শুনলে, আতেন, বললো হেসা। এখনও তোমার সন্দেহ আছে?
হ্যাঁ, দুর্বিনীত গলায় জবাব দিলো খানিয়া। অলরাসের একটা কথাও আমি বিশ্বাস করি না। যা বললো তা যদি মিথ্যা না হয় তা হলে বলবো ও স্বপ্নে দেখেছিলো ওসব, অথবা নিজের কল্পনার রঙে রাঙিয়ে রচনা করেছে। সত্যিই তুমি যদি সেই অনন্ত যৌবনা আয়শা হও, প্রমাণ দাও। এই দুজন অতীতে তোমাকে দেখেছে, এখনও দেখুক। তোমার ঘোমটা খুলে ফেল, ওরা দেখুক, আমিও দেখি, সত্যিই তুমি অনন্ত সৌন্দর্যের আধার। দেখে চোখ জুড়াই। নিশ্চয়ই তোমার প্রেমিক এখনও তোমার মোহ থেকে মুক্তি পায়নি, নিশ্চয়ই তোমাকে দেখেই ও চিনতে পারবে, এবং পদতলে লুটিয়ে পড়ে বলবে, এই তো আমার অমর মানসী, আর কেউ নয়। তার আগে আমি কিছুতেই বিশ্বাস করবে না এসব আজগুবি গল্প।
সামনে পেছনে দুলতে লাগলো হেসা। কাপড়ে ঢাকা রয়েছে বলে তার মুখটা দেখতে পাচ্ছি না, তবু বুঝতে পারছি, গভীর দুশ্চিন্তার ছাপ পড়েছে মুখে।
ক্যালিক্রেটিস, কাতর কণ্ঠে সে বললো, তোমারও কি তাই ইচ্ছা? যদি হয় তাহলে আমি অবশ্যই তা অপূর্ণ রাখবো না। তবু আমি তোমার কাছে মিনতি করছি, এখনই দেখতে চেয়ো না, এখনও সময় হয়নি, আমার শপথ এখনও পূরণ হয়নি। আমি বদলে গেছি, ক্যালিক্রেটিস, কোর-এর গুহায় যেদিন তোমার কপালে চুমু খেয়েছিলাম, তোমাকে আমার নিজের বলে ঘোষণা করেছিলাম, সেদিন যেমন দেখেছিলে তেমন আর নেই আমি।
হতাশ ভঙ্গিতে চারপাশে তাকালো লিও।
সরাতে বলো, প্রভু, এই সময় চিৎকার করে উঠলো আতেন, ঘোমটা সরাতে বলল। কথা দিচ্ছি, আমি ঈর্ষাকাতর হবো না।
ঠিক, বললো লিও, তা-ই বলবো একে, ভালো হোক মন্দ হোক, আর সহ্য করতে পারছি না এই উৎকণ্ঠা! যতই বদলে থাকুক আমি ওকে চিনতে পারবোই।
পুরুষোচিত কথা, জবাব দিলো হেসা। তোমার মুখেই মানায়, ক্যালিক্রেটিস। অন্তর থেকে ধন্যবাদ জানাই তোমাকে। বেশ, আমি ঘোমটা সরাবো। কিন্তু, হ্যাঁ, তারপর আর আমার হাতে কিছু থাকবে না, তোমাকেই। সিদ্ধান্ত নিতে হবে, আমার আজন্ম প্রতিদ্বন্দী ঐ নারীকে গ্রহণ করবে না আয়শাকে। ইচ্ছে হলেই আমাকে প্রত্যাখ্যান করতে পারো, কোনো ক্ষতি হবে না তোমার, বরং পাবে পৃথিবীর সব মানুষ যা চায় সেই ক্ষমতা, ধন, প্রেম। কেবল আমার স্মৃতিটুকু উপড়ে ফেলতে হবে তোমার হৃদয় থেকে।
তারপর হেস আমার দিকে ফিরলো। ওহ, হলি, আমার সত্যিকারের বন্ধু, এ ঘটনা, শুরুরও আগে থেকে আমাকে পথ দেখিয়ে আসছে, ওর পরেই আমি সবচেয়ে ভালোবাসি তোমাকে, তুমি ওকে পরামর্শ দাও, সঠিক পরামর্শ। বহু শতাব্দী আগে আমাকে পথ দেখিয়েছিলে, এখন ওকে দেখাও। হ্যাঁ, ও যদি। আমাকে শেষ পর্যন্ত প্রত্যাখ্যানই করে, আমরা চলে যাবো, এলোক ছাড়িয়ে। অন্যলোকে, যেখানে সব জাগতিক আবেগ, কামনা; বাসনা অস্পষ্ট হয়ে আসে; অনন্তকাল আমরা বাস করতে থাকবো, পরম গৌরবময় বন্ধুত্ব নিয়ে, কেবল তুমি আর আমি।
