খুব ধীরে হাঁটছে রমণী। তার সঙ্গীরা এগিয়ে গেল উঠানের ফটক পেরিয়ে। এতক্ষণে উঠানের প্রান্তে এলো রমণী। ফটক না পেরিয়ে দেয়ালের কাছে দাঁড়িয়ে পড়লো। পুরোহিতও এসে দাঁড়ালো। ফিসফিস করে তাকে কিছু বললো রমণী, হাত তুলে ইশারা করলো নদীর দিকে। বিরক্তির চিহ্ন ফুটে উঠলো পুরোহিতের মুখে। প্রতিবাদ করার চেষ্টা করলো রমণীর কথার। চকিতে একবার চারদিকে দৃষ্টি বুলিয়ে নিলো রমণী, ক্রন্ত হাতে সরিয়ে আনলো মুখের কাপড়। তারপর বুকলো পুরোহিতের দিকে। মিলে গেল ওদের দুজোড়া ঠোঁট।
আর এক মুহূর্ত দেরি করলো না রমণী। ফটক পেরিয়ে ছুটলো। তার আগে আমাদের দিকে ফিরলো একবার ওর মুখ। এবং—কি আশ্চর্য! হ্যাঁ, মুখটা আতেনের। কালো চুলের মাঝ থেকে মণি-মুক্তা খচিত সোনার ঝিলিক। পুরোহিতের দিকে তাকিয়ে হাসলো একবার রমণী–ঘোর লাগা হাসি। অস্তায়মান সূর্য আর নদীর দিকে ইশারা করলো আবার। তারপর চলে গেল সে।
আমাদের পাশে দাঁড়িয়ে বহু বহু দিন আগের সেই হাসির প্রতিধ্বনি করলো আতেন। ঠিক তেমনি ঘোর লাগা হাসি হেসে চিৎকার করে উঠলো বুড়ো শামানের উদ্দেশ্যে–
ঠিকই অনুভব করেছিলো আমার হৃদয়! দেখ অতীতে কি করে আমি জিতে নিয়েছিলাম ওকে।
ঠিক তক্ষুণি আগুনে বরফ পড়লো যেন। শীতল কণ্ঠে বলে উঠলো হেসা, থামো, এখন দেখ, অতীতে কি করে তুমি হারিয়েছিলে ওকে।
আমরাও দেখলাম।
বদলে গেছে দৃশ্য। সুন্দর একটা দেহ শুয়ে আছে মনোরম পালঙ্কে। স্বপ্ন দেখছে মেয়েটা। ভয় পেয়েছে ও। ওর শরীরের ওপর আবছা ছায়া ছায়া একটা অবয়ব। মন্দিরে বেদীর ওপর দেখা সেই প্রতিমার মতো। কিন্তু এখন তার মুখে রয়েছে শকুনির মুখোশ। চমকে স্বপ্ন থেকে জেগে উঠলো মেয়েটা। চারপাশে তাকালো। মুখটা আয়শার মুখের মতো। কোর-এর গুহায় প্রথম যেদিন মুখের কাপড় সরিয়েছিলো সেদিন যেমন দেখেছিলাম ঠিক তেমন।
আবার ঘুমিয়ে গেল সে। ভয়ানক মূর্তিটা আবার ঝুঁকে পড়লো তার ওপর। ফিসফিস করে কানে কানে কিছু বললো। পরমুহূর্তে আরেকটা দৃশ্য ভেসে উঠলো। ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সাগরে একটা নৌকা। নৌকার মার্কার ওপর একে অপরকে জড়িয়ে ধরে আছে সেই পুরোহিত আর রাজকীয় নারী। হঠাৎ দেখা গেল মূর্তিমান প্রতিশোধের মতো তাদের ওপর দিয়ে ডানা মেলে আসছে এক গলাছিলা শকুনি। একটু আগে দেবীর মুখে যেমন মুখোশ দেখেছি তেমন।
