মাথা নুইয়ে অবোস জবাব দিলো, খাবার এবং আশ্রয় তৈরি। বিশ্রাম নিন। কাল সকালে যেখানে চাইবেন সেখানে নিয়ে যাবো। সেরকমই নির্দেশ দেয়া হয়েছে আমাকে।
গজ পঞ্চাশেক দূরে পাহাড়ের গায়ে একটা দালানের কাছে আমাদের নিয়ে গেল অরোস। ভেতরে ঢুকে মনে হলো অতিথিশালা, অন্তত এ মুহূর্তে ঘরটাকে সেভাবেই সাজিয়ে গুছিয়ে রাখা হয়েছে। প্রদীপ জ্বলছে। ঘর গরম রাখার জন্যে আগুন জ্বালানো হয়েছে। দুটো কামরা বাড়িটায়। প্রথমটার ভেতর দিয়ে দ্বিতীয়টায় যেতে হয়। এই দ্বিতীয় ঘরটাতেই আমাদের শোয়ার বন্দোবস্ত করা হয়েছে।
ভেতরে যান, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হয়ে নিন, বললো আরোস। আমার দিকে ফিরে যোগ করলো, তারপর আপনার কুকুরে কামড়ানো হাতের চিকিৎসা হবে।
আমার হাত কুকুরে কামড়েছে আপনি জানলেন কি করে!? আমার কণ্ঠে বিস্ময়।
জবাবটা এড়িয়ে গেল অরোস। শুধু বললো, জেনেছি, এবং সেমতো ব্যবস্থাও করা হয়েছে। চলুন দয়া করে।
ঘরের ভেতর লোহার পাত্রে কুসুম গরম পানি রাখা ছিলো। হাত মুখ ধুয়ে নিলাম। ধবধবে সাদা চাদর পাতা বিছানার ওপর পরিষ্কার কাপড়, আগে থাকতেই রেখে দেয়া হয়েছে আমাদের জন্যে। পরে নিলাম। তারপর আমার হাতের চিকিৎসা করলো অরোস। লিওর বেঁধে দেয়া পট্টি খুলে ফেলে মলম লাগিয়ে নতুন পট্টি বেঁধে দিলো। বাইরের ঘরে এসে দেখি খাবার সাজানো। খেয়ে নিয়ে আবার ঢুকলাম শোবার ঘরে। বিছানায় শুতে না শুতেই ঘুম।
গভীর রাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল আমার। কোনো শব্দ পাইনি, তবু কেন যেন মনে হচ্ছে কেউ এসেছে ঘরে। চোখ মেললাম। হ্যাঁ, যা ভেবেছি তাই। ছোট্ট একটা প্রদীপ মিটমিট করে জ্বলছে। তাতে অন্ধকার দূর হওয়ার চেয়ে আরও গাঢ় হয়েছে যেন। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে অস্পষ্ট প্রেতের মতো একটা মূর্তি। প্রথমে ভাবলাম সত্যিই বুঝি ভূত। তারপর মনে পড়লো আমাদের কাফন মোড়া লাশের মতো পথপ্রদর্শকের কথা। হ্যাঁ সে-ই। লিওর বিছানার দিকে তাকিয়ে আছে।
কিছুক্ষণ স্থির দাঁড়িয়ে রইলো সে। তারপর হঠাৎ আকুল কণ্ঠে বিলাপ করে উঠলো।
তাহলে যা ভেবেছিলাম তা-ই! কাফনের মতো পোশাকের আড়ালে ওটা নারী! আর ও বোবাও নয়, দিব্যি কথা বলতে পারে! আরে, পুরু কাপড়ে ঢাকা হাত দুটো মোচড়াচ্ছে! যেন অকথ্য যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে চাইছে। একটু পরে দেখলাম ঘুমন্ত লিও–ও যেন ওর উপস্থিতির প্রভাব অনুভব করতে শুরু করেছে। ঘুমের ঘোরে নড়েচড়ে উঠে স্পষ্ট গলায় আরবীতে ডাকলো সে–আয়শা! আয়শা!
