যত আমরা এগোচ্ছি ততই উঁচুগ্রামে উঠছে পূজারীদের কণ্ঠস্বর। বিশাল শূন্য কামরার পরিবেশ আরও গমগমে হয়ে উঠেছে। সেই সাথে আমার মনে হলো–হয়তো এটা নেহায়েতই মনে হওয়া-অগ্নি স্তম্ভের উজ্জ্বলতাও যেন বাড়ছে।
অবশেষে আমরা পৌঁছুলাম সেখানে। আমাদের হাত ছেড়ে দিয়ে তিনবার মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করলো অরোস। তারপর উঠে আমাদের পেছনে এসে দাঁড়িয়ে রইলো; মাথা নিচু, আঙুলগুলো ভাজ করা। আমরাও দাঁড়িয়ে রইলাম। অরোসের মতোই নিঃশব্দে। আশা-নিরাশার দোলায় দুলছে আমাদের হৃদয়। অবশেষে কি সব পরিশ্রমের শেষ হলো?
.
১৪.
ধীরে ধীরে সরে গেল রুপোর পর্দা। একটা কুঠুরি মত দেখতে পেলাম বেদীর নিচে। সে কুঠুরির কেন্দ্রস্থলে একটা সিংহাসন। সিংহাসনে আসীন এক মূর্তি। তুষার শুভ্র ঢেউ নেমে এসেছে তার মাথা থেকে বাহু ছাড়িয়ে মর্মরের মেঝে পর্যন্ত। বস্ত্রাবৃত হাতে রত্নখচিত আংটাওয়ালা দণ্ড-সিসট্রাম!
হঠাৎ কি যে হলো আমাদের, মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে প্রণতি জানালাম মূর্তিকে, অরোস যেমন করেছিলো। এবং তারপর সেখানেই বসে রইলাম হাঁটু গেড়ে, মুখ নিচু করে। অনেক অনেকক্ষণ পর ছোট্ট ঘণ্টাগুলোর মৃদু টুং টাং আওয়াজ শুনে মুখ তুলে দেখলাম, দণ্ড ধরা হাতটা আমাদের দিকে প্রসারিত। তারপর সরু কিন্তু স্পষ্ট একটা কণ্ঠস্বর, আমার মনে হলো সামান্য যেন কাঁপছে, বিশুদ্ধ খ্রীকে বললো স্বাগতম পথিকেরা। অন্য ধর্মাবলম্বী হয়েও দীর্ঘ বন্ধুর পথ পাড়ি দিয়ে এই প্রাচীন দেবায়তনে এসেছে, সেজন্যে তোমাদের অভিনন্দন। ওঠো, আমাকে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আমিই তো তোমাদের আহ্বান করেছি। সে জন্যে কি দূত এবং ভৃত্যদের পাঠাইনি? তাহলে আর ভয় কেন?
উঠলাম আমরা। নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইলাম। কি বলবো বুঝতে পারছি না।
আমি তোমাদের অভিনন্দন জানাই, আবার শোনা গেল সেই কণ্ঠস্বর। এখন বলল,লিওর দিকে ঘুরলো দণ্ডটা-কি বলে সম্বোধন করা হয় তোমাকে?
আমার নাম লিও ভিনসি।
লিও ভিনসি! চমৎকার নাম! তোমাকেই মানায়। আর তুমি? আমাকে করা হলো প্রশ্নটা।
আমি হোরেস হলি।
আচ্ছা। এবার বলো, লিও ভিনসি, হোজেস হলি, কিসের খোঁজে এসেছ এত দূরে?
একে অন্যের দিকে তাকালাম আমরা। আমি জবাব দিলাম, সে এক আশ্চর্য, দীর্ঘ কাহিনি—কিন্তু আপনাকে কি বলে সম্বোধন করবো আমরা?
