আবার উড়ে চললাম আমরা সাগরের ওপর দিয়ে, বালুময় মরুভূমির ওপর দিয়ে, তারপর আরও সাগর। অবশেষে নিচে দেখতে পেলাম ভারতীয় উপকূল। এবার উত্তরমুখী যাত্রা শুরু হলো আমাদের। সমভূমির ওপর দিয়ে উড়ে পাহাড়ী এলাকায় পৌঁছুলাম। অনন্ত তুষারের টুপি পরা পাহাড়ের ওপর দিয়ে উড়ে চললাম আমরা। মুহূর্তের জন্যে থামলাম এক মালভূমির কিনারে একটা দালানের ওপর। ওটা একটা মঠ। সন্ন্যাসীদের দেখলাম, বাঁধানো চাতালে বসে প্রার্থনা করছে। মঠটার চেহারা এখনও মনে আছে আমার: অর্ধচন্দ্রের মতো দেখতে। তার সামনে বসে থাকা ভঙ্গিতে বিশাল এক প্রতিমা। কেন জানি না মনে হলো তিব্বতের দূরতম সীমান্তের আকাশে পৌঁছেছি আমরা। সামনে বিস্তীর্ণ সমভূমি। কোনোদিন কোনো মানুষের পাওখানে পড়েছে কিনা জানি না। তার ওপাশে অসংখ্য পাহাড় চূড়া–শত শত। সবগুলোর মাথায় রুপালি বরফের মুকুট।
মঠটার পাশে সমভূমির ভেতর দিকে ঢুকে গেছে একটা পাহাড়, অনেকটা সাগরে ঢুকে যাওয়া পাহাড়ী অন্তরীপের মতো। ওটার তুষার ছাওয়া চূড়ায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম আমরা। তারপর একসময় আচমকা একটা আলোক স্তম্ভ এসে পড়লো আমাদের পায়ের কাছে। এ স্তম্ভের ওপর দিয়ে পিছলে নেমে যেতে লাগলাম আমি আর আয়শা। নামার সময় দূরে তাকিয়ে দেখলাম আরেকটা বিশাল সমভূমি। অনেকগুলো গ্রাম সেখানে। বিরাট এক মাটির স্তূপের ওপর একটা নগর। অবশেষে উঁচু এক চূড়ায় পৌঁছুলাম। চূড়াটা কুক্স আনসাতা—মানে মিসরীয়দের জীবনের প্রতীক-এর মতো দেখতে। আগুনের লেলিহান শিখা বেরিয়ে আসছে ওপাশের এক জ্বালামুখ থেকে। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম আমরা চূড়াটার ওপর। একসময় আয়শার সেই ছায়ামূর্তি হাত তুলে ইশারা করলো নিচের দিকে। একটু হাসলো। তারপর মিলিয়ে গেল। এর পরই ঘুম ভেঙে গেল আমার।
হোরেস, আমি বলছি, সংকেত এসে গেছে। এবার যেতে হবে আমাদের।
.
অন্ধকারে মিলিয়ে গেল লিওর কণ্ঠস্বর। স্থির বসে রইলাম আমি। নড়াচড়ার শক্তিও যেন লোপ পেয়েছে। লিও এগিয়ে এসে আমার হাত ধরলো।
।ঘুমিয়ে পড়লে নাকি? হাতটায় ঝাঁকুনি দিয়ে জিজ্ঞেস করলো ও। কথা বলছো না কেন?
