শেষ হলো সঙ্গীত। ধীর পায়ে এগিয়ে এলে কয়েকজন পুরোহিত। শববাহী খাঁটিয়া তুলে নিয়ে চলে গেল কিনারে। ঘাড় ফিরিয়ে মায়ের দিকে তাকালো তারা। হাতের দণ্ড তুলে সঙ্কেত দিলো হেসা! পা নিচের দিকে দিয়ে ফেলে দেয়া হলো র্যাসেনের মৃতদেহ। সব কজন ঝুঁকে তাকালো নিচে। যতক্ষণ না ওটা টগবগে লাভার সরোবরে ডুবে গেল ততক্ষণ তাকিয়ে রইলো।
.
সময় হয়েছে। নিঃশব্দে মাথা নিচু করে বসে আছে হেসা তার প্রস্তর সিংহাসনে। সে-ও জানে সময় হয়েছে। এবার সব রহস্যের সমাধান হবে।
একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে মুখ তুললো সে। সিস্ট্রাম নেড়ে ইশারা করে একটা কি দুটো কথা বললো। যেমন এসেছিলো তেমনি সারিবদ্ধভাবে বিদায় নিলো পূজারী-পূজারিনীরা। দুজন মাত্র রইলো, অবোস আর অপূর্ব চেহারার এক পূজারিনী, নাম পাপাভ। পূজারিনীদের প্রধান সে।
তোমরা শোনো, শুরু করলো হেসা, বড় কিছু ঘটনা ঘটবে, এখন। এই বিদেশীদের আগমনের সাথে সম্পর্ক আছে তার। তোমরা জানো, দীর্ঘদিন ধরে আমি এক বিদেশীর আসার অপেক্ষায় আছি। সে এসেছে। এই দুই বিদেশীরই একজন। এখন কি ঘটবে আমি বলতে পারি না। অনেক ক্ষমতা আমার, হয়তো প্রয়োজনের তুলনায় একটু বেশিই। কিন্তু একটা শক্তি থেকে আমাকে বঞ্চিত রাখা হয়েছে। ভবিষ্যৎ দর্শনের ক্ষমতা আমার নেই। সুতরাং একটু পরেই যে কি ঘটবে তা অনুমান করারও সাধ্য আমার নেই। হয়তো-হয়তো শিগগিরই শূন্য হয়ে যাবে এই সিংহাসন, অনন্ত অ গুনের খোরাক হবে আমার দেহ। না, মন খারাপ কোরো না, মন খারাপ কর কছু নেই, কারণ আমি মরবো না। যদি মরিও আমার আত্মা ফিরে আসবে আবার।
মন দিয়ে শোনো, পাপা, তুমিই একমাত্র রক্ত মাংসের মানুষ যার সামনে আমি জ্ঞানের সকল দুয়ার খুলে দিয়েছি। একটু পরে, বা কখনও যদি আমাকে চলে যেতে হয় তুমিই গ্রহণ করবে এই সুপ্রাচীন ক্ষমতার দণ্ড; পূরণ করবে আমার শূন্যস্থান। তোমাকে আমি আরও নির্দেশ দিচ্ছি, এবং তোমাকেও, অবোস, আমাকে যদি চলে যেতেই হয় অত্যন্ত যত্নের সাথে এই বিদেশীদের পৌঁছে দিয়ে আসবে এদেশের বাইরে। হ্যাঁ, কোনোরকম কষ্ট যেন না হয় ওদের। যে পথে ওরা এসেছে সে পথে বা উত্তরের পাহাড়শ্রেণী ডিঙিয়ে–যেদিক দিয়ে সুবিধা মনে করো, বা ওরা যেতে চায়, দিয়ে আসবে। খানিয়া আতেন যদি ওদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে ওদের আটকে রাখতে চায়, বা দেরি করিয়ে দিতে চায়, উপজাতীয়দের আমার নাম করে বলবে, যেন লড়াইয়ে নামে। দখল করে নেবে ওর রাজ্য। শুনেছো?
