ঘুম ভাঙতে দেখলাম, বিছানায় শুয়ে আছি। চমৎকার ঝরঝরে লাগছে শরীর। এখনও রাত শেষ হয়নি। তার মানে খুব বেশিক্ষণ হয়নি ঘুমিয়েছি। পাশ ফিরে আবার ঘুমানোর চেষ্টা করলাম। কিন্তু ঘুম এলো না। কিছুক্ষণ এপাশ ওপাশ করার। পর মনের ভেতর ভীড় করে এলো একরাশ চিন্তা। বিশেষ করে হেসার শেষ কথাগুলো প্রস্তুতি নাও ভয়ঙ্কর সত্যের মুখোমুখি হওয়ার!
কি সেই ভয়ঙ্কর সত্য? যদি দেখা যায় ও আয়শা নয়, সত্যিই ভয়ঙ্কর কিছু, তাহলে? শেষ দিকে অত মনোবল কোথায় পেলো, খানিয়া? ভাবতে ভাবতে উঠে বসলাম আমি। দেখলাম, একটা মূর্তি এগিয়ে আসছে। চিনতে পারলাম। অরোস।
অনেক ঘুমিয়েছেন, বন্ধু হলি, সে বললো, এবার উঠুন, তৈরি হয়ে নিন।
অনেক ঘুমিয়েছি! এখনও দেখছি অন্ধকার রয়েছে!
বন্ধু, এ অন্ধকার নতুন একটা রাতের। পুরো একরাত একদিন ঘুমিয়েছেন। আপনি।
আচ্ছা, একটা কথা–।
না, বন্ধু, কোনো কথা নয়। আমি কিছুই বলবো না। এখন খানের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় যোগ দেবেন, সেখানে ভাগ্যে থাকলে আপনার প্রশ্নের জবাব পেয়ে যেতেও পারেন।
দশ মিনিট পরে খাওয়ার ঘরে নিয়ে গেল আমাকে অবোস। লিও আগে থাকতেই সেখানে বসে আছে। ওকে কাপড়-চোপড় পরিয়ে এখানে রেখে আমার কাছে গিয়েছিলো পূজারী-প্রধান। খাওয়া শেষে বেরিয়ে এলাম ঘর থেকে।
.
প্রথমেই মন্দিরে নিয়ে গেল আমাদের অরোস। অগ্নি স্তম্ভের আলোয় আলোকিত দীর্ঘ কামরা পেরিয়ে উপবৃত্তাকার কক্ষে ঢুকলাম। একদম ফাঁকা এখন জায়গাটা। এমন কি খানের মৃতদেহটাও নেই। বেদীর ওপর প্রতিমা তেমনই আছে কিন্তু নিচের কুঠুরিতে কিছু নেই। রুপালি পর্দা খোলা।
মতকে সম্মান দেখানোর জন্যে চলে গেছেন মা। প্রাচীনকাল থেকেই চলে আসছে এ রীতি, ব্যাখ্যা করলো অরোস।
বেদীর ওপর উঠলাম আমরা। প্রতিমার পেছনে একটা দরজা। দরজার ওপাশে একটা গলি। তার শেষে বড় একটা কামরা। কামরার চার দেয়ালে অনেকগুলো দরজা। সেগুলো দিয়ে ঢোকা যায় বিভিন্ন কক্ষে। অরোস জানালো, হেসা তার পরিচারিকাদের নিয়ে বাস করেন ঐ কক্ষগুলোয়।
গলির শেষের কামরায় পৌঁছে দেখলাম ছজন পূজারী বসে আছে। প্রত্যেকের বগলে কয়েকটা করে মশাল আর হাতে একটা প্রদীপ।
অন্ধকারের ভেতর দিয়ে যেতে হবে আমাদের, বললো অরোস। দিন হলে বাইরের তুষার ছাওয়া ঢাল বেয়ে যাওয়া যেতো, রাতে ওখান দিয়ে যাওয়া বিপজ্জনক।
এক পূজারীর কাছ থেকে তিনটে মশাল নিয়ে জ্বাললো সে। দুটো আমাদের দুজনের হাতে দিয়ে তৃতীয়টা রাখলো নিজের কাছে। কামরার শেষ প্রান্তের একটা। দরজা খুললো অবোস। অন্ধকার এক সুড়ঙ্গ দেখা গেল। পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে উঠে গেছে ওপর দিকে। মশাল হাতে উঠতে শুরু করলাম আমরা। প্রায় একঘণ্টা ওঠার পর দীর্ঘ এক সিঁড়ির গোড়ায় পৌঁছুলাম।
লিওর দিকে তাকালো অবোস। মাথা নুইয়ে অত্যন্ত বিনীতভাবে বললো, এবার একটু বিশ্রাম নিয়ে নিন, প্রভু, এই সিঁড়ি বেয়ে অনেকুদূর উঠতে হবে। এখন আমরা পাহাড়ের চূড়ার ঠিক নিচে রয়েছি। আংটাওয়ালা স্তম্ভে উঠবো এবার।
