একটার পর একটা সরু, লম্বা কাপড়ের ফালি খুলে আনছে পাপাভ-ওর শরীর থেকে, মুখ থেকে। এর কি শেষ নেই? কত ছোট হয়ে গেছে কাঠামোটা, আশ্চর্য! পূর্ণ বয়স্কা একজন নারী এত বেঁটে হতে পারে কল্পনাই করা যায় না। ভেতরে ভেতরে অস্বস্তি বোধ করছি আমি। শেষ ফালিটা খোলা হচ্ছে। কাঠির মতো সরু বাঁকানো দুটো হাত দেখা গেল। তারপর একই রকম দুটো পা।
একটা মাত্র অন্তর্বাস আর শেষ মুখাবরণটা ছাড়া আর কিছু এখন নেই তার শরীরে। হাত নেড়ে পাপাভকে পিছিয়ে যেতে বললো হেসা। কোনোমতে সরে এলো পূজারিনীপ্রধান। হাত দিয়ে মুখ ঢেকে মাটিতে পড়ে রইলো অচেতনের মতো। তীক্ষ্ণ্ণ একটা দুর্বোধ্য চিৎকার করে কাঠির মতো হাত দিয়ে মুখের কাপড়টা ধরলো হেসা। হ্যাচকা এক টানে সেটা ছিঁড়ে ফেলে চরম হতাশার ভঙ্গিতে ঘুরে দাঁড়ালো আমাদের দিকে মুখ করে।
ওহ! সে-না, আমি তার বর্ণনা দেবো না। দেখার সঙ্গে সঙ্গে চিনেছি, শেষবার প্রাণের আগুনের কাছে দেখেছিলাম ওকে। এবং আশ্চর্য, তখন আতঙ্কে খেয়াল করতে পারিনি, এখন দেখলাম, সেই মহামহিমাময়ী অপরূপা আয়শার সাথে কোথায় যেন একটু সাদৃশ্য আছে এই অদ্ভুত কুৎসিত বানরের মতো অবয়বটার।
.
ভয়ঙ্কর নিস্তব্ধতা মঞ্চে। আমি দেখলাম, লিওর ঠোঁট সাদা হয়ে গেছে, কাঁপছে হাঁটু দুটো। অনেক কষ্টে সামলালো ও নিজেকে। তারপর দাঁড়িয়ে রইলো সোজা, যেন তারে ঝোলানো মৃতদেহ।
আতেনকে দেখলাম, বজ্রাহতের মতো দাঁড়িয়ে আছে। প্রতিদ্বন্দ্বীর পরাভব দেখতে চেয়েছিলো সে, তবু এমন দৃশ্য সম্ভবত স্বপ্নেও কল্পনা করেনি। কেবল সিমব্রি জ্বর অরোসকে দেখলাম নির্বিকার। আমার ধারণা ওরা আগে থেকেই জানতে কি দেখতে হবে।
নীরবতা ভাঙলো, অরোস। বিড়বিড় করে কি যেন বললো। কিন্তু তার কোনো অর্থ ধরতে পারলো না আমার মস্তিষ্ক। আমার মাথার ভেতরটায় কিসে যেন কামড়াচ্ছে। খালি মনে হচ্ছে কেন মাথাটা ফেটে যাচ্ছে না, তাহলে আরও কিছু শোনার বা দেখার কষ্ট থেকে বেঁচে যেতাম।
আয়শার মমি মুখে প্রথমে সামান্য আশার ছাপ পড়লো। কিন্তু ক্ষণিকের জন্যে। তারপরই তীব্র হতাশা আর যন্ত্রণা সে আশার স্থান দখল করলো।
কিছু একটা করতে হয়, এভাবে আর চলতে পারে না। কিন্তু কে করবে? আমার ঠোঁট দুটো যেন সেঁটে গেছে একটার সাথে অন্যটা, খুলতেই পারছি না তো কথা বলবো কি? পা দুটো যেন পাথরের তৈরি! লিও এখনও তেমন দাঁড়িয়ে পাথরের মূর্তির মতো। পাপাভ তেমনি মাটিতে পড়ে। অরোস আর সিমব্রিও নির্বাক।
ওহ! ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, আতেন কথা বলছে! মুণ্ডিত মাথা জিনিসটার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো সে-তার সমস্ত সৌন্দর্য, নিখুঁত নারীত্ব নিয়ে দাঁড়ালো।
