সব শেষে, সেখানে বাস করতো এক আরবীয় কন্যা, নাম আয়শা। বুদ্ধিমতি, সুন্দরী এক নারী। সে তার হৃদয়ের শূন্যতা আর জ্ঞানের বেদনা নিয়ে আশ্রয় খুঁজেছিলো বিশ্বমায়ের চরণে, ভেবেছিলো প্রকৃত জ্ঞান অর্জন করবে, যে জ্ঞান কখনোই তার ভেতর থেকে লুপ্ত হয়ে যাবে না। সেই আয়শাকে, যেমন তোমরা দেখলে, স্বপ্নে আদেশ দিলেন দেবী, অবিশ্বাসীদের পেছন পেছন গিয়ে স্বর্গের প্রতিশোধ কার্যকর করে আসতে হবে। প্রতিশ্রুতি দিলেন, সাফল্য লাভ করলে দেবেন মরণ জয় করার ক্ষমতা আর এমন সৌন্দর্য যা পৃথিবীর কোনো নারীতে কেউ দেখেনি।
রওনা হয়ে গেল সে। অনেক অনেক পথ পাড়ি দিয়ে পৌঁছুলো এমন এক জায়গায় যেখানে ঘুরতে ঘুরতে হাজির হবে সেই অবিশ্বাসীরা—ক্যালিক্রেটিস আর আমেনার্তাস। সেখানে নুট নামের মহাজ্ঞানী এক ঋষির সাথে সাক্ষাৎ হলো তার। আয়শাকে সাহায্য করার জন্যে মা-ই নিযুক্ত করেছিলেন তাকে—তুমি, ও হলি, তুমিই ছিলে সেই নুট। অবিশ্বাসীদের জন্যে যখন অপেক্ষা করছে তখন মুটের কাছে আয়শা জানতে পারে অনন্ত জীবনের সৌরভ ঘূর্ণায়মান অগ্নিস্তম্ভের কথা। সেই আগুনে স্নান করলে অনন্ত সৌন্দর্য আর অমর যৌবন লাভ করে মানুষ।
অবশেষে অবিশ্বাসীরা এলো। তারপর, কি আশ্চর্য! জীবনে কখনও যে ভালোবাসেনি, ভালোবাসা কাকে বলে জানেনি, জানার চেষ্টা করেনি, সেই আয়শা দেখামাত্র কামনা করে বসলো ক্যালিক্রেটিসকে। ওদের প্রাণের আগুনের কাছে নিয়ে গেল সে, ইচ্ছা ক্যালিক্রেটিসকে আর নিজেকে অমরত্বের আবরণে জড়িয়ে নেবে। কিন্তু অন্যভাবে নির্ধারিত হয়ে ছিলো ওদের নিয়তি। দেবীর প্রতিশ্রুতি মতো অনন্ত জীবন পেলো আয়শা-কেবল আয়শা, এবং তারই হাতে প্রাণ ত্যাগ করলো তার দয়িত ক্যালিক্রেটিস।
এভাবেই দেবীর ক্রোধ পরিণতি পেলো। আয়শা অনন্ত জীবন, যৌবন নিয়ে পড়ে রইলো অনন্ত যাতনা ভোগ করার জন্যে।
দিন গড়িয়ে চললো। যুগের পর যুগ কেটে গেল, পেরিয়ে গেল শতাব্দীর পর শতাব্দী। অমর আয়শা কিন্তু তখনও অপেক্ষা করছে, পুনর্জন্ম নিয়ে আসবে তার ক্যালিক্রেটিস। অবশেষে এলো সে। কিন্তু দেবীর ক্রোধ প্রশমিত হয়নি। প্রেমিকের চোখের সামনে অপার লজ্জা আর বেদনা নিয়ে ডুবে গেল আয়শা। সুন্দর হয়ে গেল ভয়ঙ্কর কুৎসিক অমর, মনে হলো, মারা গেল।
তবু, ও ক্যালিক্রেটিস, আমি বলছি, সে মরেনি। কোর-এর গুহায় আয়শা শপথ করেনি তোমার কাছে, আবার সে আসবে? তারপর লিও ভিনসি, ক্যালিক্রেটিস, ওর আত্মা কি দেখা দেয়নি তোমার স্বপ্নে? তোমাকে দেখায়নি এই চূড়ায়, ওর কাছে ফিরে আসার পথ?
