আবার ওর দেখা পাবো! এ পাহাড়ে এলে কি মরা মানুষ বেঁচে ওঠে?
না। এখানে ওকে সমাহিত করতে আনা হবে। কালুনের শাসকরা অনেকদিন ধরে এই সুবিধাটুকু ভোগ করে আসছে। এই যে আপনার সঙ্গী উঠে গেছেন। তৈরি হয়ে নিন।
.
ঘণ্টাখানেক পরে আবার শুরু হলো আমাদের উধ্বমুখী যাত্রা। এবারও আমি খানের ঘোড়ায় চেপে চলেছি। আহার আর বিশ্রাম পেয়ে আবার তাজা হয়ে উঠেছে ঘোড়াটা। লিওর জন্যে একটা পালকির ব্যবস্থা করতে চাইলো অরোস। প্রত্যাখ্যান করলো লিও, মেয়ে মানুষের মতো পালকিতে চড়ে যাবে না ও। একেবারে সামনে আমাদের পথপ্রদর্শক সেই নারীমূর্তি। তার পেছনে অরোস। তারপর ঘোড়ার পিঠে আমি, পাশে পায়ে হেঁটে চলেছে লিও। সবশেষে সাদা আলখাল্লা পরা পূজারীবাহিনী।
চত্বর পেরিয়ে সেই ছোট্ট দরজা দিয়ে দেয়ালের বাইরে এলাম। কাল রাতে যে ঝরনার পাশ দিয়ে গ্রামটার কাছে এসেছিলাম সেখানে পৌঁছুলাম। তারপর উঠে যেতে লাগলাম পাহাড়ের ঢাল বেয়ে।
দুপাশে পাহাড়ের দেয়াল খাড়া উঠে গেছে, মাঝখান দিয়ে চলেছি আমরা। হঠাৎ সমবেত কণ্ঠের সুরেলা একটা ধর্মসঙ্গীত কানে ভেসে এলো। একটা বাঁক নিলো পথ। মোড় ঘুরে দেখলাম ধীর গম্ভীর একটা মিছিল এগিয়ে আসছে আমাদের দিকে। তার পুরোভাগে ঘোড়ার পিঠে আছে সুন্দরী খানিয়া, পেছনে তার চাচা বৃদ্ধ শামান, তারপর একদল সাদা আলখাল্লা পরা ন্যাড়া মাথা পূজারী। একটা শববাহী খাঁটিয়া বহন করেছে তারা। খাঁটিয়ায় শুয়ে আছে খান র্যাসেনের দেহ, কালো কাপড়ে আচ্ছাদিত।
আমাদের পথপ্রদর্শকের সাদা অবয়বটা দেখা মাত্র ভয়ঙ্কর বেগে ঘোড়া ছুটিয়ে এলো খানিয়া। চিৎকার করে উঠলো-কে তুই, কাফন পরা ডাইনী, খানিয়া আতেন আর তার মৃত স্বামীর পথ জুড়ে দাঁড়িয়ে আছিস? তারপর লিওর দিকে ফিরে, দেখতে পাচ্ছি কুসংসর্গে পড়েছে তোমরা, ওর সঙ্গে কোথায় যাচ্ছো? পরিণতি শুভ হবে না। ও যদি স্বাভাবিক নারীই হবে অমন মুখ লুকিয়ে রেখেছে কেন? কিসের লজ্জা ওর?
