খুব বেশি কিছু না, তাচ্ছিল্যের সঙ্গে জবাব দিলো সে। তিন চাঁদেরও কয়েকদিন আগে আমার গুপ্তচররা তোমাদের দেখতে পায় দূরের ঐ পাহাড়ে। এক রাতে লুকিয়ে লুকিয়ে তোমাদের তাঁবুর খুব কাছে গিয়ে তোমাদের ভ্রমণের উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানতে পারে। তারপরই ঝটপট ফিরে এসে আমাকে জানায় সব। তখন আমি খানিয়া আতেন আর তার যাদুকর চাচাকে নির্দেশ দিই কালুনের প্রাচীন রাজ্যতোরণের কাছে গিয়ে যেন অপেক্ষা করে এবং তোমরা পৌঁছুলে সমাদরের সাথে অভ্যর্থনা জানিয়ে দ্রুত এখানে পাঠানোর ব্যবস্থা করে। কিন্তু দেখছি কালুন থেকে এপর্যন্ত আসতে তোমাদের তিন মাসেরও বেশি লেগে গেছে।
যথাসম্ভব দ্রুত আসার চেষ্টা করেছি আমরা, বললো লিও; আপনার গুপ্তচররা যখন ওই দূরের পাহাড়ে গিয়ে আমাদের আসার সংবাদ আনতে পারে। আমাদের দেরি হওয়ার কারণও নিশ্চয়ই তারা বলতে পারবে। আমার প্রার্থনা, এ সম্পর্কে আর কিছু জিজ্ঞেস করবেন না আমাদের।
হ্যাঁ, আমি আতেনকেই জিজ্ঞেস করবো, শীতল গলায় জবাব দিলো হেসা। অবোস, খানিয়াকে নিয়ে এসো এখানে। তাড়াতাড়ি করবে।
চলে গেল পুরোহিত প্রধান।
আমার দিকে তাকালো লিও। ইংরেজিতে বললো, এখানে আসা ঠিক হয়নি। এবার বোধহয় ঝামেলা হবে।
আমার মনে হয় না। যদি হয়ও ঝামেলার ভেতর দিয়ে সত্যই বেরিয়ে আসবে। থেমে গেলাম আমি। মনে পড়লো, পাহাড়ে থাকতে ইংরেজি ছাড়া আর কিছু বলিনি আমরা। তবু সামনে বসা এই অদ্ভুত মহিলার চররা আমাদের কথা বুঝেছিলো। এই মহিলাও নিশ্চই বোঝে।
এক সেকেণ্ড পরেই আমার কথা সত্যি প্রমাণিত হলো।
তুমি অভিজ্ঞ লোক, হলি, বললো সে, ঠিকই বলেছো, ঝামেলার ভেতর দিয়েই সত্য বেরিয়ে আসে।
.
দরজা খুলে গেল। কালো পোশাক পরা একদল মানুষ ঢুকলো প্রায় বৃত্তাকার কামরাটায়। পুরোভাগে রয়েছে শামান সিমব্রি। তার পেছনেই খানের শববাহী খাঁটিয়া বয়ে আনছে আটজন পূজারী। তারপর খানিয়া আতেন, মাথা থেকে পা। পর্যন্ত কালো আলখাল্লায় মোড়া। সবশেষে আরেক দল পূজারী। বেদীর সামনে নামিয়ে রাখা হলো খাঁটিয়াটা। পূজারীরা পিছিয়ে গেল। আতেন আর তার চাচা কেবল রইলো মৃতদেহের কাছে।
আমার দাসী, কালুনের খানিয়া কি চায়? শীতল কণ্ঠে প্রশ্ন করলো হেসা।
এগিয়ে হাঁটু গেড়ে বসলো আতেন। প্রণাম করলো, তবে খুব বিনীত ভঙ্গিতে নয়।
মা, আমার পূর্ব-পুরুষদের মতো আমিও এসেছি আপনার চরণে আমার ভক্তি নিবেদন করতে, আবার প্রণাম করলো সে। মা, এই মৃত মানুষটা আপনার এই
পবিত্র পাহাড়ের আগুনে সমাহিত হওয়ার অধিকার চায়।
