দেখ, হোরেস, নিচু অথচ উত্তেজিত গলায় লিও বললো, ঠিক এই চেহারার একটা পাহাড়ই আমি দেখেছিলাম। এ যে চূড়ার ওপাশটায় দাঁড়িয়ে ছিলাম আমি আর আয়শা। আর ঐ পেছনে রেখেছিলাম আগুনের শিখা। হোরেস, সংকেতটা মনে হচ্ছে আমাদের দুজনের জন্যেই!
কিছু বললাম না আমি। তাকিয়ে রইলাম যতক্ষণ না পাহাড়ের মতো মেঘটা এলোমেলো হয়ে মিশে গেল অন্য মেঘের সঙ্গে। তারপর লিওর দিকে ফিরলাম। তোমার সঙ্গে যাচ্ছি আমি, লিও।
.
০২.
যোলো বছর কেটে গেছে সেই বিনিদ্র রজনীর পর। আমরা দুজন, আমি আর লিও, এখনও ঘুরছি, এখনও খুঁজছি মিসরীয়দের জীবনের প্রতীক-আকৃতির সেই পাহাড় চূড়া।
এই দীর্ঘ সময়ে অনেক রোমাঞ্চকর ঘটনা ঘটেছে আমাদের জীবনে। লিখতে গেলে মোটা মোটা কয়েকটা বই হয়ে যাবে। পাঁচ বছর তিব্বতের এখানে ওখানে ঘুরেছি, এর বেশির ভাগ সময় কেটেছে বিভিন্ন মঠে। অতিথি হয়ে থেকেছি। লামাদের আচার আচরণ, ঐতিহ্য সম্পর্কে যথাসম্ভব জ্ঞানার্জনের চেষ্টা করেছি। একবার গ্রেফতার হই আমরা নিষিদ্ধ এক প্রাচীন নগরীতে ঢুকে পড়ার অপরাধে। বিচারে প্রাণ-দণ্ড দেয়া হয় আমাদের। ভাগ্যক্রমে এক চৈনিক রাজপুরুষের সহায়তায় পালাতে পারি আমরা।
তিব্বত ছাড়ার পর পুব, পশ্চিম আর উত্তরে হাজার হাজার মাইল পথ হেঁটেছি। চীন দেশের অসংখ্য উপজাতীয় গোত্রের সান্নিধ্যে এসেছি। অনেক নতুন ভাষা শিখেছি—শিখেছি না বলে বলা উচিত শিখতে হয়েছে। এভাবে আরও দুবছর চলে গেল, কিন্তু আমাদের ভ্রমণ শেষ হলো না। কারণ যা খুঁজছি তা এখনও পাইনি।
ঘুরতে ঘুরতে অবশেষে এমন এক জায়গায় গিয়ে পৌঁছুলাম যেখানে এর আগে কোনো ইউরোপীয়ের পা পড়েনি। তুর্কিস্তান নামের সেই বিশাল দেশের এক অংশে বিরাট এক হ্রদ আছে। নাম বলকাশ। এই হ্রদের উপকূল ধরে দীর্ঘ পথ হাঁটলাম আমরা। পশ্চিম দিকে প্রায় দুশো মাইল যাওয়ার পর এক উঁচু গিরিশ্রেণীর কাছে পৌঁছুলাম। মানচিত্রে যার পরিচয় দেয়া হয়েছে আরকার্তি-তাউ বলে। এক বছর কাটলো এখানে। অনুসন্ধান চললো। কিন্তু লাভ হলো না। আবার পুব মুখে যাত্রা। প্রায় পাঁচশো মাইল যাওয়ার পর চেরগা নামের আরেক গিরিশ্রেণীর কাছে এলাম।
এখান থেকে শুরু হলো আমাদের আসল অভিযান। চেরগা পর্বতমালার এক শাখায়—মানচিত্রে এর কোনো নাম খুঁজে পাইনি-না খেয়ে মরতে বসেছি। শীত আসছে, সব পাহাড়ী জন্তুজানোয়ার নিরাপদ আশ্রয়ে লুকিয়ে পড়েছে, সেজন্যে বেশ কয়েকদিন ধরে কোনো শিকার পাইনি। কয়েকশো মাইল দক্ষিণে দেখা হয়েছিলো শেষ মানুষটার সঙ্গে। তার কাছে জেনেছিলাম এই পাহাড় শ্রেণীর কোথাও একটা মঠ আছে। অত্যন্ত ধর্মনিষ্ঠ এক লামা-চক্র সেখানে বাস করে। লোকটা বলেছিলো, আজকের পৃথিবীর কোনো দেশের দাবি নেই সেই ভূ-খণ্ডের ওপর। সম্ভবত, ঐ জায়গার অস্তিত্বের কথাই জানে না কোনো দেশ। কোনো উপজাতীয় গোত্র-ও নেই আশেপাশে। ঐ লামারাই ওখানকার একমাত্র বাসিন্দা। কথাটা বিশ্বাস হয়নি। তবু কেন জানি না মঠটা খুঁজছি আমরা। হয়তো যে কারণে ডুবন্ত মানুষ খড়কুটো আঁকড়ে ধরতে চায় সে কারণে।
