোনো:
এক সময় তুমি আমাকে তোমার নিজের শক্তি, অমর জীবন আর অনন্ত সৌন্দর্য দিয়েছিলে। কিন্তু আমি হতভাগিনী, এই মহার্ঘ প্রাপ্তির মূল্য দিতে পারিনি, গুরুতর পাপ করেছি তোমার কাছে, এবং সেই পাপের প্রতিফল ভোগ করছি শতাব্দীর পর শতাব্দী প্রাণান্তকর নিঃসঙ্গতায় কাটিয়ে। অবশেষে আমার প্রেমিকের সামনে আমার সৌন্দর্য তুমি কেড়ে নিলে, ড্রিপের পাত্রে পরিণত করলে আমাকে। তোমার নিঃশ্বাসের যে সৌরভ আমাকে আলো দিয়েছিলো তা-ই নিয়ে এলো নিঃসীম আঁধার। তুমি আমাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলে, আমি কখনও মরবো না, কিন্তু এই কুৎসিত কদাকার চেহারা নিয়ে, প্রেমিকের উপহাসের পাত্র হয়ে অনন্ত কাল বেঁচে থেকে কি লাভ? আমাকে আরেকবার সুযোগ দাও, মা, আর একটি বারের জন্যে আমাকে তুলতে দাও আমার অনন্ত সৌন্দর্যের হারানো ফুলটি। মহামহিমাময়ী মা, তোমার চরণে এই আমার প্রার্থনা। প্রেমিকের অকৃত্রিম প্রেমের কথা বিবেচনা করে আমার পাপ ক্ষমা করো। নয়তো তোমার পরম শান্তিদায়ক প্রসাদ-মৃত্যু দাও আমাকে!
১৬-২০. যে যেখানে ছিলাম তেমনি আছি
১৬.
যে যেখানে ছিলাম তেমনি আছি। অটুট নীরবতা চারদিকে। হতাশ চোখে লিওর দিকে তাকালাম। ও-ও তাকিয়ে আছে আমার দিকে। অসম্ভব আশা করছিলাম আমরা। ভাবছিলাম, এই সুন্দর করুণ প্রার্থনার জবাব বোধহয় দেবে প্রকৃতির। বোবা আত্মা। অলৌকিক কিছু ঘটবে। কিন্তু সময় গড়িয়ে চললো, অলৌকিক কেন, কিছুই ঘটলো না।
না, অনেক অনেকক্ষণ পর, কতক্ষণ জানি না, একটা ব্যাপার ঘটলো। ধীরে, ধীরে অস্পষ্ট হতে শুরু করলো অগ্নিগিরির জ্বালামুখ থেকে উঠে আসা আগুনের পর্দা। ক্রমশ নিচের দিকে নেমে যাচ্ছে। যেখান থেকে উঠেছিলো সেখানেই ডুবে যাচ্ছে। একটু একটু করে অন্ধকার হয়ে আসছে জায়গাটা।
কমতে কমতে একেবারে অস্পষ্ট হয়ে এসেছে আলো। আর কয়েক সেকেণ্ডের ভেতর একদম নিভে যাবে। এই সময় উঠে দাঁড়ালো আয়শা। ধীরে ধীরে এগোলো কয়েক পা। বাইরের দিকে বেরিয়ে থাকা এক টুকরো পাথরের ওপর গিয়ে দাঁড়ালো। নিচ থেকে উঠে আসা ধোঁয়াটে আভার বিপরীতে কালো প্রেতের মতো দেখাচ্ছে ওর, অবয়ব। আমার মনে হলো অসহনীয় গ্লানির হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যে ও মরণকে আলিঙ্গন করতে চাইছে। লিওর-ও সম্ভবত তাই মনে হলো। তড়াক করে লাফিয়ে উঠে ও ছুটলো ওকে ঠেকানোর জন্যে। কিন্তু পূজারী অরোস আর পূজারিনী পাপাভ এগিয়ে এসে বাধা দিলো ওকে। দুজন দুপাশ থেকে ধরে টেনে নিয়ে গেল পেছনে। পুরোপুরি আঁধার নেমে এলো সেখানে। অন্ধকারের ভেতর শুনতে পেলাম আয়শার গলা। অদ্ভুত পবিত্র সুরে কিছু একটা স্তবগান করছে।
একটু পরে একটা আগুনের ফুলকি দেখতে পেলাম। একটু একটু করে বড় হচ্ছে, আর পাখির মতো এদিক ওদিক ভাসতে ভাসতে উঠে আসছে। কিন্তু—কিন্তু–
হোরেস! ফিসফিস করে বলে উঠলো লিও, দেখেছো, বাতাসের উল্টো দিকে আসছে ওটা।
বাতাস বদলে গেছে হয়তো, বললাম আমি। জানি যা বললাম, ঠিক নয়, বরং একটু বেড়েছে বাতাসের বেগ, তবু বললাম।
ক্রমশ কাছে আসছে ওটা। এখন আরও ভালোভাবে দেখতে পাচ্ছি। পাখির ডানার মতো দুটো আগুনে ডানা দুপাশে নড়ছে, মাঝখানে রয়েছে কালো কিছু একটা, অন্ধকারে দেখতে পাচ্ছি না। উঠতে উঠতে একেবারে আয়শার সামনে। এসে পৌঁছুলো ওটা। গনগনে ডানা দুটো ঢেকে ফেললো ওর কুঁচকানো দেহটাকে। তারপর অদৃশ্য হয়ে গেল আগুন। নিকষ কালো অন্ধকার সামনে, পেছনে, উপরে, নিচে। কিছুই দেখতে পাচ্ছি না।
কিছুক্ষণ কেটে গেল। এক মিনিট হতে পারে, দশ মিনিটও হতে পারে। তারপর হঠাৎ পূজারিনী পাপাভ অদৃশ্য, অশ্রুত কোনো সঙ্কেত পেয়ে যেন পা টিপে টিপে এসে দাঁড়ালো আমার পাশে। ওর পোশাকের স্পর্শ পেলো আমার শরীর। আবার কিছুক্ষণ নীরবতা এবং নিচ্ছিদ্র অন্ধকার। টের পেলাম পাপাত চলে যাচ্ছে। ক্ষীণ একটা ফোঁপানোর আওয়াজ শুনতে পেলাম। নিঃসন্দেহে আয়শা ঝাঁপ দিয়েছে জ্বালামুখের ভেতর! বিয়োগান্তক ঘটনাটার পরিসমাপ্তি হলো বোধহয়!