দাঁড়াও, আতেন! কঠোর কণ্ঠে বললো হেসা। তুমি বলছে, প্রকৃতির খেয়ালে তুমি আর ঐ লোকটা একে অন্যের প্রেমে পড়েছিলে। ওর বুকের কাছে ছোট্ট একটা থলেতে এক গোছা চুল আছে। বলো, সেটা কি তোমার প্রেমের নিদর্শন?
ওর বুকের কাছে কোনো থলে আছে কিনা বা সেই থলেতে কোনো কিছু লুকানো আছে কিনা, আমি জানি না, শান্ত নিরাবেগ গলায় বললো খানিয়া।
তোমার তোরণ-গৃহে যখন অসুস্থ হয়ে পড়ে ছিলো তখন ও ঐ গোছাটা তোমার চুলের সাথে মিলিয়ে দেখেনি ব চাও?—ভালো করে মনে করে দেখ।
ওহ! আমাদের সব গোপন কথা ফাঁস করে দিয়েছে! ঘৃণার দৃষ্টিতে লিওর দিকে তাকালো আতেন। অনেক পুরুষই প্রেয়সীর স্মৃতিচিহ্ন বুকে করে রাখতে চায়, ও-ও রেখেছে।
না। এ সম্পর্কে আমি ওঁকে কিছুই বলিনি, খানিয়া! শান্তকণ্ঠে বললো লিও।
না, তুমি বলোনি; আমার অলৌকিক ক্ষমতাই আমাকে জানিয়েছে। নিজেকে তুমি কি মনে করো, আতেন? সর্বজ্ঞ সর্বদশী হেমার কাছে সত্য গোপন করবে, এতই সহজ? আমি সব জানি, আতেন, বিদেশীরা অসুস্থ বলে মিথ্যা সংবাদ দিয়েছিলে আমাকে। আমার অতিথিদের বন্দী করেছিলে। যে তোমার প্রেম প্রত্যাখ্যান করেছিলো তার কাছ থেকে জোর করে ভালোবাসা আদায় করতে চেয়েছিলে? থামলো হেসা। তারপর হিম শীতল কণ্ঠে বলে গেল, তোমার পাপের পেয়ালা পূর্ণ হয়েছে, আতেন। এত কিছুর পরও আমার আশ্রমে, আমার সামনে বসে মিথ্যা বলেছে তুমি।
হলোই বা, তাতে কি? তাচ্ছিল্যের সাথে বললো খানিয়া। আপনি নিজে কি ওই লোকটাকে ভালোবাসেন? না, সে-তো দানবীয় ব্যাপার! উহুঁ, হেস, অত রেগে যাবেন না, আপনার অশুভ ক্ষমতার কথা আমি জানি, এ-ও জানি আমি আপনার অতিথি, অতিথির রক্তে আপনি আপনার হাত কলঙ্কিত করবেন না। তাছাড়া, আমার ধারণা, আমার ক্ষতি করা আপনার সাধ্যের বাইরে। অতিলৌকিক ক্ষমতার দিক থেকে আমি আপনি দুজনেই সমান।
আতেন, মাপা গলায় জবাব দিলো হেস, ইচ্ছে করলে এ মুহূর্তে তোমাকে ধ্বংস করতে পারি। তবে, তুমি ঠিকই বলেছো, করবো না। কিন্তু এই অতিথিদের সম্পর্কে আমার স্পষ্ট নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও তা লঙ্ঘন করার সাহস দেখালে কি করে?