এটা আবার চাওয়ার কি হলো? যুগ যুগ ধরে তো এ নিয়মই চলে আসছে, খান পরিবারের সদস্যরা মারা যাওয়ামাত্র এখানে সমাহিত হওয়ার অধিকার লাভ করে। তোমার মৃত স্বামীর বেলায় ব্যতিক্রম হবে কেন? যখন সময় আসবে তোমার বেলায়ও হবে না।
ধন্যবাদ, ও হেস, আমার প্রার্থনা, নির্দেশটা লিখিতভাবে রাখা হোক। বয়সের তুষার স্তরে স্তরে জমেছে আপনার পূজনীয় দেহের ওপর। শিগগিরই হয়তো সাময়িকভাবে আমাদের ছেড়ে বিদায় নেবেন আপনি। তারপর নতুন যে হেসা আমাদের শাসন করবেন তার সময়ে যেন এর অন্যথা না হয়।
থামো! গর্জে উঠলো হেসা। বন্ধ করো তোমার এই লাগামহীন কথাবার্তা! নির্বোধ, কার সামনে বসে কি বলছো খেয়াল নেই? সৌন্দর্য আর যৌবন নিয়ে তোমার যে অহঙ্কার তা কালই আগুনের খোরাক হতে পারে জানো না? বাজে কথা রেখে বলো, কি করে মরেছে তোমার স্বামী? ১
ঐ বিদেশীদের জিজ্ঞেস করুন।
আমি ওকে হত্যা করেছি, বললো লিও। প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে এ কাজ করতে হয়েছে। আমাদের ওপর ও হিংস্র কুকুরের পাল লেলিয়ে দিয়েছিলো। এই যে তার প্রমাণ, আমার হাতের দিকে ইশারা করলো ও। পূজারী অরোসও জানেন, উনি ঐ ক্ষত চিকিৎসা করছেন।
কি করে এ সম্ভব? আতের্নের দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করলো হেসা।
আমার স্বামী উন্মাদ ছিলো, দৃঢ় গলায় বললো খানিয়া। নিষ্ঠুর হলেও ব্যাপারটাকে ও খেলা হিসেবে নিয়েছিলো।
আচ্ছা! তোমার স্বামী বোধহয় একটু ঈর্ষাকাতরও হয়ে উঠেছিলো, তাই না? উই, মিথ্যে বলার চেষ্টা কোরো না। লিও ভিনসি, তুমি বলোনা, যে নারী তোমার কাছে প্রেম নিবেদন করেছে তার সম্পর্কে তোমাকে জিজ্ঞেস করবো না। হলি, তুমি বলো, সত্যি বলবে।
খানিয়া আতেন আর শামান সিমব্রি আমাদের উদ্ধার করার পর থেকে এ পর্যন্ত যা যা ঘটেছে সংক্ষেপে বলে গেলাম আমি। নিঃশব্দে শুনলো হেসা। তারপর বললো— বলছো, খানিয়া তোমার পালিত পুত্রের প্রেমে পড়েছিলো। কিন্তু পালিত পুত্রের অবস্থা কি? ও প্রেমে পড়েনি?
তা আমি সঠিক বলতে পারবো না। তবে যতটুকু জানি, খানিয়ার হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যে পাগল হয়ে উঠেছিলো লিও।
হুঁ। দাসী আতেন! কি বলার আছে তোমার?
সামান্য, জবাব দিলো, আতেন, একটুও কাঁপছে না ওর গলা। ঐ পাগল বর্বরটার সাথে থাকতে থাকতে হাঁপিয়ে উঠেছিলাম। এমন সময় এলো এই বিদেশী। একে অন্যকে দেখলাম আমরা। তারপর প্রকৃতির খেয়াল, আমি কি করবো?-পরস্পরের প্রতি আসক্ত হলাম দুজন। পরে ব্ল্যাসেনের প্রতিশোধের ভয়ে কালুন ছেড়ে পালানোর চেষ্টা করে ওরা। নেহায়েত দৈবক্রমেই এদিকে চলে এসেছিলো। এটুকুই আমার বক্তব্য। এবার দয়া করে অনুমতি দিন, বিশ্রাম নিতে যাই, ভীষণ ক্লান্ত বোধ করছি।