এবার মানুষজনের দেখা পেলাম। পাথর কুঁদে বানানো একটা চেয়ারে বসে আছে হেসা। গাঢ় লাল রঙের কারুকাজ করা একটা পোশাক তার পরনে। আগের মতোই মাথা থেকে পা পর্যন্ত ঢাকা। একটু দূরে দাঁড়িয়ে খানিয়া আতেন আর তার চাচা, বৃদ্ধ শামান। সব শেষে খান র্যাসেন, শুয়ে আছে তার অন্ত্যেষ্টি শয্যায়।
এগিয়ে গিয়ে মাথা নুইয়ে সম্মান জানালাম আমরা। আবরণে ঢাকা মুখটা উঁচু করলো হেসা। আমাদের দিকে চোখ রেখেই অরোসকে বললো, তাহলে নিরাপদেই নিয়ে আসতে পেরেছে ওদের! অতিথিরা, কেমন মনে হচ্ছে হেস-এর সন্তানদের সমাধি গুহা?
আমাদের ধর্মে নরক বলে একটা জায়গার কথা বলা হয়েছে, জবাব দিলো লিও, আমার ধারণা সেটা এমনই দেখতে।
না, না, নরক বলে কিছু নেই, বললো হেসা। ওগুলো সব মন গড়া কথা। লিও ভিনসি, নরক বলে সত্যিই যদি কিছু থেকে থাকে তা আছে এই পৃথিবীতেই, এখানে। হাত দিয়ে বুকের ওপর টোকা দিলো সে। আবার স্কুলে পড়লো তার মুখ, গভীর ভাবে কিছু যেন ভাবছে।
বেশ কিছুক্ষণ ওভাবে রইলো সে। তারপর আমার মুখ তুললো।
মাঝরাত পেরিয়ে গেছে। অনেক কাজ, অনেক ভোগান্তি সামনে, সব ভোরের আগে শেষ করতে হবে। হ্যাঁ, আঁধার সরিয়ে আলো আনতে হবে, নয়তো আলো সরিয়ে অনন্ত অন্ধকার।
রাজকীয় নারী, আতেনকে সম্বোধন করে বলে চললো হেসা, মৃত স্বামীকে নিয়ে এসেছো তুমি। পবিত্র আগুনে সমাহিত হওয়ার অধিকার আছে ওর। কিন্তু তার আগে, অরোস, আমার পূজারী, অভিযোগকারী আর পক্ষ সমর্থনকারী–দুজনকে ডাকো; খাতা খুলতে বলো।
মৃত্যু সভার কাজ শুরু হচ্ছে!
.
১৫.
মাথা নুইয়ে চলে গেল অরোস। হেসা ইশারায় তার ডান পাশে গিয়ে দাঁড়াতে বললো আমাদের, আতেনকে বাঁ পাশে। একটু পরেই দুপাশ থেকে পূজারী পূজারিনীর দুটো দল ঢুকলো ঘরে। সংখ্যায় প্রায় পঞ্চাশ জন। মস্তকাবরণ প্রত্যেকের মাথায়। দেয়ালের কোল ঘেঁষে সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে গেল তারা। তারপর ঢুকলো কালো আলখাল্লা পরা দুটো মূর্তি, মুখে মুখোশ আঁটা, হাতে একটা করে পার্চমেন্টের বাঁধানো খাতা। মৃতদেহের দুপাশে দাঁড়ালো তারা। আর অবোস পায়ের কাছে, হেসার দিকে মুখ।
হাতের সিসট্রামটা উঁচু করলো হেসা। অনুগত ভৃত্যের মতো কথা বলে উঠলো অবোস–
খাতা খোলা হোক।
মৃতদেহের ডান পাশে দাঁড়ানো অভিযোগকারী সীলমোহর ভেঙে খাতা খুলে পড়তে শুরু করলো। মৃত মানুষটার পাপের বিবরণী লেখা তাতে। জন্ম থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত যত দুষ্কর্ম করেছে র্যাসেন তার ফিরিস্তি দিয়ে গেল কালো পোশাক পরা, মুখে মুখোশ আঁটা লোকটা।