তাহলে শুনুন, স্পর্ধা, ব্যঙ্গ সব দূর হয়ে গেছে আতেনের গলা থেকে। ওর অন্তর থেকে যেন উঠে এলো কথাগুলো। আমি আপনার নির্দেশ অমান্য করেছি কারণ, ঐ মানুষটা আপনার নয়, আমার, এবং একমাত্র আমার; অন্য কোনো নারীর নয়! আমি ওকে ভালোবাসি, জন্ম-জন্মান্তর ধরে ভালোবাসি। হ্যাঁ, আমাদের আত্ম প্রথম যখন দেহের খাঁচায় বন্দী হয়েছে তখন থেকেই আমি ওকে ভালোবাসি, যেমন ও ভালোবাসে আমাকে। আমার হৃদয় আমাকে বলেছে একথা, আমার চাচার ঐন্দ্রজালিক ক্ষমতা আমাকে বলেছে একথা, যদিও কখন, কোথায় এ প্রেমের সূচনা তা আমি জানি না। জানার জন্যেই এসেছি আপনার কাছে, মা। অতীতের কোনো রহস্যই আপনার অজ্ঞাত নয়, আপনি বলুন, সত্য প্রকাশ করুন। জানি নিজের বেদীতে বসে আপনি মিথ্যে বলতে পারবেন না। জবাব দিন আমার প্রশ্নের-কে এই লোক। কেন ওকে দেখার সঙ্গে আমার অন্তর পেয়ে গেছে ওর দিকে? অতীতে ওর সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক ছিলো? আপনার কাছে কেন এসেছে ও? বলুন, ও মহিমাময়ী মা সব গোপনীয়তার অবসান হোক। আমি আদেশ করছি, বলুন, পরে আমাকে হত্যা করতে চান করবেন, কিন্তু আগে সত্য প্রকাশ করুন।
হ্যাঁ, বলুন! বলুন! আতেন থামতেই বলে উঠলো লিও। আমিও জানতে চাই। আশা-নিরাশায় হাবুডুবু খাচ্ছে আমার মন, আমাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে স্মৃতি। বলুন আপনি!
আমিও প্রতিধ্বনি করলাম, বলুন!
চুপ করে আছে হেসা। একটা দুটো করে সেকেণ্ড পেরিয়ে যাচ্ছে।
লিও ভিনসি, অবশেষে বললো সে, তোমার কি মনে হয়? আমি কে হতে পারি?
আমার বিশ্বাস, শান্ত গলায় জবাব দিলো লিও, তুমি আয়শা। কোর-এর। গুহায় দুহাজার বছরেরও বেশি আগে যার হাতে আমি নিহত হয়েছিলাম সেই আয়শা। হ্যাঁ, আমার বিশ্বাস, তুমি আয়শা। কোর-এর সেই একই গুহায় বিশ বছর আগে আবার ফিরে আসার শপথ নিয়ে যাকে মারা যেতে দেখেছিলাম তুমি সেই আয়শা।
শুনে খুব মজা পেলো যেন খানিয়া। বললো, শোনো পাগল কি বলে! বিশ বছর নয়, আশি গ্রীষ্ম আগে আমার দাদা, তখন উনি যুবক, মায়ের এই সিংহাসনে বসে থাকতে দেখে গিয়েছিলেন এই পূজারিনীকে।
তোমার কি মনে হয়, হলি? আমি কে হতে পারি? অ্যাতেনের কথা যেন শুনতেই পায়নি এমন ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করলো হেসা।
লিওর যা বিশ্বাস আমারও তাই। অবশ্য আসলে আপনি কি তা একমাত্র আপনিই বলতে পারেন।
হ্যাঁ, আমিই বলতে পারি আসলে আমি কি। কাল ঐ মৃতদেহ সত্ত্বারের জন্যে যখন উপরে নিয়ে যাওয়া হবে তখন এ নিয়ে আবার আলাপ করবো আমরা। ততক্ষণ তোমরা বিশ্রাম নাও, আর প্রস্তুতি নাও সেই ভয়ঙ্কর সত্যের মুখোমুখি হওয়ার।
হেসার কথা শেষ হওয়ার আগেই, রুপালি পর্দা সরে এলো আগের জায়গায়। কালো পোশাক পরা পুরোহিতরা ঘিরে ধলো আতেন আর তার চাচা শামানকে। মন্দির থেকে বেরিয়ে গেল তারা। পূজারী-প্রধান অবোস ইশারায় তার পেছন পেছন যেতে বললো আমাদের। আমরাও বেরিয়ে এলাম মন্দির থেকে। অন্য পূজারী পূজারিনীরাও বেরিয়ে এলো। কেবল খান র্যাসেনের মৃতদেহ পড়ে রইলো যেখানে ছিলো সেখানে।
চমৎকার আসবাবপত্র সজ্জিত একটা বাড়িতে আমাদের নিয়ে এলো অরোস। অদ্ভুত এক পানীয় খেতে দিলো স্বপ্নাচ্ছন্নের মতো বিনা প্রতিবাদে খেয়ে নিলাম আমি আর লিও। তারপর আর কিছু মনে নেই।