ইতিমধ্যে সিমব্রিও এগিয়ে এসেছে। পোশাকের হাতায় টান দিয়ে আতেনকে থামানোর চেষ্টা করলো সে। আর পূজারী অরোস, বিনীত ভঙ্গিতে মাথা নুইয়ে বললো, দয়া করে চুপ করুন; অমন অশুভ কথা বলবেন না।
কিন্তু চুপ করল না আতেন। ঘৃণার ছাপ আরও গভীর ভাবে এঁটে বসলো তার মুখে। আগের চেয়ে কঠোরস্বরে চিৎকার করলো, কেন, চুপ করবো কেন? ডাইনী, তোর ঐ কাফন খুলে ফেল, মরা লাশই অমন কাপড় পরে থাকে। সাহস থাকে
তো মুখ দেখা; আমরা বুঝি, সত্যিই তুই কি।
থামুন, আমি মিনতি করছি, থামুন, আবার বললো অরোস, এখনও আগের মতো শান্ত তার গলা। উনি প্রতিনিধি, আর কেউ নন, ক্ষমতা ওঁরই সাথী।
আমি কালুনের খানিয়া, আমার বিরুদ্ধে ওর ক্ষমতা কোনো কাজে আসবে না। ক্ষমতা, হা! দেখাতে বলল ওর ক্ষমতা।
ভাইঝি, আতেন, চুপ করো! সন্ত্রস্ত গলায় বললো বৃদ্ধ শামান। আতঙ্কে সাদা হয়ে গেছে তার মুখ।
আবার কিছু বলার জন্যে মুখ খুললো আতেন। সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যুৎগতিতে হাত। উঁচু করলো আমাদের পথপ্রদর্শক, জংলীদের পুরোহিতকে মৃত্যুদণ্ড দেয়ার সময় যেমন করেছিলো তেমন। এক বিন্দু নড়েনি সে, একটা শব্দ করেনি, কেবল হাত উঁচু করেছে, যেন ইশারা করছে। আতেনের হাঁ মুখটা হাঁ হয়েই রইলো কিছুক্ষণ তারপর ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে গেল।
এদিকে মূর্তিকে হাত উঁচু করতে দেখেই এস্তভঙ্গিতে দুহাত তুলেছে অবোস। প্রার্থনার সুরে বলছে, ও দয়াময়ী মা, দয়ার সাগর, করুণার সিন্ধু, তুমি সব শুনেছো, সব দেখেছো, আমি ভিক্ষা চাই তোমার কাছে, এই রমণীর উন্মাদলুলভ আচরণ ক্ষমা করে দাও দয়া করে। শত হলেও ও এই অগ্নিগিরির অতিথি, ওর রক্তে তোমার দাসের হাত কলঙ্কিত কোরো না, এ আমার একান্ত মিনতি।
একটা ব্যাপার খেয়াল করলাম, হাত ওপরে ওঠানো থাকলেও অরোসের চোখ দুটো স্থির আমাদের পথপ্রদর্শকের ওপর।
অরোসের প্রার্থনার গুণেই কিনা জানি না, আস্তে আস্তে নেমে এলো মূর্তির হাত। অদৃশ্য কোনো শক্তির প্রভারে যেন খানিয়া আতেন ভয়ানক এক খোঁচা দিলো ঘোড়ার পেটে। মুহূর্তে ঝড়ের বেগে ছুটতে শুরু করলো ঘোড়াটা। শামান সিমব্রিও ঘোড়া ছুটিয়ে দিলো পেছন পেছন।
আবার রওনা হলাম আমরা। শিগগিরই খান রাসেনের শব বহনকারী মিছিলটা পেরিয়ে গেলাম। সূর্যের আলোয় ধোয়া উপত্যকার ওপর দিয়ে এগিয়ে চলেছি শ্বেতশুভ্র উজ্জ্বল চুড়ার দিকে। কিছুক্ষণ পর ঘন একগুচ্ছ পাইন গাছের কাছে পৌঁছুলাম। পাইনের ছায়ায় পৌঁছুলো আমাদের পথপ্রদর্শক, তারপর হঠাৎ আর দেখলাম না তাকে।
কোথায় গেলেন উনি? অরোসকে জিজ্ঞেস করলাম, খানিয়ার সাথে বোঝাঁপড়া করতে?
না? মৃদু হেসে বললো পুরোহিত। আমার ধারণা, হেসার অতিথিরা প্রায় এসে পড়েছেন এই খবর দেয়ার জন্যে এগিয়ে গেছেন উনি।
আশ্চর্য হলাম জবাবটা শুনে। পাহাড়ের শূন্য ঢাল উঠে গেছে চূড়া পর্যন্ত, মানুষ দূরে থাক একটা ইদুরও আমাদের চোখ এড়িয়ে ওখান দিয়ে যেতে পারবে না। ও গেল কি করে? আর কিছু বললাম না আমি। অরোসের পেছন পেছন উঠে যেতে লাগলাম।
বাকি দিনটুকু এক ভাবে উঠে গেলাম আমরা। ক্রমশ তুষারের কাছাকাছি হচ্ছি।
.
সূর্যাস্তের সামান্য আগে চূড়ার তুষার ছাওয়া এলাকার ঠিক নিচে বিশাল এক প্রাকৃতিক পেয়ালার কাছে এলাম। তলাটার আয়তন কয়েক হাজার একর। পাথর নয়, চমৎকার উর্বরা মাটি দিয়ে গঠিত। ওখানে চাষাবাদ করে মন্দিরের পুরোহিতেরা। চোখ জুড়ানো ফসল ফলে আছে। নিচে থেকে কিছুই দেখা যায় না, পেয়ালার মতো দেখতে উপত্যকাটার অস্তিত্বই টের পাওয়া যায় না। প্রাকৃতিক একটা ফটক দিয়ে ঢুকলাম আমরা সেখানে।