অত্যন্ত লঘু পায়ে, প্রায় হাওয়ায় ভর করে এগিয়ে এলো মূর্তি। উঠে বসলো লিও। চোখ বোজা, অর্থাৎ এখনও ঘুমে অচেতন। আলিঙ্গনের ভঙ্গিতে দুহাত বাড়িয়ে দিয়ে আবার বললো-আয়শা! আমার আয়শা! জীবন মৃত্যুর ভেতর দিয়ে কতদিন ধরে খুঁজছি তোমাকে। এসো, দেবী, আমার আকাক্ষিতা, আমার কাছে এসো।
আরেকটু কাছে এগুলো মূর্তি। স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি সে কাঁপছে। এবার তার হাত দুটো প্রসারিত হলো।
লিওর বিছানার পাশে গিয়ে থামলো সে। যেমন উঠেছিলো তেমনি ঘুমের ঘোরে শুয়ে পড়লো লিও। ওর গায়ের কম্বলটা পড়ে গেছে। উক্ত বুকের ওপর পড়ে আছে চামড়ার থলেটা। আয়শার চুল রয়েছে তার ভেতর। স্থির চোখে তাকিয়ে রইল মূর্তি থলেটার দিকে। তারপর একটু একটু করে এগিয়ে গেল তার হাত। থলের মুখ খুললো। কোমল হাতে বের করে আনলো চকচকে চুলের গোছাটা। অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইলো সেটার দিকে। তারপর আবার চুলগুলো রেখে থলের মুখ বন্ধ করে দিলো সে। ফুঁপিয়ে উঠে কাঁদলো একটু। এই সময় আবার হাত বাড়িয়ে দিলো লিও। গভীর আবেগে বলে উঠলো—
এসো, কাছে এসো, প্রিয়তমা, আমার বুকে এসো।
অনুচ্চ ভীত স্বরে একবার চিৎকার করে ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল মূর্তি। যখন নিশ্চিত হলাম, সত্যিই ও চলে গেছে তখন সশব্দে শ্বাস টানলাম আমি। একটা চিন্তাই তখন মাথার ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছে: কে এই নারীমূর্তি? আয়শা? পুরোহিত অবোস বলছিলো আমাদের পথপ্রদর্শক নাকি প্রতিনিধি এবং তরবারি; অর্থাৎ রায় কার্যকর করে। কিন্তু কার রায়? ওর নিজের? ওকি মানুষ, না অশরীরী? ভাবতে ভাবতে ক্লান্ত হয়ে কখন যে ঘুমিয়ে গেছি নিজেও জানি না।
.
পরদিন যখন ঘুম ভাঙলো তখন প্রায় দুপুর। পুরোহিত অরোস দাঁড়িয়ে আছে আমার বিছানার পাশে। লিও এখনও ওঠেনি। পুরোহিত ফিসফিস করে জানালো, আমার হাতে নতুন করে ওষুধ লাগিয়ে দেয়ার জন্যে সে এসেছে। তারপর ঘুমন্ত লিওর দিকে তাকিয়ে যোগ করলো–
ওঁকে জাগানোর দরকার নেই। এতদিন অনেকৃষ্ট করেছেন, সামনে আবার কি আছে কে জানে? তারচেয়ে ভালো করে ঘুমিয়ে নিতে দিন। ঘণ্টাখানেকের ভেতর আপনাদের রওনা হতে হবে।
এর অর্থ কি, বন্ধু অরোস? তীক্ষ্ণ্ণকণ্ঠে প্রশ্ন করলাম আমি। কালই না আপনি বললেন এখানে আমরা নিরাপদ?
এখনও বলছি, বন্ধু—
আমার নাম হলি।
হ্যাঁ, বন্ধু হলি, এখনও বলছি শারীরিক দিক থেকে আপনারা নিরাপদ। কিন্তু শুধুই কি শরীর নিয়ে মানুষ? মন, আত্মা আছে না? সেগুলোও জখম হতে পারে।
চিন্তিত ভঙ্গিতে মাথা দোলালাম আমি। অবোস আমার হাতের পট্টি খুলতে লাগলো।
দেখুন প্রায় ভালো হয়ে গেছে আপনার হাত, খোলা শেষ হতে বললো সে। এখন আরেকবার মলম লাগিয়ে পট্টি বেঁধে দিচ্ছি, কয়েক দিনের ভেতর পুরোপুরি ভালো হয়ে যাবে, খান র্যাসেনের কুকুর যে কোনোদিন কামড়েছিলো তা বুঝতেই পারবেন না। ও হ্যাঁ, খুব শিগগিরই আবার ওর দেখা পাবেন, সঙ্গে থাকবে ওর সুন্দরী স্ত্রী।