শুনেছি, মা, আপনার নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালিত হবে, এক স্বরে জবাব দিলো অরোস আর পাপাভ।
এখানেই ইতি হলো ব্যাপারটার। এবার খনিয়ার দিকে ফিরলো হেসা।
আতেন কাল রাতে তুমি আমাকে একটা প্রশ্ন করেছিলে, লিওর দিকে ইশারা করলো সে, কেন এই লোকটাকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে তোমার মনে প্রেম জাগলো। জবাব খুব সোজা। ওর মতো পুরুষকে দেখে কোন নারীর বুকে ভালোবাসা না জাগবে? তুমি আরও বলেছিলে, তোমার হৃদয় এবং তোমার চাচার ঐন্দ্রজালিক ক্ষমতা নাকি কি বলেছে তোমাকে। তাহলে অতীতের পর্দা এবার উন্মোচন করতে হয়।
নারী, সময় হয়েছে, আমি তোমার প্রশ্নের জবাব দেবো। না, তুমি আদেশ করেছে সেজন্যে নয়, আমার ইচ্ছা হয়েছে তাই। শুরুর কথা আমি কিছু বলতে পারবো না, কারণ আমি মানুষ, দেবী নই। আমি জানি না আমরা তিনজন কেন নিয়তির এ খেলায় জড়িয়ে গেলাম, জানি না কোথায় এর শেষ। সুতরাং যেখান থেকে আমার স্মৃতিতে আছে সেখান থেকেই শুরু করছি।
থামলো হেসা। কেঁপে উঠলো তার শরীর যেন প্রবল ইচ্ছাশক্তির জোরে দমন করছে উদগত আবেগ। তারপর হঠাৎ দুহাত ছড়িয়ে দিয়ে চিৎকার করে উঠলো, পেছনে তাকাও!
ঘুরে দাঁড়ালাম আমরা। প্রথমে কিছুই দেখতে পেলাম না। আগ্নেয়গিরির গর্ভ থেকে উঠে আসা আগুন কেবল পর্দার মতো ভাসছে সামনে। কিন্তু একটু পরেই দেখলাম, সেই লাল পর্দার গভীর থেকে যেন উঠে আসছে একটা কিছু। অস্পষ্ট। কিন্তু ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছে। কি আশ্চর্য! একটা ছবি! একেবারে জীবন্ত মনে হচ্ছে।
প্রশস্ত এক নদীর তীর। বালুকাবেলায় একটা মন্দির। মিসরীয় ঢংয়ের দেয়াল ঘেরা উঠানে পূজারীদের মিছিল। আসা যাওয়া। ফাঁকা হয়ে গেল উঠানটা। তারপরই দেখলাম, বাজপাখির ডানার ছায়া পড়লো সেই সূর্যালোকিত উঠানে। মাথা কামানো, খালি পা, পুরোহিতের সাদা আলখাল্লা পরা এক লোক এগিয়ে এলো দক্ষিণ পাশের একটা দরজা দিয়ে ঢুকলো উঠানে। ধীর পায়ে এগিয়ে গেল গ্রানাইটের তৈরি একটা বেদীর দিকে। বেদীর ওপর বসে আছে মিসরীয় ধাচের মুকুট পরা এক নারীপ্রতিমা। পবিত্র সিসট্রাম প্রতিমার হাতে। হঠাৎ যেন কিছু একটা শব্দ শুনে থেমে দাঁড়ালো পুরোহিত। ঘাড় ফিরিয়ে তাকালো আমাদের দিকে। কিন্তু, ও ঈশ্বর! এ কে? এ যে দেখছি লিও ভিনসি! যৌবনে ঠিক এমন। ছিলো ওর চেহারা। কোর-এর গুহায় মৃত ক্যালিক্রেটিসের যে চেহারা দেখেছিলাম তার সঙ্গেও হুবহু মিলে যায় এই পুরোহিতের চেহারা!
দেখ, দেখ! আমার হাত আঁকড়ে ধরে ঢোক গিলে বললো লিও। জবাবে আমি মাথা ঝাকালাম শুধু।
আবার হেঁটে চললো লোকটা। প্রতিমার সামনে গিয়ে হাঁটু গেড়ে বসলো। দুহাতে পা জড়িয়ে ধরে প্রার্থনা করলো। এর পরই মন্দিরের সবগুলো দরজা খুলে। গেল এক সাথে। একটা মিছিল ঢুকলো। পুরোভাগে মুখ ঢাকা এক মহিলা। পোশাক-আশাক প্রমাণ করছে মহিলা সম্ভ্রান্ত ঘরের। বেদীর পায়ে অর্ঘ্য নিবেদন করতে এসেছে। প্রতিমার পায়ের কাছে হাঁটু গেড়ে বসলো সে। হাতের জিনিসপত্রগুলো নামিয়ে রাখলো তারপর উঠে দাঁড়ালো। চলে যাচ্ছে। যাওয়ার সময় একটা হাত বুলিয়ে দিয়ে গেল পুরোহিতের হাতে। এক মুহূর্ত ইতস্তত করে রমণীর পেছন পেছন চললো পুরোহিত।