সঙ্গে কোনো খাবার নেই; আরগাল-মানে আগুন জ্বালানোর কোনো উপকরণ নেই। চাঁদের আলোয় সারারাত ধরে হেঁটে চলেছি। একটা মাত্র ইয়াক আমাদের সঙ্গী। পথ প্রদর্শক হিসেবে যাদের সঙ্গে এনেছিলাম তাদের শেষ জন মারা গেছে এক বছর আগে।
অসম্ভব কষ্ট সহিষ্ণু ইয়াকটা। আমাদের মতো ওটারও এখন শেষ দশা। খুব যে বেশি বোঝা বইতে হচ্ছে তা নয়। কিছু রাইফেলের গুলি—এই শ দেড়েক হবে; আর তুচ্ছ কিছু জিনিসপত্র, যেমন: ছোট একটা থলেতে কিছু স্বর্ণ আর রৌপ্য মুদ্রা, সামান্য চা, আর কয়েকটা চামড়ার কম্বল ও ভেড়ার চামড়ার পোশাক-ব্যস এই আমাদের মালপত্র।
গিরিশ্রেণীকে ডান পাশে রেখে তুষারের একটা মালভূমি পেরোনোর পরপরই লম্বা একটা শ্বাস টেনে দাঁড়িয়ে পড়লো ইয়াকটা। আমাদের-ও থামতে হলো। উপায় নেই এছাড়া। চামড়ার কম্বল গায়ে জড়িয়ে তুষারের ওপর বসে রইলাম ভোরের অপেক্ষায়। একটু পরে ইয়াকটাও বসলো আমাদের পাশে।
শেষ পর্যন্ত বোধহয় ওকে মারতেই হবে, লিও, হতভাগ্য ইয়াকটার পিঠে একটা চাপড় মেরে আমি বললাম, এবং ওর মাংস কাঁচা খেতে হবে।
কাল সকালেই হয়তো শিকার পেয়ে যাবো। আশাবাদী সুর লিওর কণ্ঠে।
না-ও পেতে পারি। সেক্ষেত্রে ওকে না মারলে আমাদেরই মরতে হবে।
মরবো। আমাদের পক্ষে যদূর সম্ভব আমরাকেরেছি।
নিশ্চয়ই, লিও, যথাসাধ্য করেছি। ষোলো বছর পাহাড়ে পাহাড়ে তুষার মাড়িয়ে চলাকে যদি এক রাতের স্বপ্ন হিসেবে কল্পনা করে নেয়া যায় তাহলে ঠিকই বলেছো।
খোঁচাটা লাগলো লিওর মনে।
তুমি জানো আমি কি বিশ্বাস করি, গম্ভীর গলায় বললো ও।
তারপর দুজনেই চুপ। সত্যি কথা বলতে কি আমিও লিওর মতোই বিশ্বাস করি, খামোকা এই প্রচণ্ড পরিশ্রম করিনি; আমাদের এত কষ্ট বিফলে যাবে না।
রাত শেষ হলো। ভোরের আলোয় উদ্বিগ্নচোখে একে অপরের দিকে তাকালাম। সভ্য কেউ দেখলে নির্ঘাত বুনো জন্তু ভাবতো আমাদের। লিওর বয়স এখন চল্লিশের ওপরে। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সহজাত এক গাম্ভীর্য এসেছে; ফলে আরও আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে ওর চেহারা। গত বছরগুলোর কঠোর পরিশ্রমে ইস্পাতের মতো কঠিন হয়ে উঠেছে পেশী। চুল দীর্ঘ হয়ে নেমে এসেছে ঘাড় ছাড়িয়ে। সিংহের সোনালি কেশরের মতো লাগে দেখতে। দাড়িও লম্বা হয়ে ঝুলে পড়েছে বুকের ওপর। মুখের যেটুকু এখনও দেখা যায় সেটুকু দেখেই বিমোহিত হতে হয়।