না, জবাব দিলাম, এর চেয়ে সজাগ কখনও ছিলাম না। একটু ভাবতে দাও আমাকে।
বিছানা ছেড়ে উঠলাম আমি। ধীর পায়ে গিয়ে দাঁড়ালাম খোলা জানালার সামনে। পর্দা সরিয়ে চোখ মেলে দিলাম নিঃসীম আকাশের দিকে। লিও এসে দাঁড়ালো আমার পাশে গায়ে গা ঠেকিয়ে। অনুভব করলাম প্রবল শীতে যেমন ঠক ঠকিয়ে কাপে তেমন কাপছে ওর শরীর।
বলছো সংকেত, মৃদুকণ্ঠে আমি বললাম, কিন্তু আমি তো ভয়ানক এক স্বপ্ন। ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারছি না একে।
স্বপ্ন না, হোরেস, ফেটে পড়লো লিও, এ হলো অলৌকিক দর্শন।
বেশ মানলাম। কিন্তু অলৌকিক দর্শনেরও তো সত্যি মিথ্যে আছে। এটা যে সত্যি তা কি করে জানছি আমরা? শোনন, লিও, আমি যতটুকু বুঝতে পারছি, আয়শাকে হারিয়ে যে নিঃসঙ্গতার বোধে তুমি আক্রান্ত হয়েছে তা থেকেই উঠে এসেছে ঐ স্বপ্ন। কিন্তু দুনিয়ার সব প্রাণীই কি অমন নিঃসঙ্গ নয়? তুমি দেখেছো। আয়শার ছায়ামূর্তি এসে দাঁড়িয়েছে তোমার কাছে, তোমার পাশ থেকে কখনও সরেছে ওটা? তুমি দেখেছো, সাগর, পাহাড়, সমভূমি তারপর সেই স্মৃতিময় অভিশপ্ত জায়গার ওপর দিয়ে ও নিয়ে যাচ্ছে তোমাকে। কোথায়? রহস্যময়, অজানা, অনাবিষ্কৃত এক চূড়ায়। তার মানে কি? মৃত্যুর ওপারে জীবনের যে চূড়া সেদিকেই ও পথ দেখিয়ে নিয়ে গেছে তোমাকে তোমার স্বপ্ন।
ওহ! থামো তো! চিৎকার করলো নিও। আমি যা দেখেছি তা দেখেছি এবং সে অনুযায়ী-ই আমি কাজ করবো। তুমি করবে তা তোমার ভাবনা। কালই আমি ভারতের পথে যাত্রা করবো। তুমি গেলে যাবে, না গেলে আমার কিছু বলার নেই। আমি একাই যাবো।
অত উত্তেজিত হয়ো না লিও। তুমি ভুলে যাচ্ছো আমার কাছে কোনো সংকেত এখনও আসেনি। তুমি যে স্বপ্ন দেখেছে তা যদি আমি-ও দেখতাম আমার কোনো সংশয় থাকতো না। কিন্তু মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে যে ছেলে আত্মহত্যা করতে চাইছিলো সে-ই যদি কয়েক ঘণ্টা পরে মধ্য এশিয়ার বরফের রাজত্বে মরতে যেতে চায় তার সঙ্গে কে যেতে রাজি হবে? তোমার কি মনে হয় আয়শা মহিলা দালাইলামা বা ঐ ধরনের কিছু একটা হয়ে পুনর্জন্ম নিয়েছে মধ্য এশিয়ায়?
এ নিয়ে কিছু ভাবিনি আমি। কিন্তু যদি আসেই আশ্চর্য হওয়ার কি আছে? কোর-এর সেই গুহার কথা এর ভেতরেই ভুলে গেলে? জীবিত আর মৃত ক্যালিক্রেটিস মুখোমুখি হয়নি? আয়শা যে শপথ করেছিলো ও আবার আসবে হ্যাঁ এই পৃথিবীতে, তা-ও ভুলে গেছো? পুনর্জন্ম ছাড়া আর কিভাবে তা সম্ভব?
এ প্রশ্নের কোনো জবাব আমি দিতে পারলাম না। নিজের মনের সঙ্গে লড়াই চলছে আমার।
আমার কাছে কোনো সংকেত এখনও আসেনি, বিড় বিড় করে বললাম আমি। এ নাটকে আমারও একটা ভূমিকা আছে, গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয় যদিও, তবু ভূমিকা তো।
হ্যাঁ, বললো লিও, তোমার কাছে কোনো সংকেত এখনও আসেনি। এলেই ভালো হতো, হোরেস, আমার মতো তুমিও নিঃসংশয় হতে পারতে…
চুপ করে গেল লিও। আমিও আর কিছু বললাম না। নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইলাম দুজন আকাশের দিকে তাকিয়ে।
ঝঞ্ঝা বিক্ষুব্ধ একটা ভোর এগিয়ে আসছে। কালো মেঘ স্তূপের পর স্তূপ হয়ে জমছে সাগরের ওপর। একটা স্থূপের চেহারা ঠিক পাহাড়ের মতো। অলস ভঙ্গিতে দেখছি আমরা। প্রতি মুহূর্তে আকার বদলাচ্ছে সেটা। চূড়াটা ধীরে ধীরে জ্বালামুখের চেহারা নিলো। এবং একটু পরে তা থেকে প্রায় ছিটকে বেরিয়ে এলো মেঘের একটা স্তম্ভ। তার মাথায় একটা গোল পিণ্ড মতো। হঠাৎ উঠে আসা সূর্যের রশ্মি পড়লো এই মেঘের পাহাড় আর তার চূড়া থেকে উঠে আসা স্তম্ভে। সঙ্গে সঙ্গে তুষারের মতো সাদা হয়ে গেল ওগুলো। আবার আকার বদলাতে লাগলো। ধীরে ধীরে শীর্ণ হয়ে আসছে স্তম্ভটা। যেন গলে স্কুলে পড়ছে বরফের স্তূপ। থামের ওপরে পিণ্ডটাও ছোট হচ্ছে একটু একটু করে। এক সময় মিলিয়ে গেল দুটোই। পাহাড়ের চেহারার মেঘটা কেবল রইলো কালির মতো কালো।