জানি তুমি আমার বন্ধুত্ব প্রত্যাখ্যান করবে না, তোমার অন্তর ইস্পাতের মতো কঠিন শুদ্ধ সত্যে পূর্ণ। ছোটখাটো লোভের স্ফুলিঙ্গ তাকে গলাতে পারবে না, বরং পরিণত হবে মরচে ধরা শিকলে, যে শিকল তোমাকে বাঁধার চেষ্টা করে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে।
ধন্যবাদ, আয়শা, আমি বললাম, এতবড় বিশেষণ আমাকে মানায় কিনা জানি না। তবে এটুকু জানি, আমি তোমার বন্ধু-এর বেশি কিছু হওয়ার কথা কোনোদিন ভাবিনি। আমি জানি, বিশ্বাস করি, তুমিই আমাদের হারানো সে।
কি বলবো ভেবে না পেয়ে এটুকুই শুধু বললাম আমি। অপার আনন্দে পূর্ণ হয়ে গেছে আমার হৃদয়, আয়শা নিজ মুখে বলেছে আমিও তার প্রিয়। এতদিন জানতাম পৃথিবীতে একজনই আমার বন্ধু; আজ জানলাম, আরেকজন আছে। এর চেয়ে বেশি আর কি চাইবে আমি?
.
একটু পিছিয়ে এলাম আমি আর লিও। নিচু স্বরে লিওর মতামত জানতে চাইলাম।
তুমিই ঠিক করো, বললো ও।তোমার সিদ্ধান্তের ফলে যা কিছুই ঘটুক না কেন, তোমাকে দোষ দেবো না, হোরেস, এটুকুই শুধু আমি বলতে পারি।
বেশ। আমি ঠিক করে ফেলেছি, বলে হেসার সামনে এগিয়ে গেলাম। আর অপেক্ষা করতে পারছি না আমরা; যে সত্য জানতেই হবে তা দেরিতে কেন? কেন এখনি নয়? আমাদের ইচ্ছা, হেস, তুমি আমাদের সামনে মুখের আবরণ সরাবে। এখানে এবং এখনি।
বেশ, পূর্ণ হবে তোমাদের ইচ্ছা, মিইয়ে যাওয়া গলায় জবাব দিলো হেসা। আমার কেবল একটাই প্রার্থনা আমাকে একটু করুণা কোরো, বিদ্রূপ কোরো না আমাকে দেখে; যে আগুন আমার হৃদয় দগ্ধ করছে আরেকটু কয়লা দিয়ো না সে আগুনে।
ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালো হেসা। হেঁটে-বলা ভালো টলতে টলতে চলে গেল ছাদহীন ফাঁকা জায়গার প্রায় কিনারে। আর কয়েক পা পরেই আগুনের অতল গহ্বর। ক্লান্ত ভঙ্গিতে মাথা নিচু করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো কিছুক্ষণ। তারপর, তীক্ষ্ণ্ণস্বরে চিৎকার করে উঠলো-এখানে এসো, পাপাভ, খুলে দাও আবরণ!
এগিয়ে গেল পাপাভ, স্পষ্ট ভীতি তার সুন্দর মুখে। কাজ শুরু করলো সে। পাপাভ মেয়েটা খুব লম্বা নয় তবু হেসার পাশে রীতিমতো একটা মিনারের মতো মনে হচ্ছে তাকে।
বাইরের সাদা কাপড়টা ধীরে সাবধানে খুলে আনলো পাপাভ। ভেতরে একই রকম আরেকটা কাপড়। সেটাও সরানো হলো। মমির মতো শীর্ণ একটা মূর্তি আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে। আরও কমে গেছে যেন ওর উচ্চতা। হাড়ের স্তূপের কাছে যে মূর্তিটা দেখেছিলাম ঠিক সেটার মতো লাগছে এখন ওকে। বুঝলাম আমাদের রহস্যময় পথপ্রদর্শক আর হেসা একই মানুষ।