থামলো হেসা। লিওর দিকে তাকালো, যেন জবাবের অপেক্ষা করছে।
কাহিনির প্রথম অংশ, অর্থাৎ পোড়া মাটির ফলকে যা লেখা ছিলো তার বাইরের যা যা দেখলাম শুনলাম এসব সম্পর্কে আমি কিছু জানি না, বললো লিও। বাকিটুকু সম্পর্কে আমি বা আমরা বলতে পারি, সব সত্যি। এখন আমার প্রশ্ন, আয়শা কোথায়? আপনিই কি আয়শা? তাহলে গলার পর অন্যরকম কেন? তাছাড়া, আয়শা অনেক দীর্ঘাঙ্গী ছিলো। বলুন, আপনার উপাস্য দেবীর দোহাই দিয়ে বলছি, আপনিই কি আয়শা?
হ্যাঁ, আমিই আয়শা, শান্ত অচঞ্চল গলায় হেলা বললো, সেই আয়শা যার কাছে তুমি অনন্তকালের জন্যে সমর্পণ করেছিলে নিজেকে।
মিথ্যে কথা! ও মিথ্যে কথা বলছে! চিৎকার করে উঠলো আতেন। স্বামী, ও-ই না একটু আগে বললো প্রায় বিশ বছর আগে যখন তোমাদের ছাড়াছাড়ি হয় তখন ও যুবতী, সুন্দরী? তাহলে কি করে ও এই মন্দিরের পূজারিনী হলো? আমি জানি একশো বছরের ভেতর এখানে নতুন কোনো পূজারিনীর অভিষেক হয়নি, আর ও যদি কুৎসিত-ই না হবে মুখ দেখাচ্ছে না কেন?
অরোস, মা বললো, খানিয়া যে পূজারিনীর কথা বলছে তার মৃত্যুর কাহিনিটা শোনাও।
মাথা নুইয়ে স্বভাবসুলভ শান্তশ্বরে শুরু করলো পূজারী প্রধান–
আঠারো বছর আগে, এই পাহাড়ে দেবী হেস-এর পূজা শুরু হওয়ার ২৩৩৩-তম বছরের শীতকালে খানিয়া আতেন যে পূজারিনীর কথা বলছেন তিনি মারা গেছেন। আমি নিজে উপস্থিত ছিলাম, সে সময়। দীর্ঘ একশো আট বছর তিনি দায়িত্ব পালন করে গেছেন, অবশেষে বার্ধক্যজনিত কারণে তার মৃত্যু ঘটে। সে সময় তিনি সিংহাসনে বসে ছিলেন। প্রাচীন রীতি অনুযায়ী তিন ঘণ্টা পর আমরা তাঁর মৃতদেহ সমাহিত করার জন্যে প্রস্তুত করতে যাই। কিন্তু আশ্চর্য! গিয়ে দেখি, আবার বেঁচে উঠেছেন তিনি, অবশ্য চেহারা আর আগের মতো নেই।
অশুভ কোনো যাদুর খেলা ভেবে পূজারী পূজারিনীরা তাঁকে প্রত্যাখ্যান করে এবং সিংহাসন থেকে বিতাড়িত করার উদ্যোগ নেয়। আর তক্ষুণি প্রজ্জ্বলিত হয়ে ওঠে পাহাড়, ভীম গর্জনে বজ্র নেমে আসে, মন্দিরে অগ্নিস্তম্ভের আলো নিভে যায়। আমরা সবাই আতঙ্কিত হয়ে উঠি। তারপর গভীর অন্ধকারে, বেদীর ওপর যেখানে মায়ের প্রতিমা স্থাপিত সেখান দুইকৈ দেবীর কণ্ঠস্বর ভেসে এলো- ওকে গ্রহণ করো, আমিই ওকে পাঠিয়েছি তোমাদের শাসন করার জন্যে, আমার উদ্দেশ্য পূরণ করার জন্যে।
মিলিয়ে গেল কণ্ঠস্বর। আলো জ্বলে উঠলো আবার। তখন আমরা হাঁটু গেড়ে বসে আনুগত্য প্রকাশ করলাম নতুন হেসার কাছে; মা হিসেবে স্বীকার করে নিলাম। এই হলো কাহিনি, শুধু আমি নই, শত শত পূজারী পূজারিনী তার সাক্ষী।