বাগানের মতো সবুজ এলাকা পেরিয়ে ছোট্ট একটা শহর। লাভা পাথরের তৈরি সুন্দর ছিমছাম শহরটায় পূজারীরা থাকে। উপজাতীয়দের কাউকে বা কোনো আগন্তুককে আসতে দেয়া হয় না এখানে।
শহরের প্রধান সড়ক ধরে এগিয়ে উঁচু একটা পাহাড়ী দেয়ালের কাছে পৌঁছুলাম। সামনে বিরাট একটা দরজা। লোহার ভারি পাল্লাগুলো লাগানো। এখান থেকে বিদায় নিলো আমাদের রক্ষী পুরোহিতেরা। আমার ঘোড়াটাও নিয়ে গেল ওরা। অবোস, আমি আর লিও কেবল রইলাম।
নিঃশব্দে খুলে গেল বিশাল দরজাটা। বাঁধানো একটা পথ ধরে এগিয়ে চললাম। কিছুক্ষণ পর অনেক উঁচু আরেকটা দরজার সামনে এলাম। এটাও লোহার। আগেরটার মতোই খুলে গেল নিঃশব্দে, কোনো সংকেত বা নির্দেশ দিতে হলো না বাইরে থেকে। পরমুহূর্তে ভেতরের উজ্জ্বল আলোয় চোখ ধাধিয়ে গেল আমাদের।
পাঠক, আপনার দেখা সবচেয়ে বড় গির্জার কথা স্মরণ করুন; তার দ্বিগুণ বা তিনগুণ আয়তনের একটা মন্দিরের ভেতর ঢুকেছি আমরা। কোনো কালে হয়তো নিছক পাহাড়ী গুহা ছিলো, কে বলতে পারে? কিন্তু এখন এর উঁচু খাড়া দেয়াল, বিশাল স্তম্ভসমূহে ভর করে থাকা ছাদ প্রমাণ করছে হাজার হাজার বছর আগে অগ্নি-উপাসক মানুষদের কি কঠোর পরিশ্রম করতে হয়েছিলো এটা তৈরি করতে।
বিস্ময়কর এক পদ্ধতিতে আলোকিত করা হয়েছে মন্দিরটাকে। মেঝে থেকে উঠে এসেছে উঁচু মোটা অগ্নিস্তম্ভ। গুণে দেখলাম আঠারোটা। নির্দিষ্ট দূরত্ব পর পর দুই সারিতে উজ্জ্বল সাদা আলো বিকিরণ করে জ্বলছে সেগুলো। ছাদের সামান্য নিচে শেষ হয়েছে অগ্নি-স্তম্ভগুলোর মাথা। কোনো গন্ধ বা ধোয়া তৈরি হচ্ছে না। সবচেয়ে আশ্চর্য, এক বিন্দু তাপ ছড়াচ্ছে না সেগুলো। বাইরের মতো শীতল পরিবেশ মন্দিরের ভেতরেও। মৃদু একটা হিস হিস শব্দ হচ্ছে শুধু।
মন্দির জনশূন্য।
আপনাদের এই মোমবাতি কখনও নেভে না? জিজ্ঞেস করলো লিও।
কি করে নিভবে? জবাব দিলো অরোস। এই মন্দিরের নির্মাতারা যার পূজা করতো সেই অনন্ত আগুন থেকে উঠে আসছে ওগুলো। আদি থেকে জ্বলছে এ আলো, অন্ত পর্যন্ত জ্বলবে। তবে ইচ্ছে করলে কিছুক্ষণের জন্যে আমরা বন্ধ করে দিতে পারি কোনো একটা বা সবগুলো। যাক, চলুন, আরও বড় জিনিস দেখার আছে।
নিঃশব্দে এগিয়ে গেলাম আমরা। অবশেষে মন্দিরের শেষ মাথায় পৌঁছলাম। সামনে একটা কাঠের দরজা, আগেরগুলোর মতোই বিরাট। ডান বা দুদিকে দুটো গলি মতো চলে গেছে। আমাদের থামতে ইশারা করলো অরোস। একটু পরেই দুপাশের গুলি থেকে ভেসে এলো সমবেত কণ্ঠের ধর্ম-সঙ্গীত। একবার এদিকে একবার ওদিকে তাকালাম। সাদা আলখাল্লাধারীদের দুটো মিছিল এগিয়ে আসছে আমাদের দিকে।