ধীরে ধীরে অস্পষ্ট হয়ে গেল ছবিটা। দুপুরের আকাশের মতো শূন্য হয়ে গেল আগুনের পর্দা। তারপর আরেকটা দৃশ্য। প্রথমে বিরাট, মসৃণ দেয়ালওয়ালা একটা গুহা, বালির মেঝে, দেখা মাত্র চিনতে পারলাম আমরা। বালির ওপর পড়ে আছে সেই পুরোহিত। মৃত। এখন আর কামানো নয়, ঝাকড়া সোনালী চুল তার মাথায়। চোখ দুটো চেয়ে আছে ওপরে, জ্বল জ্বল করছে। সাদা, গায়ে ছোপ ছোপ রক্ত। তার পাশে দাঁড়িয়ে দুই নারী। একজন সম্পূর্ণ নগ্ন, দীর্ঘ চুলের রাশি কাঁধ পিঠ ছাড়িয়ে নেমে এসেছে তার গোড়ালির কাছে। অসম্ভব সুন্দরী সে। যে দেখেনি তার পক্ষে কল্পনা করা দুঃসাধ্য সে সৌন্দর্য। হাতে বর্শা। অন্য নারীর দেহ কালো আলখাল্লায় আবৃত। হাত ছুঁড়ে ছুঁড়ে বিলাপ করছে আর অভিশাপ দিচ্ছে তার প্রতিদ্বন্দীকে। এই দুই নারী আর কেউ নয়, একজন সেই ঘুমন্ত রমণী যার কানের কাছে ফিসফিস করেছিলো ছায়ামূর্তি, অন্যজন সেই মিসরীয় রাজপুরাঙ্গনা, যে মন্দিরফটকের নিচে চুমু খেয়েছিলো পুরোহিতকে।
ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল এ দৃশ্যটাও। হেসা এতক্ষণ সামনে ঝুঁকে ছিলো, এবার হেলান দিয়ে বসলো। এরপর অত্যন্ত দ্রুত, টুকরো টুকরো ভাবে এলো, গেল অনেকগুলো ছবি। বন, মানুষের দল, বিশাল বিশাল গুহা, সে সব গুহায় অনেক মানুষ; আমাদের মুখও দেখলাম তাদের ভেতর, হতভাগ্য জব, বিলালী, সেনাবাহিনী কুচকাওয়াজ করছে, বিশাল যুদ্ধক্ষেত্র, রক্তাক্ত লাশ…আরও অনেক কিছু। এই ছবিগুলোও মিলিয়ে গেল এক সময়। আগুনের আয়না আবার শূন্য।
আতেন, তোমার প্রশ্নের জবাব পেয়েছো? নিচু গলায় জিজ্ঞেস করলো হেসা।
স্বীকার করছি, মা, অদ্ভুত কিছু দৃশ্য দেখলাম। কিন্তু কি করে বুঝবো এর ভেতরে কোনো কারসাজি নেই। আপনার যাদুর প্রভাবে মূর্ত হয়ে উঠছে না এসব?
তাহলে শোনো, ক্লান্ত কণ্ঠে শুরু করলো আয়শা, অনেক অনেক যুগ আগে, তখন সবে শুরু হয়েছে আমার এ পর্যায়ের জীবন, নীলনদের তীরে বেহবিত-এ ছিলো মিসরের মহান দেবী আইসিসের মন্দির। এখন তা ধ্বংসস্তূপ। মিসর থেকে চলে গেছেন আইসিস। অবশ্য তার কর্তৃত্ব এখনও পুরোমাত্রায়ই আছে সেখানে, সারা পৃথিবীতেই আছে, কারণ তিনিই প্রকৃতি। সেই মন্দিরের প্রধান পুরোহিত ছিলো ক্যালিফ্রেটিস নামের এক গ্রীক। দেবীর সামনে দাঁড়িয়ে সে পুরোহিতের ব্ৰত গ্রহণ করে। শপথ নেয়, আজীবন দেবীর সেবা করে যাবে।
একটু আগে যে পুরোহিতকে দেখলে সে-ই সে। আর এখানে, তোমার পাশে দাঁড়িয়ে আছে পুনর্জন্ম নেয়া ক্যালিক্রেটিস।
সে সময়কার মিসরের ফারাওয়ের এক মেয়ে ছিলো, নাম আমেনার্তাস। সে প্রেমে পড়ে এই ক্যালিক্রেটিসের। যাদুবিদ্যার চর্চা করতো আমেনার্তাস। যাদুর প্রভাবে সে ক্যালিক্রেটিসকে বাধ্য করে ব্রত ভঙ্গ করে তার সাথে পালিয়ে যেতে। তুমি, আতেন, ছিলে সেই আমেনার্তাস।