আশ্চর্য হয়ে শুনলাম আমি। জন্মের পরমুহূর্ত থেকে লোকটার ওপর কিভাবে নজর রাখা হয়েছে বুঝতে পেরে বিস্ময়ে থ হয়ে গেলাম। সবশেষে আমাদের হত্যা করার জন্যে কি ভাবে মরণ-শ্বাপদ নিয়ে তাড়া করেছিলো খান তা পড়লো লোকটা। তারপর খাতা বন্ধ করে মাটিতে রাখতে রাখতে বললো–
এই হলো বিবরণ। এবার, মা, আপনার প্রজ্ঞা দিয়ে বিচার করুন।
কোনো কথা বললো না হেসা। সিসট্রাম উঁচু করে পক্ষ সমর্থনকারীকে ইশারা করলো। খাতার সীলমোহর ভেঙে পড়তে শুরু করলো সে।
মৃত খান জীবনে কি কি ভালো কাজ করেছে তার বিবরণ দিয়ে গেল লোকটা। খারাপ কাজ যেগুলো করেছে কেন করেছে তারও ব্যাখ্যা দিলো। স্ত্রী কিভাবে তাকে প্রতারিত করেছে, কিভাবে মদে ওষুধ মিশিয়ে পাগল করা হয়েছে সব।
পড়া শেষ করে সমর্থনকারীও খাতাটা মাটিতে নামিয়ে রাখলো। বললো—
এই হলো বিবরণ। এবার, মা, আপনার প্রজ্ঞা দিয়ে বিচার করুন।
এতক্ষণ শান্ত, নিরাবেগ মুখে শুনেছে খানিয়া এবার সামনে এগিয়ে গেল কথা বলার জন্যে। পেছন পেছন গেল তার চাচা শামান সিমব্রি। কিন্তু আতেনের মুখ থেকে একটা কথাও বেরোনোর সুযোগ দিলো না হেসা। সিসট্রাম তুলে নিষেধ করলো। বললো
উঁহুঁ, তোমার বিচারের দিন এখনও আসেনি। যখন আসবে তোমার পক্ষ সমর্থনকারী তোমার হয়ে বলবে যা বলার।
ঠিক আছে, ঝাঝ মেশানো গলায় বলে পেছনে সরে এলো আতেন।
এবার পূজারী-প্রধান অরোসের পালা। মা, শুরু করলো সে, আপনি সব শুনেছেন। এবার আপনার প্রজ্ঞা, আপনার জ্ঞান দিয়ে বিশ্লেষণ করে রায় দিন; পা নিচে দিয়ে আগুনে যাবে র্যাসেন, যাতে আবার ও জীবনের পথে হাঁটতে পারে; নাকি মাথা নিচে দিয়ে যাবে, যার অর্থ চিরতরেই মারা গেছে ও?
নীরবতা। অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে সবাই। অবশেষে রায় দিলো হেসা।
আমি শুনেছি, চুলচেরা বিশ্লেষণ করেছি, কিন্তু বিচার করার সাধ্য আমার নেই। যে মহাশক্তি ওকে ঠেলে দিয়েছে সামনে, আবার যার কাছে ও ফিরে গেছে। সে-ই ওর বিচার করবে। মৃত লোকটা পাপ করেছে, সন্দেহ নেই, গুরুতর পাপ। করেছে, কিন্তু ওর বিরুদ্ধে করা হয়েছে আরও গুরুতর পাপ। সুতরাং, পা নিচের দিকে দিয়েই ওকে সমাহিত করবে, যাতে নির্ধারিত সময়ে আবার ও ফিরে আসতে পারে এই পৃথিবীতে।
এবার অভিযোগকারী মাটি থেকে অভিযোগের খাতা তুলে নিয়ে এগোলো সামনের দিকে। মঞ্চের কিনারে গিয়ে খাতাটা ফেলে দিলো নিচে অগ্নিগিরির জ্বালামুখের ভেতর, এবং ঘুরে দাঁড়িয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল। এর অর্থ র্যাসেন নামের লোকটার বিরুদ্ধে সব অভিযোগ মুছে দেয়া হলো। অন্যদিকে সমর্থনকারীও তুলে নিলো তার খাতা। সবিনয়ে তুলে দিলো পূজারী-প্রধানের হাতে। মন্দিরের সংগ্রহশালায় অনন্তকালের জন্যে সংরক্ষিত থাকবে ওটা। পূজারীরা অন্ত্যেষ্টি সঙ্গীত শুরু করলো এবার। সমবেত কণ্ঠের করুণ মূর্ছনায় পূর্ণ হয়ে উঠলো ঘরটা।