ধীর পায়ে এগিয়ে আসছে ওরা। ডান দিকের মিছিলটা পূজারীদের, বা দিকেরটা পৃজারিনীদের। সব মিলে একশো জনকি তার বেশি হবে। আমাদের সামনে এসে সারি বেঁধে দাঁড়ালো তারা। পূজারিনীরা দাঁড়ালো পেছনের সারিতে। চুপ সবাই।
অরোস একটা ইশারা করতেই আবার গেয়ে উঠলো তারা। এবার একটু দ্রুত লয়ের একটা সঙ্গীত। সামনের কাঠের দরজাটা খুলে গেল। আবার এগোলাম আমরা। পেছন পেছন সারি বেধে এলো পূজারী-পূজারিনীরা। তারপর যেমন খুলেছিলো তেমনি নিঃশব্দে আমাদের পেছনে বন্ধ হয়ে গেল দরজা। উপবৃত্তাকার একটা কামরায় পৌঁছেছি। এতক্ষণে বুঝলাম, পাহাড়ের চূড়ায় যে আঙটাওয়ালা স্তম্ভ আছে সেটার আদলে তৈরি করা হয়েছে মন্দিরটার দৈর্ঘ্যে প্রস্থে দুটো সমান। এই কামরায়ও মেঝে থেকে অগ্নি-স্তম্ভ উঠেছে। এছাড়া কামরাটা ফাঁকা।
না, পুরোপুরি ফাঁকা নয়, উপবৃত্তের শেষ প্রান্তে একটা উঁচু চৌকো বেদীমতো। একটু কাছাকাছি হতে দেখলাম, রুপোর সরু সুতো দিয়ে তৈরি পর্দা ঝুলছে সেটার সামনে। বেদীর ওপর বসানো রয়েছে বড় একটা রুপোর প্রতিমা। অগ্নি-স্তম্ভের উজ্জ্বল আলো তার ওপর পড়ে ঝকমকিয়ে উঠছে।
দেখতে সুন্দর হলেও জিনিস্টার ঠিক ঠিক বর্ণনা দেয়া দুষ্কর। মূর্তিটা ডানাওয়ালা পরিণত বয়সের এক মহিমাময়ী রমণীকে প্রতীকায়িত করছে যেন। একটা ডানা বেঁকে এসে ঢেকে দিয়েছে তার সামনেটা। ডানার আড়াল থেকে উঁকি দিচ্ছে একটা বাচ্চা ছেলের মুখ। বাঁ হাতে সে ধরে আছে নারীমূর্তির এক স্তন, ডান হাতটা উঁচু হয়ে আছে আকাশের দিকে। এক পলক দেখলে যে কেউ বুঝতে পারবে মূর্তিটা মাতৃত্বের প্রতিরূপ।
আমরা যখন মুগ্ধ বিস্ময়ে দেখছি তখন পূজারী আর পূজারিনীরা ডানে-বাঁয়ে নড়ে চড়ে নতুন একটা সারি তৈরি করে দাঁড়িয়ে গেছে। একজন পুরুষের পাশে একজন নারী এভাবে দাঁড়িয়েছে তারা। গম্ভীর অথচ সুরেলা কণ্ঠের গান চলছে। উপবৃত্তাকার কামরাটা এত বড় যে দেয়ালে দেয়ালে প্রতিধ্বনি তুলছে তার আওয়াজ। সব মিলিয়ে গভীর গাম্ভীর্যময় এক পরিবেশ। কথা বলা দূরে থাক, হাত পা নাড়তে পর্যন্ত ভয় হচ্ছে, পাছে অবমাননা হয় এই গাম্ভীর্যের। নৈঃশব্দ্যই যেন এর একমাত্র সাথী, আর সব কিছু এখানে বেমানান।
শেষ পূজারী তার জায়গা নেয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করলো অরোস। তারপর ফিরলো আমাদের দিকে। মৃদু, বিনীত কণ্ঠে বললো, এবার কাছে আসুন, প্রিয় বিদেশী পথিক, মা-কে প্রণতি জানান।
কই তিনি? ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলো লিও। কাউকে তো দেখছি না। হেসা ওখানেই থাকেন। প্রতিমার দিকে ইশারা করলো অবোস। তারপর আমাদের দুজনের হাত ধরে এগিয়ে চললো বেদীর দিকে।