লিও ভিনসি, বা ক্যালিক্রেটিস, বললো আতেন; যে নাম খুশি তুমি নিতে পারো। তুমি হয়তো অত্যন্ত নীচ ভাবব আমাকে, কিন্তু জেনে রাখো, অন্তত প্রতিদ্বন্দীর চরম লজ্জার সময় আমি তাকে বিদ্রূপ করিনি, করতে পারিনি। ও একটা অসম্ভব গল্প শুনিয়েছে আমাদের, সত্যি না মিথ্যে জানি না। আমি নাকি দেবীর এক সেবককে চুরি করে নিয়েছি, তাই দেবী প্রতিশোধ নিয়েছেন আমার কাছ থেকে আমার প্রাণের মানুষকে কেড়ে নিয়ে! বেশ, আমরা মানুষ, অসহায়। আমাদের নিয়ে যত পারেন খেলুন দেবীরা! কিন্তু আমি, যতক্ষণ প্রাণ আছে পরিপূর্ণ আত্মমর্যাদা নিয়ে যা আমার তার ওপর স্বত্ব ঘোষণা করে যাবো।
উপস্থিত এতগুলো লোকের সামনে বলতে লজ্জা পাচ্ছি না, আমি তোমাকে ভালোবাসি। এবং সম্ভবত এই মহিলাও-বা দেবী যা-ই বলল, ভালোবাসে তোমাকে। এবং একটু আগে ও বলেছেজমাদের দুজনের ভেতর থেকে একজনকে তোমার বেছে নিতে হবে। বলেছে, ও যার প্রতিনিধি হিসেবে নিজেকে দাবি করছে আমি সেই আইসিসের কাছে পাপ করেছি। কিন্তু ও কি করছে? ও তো একজন স্বর্গের দেবী আর একজন মর্তের মানবী—দুজনের কাছ থেকে তোমাকে কেড়ে নিতে চাই। আমি যদি পাপী হই ও দ্বিগুণ পাপী নয়?
অতএব বেছে নাও, লিও ভিনসি, এবং এখানেই চুকে যাক সব। নিজের সম্পর্কে আর কিছু বলতে চাই না আমি। তুমি জানো আমি কে, কি দিতে পারি তোমাকে। অতীত, সে তো স্বপ্ন, স্মৃতি। সহজেই মুছে ফেলা যায় মন থেকে। বর্তমান নিয়ে ভাবো। তুমি কাকে নেবে, আমাকে না ওকে?
নিঃশব্দে শুনলো আয়শা। একটা কথাও বললো না। এমন কি হাতটা পর্যন্ত নাড়লো না!
লিওর ফ্যাকাসে মুখটা দেখলাম। একটু যেন আতেনের দিকে ঝুকলো। তারপর আচমকা সোজা হলো আবার। মাথা নেড়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। অদ্ভুত এক আলো যেন জ্বলে উঠেছে ওর মুখে।
যত যা-ই হোক, যেন কথা বলছে না, সশব্দে চিন্তা করছে লিও। যত যা-ই হোক, অতীত হলো স্বপ্ন। এমন এক স্বপ্ন যার সাথে কোনোই সম্পর্ক নেই আমার। বর্তমান নিয়ে ভাবতে হবে আমাকে। আয়শা দুহাজার বছর ধরে অপেক্ষা করেছে আমার জন্যে; আর আতেন ক্ষমতার লোভে বিয়ে করেছে এমন এক লোককে যাকে সে ঘৃণা করে, পরে বিষ খাইয়েছে বেচারাকে। আমাকে নিয়ে ক্লান্ত হয়ে উঠলে আমাকেও যে বিষ খাওয়াবে না এমন নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারে? আমেনার্তাসের কাছে কি শপথ করেছিলাম আমার মনে নেই, অমন কোনো নারী আদৌ ছিলো কিনা তা-ই জানি না। কিন্তু আয়শার কাছে কি শপথ করেছিলাম মনে আছে। এ জীবনেই করেছিলাম। এখন যদি তা ভঙ্গ করি মিথ্যার ওপর দাঁড়িয়ে থাকবে আমার জীবন। আমি হয়ে যাব প্রবঞ্চক। প্রেম কি বয়সের স্পর্শে মিলিয়ে যেতে পারে?