যা আমার নাম, হেস।
হ্যাঁ, সে এক দীর্ঘ কাহিনি, হেস।
হোক দীর্ঘ, তবু আমি শুনতে চাই। আগ্রহ তার গলায়। না, এখনই সবটা নয়, আমি জানি তোমরা ক্লান্ত, এখন কিছুটা বলল, বাকিটা পরে শুনবো। তুমি বলো, লিও, যথাসম্ভব সংক্ষেপে।
পূজারিনী, স্বভাবসুলভ চটপটে ভঙ্গিতে বললো লিও, আপনার আদেশ শিরোধার্য। বহু বছর আগে, আমি যখন যুবক, আমার বন্ধু এবং পালক পিতা হোরেস হলি আর আমি প্রাচীন কিছু তথ্য প্রমাণের ভিত্তিতে বুনো এক দেশে গিয়েছিলাম। সেখানে স্বর্গীয় এক নারীর সাথে সাক্ষাৎ হয় আমাদের। সময়কে জয় করতে সক্ষম হয়েছিল সে।
অর্থাৎ সেই রমণীর বয়স ছিল বেশি, দেখতেও নিশ্চয় কুৎসিত?,
পূজারিনী, আমি বলেছি, সে সময়কে জয় করেছিলো সহ্য করেছিলো নয়। সে ছিলো অনন্ত যৌবনের অধিকারী, আর সৌন্দর্য? ওর তুলনা একমাত্র ও-ই। পৃথিবীর কোনো সৌন্দর্যের সাথে সে সৌন্দর্যের তুলনা চলে না।
তাহলে, বিদেশী, আর দশটা পুরুষের মত তুমিও নিছক সৌন্দর্যের খাতিরেই ওকে পূজা করেছো?
উঁহুঁ, আমি ওকে পূজা করিনি, ভালোবেসেছি। প্রেম আর পূজা নিশ্চয়ই এক জিনিস নয়? পূজারী অরোস আপনাকে পূজা করে, সেজন্যে মা ডাকে। আমি ঐ অনন্ত যৌবনা রমণীকে ভালোবেসেছিলাম।
তাহলে তো এখনও ওকে তোমার ভালোবাসা উচিত। নইলে বলতে হয়, খাদ ছিলো তোমার প্রেমে।
আমি এখনও ওকে ভালোবাসি, বললো লিও। ও মরে গেছে তবু।
তা কি করে সম্ভব? এই না বললে সে অমর।
এখনও আমি তা-ই বিশ্বাস করি। তবে আমার মানবীয় বোধ হয়তো বুঝতে পারছে না, ভাবছে ও মরে গেছে, হয়তো ও রূপ বদলেছে। মোট কথা, আমি ওকে হারিয়েছি, এবং সেই হারানো ধনই আমি খুঁজে ফিরছি এত বছর ধরে।
বুঝলাম, কিন্তু আমার পাহাড়ে কেন?
কারণ এক অলৌকিক দর্শন আমাকে এই পাহাড়ের দৈববাণীর পরামর্শ নিতে বলেছে। আমার হারানো প্রিয়তমার খবর পাবো সেই আশায় এখানে এসেছি।
আর তুমি, হলি? তুমিও কি অমন এক অমর নারীকে ভালোবাসো, যার অমরত্ব মৃত্যুর পায়ে মাথা নোয়ায়?
না, পূজারিনী, আমার দায় অন্যখানে। আমার পালিত পুত্র যেখানেই যায় আমিও ওর সঙ্গে সঙ্গে যাই। ও সৌন্দর্যেপছনে ছুটছে, আমি ওর–
তুমি ওর পেছন পেছন ছুটছো। তার মানে তোমরা দুজনই যুগ যুগ ধরে মানুষ অন্ধের মতো, পাগলের মতো যা করেছে তা-ই করছে–সৌন্দর্যের পেছনে ছুটছে।
না, আমি বললাম, ওরা যদি অন্ধ হতো সুন্দরকে দেখতে পেতো না, আর পাগল হলে বুঝতে পারতো না কোনটা সুন্দর কোনটা অসুন্দর। জ্ঞান এবং চোখ দুটোই স্বাভাবিক মানুষের আয়ত্তাধীন অনুভব।
হুঁ, বেশ গুছিয়ে কথা বলতে পারো তুমি, হলি, অনেকটা সেই- থেমে গেল সে। তারপর হঠাৎ জিজ্ঞেস করলো, আচ্ছা, আমার দাসী কালুনের খানিয়া তোমাদের যথাযথ সমাদর করেছে তো? যেমন নির্দেশ দিয়েছিলাম সেই মতো এখানে আসার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলো?
আমরা জানতাম না ও আপনার দাসী, বললাম আমি। সমাদর? হ্যাঁ, তা পেয়েছি মোটামুটি। তবে এখানে আসার ব্যাপারে ওর চেয়ে ওর স্বামী, খানের মরণ-শ্বাপদগুলোর অবদান বেশি। আচ্ছা, পূজারিনী, আমাদের আসা সম্পর্কে কি জানেন আপনি?