বসে রইলাম আমরা। সুড়ঙ্গের ফাঁক-ফোকর দিয়ে ঠাণ্ডা বাতাস আসছে। মশালের শিখা কেঁপে কেঁপে উঠছে। মেঘ গর্জনের মতো অদ্ভুত গুরু গুরু একটা আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি একটু পর পরই। অবোসকে জিজ্ঞেস করলাম, ওটা কিসের শব্দ। সে বললো, অগ্নিগিরির জ্বালামুখ থেকে খুব দূরে নেই আমরা। নিরেট পাথর ভেদ করে ভেসে আসছে অনন্ত আগুনের শব্দ।
কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে উঠতে শুরু করলাম আমরা। উঠছি—উঠছি—উঠছি— শেষই হয় না সিঁড়ি। প্রায় এক ফুট উঁচু একেকটা ধাপ। পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে উঠে গেছে স্তম্ভের ভেতর দিয়ে। কয়েক মিনিটের ভেতর হাঁপাতে শুরু করলাম। আবার বিশ্রাম নিলাম, আবার উঠলাম, তারপর আবার বিশ্রাম এবং আবার ওঠা। পুরো ছয়শো ধাপ টপকে স্তম্ভের মাথায় পৌঁছানো গেল। কিন্তু শেষ হলো না ওঠা। আংটার ভেতর দিয়েও উঠে গেছে সিঁড়ি। আবার খানিকক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে উঠে চললাম আমরা। অবশেষে আলো দেখতে পেলাম সামনে। আর বিশটা ধাপ টপকাতেই উঠে এলাম আংটার একেবারে মাথায় মঞ্চ মতো একটা জায়গায়।
আশি ফুট লম্বা ত্রিশ ফুট চওড়া সমতল জায়গাটা। মাথার ওপর নক্ষত্রখচিত আকাশ। শো শো করে বাতাস বইছে। প্রবল তার বেগ। মনে হচ্ছে উড়িয়ে নিয়ে যাবে। দক্ষিণে বিশ হাজার ফুট বা তারও নিচে অস্পষ্টভাবে দেখতে পাচ্ছি কালুনের সমভূমি। পুব এবং পশ্চিমে দূরে তুষার ছাওয়া পাহাড়শ্রেণী। এবং সবচেয়ে ভয়ঙ্কর, আমাদের ঠিক নিচে আগ্নেয়গিরির প্রকাণ্ড জ্বালামুখ। প্রশস্ত একটা আগুনের হ্রদ। টগবগ করে বুদবুদ উঠছে। নানান রঙের নানান চেহারার ফুলঝুরি তুলে ফাটছে একেকটা বুদবুদার নতুন করে তৈরি হচ্ছে আরেকটা।
আতঙ্কে হাত পা হিম হয়ে আসতে চাইছে আমার। হৃৎপিন্ত্রে গতি দ্রুত হয়ে গেছে। হাঁটু গেড়ে বসে পড়লাম। লিওকেও চিৎকার করে বললাম আমার মতো করতে। এবার একটু স্বস্তি পেলাম। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালাম চারপাশে। কিন্তু কিছুই দেখতে পেলাম না-না হেসাকে না খানিয়া আতেনকে, না তার মৃত স্বামীকে। অরোস আর তার সঙ্গী ছয় পুরোহিত নির্বিকার দাঁড়িয়ে আছে।
কোথায় হতে পারে ওরা ভাবছি, এমন সময় পূজারীরা ঘিরে ধরলো আমাদের। ভয়ের লেশমাত্র নেই তাদের আচরণে। ধরে ধরে মঞ্চের কিনারে নিয়ে গেল ওরা আমাকে আর লিওকে। একটা সিঁড়ি দেখতে পেলাম মশালের নিভু নিভু আলোতে। সেটা দিয়ে কয়েক ধাপ নিচে নামতেই লক্ষ করলাম আগের মতো উন্মুক্ত জায়গায় আর নেই আমরা। বাতাসের গর্জন এখন মাথার ওপরে। আরও বিশ পা মতো এগোলাম। মাথার ওপর ছাদ দেখতে পেলাম। প্রাচীনকালের সেই অগ্নিউপাসকরা বানিয়েছিলো বোধহয়। ছাদের নিচে তিন দিকে দেয়াল, একটা দিক উক্ত, যেদিক থেকে আমরা এসেছি সেদিকটা। তিন দেয়ালওয়ালা বড়সড় একটা কামরা যেন। আগ্নেয়গিরির গভীর থেকে উঠে আসা আগুন লাল পর্দার মতো মেলে আছে পেছনে। সেই আলোয় আলোকিত কামরাটা।